মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৯ ফেব্রুয়ারি

আইনগত উপদেশের ছদ্মাবরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে

জাতিসংঘের একটা মহল বাংলাদেশ’ নাম ব্যবহার না করে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকারের চেষ্টা চালাচ্ছে। জাতিসংঘ এখনো বাংলাদেশকে ‘ঢাকা এলাকা’ বলে অভিহিত করেন, আর এ থেকেই উক্ত মহলের দূরবিসদ্ধি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তা পরিষদের ৩টি স্থায়ী সদস্যসহ ৪০টিরও অধিক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও জাতিসংঘ এখনো এ ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে। রিলিফ কার্যপরিচালোনায় জাতিসংঘের নিযুক্ত বিশেষ প্রতিনিধি মি. পল মার্ক হেনরী শুক্রবার জাতিসংঘে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের নীতি ব্যাখ্যা করেন বলে পি টি আই-এর এক খবরে প্রকাশ। জাতিসংঘ মহল থেকে বলা হয় যে, আইনগত উপদেশ হলেও যতদিন বাংলাদেশ জাতিসংঘের অথবা জাতিসংঘের কোনো কমিটিতে সদস্য না হবে ততদিন এটাকে বাংলাদেশ বলা যেতে পারে না। এ ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামত কি জিজ্ঞাসা করা হলে পল মার্ক হেনরী বলেন, রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সেখানকার সরকার সবকিছু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং দ্রুত সমস্যাগুলো মোকাবিলায় এগিয়ে যাচ্ছেন। এটা একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার, আর এতে বোঝা যায় যে তাদের লোকজন রয়েছে তারা প্রথম শ্রেণীর গুণ সম্পন্ন।

উত্তরবঙ্গের সমস্যা যথাসময়ে বিবেচিত হবে

পূর্ত ও গৃহনির্মাণ দফতরের মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান গত শুক্রবার এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছেন যে, উত্তর বঙ্গের সমস্যাগুলি সম্পর্কে সঠিক সময়ে বিবেচ্য করে দেখা হবে। তিনি তার বাসভবনে আয়োজিত এক চা চক্রে ঢাকায় বসবাসকারী রংপুরের অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে বলেন যে, বর্তমান সরকার সল্প সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত আগ্রহী। মন্ত্রী বলেন যে জনগণের সরকার দ্বারা কোনো সমাধান করা অসুবিধা নয়। তিনি বলেন যে, জনগণের প্রতিনিধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদেরও সমানভাবে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। মন্ত্রী আরো বলেন যে, দেশের নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে জনগণের ঐক্যের প্রয়োজন রয়েছে। অনুষ্ঠানের পূর্বাহ্নে বক্তৃতা করেন গণপরিষদ সদস্য জনাব আবেদ আলী, জনাব তোফায়েল হোসেন, জনাব এ. আলম, জনাব শামসুল হুদা এবং জনাব রকিবুর রহমান। জনাব আবদুর রউফকে আহ্বায়ক করে রংপুর জেলা সমিতি গঠনের জন্যে অনুষ্ঠানে কুড়ি সদস্যের একটি অস্থায়ী পরিষদ গঠন করা হয়।

২০ ফেব্রুয়ারি

কৃষি বিপ্লবের জন্য কাজ করুন- বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্যে চাষিদের প্রতি কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি রামগতিতে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, বাংলাদেশে এক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। বঙ্গবন্ধু দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্যে স্বাবলম্বন এবং আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে বাধ পুনর্নির্মাণের জন্য যারা ঝুড়ি ও কোদাল নিয়ে বাঁধ এলাকায় উপস্থিত হন। শেখ মুজিব তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন যে, জাতির অর্থকোষ এখন শূন্য। কারণ হানাদাররা কেবল লোকজনকেই হত্যা করেন নি তারা নির্বিচারে এদেশের ধনসম্পদ ধংস এবং লুট করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, বিশ্বে কোন জাতিই স্বাধীনতার মূল্য হিসেবে এতো রক্ত দেয়নি। কঠিন সংগ্রামলব্ধ স্বাধীনতাকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, ব্রিটিশরা ২০০ বছর শোষণ চালিয়েও জাতিকে যত ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি পাকিস্তানিরা ২২ বছরে তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

সাড়ে সাত কোটি মানুষ আছে : শেখ মুজিব বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের সবকিছু ধ্বংস করে গেছে এবং যা ধ্বংস করতে পারেনি তারা তা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। কিন্তু প্রগতিশীল জাতি হিসেবে দেশকে গড়ে তোলার জন্য আমার এখানে ইস্পাতদৃঢ় সংকল্পের অধিকারী সাড়ে সাত কোটি মানুষ আছে। সংগ্রাম এখনও অব্যাহত রয়েছে মনে করে বঙ্গবন্ধু জাতির পুনর্গঠনের জন্যে জনসাধারণকে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, দেশ সকলের কাছ থেকে সাহায্যকে অভিনন্দন জানান; কিন্তু তা শর্তহীন হতে হবে। তিনি বলেন, আমরা স্বাধীনতার বিনিময়ে সাহায্যের জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বাইরে যেতে পারি না। কাজেই জনসাধারণকে অবশ্যই শুধু কাজ আর কাজ করে যেতে হবে।

সরকার জনগণের : তিনি বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের সরকার। আমাদের এখন সমাজ কায়েম করতে হবে যেখানে ক্ষুধার্ত মানুষ চাষি এবং শ্রমিক পুনরায় হাসবে। সাধারণ মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারলে স্বাধীনতাই বৃথা যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

দুষ্কৃতকারীদের প্রতি হুঁশিয়ারি : বঙ্গবন্ধু দুষ্কৃতকারীদের প্রতি

সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। তিনি বলেন যে, যারা স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করেছে, তারা তার আহ্বানে অস্ত্র হস্তান্তর করেছে। কিন্তু কতিপয় দুষ্কৃতকারী পাকিস্তানিবাহিনীর চররা এখনও ধরে আছে। তিনি এসব অস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী অর্থ আত্মসাৎ এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে অফিসারদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তিনি এ ব্যপারে জনসাধারণকে প্রহরীর মতো কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তিনি বেঁচে থাকুন আর নাই বা থাকুন এদেশে আর কখনও শোষক এবং মোটা ভুড়িওয়ালাদের স্থান হবে না।

২১ ফেব্রুয়ারি

একুশে উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির বাণী

রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী সন্ধ্যায় শহীদ দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে বলেন যে, ভাষা আন্দোলনে শহীদদের আত্মদান বর্তমান ও ভাবীকালের বংশধরদের জন্য চির অনির্বান দ্বীপশিখা হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, এই অমর শিখা সবসময় জাতিকে অত্যাচারীর চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার এবং সত্য ও ন্যায় এর পতাকা সমুন্নত রাখার পথ দেখাবে রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সবাইকে সাড়া দিয়ে দেশের গঠনমূলক কাজে যোগদানের জন্য আবেদন জানান। তিনি বলেন, শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণের জন্য একমাত্র কাজের মাধ্যমেই আমরা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারে।

মুক্ত বাংলার প্রথম একুশের পথ নির্দেশ

মুক্ত বাংলার প্রথম একুশে জাতির সম্মুখে রেখে গেল এক নতুন পথ নির্দেশ-শশাষণ থাকলে স্বাধীনতাই মিথ্যে। পুষ্পশোভিত শহীদমিনারে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “স্বাধীন বাংলাদেশে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে না পারলে এতো মানুষের আত্মত্যাগ অর্থহীন হয়ে পড়বে।” এ কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে পল্টন ছাত্রলীগের জনসভায়, “শোষণের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অব্যহত থাকবে।” মিনারে-মাজারে-সভায়-বৈঠকে উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে হলে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অত্যাবশ্যক। আর সে মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবেই। গত সোমবার ছিল এ সূর্য্য শপথের মহালয়। কিন্তু একটি দিনের গণ্ডিতে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি। মঙ্গলবারেও তা অব্যাহত থেকে অমর একুশের শেষ বাণীটি শুনিয়ে গেছে- সমাজতান্ত্রিক উত্তোলনে বাংলাকে কেউ রুখতে পারবে না। সিগ্ধ শ্রী বাংলায় এবার একুশে এসেছে এক নতুন তাৎপর্য; অনেক না বলা কথার সোচ্চার অভিব্যক্তি হয়ে এবার একুশে এসেছে এক নদী রক্ত পেরিয়ে। এবারের একুশের এ অন্যান্যতা ফুট উঠেছে এর ব্যাপকতায়, বৈচিত্র্যে, আর বলিষ্ঠতায়। আগের মতো এবারও শহীদ মিনারে শপথের হাত উঠেছিল। তবে সে হাতে কেবল কোমল ফুলের সৌরভ ছিল না- ছিল বারুদের তপ্ত গন্ধও এবারেও বেদীতে গান হয়েছিল তবে কেবল কান্না নয়-সে গানে বিজয়ের উল্লাসও ছিল, প্রতিজ্ঞার সুকঠিন দৃঢ়তাও ছিল। এ প্রতিজ্ঞা আর দৃঢ়তা নতুনতর সৃষ্টির উল্লাসেও হয়েছে অভিব্যক্ত। শহীদ দিবস যেন দিন নয়-একটি সৃষ্টি সুখের মত্ততা। রাজপথ-গলিপথ সব খানেই এ নতুনের আমন্ত্রণ। অগমন, সঙ্কলন ও স্মারক এ ঘোষণায় জারি করেছে দিনমান। এক নয় দুই নয় শতে শতে সাহিত্য সঙ্কলন প্রকাশ পেয়েছে এদিন। কলমের পাশাপাশি তুলিও নীরব থাকেনি। বেদীর চারপাশ থেকে শুরু করে বড় বড় রাজপথ সবখানেই শিল্পী বিদ্রোহী বাংলাকে ভাস্কর করে রাখতে চেয়েছেন। সে ছবি তো কেবল শহীদ দিবসের নয়-কেবল বাংলাদেশের নয়। তাইতো ওপার বাংলার সুধীজন এসেছেন এপার বাংলাকে প্রত্যক্ষ করতে; মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এপার বাংলা ওপার বাংলা শহীদ বেদীতে এসে এক হয়ে গেছে; পঁচিশ বছরের লালিত ষড়যন্ত্রের সমাধী করে দিয়েছে এই শহীদ দিবস।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৮ ফল্গুন ১৪২৬, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪১

মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

image

১৯ ফেব্রুয়ারি

আইনগত উপদেশের ছদ্মাবরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে

জাতিসংঘের একটা মহল বাংলাদেশ’ নাম ব্যবহার না করে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকারের চেষ্টা চালাচ্ছে। জাতিসংঘ এখনো বাংলাদেশকে ‘ঢাকা এলাকা’ বলে অভিহিত করেন, আর এ থেকেই উক্ত মহলের দূরবিসদ্ধি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তা পরিষদের ৩টি স্থায়ী সদস্যসহ ৪০টিরও অধিক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও জাতিসংঘ এখনো এ ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে। রিলিফ কার্যপরিচালোনায় জাতিসংঘের নিযুক্ত বিশেষ প্রতিনিধি মি. পল মার্ক হেনরী শুক্রবার জাতিসংঘে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের নীতি ব্যাখ্যা করেন বলে পি টি আই-এর এক খবরে প্রকাশ। জাতিসংঘ মহল থেকে বলা হয় যে, আইনগত উপদেশ হলেও যতদিন বাংলাদেশ জাতিসংঘের অথবা জাতিসংঘের কোনো কমিটিতে সদস্য না হবে ততদিন এটাকে বাংলাদেশ বলা যেতে পারে না। এ ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামত কি জিজ্ঞাসা করা হলে পল মার্ক হেনরী বলেন, রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সেখানকার সরকার সবকিছু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং দ্রুত সমস্যাগুলো মোকাবিলায় এগিয়ে যাচ্ছেন। এটা একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার, আর এতে বোঝা যায় যে তাদের লোকজন রয়েছে তারা প্রথম শ্রেণীর গুণ সম্পন্ন।

উত্তরবঙ্গের সমস্যা যথাসময়ে বিবেচিত হবে

পূর্ত ও গৃহনির্মাণ দফতরের মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান গত শুক্রবার এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছেন যে, উত্তর বঙ্গের সমস্যাগুলি সম্পর্কে সঠিক সময়ে বিবেচ্য করে দেখা হবে। তিনি তার বাসভবনে আয়োজিত এক চা চক্রে ঢাকায় বসবাসকারী রংপুরের অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে বলেন যে, বর্তমান সরকার সল্প সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত আগ্রহী। মন্ত্রী বলেন যে জনগণের সরকার দ্বারা কোনো সমাধান করা অসুবিধা নয়। তিনি বলেন যে, জনগণের প্রতিনিধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদেরও সমানভাবে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। মন্ত্রী আরো বলেন যে, দেশের নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে জনগণের ঐক্যের প্রয়োজন রয়েছে। অনুষ্ঠানের পূর্বাহ্নে বক্তৃতা করেন গণপরিষদ সদস্য জনাব আবেদ আলী, জনাব তোফায়েল হোসেন, জনাব এ. আলম, জনাব শামসুল হুদা এবং জনাব রকিবুর রহমান। জনাব আবদুর রউফকে আহ্বায়ক করে রংপুর জেলা সমিতি গঠনের জন্যে অনুষ্ঠানে কুড়ি সদস্যের একটি অস্থায়ী পরিষদ গঠন করা হয়।

২০ ফেব্রুয়ারি

কৃষি বিপ্লবের জন্য কাজ করুন- বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্যে চাষিদের প্রতি কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি রামগতিতে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, বাংলাদেশে এক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। বঙ্গবন্ধু দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্যে স্বাবলম্বন এবং আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে বাধ পুনর্নির্মাণের জন্য যারা ঝুড়ি ও কোদাল নিয়ে বাঁধ এলাকায় উপস্থিত হন। শেখ মুজিব তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন যে, জাতির অর্থকোষ এখন শূন্য। কারণ হানাদাররা কেবল লোকজনকেই হত্যা করেন নি তারা নির্বিচারে এদেশের ধনসম্পদ ধংস এবং লুট করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, বিশ্বে কোন জাতিই স্বাধীনতার মূল্য হিসেবে এতো রক্ত দেয়নি। কঠিন সংগ্রামলব্ধ স্বাধীনতাকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, ব্রিটিশরা ২০০ বছর শোষণ চালিয়েও জাতিকে যত ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি পাকিস্তানিরা ২২ বছরে তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

সাড়ে সাত কোটি মানুষ আছে : শেখ মুজিব বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের সবকিছু ধ্বংস করে গেছে এবং যা ধ্বংস করতে পারেনি তারা তা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। কিন্তু প্রগতিশীল জাতি হিসেবে দেশকে গড়ে তোলার জন্য আমার এখানে ইস্পাতদৃঢ় সংকল্পের অধিকারী সাড়ে সাত কোটি মানুষ আছে। সংগ্রাম এখনও অব্যাহত রয়েছে মনে করে বঙ্গবন্ধু জাতির পুনর্গঠনের জন্যে জনসাধারণকে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, দেশ সকলের কাছ থেকে সাহায্যকে অভিনন্দন জানান; কিন্তু তা শর্তহীন হতে হবে। তিনি বলেন, আমরা স্বাধীনতার বিনিময়ে সাহায্যের জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বাইরে যেতে পারি না। কাজেই জনসাধারণকে অবশ্যই শুধু কাজ আর কাজ করে যেতে হবে।

সরকার জনগণের : তিনি বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের সরকার। আমাদের এখন সমাজ কায়েম করতে হবে যেখানে ক্ষুধার্ত মানুষ চাষি এবং শ্রমিক পুনরায় হাসবে। সাধারণ মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারলে স্বাধীনতাই বৃথা যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

দুষ্কৃতকারীদের প্রতি হুঁশিয়ারি : বঙ্গবন্ধু দুষ্কৃতকারীদের প্রতি

সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। তিনি বলেন যে, যারা স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করেছে, তারা তার আহ্বানে অস্ত্র হস্তান্তর করেছে। কিন্তু কতিপয় দুষ্কৃতকারী পাকিস্তানিবাহিনীর চররা এখনও ধরে আছে। তিনি এসব অস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী অর্থ আত্মসাৎ এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে অফিসারদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তিনি এ ব্যপারে জনসাধারণকে প্রহরীর মতো কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তিনি বেঁচে থাকুন আর নাই বা থাকুন এদেশে আর কখনও শোষক এবং মোটা ভুড়িওয়ালাদের স্থান হবে না।

২১ ফেব্রুয়ারি

একুশে উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির বাণী

রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী সন্ধ্যায় শহীদ দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে বলেন যে, ভাষা আন্দোলনে শহীদদের আত্মদান বর্তমান ও ভাবীকালের বংশধরদের জন্য চির অনির্বান দ্বীপশিখা হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, এই অমর শিখা সবসময় জাতিকে অত্যাচারীর চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার এবং সত্য ও ন্যায় এর পতাকা সমুন্নত রাখার পথ দেখাবে রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সবাইকে সাড়া দিয়ে দেশের গঠনমূলক কাজে যোগদানের জন্য আবেদন জানান। তিনি বলেন, শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণের জন্য একমাত্র কাজের মাধ্যমেই আমরা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারে।

মুক্ত বাংলার প্রথম একুশের পথ নির্দেশ

মুক্ত বাংলার প্রথম একুশে জাতির সম্মুখে রেখে গেল এক নতুন পথ নির্দেশ-শশাষণ থাকলে স্বাধীনতাই মিথ্যে। পুষ্পশোভিত শহীদমিনারে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “স্বাধীন বাংলাদেশে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে না পারলে এতো মানুষের আত্মত্যাগ অর্থহীন হয়ে পড়বে।” এ কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে পল্টন ছাত্রলীগের জনসভায়, “শোষণের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অব্যহত থাকবে।” মিনারে-মাজারে-সভায়-বৈঠকে উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে হলে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অত্যাবশ্যক। আর সে মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবেই। গত সোমবার ছিল এ সূর্য্য শপথের মহালয়। কিন্তু একটি দিনের গণ্ডিতে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি। মঙ্গলবারেও তা অব্যাহত থেকে অমর একুশের শেষ বাণীটি শুনিয়ে গেছে- সমাজতান্ত্রিক উত্তোলনে বাংলাকে কেউ রুখতে পারবে না। সিগ্ধ শ্রী বাংলায় এবার একুশে এসেছে এক নতুন তাৎপর্য; অনেক না বলা কথার সোচ্চার অভিব্যক্তি হয়ে এবার একুশে এসেছে এক নদী রক্ত পেরিয়ে। এবারের একুশের এ অন্যান্যতা ফুট উঠেছে এর ব্যাপকতায়, বৈচিত্র্যে, আর বলিষ্ঠতায়। আগের মতো এবারও শহীদ মিনারে শপথের হাত উঠেছিল। তবে সে হাতে কেবল কোমল ফুলের সৌরভ ছিল না- ছিল বারুদের তপ্ত গন্ধও এবারেও বেদীতে গান হয়েছিল তবে কেবল কান্না নয়-সে গানে বিজয়ের উল্লাসও ছিল, প্রতিজ্ঞার সুকঠিন দৃঢ়তাও ছিল। এ প্রতিজ্ঞা আর দৃঢ়তা নতুনতর সৃষ্টির উল্লাসেও হয়েছে অভিব্যক্ত। শহীদ দিবস যেন দিন নয়-একটি সৃষ্টি সুখের মত্ততা। রাজপথ-গলিপথ সব খানেই এ নতুনের আমন্ত্রণ। অগমন, সঙ্কলন ও স্মারক এ ঘোষণায় জারি করেছে দিনমান। এক নয় দুই নয় শতে শতে সাহিত্য সঙ্কলন প্রকাশ পেয়েছে এদিন। কলমের পাশাপাশি তুলিও নীরব থাকেনি। বেদীর চারপাশ থেকে শুরু করে বড় বড় রাজপথ সবখানেই শিল্পী বিদ্রোহী বাংলাকে ভাস্কর করে রাখতে চেয়েছেন। সে ছবি তো কেবল শহীদ দিবসের নয়-কেবল বাংলাদেশের নয়। তাইতো ওপার বাংলার সুধীজন এসেছেন এপার বাংলাকে প্রত্যক্ষ করতে; মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এপার বাংলা ওপার বাংলা শহীদ বেদীতে এসে এক হয়ে গেছে; পঁচিশ বছরের লালিত ষড়যন্ত্রের সমাধী করে দিয়েছে এই শহীদ দিবস।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২