নতুন বছরের শুরুতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন

ফকীর আবদুর রাজ্জাক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সর্বাধিক উন্নত ও শক্তিশালী দেশ। জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই উন্নতির প্রশ্নে তার তুলনা নেই। এক সময় পৃথিবীর সেরা উন্নত দেশের কাতারে সোভিয়েত ইউনিয়নও জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর বা তার নীতি আদর্শ ও উন্নয়নের দর্শন ভেঙ্গে যাওয়ার পর দেশটি এখন আগের অবস্থানে নেই। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে এখন ১৫/১৬ স্বাধীন দেশের উত্থান হয়েছে। এরা সবাই পুঁজিবাদের ধারক সমাজবাদী অর্থনীতির পথ থেকে সরে এসে এখন পশ্চিমা পথেই ধাবমান। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই বীভৎস পতন হয়েছে প্রায় চার যুগ আগে। এখন দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আদর্শের পথ ধরে চলছে। তারপরও পৃথিবীর অন্যতম বড় দেশ রাশিয়া জনসংখ্যা ও আয়তনের দিক থেকে। ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া উন্নতির সাবেক ধারা থেকে রাশিয়া অনেকখানি বেরিয়ে এসেছে, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক নীতিতে এখন রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সাথেই ঐকমত্য পোষণ করে না। পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের ব্যাপারেও সে এখন একেবারে পিছিয়ে নেই। তবু পৃথিবীর এখনও একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। এই যুক্তরাষ্ট্রই জন্ম দিয়েছে অনেক বিখ্যাত নেতা, প্রেসিডেন্ট, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিষ্কারে পৃথিবীর শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে। তারপরও এই দেশটিতেই জন্ম নিয়েছে যুদ্ধবাজ শত নেতা। যারা পৃথিবীকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে বারবার। অতীতের কথা বাদ দিলেও সর্বশেষ বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ২০১৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়েই প্রায় প্রতিদিন এমন সব সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন, যাতে গোটা বিশ্বে শান্তির বদলে চরম উত্তেজনা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। যুদ্ধ বাধিয়ে রাখাই তার নীতি। এটা কি মার্কিন অস্ত্র কারখানার মালিকদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার উদ্দেশ্যে? সর্বশেষ এবার ২০২০ সালের নববর্ষে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছেন ইরানের শীর্ষ সামরিক জেনারেলকে হত্যা করে। এই ইরানি জেনারেল, গিয়েছিলেন সামরিক তদারকি করার উদ্দেশ্যে ইরাকে। সেখানেই মার্কিন সৈন্যরা সুযোগ বুঝে ড্রোন হামলা চালিয়ে ওই সাতজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন অবকাশ যাপনরত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি সংসদ, নিজ দল বা পরামর্শদাতাদের কোনরূপ না জানিয়েই হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে যিনি শীর্ষ জেনারেল ছিলেন, তিনি ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি অভিজাত কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি।

সর্বশেষ খবর, জেনারেল সোলাইমানির মরদেহ ইরাক থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ইরানে নিয়ে আসা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল তার দাফনকাজ সম্পন্ন করার সামগ্রিক অনুষ্ঠানে। সেই দিনই গোটা ইরানজুড়ে লাল পতাকা ওড়ানো হয়েছে। শিয়াদের শীর্ষ মসজিদেও তা উড়ছে। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্যে ইরান প্রস্তুত। উল্লেখ্য, ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়ও ইরান এই লাল পতাকা ওড়ায়নি। ধরেই নেয়া যায়, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ আসন্ন। যে কোন সময় তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন পাল্টা হামলা চালানো হলে ইরানের ৫২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা করা হবে। ইরানও তার সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ওদিকে ইরাক থেকে সকল মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের নিদের্শ দিয়ে তা আবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের পার্লামেন্ট ঐকমত্য হয়েই দিয়েছে এ আদেশ। ইয়েমেনের বিদ্রোহী বাহিনী মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করে রেখেছে। ফিলিস্তিনী যোদ্ধারাও সামগ্রিক প্রস্তুতি নিয়েছে যুদ্ধের জন্যে। রাশিয়া ও চীন এখনই সরাসরি না জড়ালেও তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে মোটেই অনুকূল নয়। তারা উভয় বৃহৎ শক্তিই বলেছে যুক্তরাষ্ট্র সকল নিয়মনীতি ভেঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঘনঘটা বাজিয়েছে, যা গোটা বিশ্বে চরম অশাস্তি ডেকে আনবে। এই আসন্ন যুদ্ধে ইরান যে একা নয় তা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছে। এই যুদ্ধ সৌদি আরব ও ইসরাইলের জন্যেও বিপদ ডেকে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে তার ওই দুই তাবেদার বন্ধুকে রক্ষা করতে যুদ্ধ জড়াতে হবে। আমরা জানি ইরান ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই রয়েছে শিয়া মুসলিমদের শক্ত অবস্থান। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনির চরম প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণার পর মধ্যপ্রাচ্যে সকল শিয়া মুসলমানরা নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ভুলে প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তাছাড়া নিহত সোলাইমানি এমন একজন যোগ্য ও চৌকস জেনারেল ছিলেন যে, তিনি তার কূটনৈতিক ও দূরদর্শিতা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে শিয়াদের সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে কারণেও তিনি সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার হত্যার চরম প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে খামেনির পক্ষে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করেছে যে, পৃথিবীর সকল মিডিয়া ও বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিতভাবেই মনে করছেন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ অনিবার্য। কোনভাবেই যার পরিণতি বিশ্ববাসীর জন্যে শুভ হবে না।

চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত উন্নত দেশসমূহের প্রতিক্রিয়াতেও এটা স্পষ্ট যে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে কেউই এমন পরিস্থিতি আশা করে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার স্বভাবসূলভ উগ্রতার বশবর্তী হয়ে কোন সংস্থা বা কোন উপদেষ্টার পরামর্শ না নিয়েই জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিশ্বের যে কোন স্থানে যুদ্ধে জড়ানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন কোন ব্যাপার নয়। কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিশেষ করে ভিয়েতনামে কয়েক বছর যুদ্ধ করে পরাজয় বরণ করে সমরবাণ থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল তারা। খুইয়েছিল হাজার হাজার সৈন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকানোর জন্য তাবেদার পাকিস্তানকে বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ, অর্থ মারণাস্ত্র দিয়েও যখন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ঠেকানো যাচ্ছিল না, তখন ভারত মহাসাগরে তাদের অত্যাধুনিক ৭ম নৌবহর পাঠিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব বিবেকের তীব্র প্রতিবাদ ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে ৭ম নৌবহরকে শিক্ষা দেয়ার হুমকির পর যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটতে বাধ্য হয়। বাঙালি তিরিশ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে হলেও স্বাধীনতা অর্জন করে। পাকিস্তানের ৯২ হাজার সৈন্যকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছেড়ে যেতেও বাধেনি। এটাই মার্কিন নীতি। ইরাক-ইরান যুদ্ধে জর্জ সিনিয়র বুশকে শিখণ্ডী করে যুদ্ধ বাধিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকের পক্ষ, আবার ইরানের পক্ষ অবলম্বনের খেলা খেলেই ইরাক শেষ পর্যন্ত চরম মার খেয়েছিল ইরানের হাতে। পরে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রের মিথ্যা অভিযোগ এনে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে টার্গেট করে তাকেই হত্যা করে বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে। সেই একই অসত্য মনগড়া অভিযোগ এনে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করে ইরানকে শায়েস্তা করার খেলায় মেতে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যিনি হঠকারি এবং জ্ঞানবুদ্ধিহীন অদূরদর্শী নেতা। এ কথা পৃথিবীর সকল বিবেকবান মানুষই আজ বিশ্বাস করে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে জন এফ কেনেডির নাম জড়িত। তিনি মেয়াদপূর্ণ করার আগেই নিহত হন। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু এবং পরিকল্পনা করেছিলো তার প্রশাসনই। অথচ এটাও সত্যি যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে কেনেডি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক। জর্জ সিনিয়র বুশ এবং জুনিয়র বুশ দুই পিতাপুত্রই উপসাগরীয় যুদ্ধের হোতা। যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট হিসেবেই তারা পরিচিত। এরপর ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এসে পৃথিবীতে শান্তি ও যুদ্ধ পরিহারের নীতি গ্রহণ করবেন বলে বিশ্ববাসী আশা করলেও প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষপর্যায়ের দুর্নাম তিনিও এড়াতে পারেননি। তবে আরেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট আমেরিকার ইতিহাসে নজির স্থাপন করে একজন আফ্রিকান মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে বারাক ওবামার দুই মেয়াদ পৃথিবীতে অনেকখানি সুবাতাস বইয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধের বদলে আলাপ-আলোচনার নীতি গ্রহণ করে অনেক বেশি সাফল্য পেয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তিনি ইতিবাচক অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি কালো আফ্রিকান বংশোভূত মানুষ, সেহেতু প্রথম থেকেই সাদা চামড়ার আমেরিকানরা তাকে কখনই ভালো নজরে দেখেনি। ফলে তিনি তার পরিকল্পনা ও নীতি আদর্শের অনেক কিছুই প্রশাসনিক নানা বাধার কারণে বাস্তবায়িত করে যেতে পারেননি। তবু ইতিহাসে তিনি স্মরণীয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতার আগে থেকেই এমন সব নীতির কথা ঘোষণা করেছিলেন, যা ছিল যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। তার এক মেয়াদেই তার নানা মন্ত্রণা বিশ্ববাসী দেখেছে। এখন তিনি ইরানকে কেন্দ্র করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন। ইরানিরাও প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে চরম হুমকি দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের আরও অনেক দেশ যেমন ধীরে ধীরে যুদ্ধে জড়াবে তেমনি শক্তিশালী শিয়া সংগঠনগুলোও মরণপণ প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে ঘোষণা দিয়ে চলেছে। পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অত্যন্ত খারাপ হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিশ্ব নেতারা যতই উভয় পক্ষকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান না কেন, তারা কেউ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোন নিন্দা জানায়নি।

নতুন বছরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন সাফল্যের সাথেই। তিনি কি মার্কিন শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চান, নাকি নিজেকে সবচাইতে যোগ্য প্রেসিডেন্ট প্রমাণ করতে চান। সময়ই বলে দেবে যথাসময়ে। তবে নিজের বা রাষ্ট্রের না হলেও একটি স্বাধীন দেশে বেআইনিভাবে ঢুকে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা এবং ইরাকে ঢুকে প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে হত্যা করার মতো যোগ্যতা তারা সাম্প্রতিককালেই দেখিয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো- পৃথিবীর কোন দেশের স্বাধীনতাকামী সমস্ত নাগরিকদের দাবি নস্যাৎ করে তাদের পদানত করতে পারেনি আমেরিকা। সবখানেই তাকে পরাজয়ের গ্লানি মুখে নিয়ে লেজগুটিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। তবে ষড়যন্ত্র করে কোন দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন ধ্বংস করতে তারা পারঙ্গম।

[লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট]

শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২০ , ২৭ পৌষ ১৪২৬, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

রাজনীতির পথে প্রান্তে

নতুন বছরের শুরুতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন

ফকীর আবদুর রাজ্জাক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সর্বাধিক উন্নত ও শক্তিশালী দেশ। জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই উন্নতির প্রশ্নে তার তুলনা নেই। এক সময় পৃথিবীর সেরা উন্নত দেশের কাতারে সোভিয়েত ইউনিয়নও জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর বা তার নীতি আদর্শ ও উন্নয়নের দর্শন ভেঙ্গে যাওয়ার পর দেশটি এখন আগের অবস্থানে নেই। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে এখন ১৫/১৬ স্বাধীন দেশের উত্থান হয়েছে। এরা সবাই পুঁজিবাদের ধারক সমাজবাদী অর্থনীতির পথ থেকে সরে এসে এখন পশ্চিমা পথেই ধাবমান। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই বীভৎস পতন হয়েছে প্রায় চার যুগ আগে। এখন দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আদর্শের পথ ধরে চলছে। তারপরও পৃথিবীর অন্যতম বড় দেশ রাশিয়া জনসংখ্যা ও আয়তনের দিক থেকে। ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া উন্নতির সাবেক ধারা থেকে রাশিয়া অনেকখানি বেরিয়ে এসেছে, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক নীতিতে এখন রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সাথেই ঐকমত্য পোষণ করে না। পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের ব্যাপারেও সে এখন একেবারে পিছিয়ে নেই। তবু পৃথিবীর এখনও একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। এই যুক্তরাষ্ট্রই জন্ম দিয়েছে অনেক বিখ্যাত নেতা, প্রেসিডেন্ট, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিষ্কারে পৃথিবীর শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে। তারপরও এই দেশটিতেই জন্ম নিয়েছে যুদ্ধবাজ শত নেতা। যারা পৃথিবীকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে বারবার। অতীতের কথা বাদ দিলেও সর্বশেষ বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ২০১৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়েই প্রায় প্রতিদিন এমন সব সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন, যাতে গোটা বিশ্বে শান্তির বদলে চরম উত্তেজনা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। যুদ্ধ বাধিয়ে রাখাই তার নীতি। এটা কি মার্কিন অস্ত্র কারখানার মালিকদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার উদ্দেশ্যে? সর্বশেষ এবার ২০২০ সালের নববর্ষে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছেন ইরানের শীর্ষ সামরিক জেনারেলকে হত্যা করে। এই ইরানি জেনারেল, গিয়েছিলেন সামরিক তদারকি করার উদ্দেশ্যে ইরাকে। সেখানেই মার্কিন সৈন্যরা সুযোগ বুঝে ড্রোন হামলা চালিয়ে ওই সাতজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন অবকাশ যাপনরত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি সংসদ, নিজ দল বা পরামর্শদাতাদের কোনরূপ না জানিয়েই হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে যিনি শীর্ষ জেনারেল ছিলেন, তিনি ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি অভিজাত কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি।

সর্বশেষ খবর, জেনারেল সোলাইমানির মরদেহ ইরাক থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ইরানে নিয়ে আসা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল তার দাফনকাজ সম্পন্ন করার সামগ্রিক অনুষ্ঠানে। সেই দিনই গোটা ইরানজুড়ে লাল পতাকা ওড়ানো হয়েছে। শিয়াদের শীর্ষ মসজিদেও তা উড়ছে। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্যে ইরান প্রস্তুত। উল্লেখ্য, ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়ও ইরান এই লাল পতাকা ওড়ায়নি। ধরেই নেয়া যায়, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ আসন্ন। যে কোন সময় তা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন পাল্টা হামলা চালানো হলে ইরানের ৫২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা করা হবে। ইরানও তার সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ওদিকে ইরাক থেকে সকল মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের নিদের্শ দিয়ে তা আবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের পার্লামেন্ট ঐকমত্য হয়েই দিয়েছে এ আদেশ। ইয়েমেনের বিদ্রোহী বাহিনী মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করে রেখেছে। ফিলিস্তিনী যোদ্ধারাও সামগ্রিক প্রস্তুতি নিয়েছে যুদ্ধের জন্যে। রাশিয়া ও চীন এখনই সরাসরি না জড়ালেও তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে মোটেই অনুকূল নয়। তারা উভয় বৃহৎ শক্তিই বলেছে যুক্তরাষ্ট্র সকল নিয়মনীতি ভেঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঘনঘটা বাজিয়েছে, যা গোটা বিশ্বে চরম অশাস্তি ডেকে আনবে। এই আসন্ন যুদ্ধে ইরান যে একা নয় তা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছে। এই যুদ্ধ সৌদি আরব ও ইসরাইলের জন্যেও বিপদ ডেকে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে তার ওই দুই তাবেদার বন্ধুকে রক্ষা করতে যুদ্ধ জড়াতে হবে। আমরা জানি ইরান ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই রয়েছে শিয়া মুসলিমদের শক্ত অবস্থান। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনির চরম প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণার পর মধ্যপ্রাচ্যে সকল শিয়া মুসলমানরা নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ভুলে প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তাছাড়া নিহত সোলাইমানি এমন একজন যোগ্য ও চৌকস জেনারেল ছিলেন যে, তিনি তার কূটনৈতিক ও দূরদর্শিতা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে শিয়াদের সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে কারণেও তিনি সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার হত্যার চরম প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে খামেনির পক্ষে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করেছে যে, পৃথিবীর সকল মিডিয়া ও বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিতভাবেই মনে করছেন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ অনিবার্য। কোনভাবেই যার পরিণতি বিশ্ববাসীর জন্যে শুভ হবে না।

চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত উন্নত দেশসমূহের প্রতিক্রিয়াতেও এটা স্পষ্ট যে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে কেউই এমন পরিস্থিতি আশা করে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার স্বভাবসূলভ উগ্রতার বশবর্তী হয়ে কোন সংস্থা বা কোন উপদেষ্টার পরামর্শ না নিয়েই জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিশ্বের যে কোন স্থানে যুদ্ধে জড়ানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন কোন ব্যাপার নয়। কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিশেষ করে ভিয়েতনামে কয়েক বছর যুদ্ধ করে পরাজয় বরণ করে সমরবাণ থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল তারা। খুইয়েছিল হাজার হাজার সৈন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকানোর জন্য তাবেদার পাকিস্তানকে বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ, অর্থ মারণাস্ত্র দিয়েও যখন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ঠেকানো যাচ্ছিল না, তখন ভারত মহাসাগরে তাদের অত্যাধুনিক ৭ম নৌবহর পাঠিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব বিবেকের তীব্র প্রতিবাদ ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে ৭ম নৌবহরকে শিক্ষা দেয়ার হুমকির পর যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটতে বাধ্য হয়। বাঙালি তিরিশ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে হলেও স্বাধীনতা অর্জন করে। পাকিস্তানের ৯২ হাজার সৈন্যকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছেড়ে যেতেও বাধেনি। এটাই মার্কিন নীতি। ইরাক-ইরান যুদ্ধে জর্জ সিনিয়র বুশকে শিখণ্ডী করে যুদ্ধ বাধিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকের পক্ষ, আবার ইরানের পক্ষ অবলম্বনের খেলা খেলেই ইরাক শেষ পর্যন্ত চরম মার খেয়েছিল ইরানের হাতে। পরে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রের মিথ্যা অভিযোগ এনে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে টার্গেট করে তাকেই হত্যা করে বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে। সেই একই অসত্য মনগড়া অভিযোগ এনে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করে ইরানকে শায়েস্তা করার খেলায় মেতে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যিনি হঠকারি এবং জ্ঞানবুদ্ধিহীন অদূরদর্শী নেতা। এ কথা পৃথিবীর সকল বিবেকবান মানুষই আজ বিশ্বাস করে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে জন এফ কেনেডির নাম জড়িত। তিনি মেয়াদপূর্ণ করার আগেই নিহত হন। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু এবং পরিকল্পনা করেছিলো তার প্রশাসনই। অথচ এটাও সত্যি যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে কেনেডি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক। জর্জ সিনিয়র বুশ এবং জুনিয়র বুশ দুই পিতাপুত্রই উপসাগরীয় যুদ্ধের হোতা। যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট হিসেবেই তারা পরিচিত। এরপর ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এসে পৃথিবীতে শান্তি ও যুদ্ধ পরিহারের নীতি গ্রহণ করবেন বলে বিশ্ববাসী আশা করলেও প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষপর্যায়ের দুর্নাম তিনিও এড়াতে পারেননি। তবে আরেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট আমেরিকার ইতিহাসে নজির স্থাপন করে একজন আফ্রিকান মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে বারাক ওবামার দুই মেয়াদ পৃথিবীতে অনেকখানি সুবাতাস বইয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধের বদলে আলাপ-আলোচনার নীতি গ্রহণ করে অনেক বেশি সাফল্য পেয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তিনি ইতিবাচক অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি কালো আফ্রিকান বংশোভূত মানুষ, সেহেতু প্রথম থেকেই সাদা চামড়ার আমেরিকানরা তাকে কখনই ভালো নজরে দেখেনি। ফলে তিনি তার পরিকল্পনা ও নীতি আদর্শের অনেক কিছুই প্রশাসনিক নানা বাধার কারণে বাস্তবায়িত করে যেতে পারেননি। তবু ইতিহাসে তিনি স্মরণীয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতার আগে থেকেই এমন সব নীতির কথা ঘোষণা করেছিলেন, যা ছিল যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। তার এক মেয়াদেই তার নানা মন্ত্রণা বিশ্ববাসী দেখেছে। এখন তিনি ইরানকে কেন্দ্র করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন। ইরানিরাও প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে চরম হুমকি দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের আরও অনেক দেশ যেমন ধীরে ধীরে যুদ্ধে জড়াবে তেমনি শক্তিশালী শিয়া সংগঠনগুলোও মরণপণ প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে ঘোষণা দিয়ে চলেছে। পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অত্যন্ত খারাপ হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিশ্ব নেতারা যতই উভয় পক্ষকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান না কেন, তারা কেউ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোন নিন্দা জানায়নি।

নতুন বছরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন সাফল্যের সাথেই। তিনি কি মার্কিন শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চান, নাকি নিজেকে সবচাইতে যোগ্য প্রেসিডেন্ট প্রমাণ করতে চান। সময়ই বলে দেবে যথাসময়ে। তবে নিজের বা রাষ্ট্রের না হলেও একটি স্বাধীন দেশে বেআইনিভাবে ঢুকে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা এবং ইরাকে ঢুকে প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে হত্যা করার মতো যোগ্যতা তারা সাম্প্রতিককালেই দেখিয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো- পৃথিবীর কোন দেশের স্বাধীনতাকামী সমস্ত নাগরিকদের দাবি নস্যাৎ করে তাদের পদানত করতে পারেনি আমেরিকা। সবখানেই তাকে পরাজয়ের গ্লানি মুখে নিয়ে লেজগুটিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। তবে ষড়যন্ত্র করে কোন দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন ধ্বংস করতে তারা পারঙ্গম।

[লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট]