সিটি নির্বাচন প্রার্থী সমীপে ১১ দফা পরিবেশ-প্রস্তাব

পাভেল পার্থ

দুঃসহ পরিবেশ যন্ত্রণায় কাতর ঢাকা শহরে আবারও নির্বাচনের সময় এসেছে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা ২০১০ অনুযায়ী ইতোমধ্যেই মেয়র, সংরক্ষিত ও সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে প্রার্থী নির্বাচন ও প্রতীক বরাদ্দ সমাপ্ত হয়েছে। বায়ু, শব্দ ও রাসায়নিক দূষণে কাতর এ নগরের জন্য নিশ্চয়ই এমন কেউ নির্বাচিত হয়ে আসবেন না, যিনি রাতারাতি এই দূষণ থামিয়ে দেয়ার জাদু জানেন। জানি মশা, জলাবদ্ধতা, ধূলি, যানজট, দুর্ঘটনা আর অসহনীয় পরিবেশ কোনো একটি পক্ষ বা এজেন্সি চাইলে এক নিমিষেই দূর করে দিতে পারবে না। তবে যদি কর্তৃপক্ষের নগরের প্রতি মায়া থাকে, নগরের প্রাণ-প্রকৃতির তরে বুকে দরদ থাকে হয়তো এই দূষণমাত্রা বিপদসীমা অতিক্রম করবে না। আমরা বিশ্বাস করি এ বছরের সিটি করপোরেশন নির্বাচন নগরের পরিবেশ প্রশ্নকে প্রধান করে তুলবে। প্রার্থীরা নগরের গণতান্ত্রিক পরিবেশ শুধু নয়, পরিবেশের গণতান্ত্রিক ভারসাম্য নিয়েও সোচ্চার হবেন। আসন্ন সিটি করপোরেশ নির্বাচনের সম্মানিত মেয়ার প্রার্থীর কাছে আমাদের চিরচেনা বারবার উচ্চারিত এগারো দফা পরিবেশ-প্রস্তাব আবারো পেশ করছি। এটি এই নির্বাচনের সময় শুধুমাত্র স্মরণ করিয়ে দেয়া, যাতে আমাদের ভেতরের প্রিয় এই নগরের প্রতি দরদ ও দায়িত্ব থাকে।

মশা ও মশাবাহিত রোগ নির্মূল : ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ঢাকাসহ পুরো দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। কত পরিবার প্রিয়জনহারা হয়েছে। তবু কমেনি আশংকা, তবু তৎপর হয়নি সমন্বিত নির্মূল ব্যবস্থাপনা। মশা নিধনে সমন্বিত পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার দিকেই নজর দিতে হবে। মশার উৎপত্তিস্থল ও পরিবেশ বিনষ্ট করতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে মশা দমন হয় এমন প্রাণীদের বসবাসের পরিবেশের নিশ্চয়তা তৈরি করতে হবে। বছরব্যাপি শুমারী ও গবেষণার মাধ্যমে নিরাপদ ব্যবস্থাপনাগুলো সহজে সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে বছরব্যাপী এলাকা অনুযায়ী রোগ ও মশা বংশবিস্তারের পূর্বাভাসগুলো আগাম জানানো জরুরি।

নদী, জলাভূমি, মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ : যে ১৯ খাল ছিল ঢাকার প্রাণ, তা এখন মুমূর্ষু লাশ। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, বংশী নদীর ধারায় গড়ে ওঠা এই নগরে এখন নদীর গন্ধ নেই। ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে ঢাকার চারধারের নদী সুরক্ষায় সাহসী ও অগ্রণী হতে হবে। এখানে নতুন প্রজন্মের জন্য খেলা ও বিনোদনের মাঠ ও নানামুখী সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য উন্মুক্ত স্থান একেবারেই নেই। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে পর্যাপ্ত জলাভূমি, খাল, লেক, মাঠ ও উন্মুক্ত প্রান্তর পাবলিক স্থল হিসেবে সুরক্ষা করতে হবে।

নিরাপদ সড়ক : নিরাপদ সড়ক মানে কেবলমাত্র দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক চলাচল নয়, এখানে নারীসহ সকলের জন্য সকল সময়ে যাতায়াত নিশ্চিত ও নির্বিঘ্ন হতে হবে। পায়ে চলার পথসহ আলাদা সাইকেল লেন ও ঢাকার চারধারে নদী ও খালগুলোকে ব্যবহার করে নৌপথ এবং নিরাপদ রেলপথের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

নির্মল বায়ু ও শব্দদূষণ রোধ : ঢাকা এখন দুনিয়ার এক নম্বর দূষিত বায়ুর শহর। শব্দদূষণেও কাহিল এই নগর। বায়ু ও শব্দদূষণের সকল উৎসসমূহ কঠোর আইনের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে। যত্রতত্র গাড়ির হর্ন ও অযথা কোলাহল ও নৈরাজ্যকারী শব্দের দূষণ থামাতে হবে।

পরিবেশবান্ধব স্থাপনা ও অবকাঠামো : এ নগর একেবারেই পরিকল্পনাহীনভাবে বাড়ছে। এই বিশৃংখলা থামানো জরুরি। নগরের প্রতিটি স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণে স্থানীয় পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং নান্দনিকতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি নির্মাণকাজে পরিবেশবান্ধব সামগ্রির ব্যবহার বাড়াতে নজরদারি বাড়াতে হবে।

পলিথিন ও প্লাস্টিকমুক্ত নগর : ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ পলিথিন। নিদেনপক্ষে এখানকার সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পলিথিন ও প্লাস্টিকমুক্ত করা জরুরি।

রাসায়নিক, বিষ ও বিস্ফোরকমুক্ত নগর : ঢাকার চারধারে গড়ে ওঠেছে বিপদজনক সব রাসায়নিক কারখানা। নানাভাবে ঢাকায় নিমতলীর মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। অনেকের বাসাবাড়ির নিচেও বিস্ফোরকের ভাগাড়। ঢাকাকে সম্পূর্ণভাবে রাসায়নিক ও বিস্ফোরকমুক্ত করতে হবে।

বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য ও পানি : এ নগরে শিশুরা বাড়ছে বিষাক্ত খাবার খেয়ে। ফরমালিন, কার্বাইড, কাপড়ের রঙ, সীসা, ক্রোমিয়াম, মনো সোডিয়াম গ্লুটামেটসহ নানান বিপজ্জনক বিষ মিশে আছে আমাদের খাবারে। বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য ও পানির জন্য নিয়মিত কঠোর নজরদারি, ভ্রাম্যমাণ আদালত, গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। খাদ্য উৎস থেকে বিপণন, গুদামজাতকরণ কী পরিবেশন সকল স্তরে নজরদারি জারি রাখতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে।

অংশগ্রহণমূলক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : এখনো আমাদের বর্জ্যব্যবস্থাপনার সক্রিয় কর্মসূচি নেই। পরিবারভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবারকে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করার প্রক্রিয়ায় আনা জরুরি। বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করে এখানে থেকে নগরবাসীর জন্য পরবর্তী সময়ে উপহার প্রদানও সম্ভব।

উদ্যান, নগরকৃষি ও শহুরে বন্যপ্রাণী সুরক্ষা : নগরের প্রতিটি উদ্যানকে সুরক্ষা করতে হবে। আরো বেশি নাগরিক উদ্যান গড়ে তুলতে হবে। সড়ক ও উদ্যানের ক্ষেত্রে বৃক্ষপ্রজাতি নির্বাচনে অবশ্যই দেশীয় বৈচিত্র্যময় ফলজ, বনজ ও ভেষজ গাছের প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে। ছাদ ও বারান্দাসহ নগরের নানা অব্যবহৃত অংশকে নগর কৃষির আওতায় এনে সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। এখনো এই শহরে বানর, বেজি, গুঁইসাপ, তক্ষক, বর্ণচোরা, কাকসহ নানা পাখির বাস রয়েছে। শহরের বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।

বৈচিত্র্য ও বৈভবের নগর : নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। নগর হবে প্রবীণ, শিশু, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ, নারীবান্ধব। ভাষা, বর্ণ, জাতিগতবৈচিত্র্য ও নানামুখী আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দিয়েই নাগরিক বৈচিত্র্য সুরক্ষা করতে হবে। নগরে দরিদ্র মানুষের আবাসন ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

জানি এই ১১ দফা পরিবেশ-প্রস্তাবের কোনোটিই সিটি করপোরেশন প্রার্থীদের কাছে অপরিচিত নয়। প্রার্থীরাও এই চলমান পরিবেশযন্ত্রণা সামলেই বেঁচে আছেন। কিন্তু আমরা কী আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য এমন একটি বিষাক্ত নগর রেখে যাব? এটি কী কোনো প্রার্থী আশা করেন? জানি প্রস্তাবিত ১১ দফা পূরণ করা কোনোভাবেই সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এই কাজে নগরের সকল স্তরের নাগরিকের সমান অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তা জরুরি। আর এটিই করতে পারে সিটি করপোরেশন। এতে এই নগর সরকারের জনসম্পৃক্ততা যেমন বাড়বে, জনগণও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার আরো কাছাকাছি আসতে পারবে। আশা করি এই ১১ দফা পরিবেশ-প্রস্তাবকে প্রধান করেই শুরু হবে আমাদের সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও সম্মানিত প্রার্থীদের তুমুল কর্মসূচি। স্বপ্ন দেখি আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ এই নগরকে সুস্থ, নির্মল, নান্দনিক এবং সকল প্রাণের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য এক দীর্ঘ দরদ ও সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমরা মনেপ্রাণে এই সাহস ও দরদের জনবিজয় আশা করি।

[লেখক : গবেষক]

animistbangla@gmail.com

বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২০ , ১ মাঘ ১৪২৬, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

সিটি নির্বাচন প্রার্থী সমীপে ১১ দফা পরিবেশ-প্রস্তাব

পাভেল পার্থ

image

দুঃসহ পরিবেশ যন্ত্রণায় কাতর ঢাকা শহরে আবারও নির্বাচনের সময় এসেছে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা ২০১০ অনুযায়ী ইতোমধ্যেই মেয়র, সংরক্ষিত ও সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে প্রার্থী নির্বাচন ও প্রতীক বরাদ্দ সমাপ্ত হয়েছে। বায়ু, শব্দ ও রাসায়নিক দূষণে কাতর এ নগরের জন্য নিশ্চয়ই এমন কেউ নির্বাচিত হয়ে আসবেন না, যিনি রাতারাতি এই দূষণ থামিয়ে দেয়ার জাদু জানেন। জানি মশা, জলাবদ্ধতা, ধূলি, যানজট, দুর্ঘটনা আর অসহনীয় পরিবেশ কোনো একটি পক্ষ বা এজেন্সি চাইলে এক নিমিষেই দূর করে দিতে পারবে না। তবে যদি কর্তৃপক্ষের নগরের প্রতি মায়া থাকে, নগরের প্রাণ-প্রকৃতির তরে বুকে দরদ থাকে হয়তো এই দূষণমাত্রা বিপদসীমা অতিক্রম করবে না। আমরা বিশ্বাস করি এ বছরের সিটি করপোরেশন নির্বাচন নগরের পরিবেশ প্রশ্নকে প্রধান করে তুলবে। প্রার্থীরা নগরের গণতান্ত্রিক পরিবেশ শুধু নয়, পরিবেশের গণতান্ত্রিক ভারসাম্য নিয়েও সোচ্চার হবেন। আসন্ন সিটি করপোরেশ নির্বাচনের সম্মানিত মেয়ার প্রার্থীর কাছে আমাদের চিরচেনা বারবার উচ্চারিত এগারো দফা পরিবেশ-প্রস্তাব আবারো পেশ করছি। এটি এই নির্বাচনের সময় শুধুমাত্র স্মরণ করিয়ে দেয়া, যাতে আমাদের ভেতরের প্রিয় এই নগরের প্রতি দরদ ও দায়িত্ব থাকে।

মশা ও মশাবাহিত রোগ নির্মূল : ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ঢাকাসহ পুরো দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। কত পরিবার প্রিয়জনহারা হয়েছে। তবু কমেনি আশংকা, তবু তৎপর হয়নি সমন্বিত নির্মূল ব্যবস্থাপনা। মশা নিধনে সমন্বিত পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার দিকেই নজর দিতে হবে। মশার উৎপত্তিস্থল ও পরিবেশ বিনষ্ট করতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে মশা দমন হয় এমন প্রাণীদের বসবাসের পরিবেশের নিশ্চয়তা তৈরি করতে হবে। বছরব্যাপি শুমারী ও গবেষণার মাধ্যমে নিরাপদ ব্যবস্থাপনাগুলো সহজে সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে বছরব্যাপী এলাকা অনুযায়ী রোগ ও মশা বংশবিস্তারের পূর্বাভাসগুলো আগাম জানানো জরুরি।

নদী, জলাভূমি, মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ : যে ১৯ খাল ছিল ঢাকার প্রাণ, তা এখন মুমূর্ষু লাশ। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, বংশী নদীর ধারায় গড়ে ওঠা এই নগরে এখন নদীর গন্ধ নেই। ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে ঢাকার চারধারের নদী সুরক্ষায় সাহসী ও অগ্রণী হতে হবে। এখানে নতুন প্রজন্মের জন্য খেলা ও বিনোদনের মাঠ ও নানামুখী সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য উন্মুক্ত স্থান একেবারেই নেই। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে পর্যাপ্ত জলাভূমি, খাল, লেক, মাঠ ও উন্মুক্ত প্রান্তর পাবলিক স্থল হিসেবে সুরক্ষা করতে হবে।

নিরাপদ সড়ক : নিরাপদ সড়ক মানে কেবলমাত্র দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক চলাচল নয়, এখানে নারীসহ সকলের জন্য সকল সময়ে যাতায়াত নিশ্চিত ও নির্বিঘ্ন হতে হবে। পায়ে চলার পথসহ আলাদা সাইকেল লেন ও ঢাকার চারধারে নদী ও খালগুলোকে ব্যবহার করে নৌপথ এবং নিরাপদ রেলপথের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

নির্মল বায়ু ও শব্দদূষণ রোধ : ঢাকা এখন দুনিয়ার এক নম্বর দূষিত বায়ুর শহর। শব্দদূষণেও কাহিল এই নগর। বায়ু ও শব্দদূষণের সকল উৎসসমূহ কঠোর আইনের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে। যত্রতত্র গাড়ির হর্ন ও অযথা কোলাহল ও নৈরাজ্যকারী শব্দের দূষণ থামাতে হবে।

পরিবেশবান্ধব স্থাপনা ও অবকাঠামো : এ নগর একেবারেই পরিকল্পনাহীনভাবে বাড়ছে। এই বিশৃংখলা থামানো জরুরি। নগরের প্রতিটি স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণে স্থানীয় পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং নান্দনিকতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি নির্মাণকাজে পরিবেশবান্ধব সামগ্রির ব্যবহার বাড়াতে নজরদারি বাড়াতে হবে।

পলিথিন ও প্লাস্টিকমুক্ত নগর : ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ পলিথিন। নিদেনপক্ষে এখানকার সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পলিথিন ও প্লাস্টিকমুক্ত করা জরুরি।

রাসায়নিক, বিষ ও বিস্ফোরকমুক্ত নগর : ঢাকার চারধারে গড়ে ওঠেছে বিপদজনক সব রাসায়নিক কারখানা। নানাভাবে ঢাকায় নিমতলীর মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। অনেকের বাসাবাড়ির নিচেও বিস্ফোরকের ভাগাড়। ঢাকাকে সম্পূর্ণভাবে রাসায়নিক ও বিস্ফোরকমুক্ত করতে হবে।

বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য ও পানি : এ নগরে শিশুরা বাড়ছে বিষাক্ত খাবার খেয়ে। ফরমালিন, কার্বাইড, কাপড়ের রঙ, সীসা, ক্রোমিয়াম, মনো সোডিয়াম গ্লুটামেটসহ নানান বিপজ্জনক বিষ মিশে আছে আমাদের খাবারে। বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য ও পানির জন্য নিয়মিত কঠোর নজরদারি, ভ্রাম্যমাণ আদালত, গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। খাদ্য উৎস থেকে বিপণন, গুদামজাতকরণ কী পরিবেশন সকল স্তরে নজরদারি জারি রাখতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে।

অংশগ্রহণমূলক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : এখনো আমাদের বর্জ্যব্যবস্থাপনার সক্রিয় কর্মসূচি নেই। পরিবারভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবারকে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করার প্রক্রিয়ায় আনা জরুরি। বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করে এখানে থেকে নগরবাসীর জন্য পরবর্তী সময়ে উপহার প্রদানও সম্ভব।

উদ্যান, নগরকৃষি ও শহুরে বন্যপ্রাণী সুরক্ষা : নগরের প্রতিটি উদ্যানকে সুরক্ষা করতে হবে। আরো বেশি নাগরিক উদ্যান গড়ে তুলতে হবে। সড়ক ও উদ্যানের ক্ষেত্রে বৃক্ষপ্রজাতি নির্বাচনে অবশ্যই দেশীয় বৈচিত্র্যময় ফলজ, বনজ ও ভেষজ গাছের প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে। ছাদ ও বারান্দাসহ নগরের নানা অব্যবহৃত অংশকে নগর কৃষির আওতায় এনে সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। এখনো এই শহরে বানর, বেজি, গুঁইসাপ, তক্ষক, বর্ণচোরা, কাকসহ নানা পাখির বাস রয়েছে। শহরের বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।

বৈচিত্র্য ও বৈভবের নগর : নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। নগর হবে প্রবীণ, শিশু, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ, নারীবান্ধব। ভাষা, বর্ণ, জাতিগতবৈচিত্র্য ও নানামুখী আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দিয়েই নাগরিক বৈচিত্র্য সুরক্ষা করতে হবে। নগরে দরিদ্র মানুষের আবাসন ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

জানি এই ১১ দফা পরিবেশ-প্রস্তাবের কোনোটিই সিটি করপোরেশন প্রার্থীদের কাছে অপরিচিত নয়। প্রার্থীরাও এই চলমান পরিবেশযন্ত্রণা সামলেই বেঁচে আছেন। কিন্তু আমরা কী আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য এমন একটি বিষাক্ত নগর রেখে যাব? এটি কী কোনো প্রার্থী আশা করেন? জানি প্রস্তাবিত ১১ দফা পূরণ করা কোনোভাবেই সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এই কাজে নগরের সকল স্তরের নাগরিকের সমান অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তা জরুরি। আর এটিই করতে পারে সিটি করপোরেশন। এতে এই নগর সরকারের জনসম্পৃক্ততা যেমন বাড়বে, জনগণও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার আরো কাছাকাছি আসতে পারবে। আশা করি এই ১১ দফা পরিবেশ-প্রস্তাবকে প্রধান করেই শুরু হবে আমাদের সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও সম্মানিত প্রার্থীদের তুমুল কর্মসূচি। স্বপ্ন দেখি আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ এই নগরকে সুস্থ, নির্মল, নান্দনিক এবং সকল প্রাণের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য এক দীর্ঘ দরদ ও সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমরা মনেপ্রাণে এই সাহস ও দরদের জনবিজয় আশা করি।

[লেখক : গবেষক]

animistbangla@gmail.com