নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে

মোহাম্মদ শাহজাহান

ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারই প্রথম নৌকা ও ধানের শীষ দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। রাজধানীতে নৌকা ভার্সেস ধানের শীষ প্রতীকের এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই শক্তিশালী মেয়র প্রার্থী দক্ষিণে শেখ ফজলে নূর তাপস ও উত্তরে আতিকুল ইসলামের বিপক্ষে লড়ছেন বিএনপির দুই তরুণ প্রার্থী দক্ষিণে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন ও উত্তরে তাবিথ আউয়াল। দুই সিটি করপোরেশনের চার প্রার্থীই উচ্চশিক্ষিত ও সম্পদশালী। উত্তরে দুই দলের প্রার্থীই বড় ব্যবসায়ী। দু’জনেরই রয়েছে শত কোটি টাকার ব্যবসায়িক ঋণ। তবে বেশি সম্পদের মালিক হচ্ছেন শেখ ফজলে নূর তাপস আর বেশি ঋণ রয়েছে আতিকুল ইসলামের। ফজলে নূর তাপস আইনজীবী। অন্য তিনজন ব্যবসায়ী। হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুসারে বছরে তার মোট আয় ১০ কোটি টাকার কাছাকাছি। তার ওপর নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় দুই কোটি টাকার উপরে। সব মিলিয়ে ফজলে নূর তাপস শতাধিক কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক। উত্তরের বিএনপির প্রার্থী ব্যবসায়ী তাবিথ আউয়াল ইনফরমেশন সিস্টেমস টেকনোলজির ওপর এমএসসি ডিগ্রি নিয়েছেন। তার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৭টি। বিভিন্ন খাত থেকে তাবিথের বার্ষিক আয় ৪ কোটি টাকার বেশি। তার প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ আছে, স্ত্রীর নামে রয়েছে সাড়ে ৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ। তার ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ আছে। তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। যদ্দূর মনে পড়ে, ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আবদুল আউয়াল মিন্টু আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীর অর্থের জোগান দিয়েছেন। তার ঢাকার মেয়র হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল।

ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আাতিকুল ইসলাম ব্যবসায়ী। তিনি বিকম পাস। ১৬টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাবেক এই ব্যবসায়ী নেতার। তার হাতে নগদ রয়েছে ৯ লাখ টাকার কাছাকাছি। আতিকুল ইসলাম সব মিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক। তার স্থাবর সম্পদ রয়েছে ৭ কোটি টাকার মতো। তার স্ত্রী ৩ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক। আতিকুলের ব্যবসায়িক ঋত ৬ কোটি টাকার কাছাকাছি। দক্ষিণে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন অবিভক্ত ঢাকার নির্বাচিত মেয়র বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার পুত্র। ইশরাক এমএসসি (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও স্বত্বাধিকারী। তার বার্ষিক আয় ১ কোটি টাকার কাছাকাছি। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ মিলে তিনি প্রায় ৬ কোটি টাকার মালিক। তার নগদ টাকার পরিমাণ ৩৩ হাজার। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে দেড় কোটি টাকার কাছাকাছি। ৩ কোটি টাকার রয়েছে শেয়ার। তার বিরুদ্ধে দুদকে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

নির্বাচনে যে কারচুপি হবে-এ ব্যাপারে এখনই নিশ্চিত হয়ে গেছে বিএনপি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কারচুপি হবে জেনেও তারা নির্বাচনে আসছে কেন? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা করব। এই নির্বাচনে হেরে গেলে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না। তবে বিএনপি নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে ইভিএম-এর বিরুদ্ধে আবোলতাবোল বক্তব্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থার কথা বলে বিএনপি কেন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তা জানতে চান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, তা প্রমাণ করতেই বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। মির্জা ফখরুল বলেন, মানুষ শুধু প্রশ্ন করে, আপনারা নির্বাচনে কেন গেলেন? আমাদের অভিযোগ প্রমাণ করতেই আমরা এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যায়নি। তখন বলা হয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে ভুল করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনে না গিয়ে যে ভুল করিনি তা প্রমাণ করতে ২০১৮ সালে আমরা নির্বাচনে গিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমদ বলেছেন, নালিশ করা, অভিযোগ করা বিএনপির পুরনো ঐতিহ্য। বিএনপি এখনই বলছে যে, তারা নির্বাচনে জিতবে না। আর সেটা জেনেও তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এটা হতাশাগ্রস্থদের কথা। এতে তাদের নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়। এ কথার মধ্য দিয়েই তারা হেরে গেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন লোক দেখানো। হৈচৈ হবে, মিছিল হবে, সবাই স্লোগান দেবে। তবে নির্বাচনের দুদিন আগে সব ঠা-া হয়ে যাবে। এর মধ্যে বিএনপির একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে ধরে নিয়ে গেছে। একদিকে গ্রেফতার চলছে, অন্যদিকে চলছে নির্বাচনী প্রচার। এগুলো লোক দেখানো। এই নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।’

এগারো বছর ধরে টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এ সময়ে বিএনপি বেশ কিছু নির্বাচন বর্জন করেছে, আবার কিছু নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছে বেগম জিয়ার দল। কিন্তু ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি। ওই নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যানের পর দলটি বলছিল, ‘আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এর পর ইসির প্রতি অনাস্থা জানিয়ে গত বছর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচন বর্জন করলেও এবার আবার ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। এরই মধ্যে দলের দুই প্রার্থী সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন। মির্জা ফখরুলসহ বিএনপি নেতাদের বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে না গিয়ে তারা ভুল করেনি এবং আওয়ামী লীগ তথা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এটা প্রমাণের জন্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আবার বর্তমান সরকারের অধীনে আগেও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি এবং এবারও হবে না এটা আবার প্রমাণের জন্য তারা ৩০ জানুয়ারির সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। তাহলে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না-এটি বারবার প্রমাণের জন্যই বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে।

আর দু’সপ্তাহ পরেই ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন। ৫ বছর আগে ২০১৫ সালে সিটি নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তে উত্তরে তাবিথ আউয়াল এবং দক্ষিণে মির্জা আব্বাস ভোট গ্রহণের দিন দুপুরেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। শোনা যায়, এবার তারা তা করতে চায় না। গতবার মাঝপথে নির্বাচন বর্জনের পরেও উভয় সিটিতে বিএনপি প্রচুর সংখ্যায় ভোট পেয়েছিল। কারো কারো ধারণা, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকলে হয়তো ইতিবাচক ফল আসতে পারতো। বর্জনের ব্যাপারে তখন দলের ভেতরে-বাইরে তীব্র সমালোচনা হয়। যে কারণে এবার পরিস্থিতি যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত লড়তে চায় বিএনপি। বিএনপি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কার্যাবলীও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কমিশন কোন প্রকার পক্ষপাতমূলক আচরণ করলে ভবিষ্যতে এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেবে তারা।

বিএনপি আশঙ্কা করছে এবারও নানা অজুহাতে বিএনপি সমর্থিত মেয়র-কাউন্সিলর এবং তাদের সমর্থকদের মাঠছাড়া করতে সরকারি দল ফন্দি-ফিকির করে যাচ্ছে। একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে গ্রেফতার করায় তারা উদ্বিগ্ন। একটি জাতীয় পত্রিকাতে একজন বিএনপি নেতা বলেছেন, তাদের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের নামে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ঋণ এবং লিজিং কোম্পানিগুলোতে ঋত সম্পর্কিত ফাইল খোঁজা হচ্ছে। দুদক পুরনো ফাইল পুনরায় নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছে। প্যারাডাইস পেপারস মামলায় তাবিথ আউয়ালসহ ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিষয়ক ফাইলগুলো সামনে আনতে তৎপর হয়ে উঠেছে একটি মহল। বিএনপি বলছে গত সংসদ নির্বাচনের আগের দিন ২৯ ডিসেম্বর রাতে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ভোট কারচুপি করেছে আর এবার ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) এর মাধ্যমে কারচুপি করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ইভিএম-এর ভোটে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এখন পর্যন্ত এই সরকারের অধীনে আর এই নির্বাচন কমিশনারের পরিচালনায় কোন নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। অন্যদিকে ইভিএম সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিযুক্ত। এ জন্য তারা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই ইভিএমে জনগণের রায় প্রতিফলিত হবে না। এতে ভোটের ফলাফলকে ভিন্নমুখী করার যথেষ্ট সুযোগ থাকবে। বিএনপির এই অভিযোগ মানতে রাজি নন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ের জন্য আসেনি। ওরা কারচুপি প্রমাণ করতে অংশ নিচ্ছে। এ জন্য তারা আগেভাগেই কারচুপির অভিযোগ তুলছে। ইভিএম নিয়ে কোন বড় অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বরং যেসব জায়গায় ইভিএমে ভোট হয়েছে, সেখানে বেশির ভাগ জায়গায় বিএনপি প্রার্থীই বিজয়ী হয়েছে।

মির্জা ফখরুলের কাছে জানতে চাই, আসন্ন সিটি নির্বাচনেও যদি কারচুপি হয়, তাহলে তারা কি করবেন? তারা কি আবারো আওয়ামী লীগের ভোট কারচুপি প্রমাণের জন্য পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেবেন? দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় সরকারি ও বিরোধী দল উভয় দলকে অবদান রাখতে হয়। গণতন্ত্র হলো দুই চাকাওয়ালা সাইকেলের মতো। এক চাকা কাজ না করলে সাইকেল চলে না। গত ১১ বছর দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তাদের দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সংসদে বিএনপি ৬-৭টি আসন রয়েছে। গণতন্ত্রে সরকারি ও বিরোধী দল মিলেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে ভোটের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দলের পর পর দু’বার ক্ষমতায় আসার রেকর্ড নেই। ভোটের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরপর তিনবার ক্ষমতায় এসেছে।

পরপর তিনটি নির্বাচনে বিজয়ের পেছনে আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব এবং বিএনপির ব্যর্থতা কার কতটুকু তা ইতিহাসই বিচার করবে। ইতিহাস থেকে বিএনপিকে শিক্ষা নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের তাজা রক্ত এবং চার লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই বিএনপিসহ সব দলকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনীতি করতে হবে। ২০২০ সাল বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী। সারা বছর ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপিত হচ্ছে। বিএনপি কি মুজিববর্ষ পালন করবে? শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই এদেশ স্বাধীন হয়েছে। শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শেখ মুজিবের বিরোধিতা করা বাংলাদেশের বিরোধিতা করার শামিল। মুজিবের অবদানকে অস্বীকার করলে বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা হয়। শেখ মুজিব এই রাষ্ট্রের জনক, আমাদের স্বাধীনতার জনক। এই মহান নেতার অবদান অস্বীকার করে এদেশে রাজনীতি করা যাবে না, এই কঠিন সত্যটুকু বিএনপি নেতৃত্বকে অনুধাবন করতে হবে।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৮ বছরের ইতিহাসে দল ও সরকার পরিচালনায় এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। দল আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্বে সুসংহত; অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভুল রাজনীতি ও ব্যর্থ নেতৃত্বের জন্য ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যা দু’জনই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে আসছেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ছিল একতরফা। গত বছরের সংসদ নির্বাচন এবং উপজেলা, মেয়র ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর ইতিহাস সুখকর নয়। নির্বাচন নিয়ে যা হওয়ার হয়ে গেছে। সর্ব পর্যায়ের নির্বাচন অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে না। দেশ, জাতি, গণতন্ত্র, রাজনীতিবিদ ও রাজনীতির স্বার্থেই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। আর এই কঠিন কাজটি করা অনেক ইতিহাস সৃষ্টিকারী বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষেই সম্ভব। জনগণ আর কোন কালো, কুৎসিৎ, ভঙ্গুর, কলংকিত নির্বাচন দেখতে চায় না। নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই প্রত্যাশিত শুভ উদ্যোগের সূচনা হবেÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

১৩ জানুয়ারি ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা ]

bandhu.ch77@yahoo.com

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২০ , ৩০ পৌষ ১৪২৬, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে

মোহাম্মদ শাহজাহান

ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারই প্রথম নৌকা ও ধানের শীষ দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। রাজধানীতে নৌকা ভার্সেস ধানের শীষ প্রতীকের এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই শক্তিশালী মেয়র প্রার্থী দক্ষিণে শেখ ফজলে নূর তাপস ও উত্তরে আতিকুল ইসলামের বিপক্ষে লড়ছেন বিএনপির দুই তরুণ প্রার্থী দক্ষিণে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন ও উত্তরে তাবিথ আউয়াল। দুই সিটি করপোরেশনের চার প্রার্থীই উচ্চশিক্ষিত ও সম্পদশালী। উত্তরে দুই দলের প্রার্থীই বড় ব্যবসায়ী। দু’জনেরই রয়েছে শত কোটি টাকার ব্যবসায়িক ঋণ। তবে বেশি সম্পদের মালিক হচ্ছেন শেখ ফজলে নূর তাপস আর বেশি ঋণ রয়েছে আতিকুল ইসলামের। ফজলে নূর তাপস আইনজীবী। অন্য তিনজন ব্যবসায়ী। হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুসারে বছরে তার মোট আয় ১০ কোটি টাকার কাছাকাছি। তার ওপর নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় দুই কোটি টাকার উপরে। সব মিলিয়ে ফজলে নূর তাপস শতাধিক কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক। উত্তরের বিএনপির প্রার্থী ব্যবসায়ী তাবিথ আউয়াল ইনফরমেশন সিস্টেমস টেকনোলজির ওপর এমএসসি ডিগ্রি নিয়েছেন। তার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৭টি। বিভিন্ন খাত থেকে তাবিথের বার্ষিক আয় ৪ কোটি টাকার বেশি। তার প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ আছে, স্ত্রীর নামে রয়েছে সাড়ে ৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ। তার ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ আছে। তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। যদ্দূর মনে পড়ে, ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আবদুল আউয়াল মিন্টু আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীর অর্থের জোগান দিয়েছেন। তার ঢাকার মেয়র হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল।

ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আাতিকুল ইসলাম ব্যবসায়ী। তিনি বিকম পাস। ১৬টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাবেক এই ব্যবসায়ী নেতার। তার হাতে নগদ রয়েছে ৯ লাখ টাকার কাছাকাছি। আতিকুল ইসলাম সব মিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক। তার স্থাবর সম্পদ রয়েছে ৭ কোটি টাকার মতো। তার স্ত্রী ৩ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক। আতিকুলের ব্যবসায়িক ঋত ৬ কোটি টাকার কাছাকাছি। দক্ষিণে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন অবিভক্ত ঢাকার নির্বাচিত মেয়র বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার পুত্র। ইশরাক এমএসসি (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও স্বত্বাধিকারী। তার বার্ষিক আয় ১ কোটি টাকার কাছাকাছি। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ মিলে তিনি প্রায় ৬ কোটি টাকার মালিক। তার নগদ টাকার পরিমাণ ৩৩ হাজার। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে দেড় কোটি টাকার কাছাকাছি। ৩ কোটি টাকার রয়েছে শেয়ার। তার বিরুদ্ধে দুদকে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

নির্বাচনে যে কারচুপি হবে-এ ব্যাপারে এখনই নিশ্চিত হয়ে গেছে বিএনপি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কারচুপি হবে জেনেও তারা নির্বাচনে আসছে কেন? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা করব। এই নির্বাচনে হেরে গেলে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না। তবে বিএনপি নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে ইভিএম-এর বিরুদ্ধে আবোলতাবোল বক্তব্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থার কথা বলে বিএনপি কেন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তা জানতে চান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, তা প্রমাণ করতেই বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। মির্জা ফখরুল বলেন, মানুষ শুধু প্রশ্ন করে, আপনারা নির্বাচনে কেন গেলেন? আমাদের অভিযোগ প্রমাণ করতেই আমরা এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যায়নি। তখন বলা হয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে ভুল করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনে না গিয়ে যে ভুল করিনি তা প্রমাণ করতে ২০১৮ সালে আমরা নির্বাচনে গিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমদ বলেছেন, নালিশ করা, অভিযোগ করা বিএনপির পুরনো ঐতিহ্য। বিএনপি এখনই বলছে যে, তারা নির্বাচনে জিতবে না। আর সেটা জেনেও তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এটা হতাশাগ্রস্থদের কথা। এতে তাদের নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়। এ কথার মধ্য দিয়েই তারা হেরে গেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন লোক দেখানো। হৈচৈ হবে, মিছিল হবে, সবাই স্লোগান দেবে। তবে নির্বাচনের দুদিন আগে সব ঠা-া হয়ে যাবে। এর মধ্যে বিএনপির একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে ধরে নিয়ে গেছে। একদিকে গ্রেফতার চলছে, অন্যদিকে চলছে নির্বাচনী প্রচার। এগুলো লোক দেখানো। এই নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।’

এগারো বছর ধরে টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এ সময়ে বিএনপি বেশ কিছু নির্বাচন বর্জন করেছে, আবার কিছু নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছে বেগম জিয়ার দল। কিন্তু ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি। ওই নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যানের পর দলটি বলছিল, ‘আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এর পর ইসির প্রতি অনাস্থা জানিয়ে গত বছর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচন বর্জন করলেও এবার আবার ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। এরই মধ্যে দলের দুই প্রার্থী সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন। মির্জা ফখরুলসহ বিএনপি নেতাদের বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে না গিয়ে তারা ভুল করেনি এবং আওয়ামী লীগ তথা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এটা প্রমাণের জন্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আবার বর্তমান সরকারের অধীনে আগেও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি এবং এবারও হবে না এটা আবার প্রমাণের জন্য তারা ৩০ জানুয়ারির সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। তাহলে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না-এটি বারবার প্রমাণের জন্যই বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে।

আর দু’সপ্তাহ পরেই ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন। ৫ বছর আগে ২০১৫ সালে সিটি নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তে উত্তরে তাবিথ আউয়াল এবং দক্ষিণে মির্জা আব্বাস ভোট গ্রহণের দিন দুপুরেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। শোনা যায়, এবার তারা তা করতে চায় না। গতবার মাঝপথে নির্বাচন বর্জনের পরেও উভয় সিটিতে বিএনপি প্রচুর সংখ্যায় ভোট পেয়েছিল। কারো কারো ধারণা, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকলে হয়তো ইতিবাচক ফল আসতে পারতো। বর্জনের ব্যাপারে তখন দলের ভেতরে-বাইরে তীব্র সমালোচনা হয়। যে কারণে এবার পরিস্থিতি যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত লড়তে চায় বিএনপি। বিএনপি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কার্যাবলীও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কমিশন কোন প্রকার পক্ষপাতমূলক আচরণ করলে ভবিষ্যতে এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেবে তারা।

বিএনপি আশঙ্কা করছে এবারও নানা অজুহাতে বিএনপি সমর্থিত মেয়র-কাউন্সিলর এবং তাদের সমর্থকদের মাঠছাড়া করতে সরকারি দল ফন্দি-ফিকির করে যাচ্ছে। একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে গ্রেফতার করায় তারা উদ্বিগ্ন। একটি জাতীয় পত্রিকাতে একজন বিএনপি নেতা বলেছেন, তাদের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের নামে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ঋণ এবং লিজিং কোম্পানিগুলোতে ঋত সম্পর্কিত ফাইল খোঁজা হচ্ছে। দুদক পুরনো ফাইল পুনরায় নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছে। প্যারাডাইস পেপারস মামলায় তাবিথ আউয়ালসহ ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিষয়ক ফাইলগুলো সামনে আনতে তৎপর হয়ে উঠেছে একটি মহল। বিএনপি বলছে গত সংসদ নির্বাচনের আগের দিন ২৯ ডিসেম্বর রাতে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ভোট কারচুপি করেছে আর এবার ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) এর মাধ্যমে কারচুপি করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ইভিএম-এর ভোটে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এখন পর্যন্ত এই সরকারের অধীনে আর এই নির্বাচন কমিশনারের পরিচালনায় কোন নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। অন্যদিকে ইভিএম সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিযুক্ত। এ জন্য তারা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই ইভিএমে জনগণের রায় প্রতিফলিত হবে না। এতে ভোটের ফলাফলকে ভিন্নমুখী করার যথেষ্ট সুযোগ থাকবে। বিএনপির এই অভিযোগ মানতে রাজি নন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ের জন্য আসেনি। ওরা কারচুপি প্রমাণ করতে অংশ নিচ্ছে। এ জন্য তারা আগেভাগেই কারচুপির অভিযোগ তুলছে। ইভিএম নিয়ে কোন বড় অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বরং যেসব জায়গায় ইভিএমে ভোট হয়েছে, সেখানে বেশির ভাগ জায়গায় বিএনপি প্রার্থীই বিজয়ী হয়েছে।

মির্জা ফখরুলের কাছে জানতে চাই, আসন্ন সিটি নির্বাচনেও যদি কারচুপি হয়, তাহলে তারা কি করবেন? তারা কি আবারো আওয়ামী লীগের ভোট কারচুপি প্রমাণের জন্য পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেবেন? দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় সরকারি ও বিরোধী দল উভয় দলকে অবদান রাখতে হয়। গণতন্ত্র হলো দুই চাকাওয়ালা সাইকেলের মতো। এক চাকা কাজ না করলে সাইকেল চলে না। গত ১১ বছর দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তাদের দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সংসদে বিএনপি ৬-৭টি আসন রয়েছে। গণতন্ত্রে সরকারি ও বিরোধী দল মিলেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে ভোটের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দলের পর পর দু’বার ক্ষমতায় আসার রেকর্ড নেই। ভোটের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরপর তিনবার ক্ষমতায় এসেছে।

পরপর তিনটি নির্বাচনে বিজয়ের পেছনে আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব এবং বিএনপির ব্যর্থতা কার কতটুকু তা ইতিহাসই বিচার করবে। ইতিহাস থেকে বিএনপিকে শিক্ষা নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের তাজা রক্ত এবং চার লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই বিএনপিসহ সব দলকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনীতি করতে হবে। ২০২০ সাল বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী। সারা বছর ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপিত হচ্ছে। বিএনপি কি মুজিববর্ষ পালন করবে? শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই এদেশ স্বাধীন হয়েছে। শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শেখ মুজিবের বিরোধিতা করা বাংলাদেশের বিরোধিতা করার শামিল। মুজিবের অবদানকে অস্বীকার করলে বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা হয়। শেখ মুজিব এই রাষ্ট্রের জনক, আমাদের স্বাধীনতার জনক। এই মহান নেতার অবদান অস্বীকার করে এদেশে রাজনীতি করা যাবে না, এই কঠিন সত্যটুকু বিএনপি নেতৃত্বকে অনুধাবন করতে হবে।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৮ বছরের ইতিহাসে দল ও সরকার পরিচালনায় এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। দল আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্বে সুসংহত; অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভুল রাজনীতি ও ব্যর্থ নেতৃত্বের জন্য ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যা দু’জনই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে আসছেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ছিল একতরফা। গত বছরের সংসদ নির্বাচন এবং উপজেলা, মেয়র ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর ইতিহাস সুখকর নয়। নির্বাচন নিয়ে যা হওয়ার হয়ে গেছে। সর্ব পর্যায়ের নির্বাচন অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে না। দেশ, জাতি, গণতন্ত্র, রাজনীতিবিদ ও রাজনীতির স্বার্থেই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। আর এই কঠিন কাজটি করা অনেক ইতিহাস সৃষ্টিকারী বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষেই সম্ভব। জনগণ আর কোন কালো, কুৎসিৎ, ভঙ্গুর, কলংকিত নির্বাচন দেখতে চায় না। নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই প্রত্যাশিত শুভ উদ্যোগের সূচনা হবেÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

১৩ জানুয়ারি ২০২০

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা ]

bandhu.ch77@yahoo.com