অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

কাজী সালাহ উদ্দীন

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের নাম, ব্যক্তিত্বে প্রভা বিচারালয়ের চার দেয়ালের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশের সীমানা পেরিয়ে সে প্রভা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়েছে। আলোকিত, প্রগাঢ় মানবতা বোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি।

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ আবদুস মালিক ছিলেন তৎকালীন বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস)। একসময় বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মাতা আফজালুন্নেছা শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের ভগ্নি। যুদ্ধোত্তর (১৯৪৩) ব্রিটিশ ভারতে ‘আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম’ সংস্থাটির মাধ্যমে মানবতার সেবায় তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। দেশ ভাগের আগে সংঘঠিত সময়ে দাঙ্গা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি। প্রনয়নে তার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে ৬ দফা যা ২১ দফারই সারাংশ হিসেবে ইতিহাসবেত্তাদের কাছে বিবেচিত। উনসত্তরে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে ১১ দফা দাবির প্রতিবাদ্য যে একই সূত্রে গাঁথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব দাবি প্রণয়নে যার মেধা, প্রজ্ঞা) এবং মনন, ক্রিয়াশীল ছিল তিনি অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের সব বাধা উপক্ষো করে অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কবি শামসুর, রাহমান এক স্মৃতিচারণে লেখেন ‘মনে পড়ে। সে ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে স্টেজে তার পাশে বসার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি সভাপতির ভাষণ পাঠ করেছিলেন তার দরদময় কণ্ঠস্বরে আর আমি পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত একটি কবিতা। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম বিচারপতি মোরশেদের সুলিখিত ভাষণ। সেই ভাষণ ছিল কুৎসিতের বিরুদ্ধে সুন্দরের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ঔদার্যের প্রতিবাদ। এখনও মনে পড়ে তার সেই ঋজুদীর্ঘ দণ্ডায়মান মূর্তি, সেই প্রগাঢ় উচ্চারণ, মনে হয় এখনও তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে, সেই আলোকময় মণ্ডপে ‘চিক্ত যেথা ভয়শূন্য বিচারপতি মোরশেদ মাথা উঁচু করে বলিষ্ঠ বক্তব্য নির্ভীকভাবে তুলে ধরার ইতিহাস রচনা করার মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবেই দীর্ঘকাল। বেঁচে থাকবেন। স্বদেশপ্রেম আর ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন প্রধান বিচারপতির সম্মানিত গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ইস্তফা দেয়। কুখ্যাত আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে অকাট্য যুক্তি প্রদর্শন করে তিনি সেদিন আইয়ুব সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার সুচিন্তিত ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ পদ্ধতিতেই সত্তরের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব । পাকিস্তান ১৬৯টি আসন লাভ করেছিল।

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে আইনজীবী সমাবেশে এবং সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি মোরশেদ যে সব ভাষণ রেখেছিলেন তা মুক্ত চিন্তার অনুশীলনের ক্ষেত্রে তার তাৎপর্য অসমাপ্ত। পেশাগত চৌহদ্দির মধ্যে আবব্ধ না থেকে ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পথ নির্দেশকের ভূমিকা পালনের জন্য আইনজীবীদের প্রতি তিনি উদাত্ত আহ্বান রেখেছিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় তার আস্থা ছিল গভীর। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিন্তা এবং লেখার স্বাধীনতা না থাকলে সমাজে কোন মূল্যবোধই অবশিষ্ট থাকবে না। এক সময় গোটা সমাজ তলিয়ে যাবে সর্বনাশের অন্ধকারে। শিক্ষাঙ্গনে সংক্রামিত দূষিত পরিবেশের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে বারবার তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তার প্রত্যাশা ছিল শিক্ষাগত মূল্যবোধের জাগরণে অবশ্যই শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদদের দাঁড়াতে হবে সবার সামনে এসে।

অসংখ্য মূল্যবান রচনা রেখে গেছেন তিনি, যা আজও অপ্রকাশিত। বর্তমান মূল্যবোধের এ অবক্ষয়ের ক্রান্তিকালে সে সব রচনাসম্ভার আবিলম্বে আলোর মুখ দেখবে এটাই প্রত্যাশা। তিনি ছিলেন জাতির অভিভাবক। স্বাধীনতার অন্যতম কাণ্ডারি তিনি আমাদের জাগ্রত বিবেক। অসত্যের কাছে তিনি মাথানত করেননি কখনও। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস, বাতিঘর।

শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২০ , ২৭ পৌষ ১৪২৬, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

কাজী সালাহ উদ্দীন

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের নাম, ব্যক্তিত্বে প্রভা বিচারালয়ের চার দেয়ালের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশের সীমানা পেরিয়ে সে প্রভা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়েছে। আলোকিত, প্রগাঢ় মানবতা বোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি।

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ আবদুস মালিক ছিলেন তৎকালীন বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস)। একসময় বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মাতা আফজালুন্নেছা শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের ভগ্নি। যুদ্ধোত্তর (১৯৪৩) ব্রিটিশ ভারতে ‘আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম’ সংস্থাটির মাধ্যমে মানবতার সেবায় তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। দেশ ভাগের আগে সংঘঠিত সময়ে দাঙ্গা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি। প্রনয়নে তার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে ৬ দফা যা ২১ দফারই সারাংশ হিসেবে ইতিহাসবেত্তাদের কাছে বিবেচিত। উনসত্তরে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে ১১ দফা দাবির প্রতিবাদ্য যে একই সূত্রে গাঁথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব দাবি প্রণয়নে যার মেধা, প্রজ্ঞা) এবং মনন, ক্রিয়াশীল ছিল তিনি অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের সব বাধা উপক্ষো করে অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কবি শামসুর, রাহমান এক স্মৃতিচারণে লেখেন ‘মনে পড়ে। সে ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে স্টেজে তার পাশে বসার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি সভাপতির ভাষণ পাঠ করেছিলেন তার দরদময় কণ্ঠস্বরে আর আমি পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত একটি কবিতা। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম বিচারপতি মোরশেদের সুলিখিত ভাষণ। সেই ভাষণ ছিল কুৎসিতের বিরুদ্ধে সুন্দরের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ঔদার্যের প্রতিবাদ। এখনও মনে পড়ে তার সেই ঋজুদীর্ঘ দণ্ডায়মান মূর্তি, সেই প্রগাঢ় উচ্চারণ, মনে হয় এখনও তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে, সেই আলোকময় মণ্ডপে ‘চিক্ত যেথা ভয়শূন্য বিচারপতি মোরশেদ মাথা উঁচু করে বলিষ্ঠ বক্তব্য নির্ভীকভাবে তুলে ধরার ইতিহাস রচনা করার মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবেই দীর্ঘকাল। বেঁচে থাকবেন। স্বদেশপ্রেম আর ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন প্রধান বিচারপতির সম্মানিত গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ইস্তফা দেয়। কুখ্যাত আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে অকাট্য যুক্তি প্রদর্শন করে তিনি সেদিন আইয়ুব সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার সুচিন্তিত ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ পদ্ধতিতেই সত্তরের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব । পাকিস্তান ১৬৯টি আসন লাভ করেছিল।

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে আইনজীবী সমাবেশে এবং সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি মোরশেদ যে সব ভাষণ রেখেছিলেন তা মুক্ত চিন্তার অনুশীলনের ক্ষেত্রে তার তাৎপর্য অসমাপ্ত। পেশাগত চৌহদ্দির মধ্যে আবব্ধ না থেকে ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পথ নির্দেশকের ভূমিকা পালনের জন্য আইনজীবীদের প্রতি তিনি উদাত্ত আহ্বান রেখেছিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় তার আস্থা ছিল গভীর। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিন্তা এবং লেখার স্বাধীনতা না থাকলে সমাজে কোন মূল্যবোধই অবশিষ্ট থাকবে না। এক সময় গোটা সমাজ তলিয়ে যাবে সর্বনাশের অন্ধকারে। শিক্ষাঙ্গনে সংক্রামিত দূষিত পরিবেশের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে বারবার তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তার প্রত্যাশা ছিল শিক্ষাগত মূল্যবোধের জাগরণে অবশ্যই শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদদের দাঁড়াতে হবে সবার সামনে এসে।

অসংখ্য মূল্যবান রচনা রেখে গেছেন তিনি, যা আজও অপ্রকাশিত। বর্তমান মূল্যবোধের এ অবক্ষয়ের ক্রান্তিকালে সে সব রচনাসম্ভার আবিলম্বে আলোর মুখ দেখবে এটাই প্রত্যাশা। তিনি ছিলেন জাতির অভিভাবক। স্বাধীনতার অন্যতম কাণ্ডারি তিনি আমাদের জাগ্রত বিবেক। অসত্যের কাছে তিনি মাথানত করেননি কখনও। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস, বাতিঘর।