বিচারহীনতার কারণেই বাড়ছে শিশু ধর্ষণ

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

আট বছরের শিশু কুলসুমকে (প্রকৃত নাম ব্যবহার করা হচ্ছে না) ঘরে রেখে এলাকার পানির কল থেকে পানি আনতে গিয়েছিলেন তার মা। ঘিঞ্জি এলাকার খুপরি ঘরগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া। মনের মাঝে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও শিশুকন্যাটিকে একাই রেখে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু ফিরে এসে মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তার মা।

“তিন মাস আগে রাত ৯টার দিকে আমি পানি আনতে গেলাম। মেয়ে বলল সে একাই ঘরে থাকতে পারবে। এরপরে আমি পানি নিয়ে এসে দেখি আমার বাচ্চা ঘরে নাই। তখন ভাবলাম পাশের বাড়িতে যে পুরুষ লোকটি বসা ছিল, সে কোথায় গেল? তখন আমি পাশের বাড়ির দরজা ধাক্কাই, কিন্তু কেউ খোলে না”। শিশুটির মা কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারেন তার মাত্র আট বছরের শিশুটিকে প্রতিবেশী বৃদ্ধ ধর্ষণ করেছে।

কিছুদিন আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি আবাসিক মাদরাসার ছাত্রটি তার নিজের শিক্ষকের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠায় পুলিশ ওই শিক্ষককে আটক করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক মাদরাসা শিক্ষক নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বীকার করে। তবে এ বিষয়টিতে ধর্ষণের শিকার ছেলেটির পরিবারের সদস্যরা প্রথমে উদ্যোগ নিলেও পরে আর মামলা করতে এগিয়ে আসেননি বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ছেলে শিশুরাও। পুলিশের ধারণা শিশুরা একশ্রেণীর মানুষের যৌন বিকৃতির টার্গেটে পরিণত হয়েছে। শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছর এক হাজার পাঁচটি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৭৬ দশমিক ০১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৮৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশু ধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনাকাক্সিক্ষত এ আতঙ্ক শিশুর মনোজগতে নানাভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

সামাজিক মূল্যবোধের স্খলন ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রকোপ বাড়ছে। শিশু ধর্ষণের নেপথ্যে রয়েছে- সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়া, পর্নোগ্রাফির কুপ্রভাব, স্কুলশিক্ষক, মাদরাসা শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মক্তবের হুজুরদের অবদমিত যৌন জীবন ও বিকৃত যৌনাচার। পেডোফিলিয়া নামের মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ থাকে। কিছু ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের এটিও একটি কারণ। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। শিশু ধর্ষণের পেছনে মানুষের মূল্যবোধ- নৈতিকতার অবক্ষয়, পর্নোগ্রাফি, মাদকের প্রভাব রয়েছে। পাশাপাশি, শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। পরিবারে এ ধরনের ঘটনা লুকিয়ে রাখার প্রবণতা প্রকট। আগে যখন একটি পরিবারে একাধিক ভাইবোন থাকত, তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখত, খোঁজখবর রাখত, আজকাল তা নেই। পরিবারও ছোট হয়ে গেছে, সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে এবং পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অনিরাপদ হয়ে গেছে।

দেশে আইনের শাসনের অভাব রয়েছে। আর এ কারণে যে কেউ অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। আর শিশুরা অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারে না, তাদের ভয় দেখানো সহজ এবং তারা সহজে কাউকে কিছু বলতেও পারে না, এসব কারণে অপরাধীরা শিশুদের লক্ষ্য বানায়। কারণ চাইলেই সেই অপকর্মটা বড় কারও সঙ্গে করা তার পক্ষে সম্ভব না। শিশু ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৫ থেকে ১২-এর মধ্যে। এদের নানা কৌশলে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ৫-১২ বছরের শিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে চকোলেট, খেলনা বা কোন শৌখিন জিনিস দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এবং কোন নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে। ১৩-১৮ বছরের কিশোরীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে।

মূলত দরিদ্র শ্রেণীর শিশুরা বাবা শ্রমজীবী বাবা-মায়েদের এবং তাদের অনুপস্থিতিতে এইসব শিশুদের দেখার কেউ থাকে না। আরেকটি গ্রুপ যারা নিজেরাই কর্মজীবী তারা, এবং গৃহকর্মীরা ধর্ষণের ঝুঁকিতে থাকছে বেশি। অনেকে অজ্ঞতার কারণে আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই আদালত বা পুলিশের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না। অনেকে জানেই না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। আর অনেকে দেখছেন অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে কিন্তু বিচার তো হচ্ছে না। বাইরে মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

ধর্ষণের মামলা চলাকালীন বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা তৈরি করে। নির্যাতনের শিকার শিশু ও তার পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না জোগালে তারা বিচার বা প্রতিকারের জন্য লেগে থাকতে পারে না। এমন সহযোগিতা বা পুনর্বাসনের সুযোগ এখন খুব সীমিত। সরকারের একটি হেল্পলাইন ও একটি মোবাইল অ্যাপ আছে। তবে এগুলোর কার্যকারিতা যথেষ্ট না। ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আবাসনও খুবই অপ্রতুল। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই বেশিরভাগ সময় এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাদের ভয়ে পরিবার মামলা করতে সাহস পায় না। আবার মামলা করলেও আপস করে ফেলতে হয়। সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় সাক্ষীও পাওয়া যায় না। শিশু নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে সমস্যা আরও আছে। শিশু অধিকার কর্মীরা অভিযোগ তুলছেন, জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে জামিন পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। অপরাধ করে সহজে জামিন পাওয়া গেলে অপরাধের মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়।

শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন নিঃসন্দেহে জঘন্যতম অপরাধ। শিশু ধর্ষণ বাড়ছে কিংবা কমছে, এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে একটি শিশুও যদি যৌন, শারীরিক নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার হয়, সেটাই অগ্রহণযোগ্য, অমার্জনীয়। সবচেয়ে বড় কলঙ্কের। এমন ভয়ানক অপরাধ বন্ধে আইনের প্রয়োগ আরও কঠোর হওয়া দরকার। শুধু আইন দিয়েই এমন অনাচার রোধ করা যাবে না, এ জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন ও ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যাতে কোন শিশুর প্রতি এমন ভয়ানক ঘটনা না ঘটাতে পারে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কখনও শিশুদের একাকী রাখা যাবে না। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই কর্মজীবী হলে শিশু সন্তানকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে বা বিকল্প ব্যবস্থায় রাখতে হবে।

আইনি সহায়তা নেয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি নয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। শিশু ধর্ষণের ব্যাপারে একটি আলাদা সেল করা হয়, মামলার গতি তদারকি করা হয়, তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমতে পারে।

শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন ও শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। শিশু নির্যাতনকারী ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের ঘটনায় পরিবার ও সমাজকে প্রতিবাদী হতে হবে। পরিবার ও আক্রান্তকে বুঝতে হবে, এতে তাদের কোনো দায় নেই। এ লজ্জা অপরাধীর। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন ছাত্র উপদেষ্টা থাকা প্রয়োজন, যার সঙ্গে যে কেউ যে কোনো বিষয়ে অকপটে কথা বলতে পারবে। কোন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কেউ খারাপ আচরণ করলে, গায়ে হাত দিলে, তিনি শিক্ষক বা যে কেউ হোন না কেন, তার বিষয়ে যেন ওই শিক্ষার্থী সেই ছাত্র উপদেষ্টাকে বলতে পারে যে, তার সঙ্গে এই খারাপ কাজটা করা হয়েছে। কোন একজন শিক্ষককেই এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে, যিনি নিয়মিত তার শিক্ষার্থীদের ওপর খেয়াল রাখবেন।

আইনের শাসন কায়েম করা প্রথম এবং শেষ কাজ। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করে এবং জনগণকে সচেতন করে তুলে এ পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব।একই সঙ্গে সম্ভাব্য অপরাধী ও ঝুঁকিপূর্ণ ভিকটিমকেন্দ্রিক প্রচারণা চালানো, জনসাধারণকে অপরাধ প্রতিরোধে দায়িত্বশীল ও সমাজ স্বীকৃত উপায়ে যৌন চাহিদা মেটানো এবং অপরাধীর দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

[লেখক : সাংবাদিক]

Suva.muntasir@gmail.com

রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২০ , ২৮ পৌষ ১৪২৬, ১৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

বিচারহীনতার কারণেই বাড়ছে শিশু ধর্ষণ

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

আট বছরের শিশু কুলসুমকে (প্রকৃত নাম ব্যবহার করা হচ্ছে না) ঘরে রেখে এলাকার পানির কল থেকে পানি আনতে গিয়েছিলেন তার মা। ঘিঞ্জি এলাকার খুপরি ঘরগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া। মনের মাঝে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও শিশুকন্যাটিকে একাই রেখে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু ফিরে এসে মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তার মা।

“তিন মাস আগে রাত ৯টার দিকে আমি পানি আনতে গেলাম। মেয়ে বলল সে একাই ঘরে থাকতে পারবে। এরপরে আমি পানি নিয়ে এসে দেখি আমার বাচ্চা ঘরে নাই। তখন ভাবলাম পাশের বাড়িতে যে পুরুষ লোকটি বসা ছিল, সে কোথায় গেল? তখন আমি পাশের বাড়ির দরজা ধাক্কাই, কিন্তু কেউ খোলে না”। শিশুটির মা কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারেন তার মাত্র আট বছরের শিশুটিকে প্রতিবেশী বৃদ্ধ ধর্ষণ করেছে।

কিছুদিন আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি আবাসিক মাদরাসার ছাত্রটি তার নিজের শিক্ষকের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠায় পুলিশ ওই শিক্ষককে আটক করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক মাদরাসা শিক্ষক নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বীকার করে। তবে এ বিষয়টিতে ধর্ষণের শিকার ছেলেটির পরিবারের সদস্যরা প্রথমে উদ্যোগ নিলেও পরে আর মামলা করতে এগিয়ে আসেননি বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ছেলে শিশুরাও। পুলিশের ধারণা শিশুরা একশ্রেণীর মানুষের যৌন বিকৃতির টার্গেটে পরিণত হয়েছে। শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছর এক হাজার পাঁচটি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৭৬ দশমিক ০১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৮৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশু ধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনাকাক্সিক্ষত এ আতঙ্ক শিশুর মনোজগতে নানাভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

সামাজিক মূল্যবোধের স্খলন ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রকোপ বাড়ছে। শিশু ধর্ষণের নেপথ্যে রয়েছে- সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়া, পর্নোগ্রাফির কুপ্রভাব, স্কুলশিক্ষক, মাদরাসা শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মক্তবের হুজুরদের অবদমিত যৌন জীবন ও বিকৃত যৌনাচার। পেডোফিলিয়া নামের মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ থাকে। কিছু ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের এটিও একটি কারণ। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। শিশু ধর্ষণের পেছনে মানুষের মূল্যবোধ- নৈতিকতার অবক্ষয়, পর্নোগ্রাফি, মাদকের প্রভাব রয়েছে। পাশাপাশি, শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। পরিবারে এ ধরনের ঘটনা লুকিয়ে রাখার প্রবণতা প্রকট। আগে যখন একটি পরিবারে একাধিক ভাইবোন থাকত, তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখত, খোঁজখবর রাখত, আজকাল তা নেই। পরিবারও ছোট হয়ে গেছে, সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে এবং পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অনিরাপদ হয়ে গেছে।

দেশে আইনের শাসনের অভাব রয়েছে। আর এ কারণে যে কেউ অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। আর শিশুরা অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারে না, তাদের ভয় দেখানো সহজ এবং তারা সহজে কাউকে কিছু বলতেও পারে না, এসব কারণে অপরাধীরা শিশুদের লক্ষ্য বানায়। কারণ চাইলেই সেই অপকর্মটা বড় কারও সঙ্গে করা তার পক্ষে সম্ভব না। শিশু ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৫ থেকে ১২-এর মধ্যে। এদের নানা কৌশলে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ৫-১২ বছরের শিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে চকোলেট, খেলনা বা কোন শৌখিন জিনিস দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এবং কোন নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে। ১৩-১৮ বছরের কিশোরীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে।

মূলত দরিদ্র শ্রেণীর শিশুরা বাবা শ্রমজীবী বাবা-মায়েদের এবং তাদের অনুপস্থিতিতে এইসব শিশুদের দেখার কেউ থাকে না। আরেকটি গ্রুপ যারা নিজেরাই কর্মজীবী তারা, এবং গৃহকর্মীরা ধর্ষণের ঝুঁকিতে থাকছে বেশি। অনেকে অজ্ঞতার কারণে আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই আদালত বা পুলিশের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না। অনেকে জানেই না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। আর অনেকে দেখছেন অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে কিন্তু বিচার তো হচ্ছে না। বাইরে মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

ধর্ষণের মামলা চলাকালীন বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা তৈরি করে। নির্যাতনের শিকার শিশু ও তার পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না জোগালে তারা বিচার বা প্রতিকারের জন্য লেগে থাকতে পারে না। এমন সহযোগিতা বা পুনর্বাসনের সুযোগ এখন খুব সীমিত। সরকারের একটি হেল্পলাইন ও একটি মোবাইল অ্যাপ আছে। তবে এগুলোর কার্যকারিতা যথেষ্ট না। ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আবাসনও খুবই অপ্রতুল। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই বেশিরভাগ সময় এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাদের ভয়ে পরিবার মামলা করতে সাহস পায় না। আবার মামলা করলেও আপস করে ফেলতে হয়। সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় সাক্ষীও পাওয়া যায় না। শিশু নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে সমস্যা আরও আছে। শিশু অধিকার কর্মীরা অভিযোগ তুলছেন, জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে জামিন পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। অপরাধ করে সহজে জামিন পাওয়া গেলে অপরাধের মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়।

শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন নিঃসন্দেহে জঘন্যতম অপরাধ। শিশু ধর্ষণ বাড়ছে কিংবা কমছে, এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে একটি শিশুও যদি যৌন, শারীরিক নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার হয়, সেটাই অগ্রহণযোগ্য, অমার্জনীয়। সবচেয়ে বড় কলঙ্কের। এমন ভয়ানক অপরাধ বন্ধে আইনের প্রয়োগ আরও কঠোর হওয়া দরকার। শুধু আইন দিয়েই এমন অনাচার রোধ করা যাবে না, এ জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন ও ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যাতে কোন শিশুর প্রতি এমন ভয়ানক ঘটনা না ঘটাতে পারে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কখনও শিশুদের একাকী রাখা যাবে না। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই কর্মজীবী হলে শিশু সন্তানকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে বা বিকল্প ব্যবস্থায় রাখতে হবে।

আইনি সহায়তা নেয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি নয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। শিশু ধর্ষণের ব্যাপারে একটি আলাদা সেল করা হয়, মামলার গতি তদারকি করা হয়, তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমতে পারে।

শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন ও শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। শিশু নির্যাতনকারী ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের ঘটনায় পরিবার ও সমাজকে প্রতিবাদী হতে হবে। পরিবার ও আক্রান্তকে বুঝতে হবে, এতে তাদের কোনো দায় নেই। এ লজ্জা অপরাধীর। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন ছাত্র উপদেষ্টা থাকা প্রয়োজন, যার সঙ্গে যে কেউ যে কোনো বিষয়ে অকপটে কথা বলতে পারবে। কোন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কেউ খারাপ আচরণ করলে, গায়ে হাত দিলে, তিনি শিক্ষক বা যে কেউ হোন না কেন, তার বিষয়ে যেন ওই শিক্ষার্থী সেই ছাত্র উপদেষ্টাকে বলতে পারে যে, তার সঙ্গে এই খারাপ কাজটা করা হয়েছে। কোন একজন শিক্ষককেই এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে, যিনি নিয়মিত তার শিক্ষার্থীদের ওপর খেয়াল রাখবেন।

আইনের শাসন কায়েম করা প্রথম এবং শেষ কাজ। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করে এবং জনগণকে সচেতন করে তুলে এ পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব।একই সঙ্গে সম্ভাব্য অপরাধী ও ঝুঁকিপূর্ণ ভিকটিমকেন্দ্রিক প্রচারণা চালানো, জনসাধারণকে অপরাধ প্রতিরোধে দায়িত্বশীল ও সমাজ স্বীকৃত উপায়ে যৌন চাহিদা মেটানো এবং অপরাধীর দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

[লেখক : সাংবাদিক]

Suva.muntasir@gmail.com