মনের পথে বহুমাত্রিক দৃষ্টি

কাজী সালমান শীশ

‘মনের পথে’ এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের গ্রন্থ। গ্রন্থের লেখক কাজী মোহাম্মদ শীশ আমার পিতা। সে জন্য আব্বার পেশা, পরিচয় ও আদর্শ সম্পর্কে লেখা আমার জন্য কিছুটা অস্বস্তিকর। বইয়ের শুরুতে ‘প্রাক কথনে’ দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। ‘মনের পথে’ নামটা স্নিগ্ধ ও শান্ত। লেখার ভাষা, অভিব্যক্তি ও উপস্থাপনে সেই মসৃণতার ছাপ পাওয়া যায়, যদিও রচনাগুলোর বিষয়বস্তু জীবনঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক, জাতীয়, এমনকি পারিবার নিয়ে লেখাও এখানে স্থান পেয়েছে, কিন্তু কোনটিই ব্যক্তিগত বিন্দুতে সীমাবদ্ধ থাকেনি; ছুঁয়ে গেছে সার্বজনীন সমস্যা ও সম্ভাবনাকে। বেশ কয়েকটি প্রবন্ধই দৈনিক সংবাদের উপসম্পাদকীয় অথবা মুক্ত আলোচনা পাতায় ছাপা হয়ে এসেছে। সারা বছরে একটি হলেও ছবি আঁকা হয় কারণ প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আব্বার একটি বই করে প্রকাশ পেয়ে থাকে, আর আমি পাই প্রচ্ছদ আঁকার কাজটি। উল্লেখ্য এটি তার ১৫তম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। সমকালীন ঘটনা, বিপন্ন পরিবেশ, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ইতিহাস-এরকম বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে তার লেখা প্রবন্ধের বইয়ের সংখ্যাই বেশি। এছাড়া রয়েছে ভ্রমণ কাহিনী ও একটি উপন্যাস। এখানে তার সদ্য প্রকাশিত বইটির সম্পর্কে কিছু ব্যক্তিগত ভাবনা ব্যক্ত করবো।

বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষা গড়ে ওঠা এক বিশাল পদযাত্রা। হাজার বছরের ছোট ছোট উপাদান নকশিকাঁথার মতো যেন সুতায় বুনা। বঙ্গীয় বস্ত্র, চিত্রকলা ও নকশা, ভিন্নমাত্রার প্রথা, আচরণ ও বিশ্বাস -তদনুযায়ী উৎসব গড়ে উঠতে লেগে যায় বহুকাল। কাব্যের মতো সরল, ছন্দ ও শান্তিতে চলতে থাকে বছরের পর বছর। তারপর একসময় বিদেশি পুঁজিবাদী শক্তি দখল করে নেয় ঘর, ভূমি তথা দেশ। রক্তে রঙ্গীন হয়ে ওঠে নকশিকাঁথা ও উঠানের আলপনা। শক্তিধর আগ্রাসীরা সক্ষম হয় সাময়িক রাজত্ব গড়তে, কিন্তু টিকে যায় ভূমির সংস্কৃতি ও ভাষা। ইতিহাস তাই বলে। পশ্চিমা শক্তিধর জাতি- ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, ডাচ, স্প্যানিশরা জল ও স্থলপথে যুদ্ধ করে, নিজেদের সুবিধানুযায়ী আইন তৈরি করে, অন্যের ভূমি দখল ও লুট করে গড়ে তোলে সাম্রাজ্যবাদ। বাংলার ভূ-খণ্ড যেমন আগ্রাসনের শিকার হয়েছে, তেমনি হয়েছে আফ্রিকার দেশগুলো, মধ্য আমেরিকার দেশ মেক্সিকো, আরো বিভিন্ন জাতি। ‘মনের পথে’র প্রথম রচনাটির শিরোনাম ‘বাংলা ভাষার চর্চা ও বঙ্গীয় সংস্কৃতির বিকাশ’ হলেও রয়েছে মেক্সিকোর মায়া সভ্যতার বিলুপ্তির কথা; যার প্রাথমিক বিলুপ্তি রহস্যময় হলেও স্পেনের শাসন আমলে তা স্থায়ীভাবে নিঃশেষ হয়।

মে দিবস নিয়ে একটি তথ্য সম্বলিত লেখা ‘মনের পথে’ বিদ্যমান। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর শ্রমিক আন্দোলন এবং তাদের প্রতি নির্যাতনের কথা সবারই জানা। আমরা আরো জানি দিনপ্রতি ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রম না দেয়া, আন্দোলন দানা বেঁধে বিপ্লবে পরিণত হওয়া, ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন গঠন, পুলিশের আক্রমণে হতাহতের খবর এবং একসময় বিপ্লবী শ্রমিকদের বিজয়। বিশ্বময় শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও প্রভাব এখনও চলমান। কিন্তু মে দিবসের সঙ্গে জড়িত খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ, আত্মত্যাগ, ইন্টেলেকচুয়াল সমাজের সম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক নীতি পরিবর্তনের কথাগুলো রচনাটিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিয়মান।

কাজী আজিজা ইদ্রিস (১৯২৬-২০১০) আমার দাদি, অর্থাৎ লেখকের মা। তার স্বামী কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস একজন আদর্শ সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি সততার জন্যে ১৮-১৯ বার চাকরি ছেড়েছেন। আর্থিক অভাব কখনোই তার প্রধানতম মানসিক কষ্টের কারণ হয় নি, এর অন্যতম কারণ নিঃসন্দেহে তার সহধর্মিণী কাজী আজিজা ইদ্রিস। দাদি দিনাজপুরের সচ্ছল মীর্জা পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা। বিয়ের আগে আর্থিক অভাব সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না। ছয় সন্তানের জননী; অভাব-অনটনের সংসার চালাতে তাকে যথেষ্ট বৈষয়িক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে কিন্তু হার মানেন নি, আপস করেননি, হাল ছাড়েননি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচয়ে নয়, আজিজা ইদ্রিস তার নিজের পরিচয়ে মহিমান্বিত। ১৯৫৭ সালে ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) গঠিত হলে তিনি ঢাকা মহানগর কমিটির নির্বাহী সদস্য হন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যুক্ত হন আন্দোলনে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’তে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭৪ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। এরপর আমৃত্যু তিনি গণতন্ত্রী পার্টি করেন এবং নারী স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্ভীকভাবে কাজ করে যান। গ্রন্থে ‘সেই যে আমার মা’ রচনায় সন্তানের দৃষ্টি থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসার কথা আবেগঘন ও যৌক্তিকভাবে বর্ণিত আছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্গজনক দিন। জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভাগ্যগুণে বেঁচে যান ইউরোপে থাকার কারণে। তাৎপর্যপূর্ণ এই বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রামাণ্যচিত্র “হাসিনা-এ ডটার’স টেল” নির্মাণ করেন পিপলু খান। চলচ্চিত্রটিতে উঠে আসে সেই সময় দুইবোনের দুঃসহ ও অনিশ্চিত জীবনযাপন, বেলজিয়ামে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাতারাতি বিরূপ আচরণ, পশ্চিম জার্মানির বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও পরবর্তী সময়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহান নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতার কথা। অপরদিকে বাংলাদেশের সামরিক সরকারের অমানবিক আচরণ ও অনাচার। তারা ব্যবস্থা করে যেন হাসিনা ও রেহানা দুই বোন কোনোভাবেই বাংলাদেশে ফিরতে না পারে। ইউরোপ ও ইন্দিরা গান্ধীর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে না থেকে, অন্য দেশে থাকলে বহু আগেই দুষ্কৃতকারীরা দুই বোনের জীবন নাশের প্রচেষ্টা চালাতো তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। প্রামাণ্যচিত্রে প্রধানত দৃষ্টিপাত দেয়া হয়েছে পঁচাত্তর থেকে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগে ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত দুই-বোনের জীবন সংগ্রাম। তবে সর্বাধিক মূল্যবান বিষয় ছিল বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার বোনের খণ্ড খণ্ড সাক্ষাৎকারগুলো। রূপকথার গল্পের মতো শত বাধা, ষড়যন্ত্র, এমনকি একাধিকবার মৃত্যুর হাতছানি থেকে ফিরে এসে একসময় দেশপ্রধান হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ব্যাপারটা এতই বড় যে এখানে ছবির ভাষা, শৈলী, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিক দিক নিয়ে কিছু লিখতে আমি ইচ্ছুক না। এই ছবির বিষয়ে আব্বার প্রবন্ধে বিস্তারিত ও নিরপেক্ষ মতামত বিদ্যমান।

প্রবাস জীবনে যাদের কর্ম, শিক্ষা বা অন্য কারণে দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছে, তাদের মধ্যে এক ধরণের হাহাকার কাজ করে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করেছি যে একসময় মাতৃভাষায় কথা বলতে না পারার কারণে দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে চায়! কবে ফিরে যাবো শত অভিযোগ, অভিমানে পরিপূর্ণ আমার বাংলাদেশে! এই বিস্বাদ অনুভব করতে ইতিহাসবেত্তা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু ইতিহাসই প্রতিষ্ঠা করেছে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা আর মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। অবিভক্ত ভারতে ১৯০৮ সালে কিশোর ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য। দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ -এ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ, যার সঙ্গে যুক্ত আছে নাম না জানা লাখ লাখ জনগণের দীর্ঘকালের আত্মত্যাগ ও নীরব অবদান। কিছু মনীষীর নাম আমরা জানি বটে যা পরিমাণের তুলনায় অপ্রতুল। লেখক সমস্ত বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক লেখা লিখেছেন তার গ্রন্থে, যেখানে স্থান পেয়েছে ৫২ সালের গণমানুষের গান থেকে প্রেরণা পাওয়া সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক, গায়ক অজিত রায়ের কথা। একই সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ রফিকের মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার বিষয়টি, লেখকের পিতা কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের ভাষা-আন্দোলনে ভূমিকা এবং মিল্লাত, ধূমকেতু ও দৈনিক সংবাদের মতো প্রগতিশীল পত্রিকায় আপসহীনভাবে কাজ করে যাওয়ার ছাপ।

১৯৭২ সালে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবী, বামপন্থি আদর্শের অনন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের জীবন ও কাজের কথা, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ডাক টিকিট নকশাকারী শিল্পী মো. ইদ্রিসের কর্ম ও লেখক পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি, অসাম্প্রদায়িক সংগীতশিল্পী জাহেদুর রহিমের (১৯৩৫-১৯৭৮) স্মৃতিচারণ, ফুপাতো বোন নারগিস আনাম ডজির (ডজিবু) প্রগতিশীল মানসিকতা ও নাট্যকর্মী হিসাবে পদচারণার প্রকাশ থেকে নানা বিষয়। ইতিহাসে বড় নেতা, মহান শিল্পী ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের কথা উল্লেখ থাকে, কিন্তু গোটা একটা জাতি যখন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তখন স্বল্প জনপ্রিয় ও নাম না জানা বহু মানুষের ভূমিকা থাকে নেপথ্যে। ‘মনের পথে’ বইয়ে এধরণের অনেক ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাবে যা লিপিবদ্ধ থেকে যাবে সারাজীবন।

আর ২-৩টা আর্টিকেল সম্পর্কে উল্লেখ করেই লেখাটি শেষ করবো। ফ্রান্সের সেই বিখ্যাত গির্জা নোৎরদাম নিয়ে আব্বার স্মৃতিচারণ। উনি প্রথম এই অপূর্ব স্থাপত্যের সামনে উপস্থিত হন ১৯৭৯ সালে। একজন প্রকৌশলী হিসেবে নয়, একজন পর্যটক হিসেবে তার মুগ্ধতা রয়ে যায় এবং এর কথা মনে পড়ে দীর্ঘ চার দশক পরে। ১৫ এপ্রিল ২০১৯ সালের সন্ধ্যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিধ্বস্ত হয় নোৎরদাম। বিশ্ববাসী দূর থেকে রেডিও, টিভি, ইন্টারনেট ও খবরের কাগজের মাধ্যমে এই দুর্ঘটনার সংবাদ পায়। আর যারা কাছে ছিলেন, তারা তো সরাসরি সেই দুঃসহ অগ্নিকাণ্ড দেখতে বাধ্য হয়েছেন। নোৎরদামের মধ্যে ছিল তিনটি মৌমাছির চাক। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে আগুন নেভার দিন তিনেক পর স্যাটেলাইটে দেখা যায় সেই মৌমাছিগুলো (আনুমানিক ২ লাখ) আবার ফিরে আসছে নোৎরদামে! সত্যিই প্রকৃতির সব আচরণ বোঝার চেষ্টা না করাই বোধহয় ভালো।

আমাদের এ অঞ্চলে অর্থাৎ উপমহাদেশে আদিবাসীদের সংখ্যা, সংস্কার ও সংস্কৃতি অত্যন্ত অর্থবহ। আদিবাসী বলতে চোখে ভাসে ছোট ছোট গোত্র পাহাড়ি অঞ্চলে বা জঙ্গলে স্বতন্ত্রভাবে জীবনযাপন করছে, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা এত ঠুনকো বৃত্তে সীমাবদ্ধ না। যুগে যুগে তারা বিদেশি পরাশক্তিদের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে প্রাণ দিয়েছেন নিজেদের মাটিকে রক্ষা করার জন্য। সিডো ও কানহু ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের বিরূদ্ধে বিদ্রোহের যে ডাক দেন তাতে ১০ হাজার সাঁওতাল অংগ্রহণ করেছিলেন। এতে মৃত্যুবরণ করেন অধিকাংশ বিদ্রোহী। পৃথক সময়ে সিডো ও কানহু দুজনই ধরা পড়েন এবং ব্রিটিশ সরকার তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়। তবে বিদ্রোহ থেমে থাকেনি। প্রায় ৪০ বছর পর বড় আকারে বিপ্লব ঘটান বিরসা মুন্ডা। তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। ইংরেজরা তাকে অমানুষিক অত্যাচার করে হত্যা করে। উপমহাদেশের পাহাড় ও জঙ্গল এলাকার অধিকাংশ ভূমির প্রকৃত মালিক আদিবাসীগণ। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তারা নিজেদের নির্মল-নিরীহ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।

‘মনের পথে’ গ্রন্থে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে যেগুলো পাঠকের নিজেদের পড়ে অনুভব করতে হবে। খাপরা ওয়ার্ডে পাকিস্তানি পাষণ্ড শাসকদের অত্যাচার, মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে লেখকের কথা বা তার বাবা কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের প্রতি নিজস্ব ভক্তি ও ভালোবাসার গভীরতা বিষয়গুলো নিয়ে আলাদা করে কিছু লেখার চেষ্টা করাটা ঠিক হবে না। কিছু কিছু অনুভূতি থাকে যার সম্পর্কে অল্প জেনে মন্তব্য করা ঠিক না। মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে, তবে এতটুকু বলা যায় যে রচনাগুলোতে সুপ্তভাবে রয়েছে মানুষের কল্যাণের দিক-নির্দেশনা। বইটি পাঠকের মনে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার পথ খুলে দিবে নিঃসন্দেহে। মনের ভাষা এত সহজ, সুন্দর ও সাবলীলভাবে প্রকাশের জন্য আমার আব্বা কাজী মোহাম্মদ শীশকে অজস্র ধন্যবাদ।

মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২৮ মাঘ ১৪২৬, ১৬ জমাদিউল সানি ১৪৪১

মনের পথে বহুমাত্রিক দৃষ্টি

কাজী সালমান শীশ

‘মনের পথে’ এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের গ্রন্থ। গ্রন্থের লেখক কাজী মোহাম্মদ শীশ আমার পিতা। সে জন্য আব্বার পেশা, পরিচয় ও আদর্শ সম্পর্কে লেখা আমার জন্য কিছুটা অস্বস্তিকর। বইয়ের শুরুতে ‘প্রাক কথনে’ দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। ‘মনের পথে’ নামটা স্নিগ্ধ ও শান্ত। লেখার ভাষা, অভিব্যক্তি ও উপস্থাপনে সেই মসৃণতার ছাপ পাওয়া যায়, যদিও রচনাগুলোর বিষয়বস্তু জীবনঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক, জাতীয়, এমনকি পারিবার নিয়ে লেখাও এখানে স্থান পেয়েছে, কিন্তু কোনটিই ব্যক্তিগত বিন্দুতে সীমাবদ্ধ থাকেনি; ছুঁয়ে গেছে সার্বজনীন সমস্যা ও সম্ভাবনাকে। বেশ কয়েকটি প্রবন্ধই দৈনিক সংবাদের উপসম্পাদকীয় অথবা মুক্ত আলোচনা পাতায় ছাপা হয়ে এসেছে। সারা বছরে একটি হলেও ছবি আঁকা হয় কারণ প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আব্বার একটি বই করে প্রকাশ পেয়ে থাকে, আর আমি পাই প্রচ্ছদ আঁকার কাজটি। উল্লেখ্য এটি তার ১৫তম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। সমকালীন ঘটনা, বিপন্ন পরিবেশ, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ইতিহাস-এরকম বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে তার লেখা প্রবন্ধের বইয়ের সংখ্যাই বেশি। এছাড়া রয়েছে ভ্রমণ কাহিনী ও একটি উপন্যাস। এখানে তার সদ্য প্রকাশিত বইটির সম্পর্কে কিছু ব্যক্তিগত ভাবনা ব্যক্ত করবো।

বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষা গড়ে ওঠা এক বিশাল পদযাত্রা। হাজার বছরের ছোট ছোট উপাদান নকশিকাঁথার মতো যেন সুতায় বুনা। বঙ্গীয় বস্ত্র, চিত্রকলা ও নকশা, ভিন্নমাত্রার প্রথা, আচরণ ও বিশ্বাস -তদনুযায়ী উৎসব গড়ে উঠতে লেগে যায় বহুকাল। কাব্যের মতো সরল, ছন্দ ও শান্তিতে চলতে থাকে বছরের পর বছর। তারপর একসময় বিদেশি পুঁজিবাদী শক্তি দখল করে নেয় ঘর, ভূমি তথা দেশ। রক্তে রঙ্গীন হয়ে ওঠে নকশিকাঁথা ও উঠানের আলপনা। শক্তিধর আগ্রাসীরা সক্ষম হয় সাময়িক রাজত্ব গড়তে, কিন্তু টিকে যায় ভূমির সংস্কৃতি ও ভাষা। ইতিহাস তাই বলে। পশ্চিমা শক্তিধর জাতি- ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, ডাচ, স্প্যানিশরা জল ও স্থলপথে যুদ্ধ করে, নিজেদের সুবিধানুযায়ী আইন তৈরি করে, অন্যের ভূমি দখল ও লুট করে গড়ে তোলে সাম্রাজ্যবাদ। বাংলার ভূ-খণ্ড যেমন আগ্রাসনের শিকার হয়েছে, তেমনি হয়েছে আফ্রিকার দেশগুলো, মধ্য আমেরিকার দেশ মেক্সিকো, আরো বিভিন্ন জাতি। ‘মনের পথে’র প্রথম রচনাটির শিরোনাম ‘বাংলা ভাষার চর্চা ও বঙ্গীয় সংস্কৃতির বিকাশ’ হলেও রয়েছে মেক্সিকোর মায়া সভ্যতার বিলুপ্তির কথা; যার প্রাথমিক বিলুপ্তি রহস্যময় হলেও স্পেনের শাসন আমলে তা স্থায়ীভাবে নিঃশেষ হয়।

মে দিবস নিয়ে একটি তথ্য সম্বলিত লেখা ‘মনের পথে’ বিদ্যমান। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর শ্রমিক আন্দোলন এবং তাদের প্রতি নির্যাতনের কথা সবারই জানা। আমরা আরো জানি দিনপ্রতি ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রম না দেয়া, আন্দোলন দানা বেঁধে বিপ্লবে পরিণত হওয়া, ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন গঠন, পুলিশের আক্রমণে হতাহতের খবর এবং একসময় বিপ্লবী শ্রমিকদের বিজয়। বিশ্বময় শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও প্রভাব এখনও চলমান। কিন্তু মে দিবসের সঙ্গে জড়িত খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ, আত্মত্যাগ, ইন্টেলেকচুয়াল সমাজের সম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক নীতি পরিবর্তনের কথাগুলো রচনাটিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিয়মান।

কাজী আজিজা ইদ্রিস (১৯২৬-২০১০) আমার দাদি, অর্থাৎ লেখকের মা। তার স্বামী কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস একজন আদর্শ সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি সততার জন্যে ১৮-১৯ বার চাকরি ছেড়েছেন। আর্থিক অভাব কখনোই তার প্রধানতম মানসিক কষ্টের কারণ হয় নি, এর অন্যতম কারণ নিঃসন্দেহে তার সহধর্মিণী কাজী আজিজা ইদ্রিস। দাদি দিনাজপুরের সচ্ছল মীর্জা পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা। বিয়ের আগে আর্থিক অভাব সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না। ছয় সন্তানের জননী; অভাব-অনটনের সংসার চালাতে তাকে যথেষ্ট বৈষয়িক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে কিন্তু হার মানেন নি, আপস করেননি, হাল ছাড়েননি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচয়ে নয়, আজিজা ইদ্রিস তার নিজের পরিচয়ে মহিমান্বিত। ১৯৫৭ সালে ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) গঠিত হলে তিনি ঢাকা মহানগর কমিটির নির্বাহী সদস্য হন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যুক্ত হন আন্দোলনে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’তে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭৪ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। এরপর আমৃত্যু তিনি গণতন্ত্রী পার্টি করেন এবং নারী স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্ভীকভাবে কাজ করে যান। গ্রন্থে ‘সেই যে আমার মা’ রচনায় সন্তানের দৃষ্টি থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসার কথা আবেগঘন ও যৌক্তিকভাবে বর্ণিত আছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্গজনক দিন। জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভাগ্যগুণে বেঁচে যান ইউরোপে থাকার কারণে। তাৎপর্যপূর্ণ এই বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রামাণ্যচিত্র “হাসিনা-এ ডটার’স টেল” নির্মাণ করেন পিপলু খান। চলচ্চিত্রটিতে উঠে আসে সেই সময় দুইবোনের দুঃসহ ও অনিশ্চিত জীবনযাপন, বেলজিয়ামে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাতারাতি বিরূপ আচরণ, পশ্চিম জার্মানির বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও পরবর্তী সময়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহান নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতার কথা। অপরদিকে বাংলাদেশের সামরিক সরকারের অমানবিক আচরণ ও অনাচার। তারা ব্যবস্থা করে যেন হাসিনা ও রেহানা দুই বোন কোনোভাবেই বাংলাদেশে ফিরতে না পারে। ইউরোপ ও ইন্দিরা গান্ধীর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে না থেকে, অন্য দেশে থাকলে বহু আগেই দুষ্কৃতকারীরা দুই বোনের জীবন নাশের প্রচেষ্টা চালাতো তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। প্রামাণ্যচিত্রে প্রধানত দৃষ্টিপাত দেয়া হয়েছে পঁচাত্তর থেকে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগে ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত দুই-বোনের জীবন সংগ্রাম। তবে সর্বাধিক মূল্যবান বিষয় ছিল বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার বোনের খণ্ড খণ্ড সাক্ষাৎকারগুলো। রূপকথার গল্পের মতো শত বাধা, ষড়যন্ত্র, এমনকি একাধিকবার মৃত্যুর হাতছানি থেকে ফিরে এসে একসময় দেশপ্রধান হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ব্যাপারটা এতই বড় যে এখানে ছবির ভাষা, শৈলী, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিক দিক নিয়ে কিছু লিখতে আমি ইচ্ছুক না। এই ছবির বিষয়ে আব্বার প্রবন্ধে বিস্তারিত ও নিরপেক্ষ মতামত বিদ্যমান।

প্রবাস জীবনে যাদের কর্ম, শিক্ষা বা অন্য কারণে দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছে, তাদের মধ্যে এক ধরণের হাহাকার কাজ করে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করেছি যে একসময় মাতৃভাষায় কথা বলতে না পারার কারণে দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে চায়! কবে ফিরে যাবো শত অভিযোগ, অভিমানে পরিপূর্ণ আমার বাংলাদেশে! এই বিস্বাদ অনুভব করতে ইতিহাসবেত্তা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু ইতিহাসই প্রতিষ্ঠা করেছে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা আর মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। অবিভক্ত ভারতে ১৯০৮ সালে কিশোর ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য। দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ -এ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ, যার সঙ্গে যুক্ত আছে নাম না জানা লাখ লাখ জনগণের দীর্ঘকালের আত্মত্যাগ ও নীরব অবদান। কিছু মনীষীর নাম আমরা জানি বটে যা পরিমাণের তুলনায় অপ্রতুল। লেখক সমস্ত বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক লেখা লিখেছেন তার গ্রন্থে, যেখানে স্থান পেয়েছে ৫২ সালের গণমানুষের গান থেকে প্রেরণা পাওয়া সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক, গায়ক অজিত রায়ের কথা। একই সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ রফিকের মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার বিষয়টি, লেখকের পিতা কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের ভাষা-আন্দোলনে ভূমিকা এবং মিল্লাত, ধূমকেতু ও দৈনিক সংবাদের মতো প্রগতিশীল পত্রিকায় আপসহীনভাবে কাজ করে যাওয়ার ছাপ।

১৯৭২ সালে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবী, বামপন্থি আদর্শের অনন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের জীবন ও কাজের কথা, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ডাক টিকিট নকশাকারী শিল্পী মো. ইদ্রিসের কর্ম ও লেখক পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি, অসাম্প্রদায়িক সংগীতশিল্পী জাহেদুর রহিমের (১৯৩৫-১৯৭৮) স্মৃতিচারণ, ফুপাতো বোন নারগিস আনাম ডজির (ডজিবু) প্রগতিশীল মানসিকতা ও নাট্যকর্মী হিসাবে পদচারণার প্রকাশ থেকে নানা বিষয়। ইতিহাসে বড় নেতা, মহান শিল্পী ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের কথা উল্লেখ থাকে, কিন্তু গোটা একটা জাতি যখন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তখন স্বল্প জনপ্রিয় ও নাম না জানা বহু মানুষের ভূমিকা থাকে নেপথ্যে। ‘মনের পথে’ বইয়ে এধরণের অনেক ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাবে যা লিপিবদ্ধ থেকে যাবে সারাজীবন।

আর ২-৩টা আর্টিকেল সম্পর্কে উল্লেখ করেই লেখাটি শেষ করবো। ফ্রান্সের সেই বিখ্যাত গির্জা নোৎরদাম নিয়ে আব্বার স্মৃতিচারণ। উনি প্রথম এই অপূর্ব স্থাপত্যের সামনে উপস্থিত হন ১৯৭৯ সালে। একজন প্রকৌশলী হিসেবে নয়, একজন পর্যটক হিসেবে তার মুগ্ধতা রয়ে যায় এবং এর কথা মনে পড়ে দীর্ঘ চার দশক পরে। ১৫ এপ্রিল ২০১৯ সালের সন্ধ্যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিধ্বস্ত হয় নোৎরদাম। বিশ্ববাসী দূর থেকে রেডিও, টিভি, ইন্টারনেট ও খবরের কাগজের মাধ্যমে এই দুর্ঘটনার সংবাদ পায়। আর যারা কাছে ছিলেন, তারা তো সরাসরি সেই দুঃসহ অগ্নিকাণ্ড দেখতে বাধ্য হয়েছেন। নোৎরদামের মধ্যে ছিল তিনটি মৌমাছির চাক। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে আগুন নেভার দিন তিনেক পর স্যাটেলাইটে দেখা যায় সেই মৌমাছিগুলো (আনুমানিক ২ লাখ) আবার ফিরে আসছে নোৎরদামে! সত্যিই প্রকৃতির সব আচরণ বোঝার চেষ্টা না করাই বোধহয় ভালো।

আমাদের এ অঞ্চলে অর্থাৎ উপমহাদেশে আদিবাসীদের সংখ্যা, সংস্কার ও সংস্কৃতি অত্যন্ত অর্থবহ। আদিবাসী বলতে চোখে ভাসে ছোট ছোট গোত্র পাহাড়ি অঞ্চলে বা জঙ্গলে স্বতন্ত্রভাবে জীবনযাপন করছে, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা এত ঠুনকো বৃত্তে সীমাবদ্ধ না। যুগে যুগে তারা বিদেশি পরাশক্তিদের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে প্রাণ দিয়েছেন নিজেদের মাটিকে রক্ষা করার জন্য। সিডো ও কানহু ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের বিরূদ্ধে বিদ্রোহের যে ডাক দেন তাতে ১০ হাজার সাঁওতাল অংগ্রহণ করেছিলেন। এতে মৃত্যুবরণ করেন অধিকাংশ বিদ্রোহী। পৃথক সময়ে সিডো ও কানহু দুজনই ধরা পড়েন এবং ব্রিটিশ সরকার তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়। তবে বিদ্রোহ থেমে থাকেনি। প্রায় ৪০ বছর পর বড় আকারে বিপ্লব ঘটান বিরসা মুন্ডা। তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। ইংরেজরা তাকে অমানুষিক অত্যাচার করে হত্যা করে। উপমহাদেশের পাহাড় ও জঙ্গল এলাকার অধিকাংশ ভূমির প্রকৃত মালিক আদিবাসীগণ। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তারা নিজেদের নির্মল-নিরীহ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।

‘মনের পথে’ গ্রন্থে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে যেগুলো পাঠকের নিজেদের পড়ে অনুভব করতে হবে। খাপরা ওয়ার্ডে পাকিস্তানি পাষণ্ড শাসকদের অত্যাচার, মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে লেখকের কথা বা তার বাবা কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের প্রতি নিজস্ব ভক্তি ও ভালোবাসার গভীরতা বিষয়গুলো নিয়ে আলাদা করে কিছু লেখার চেষ্টা করাটা ঠিক হবে না। কিছু কিছু অনুভূতি থাকে যার সম্পর্কে অল্প জেনে মন্তব্য করা ঠিক না। মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে, তবে এতটুকু বলা যায় যে রচনাগুলোতে সুপ্তভাবে রয়েছে মানুষের কল্যাণের দিক-নির্দেশনা। বইটি পাঠকের মনে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার পথ খুলে দিবে নিঃসন্দেহে। মনের ভাষা এত সহজ, সুন্দর ও সাবলীলভাবে প্রকাশের জন্য আমার আব্বা কাজী মোহাম্মদ শীশকে অজস্র ধন্যবাদ।