করোনা মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব

ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ

উপসর্গটি চীনে দেখা দিলেও এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মরণঘাতী ভাইরাস করোনা (কোভিড-১৯)। দিনকে দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে। চীন করোনার ধাক্কা সামলে উঠলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেনের অবস্থা এখন ভয়াবহ। মৃতের মিছিল প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হওয়া এ ভাইরাস থাবা বসিয়েছে বাংলাদেশেও। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দেশে তিনজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। আর আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন পাঁচজন। তবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ রোগের লক্ষণগুলো বহন করে দু-একজন মারা গেছেন বলেও খবর এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষও চরম ঝুঁকিতে। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার।

এ অবস্থায় জরুরি প্রয়োজন বিশেষ করে ওষুধ, খাদ্যপণ্য কেনা বাদে ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গত ১৬ মার্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া আসন্ন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও অনেক প্রতিষ্ঠানে বাসা থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন কর্মীরা।

নিজের, পরিবার এবং সমাজের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে স্বেচ্ছায় গৃহে অবস্থান বা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে দেশজুড়ে অনেক মানুষকে। তবে এই নির্দেশ মানছেন না অনেক মানুষ। যা এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কখনই কাম্য নয়।

পত্রিকার খবর, বিদেশ ফেরত অনেক প্রবাসী রয়েছেন; যারা হোম কোয়ারেন্টিন না মেনে বাজারে ঘুরছেন, মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশছেন। এ অবস্থায় কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, ভোলা, চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, ঝালকাঠি, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, জামালপুর, ময়মনসিংহে গত ১৮ ও ১৯ মার্চ ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ না মানায় বিদেশ ফেরত ১৭ প্রবাসীকে জরিমানা করা হয়েছে। এরপরও থেমে নেই, অনেকে প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টিন থেকেও পালিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে।

এমন একটা পরিস্থিতিতে আমাদের সবার উচিত, কোনোভাবে আতঙ্কিত না হয়ে বরং নিজে সতর্ক হতে হবে, পরিবারকে সচেতন করতে হবে, সচেতন করতে হবে প্রতিবেশীকে। আর কোন গুজবে কিংবা ভুল তথ্যে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক তথ্যটি জানতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও করোনা মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

এ মহামারী রোধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও সাধ্য অনুযায়ী মানবসেবার উদ্দেশ্যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

করোনার উৎপত্তি মূলত চীনের উহান শহরে। গতবছরের ৩১ ডিসেম্বর একটি অচেনা রোগের কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএইচও) জানায় চীন। এরই মাঝে ৯০ দিনেরও কম সময়ে ১৮৭টি দেশকে আক্রান্ত করে ফেলেছে এই ভাইরাস। বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা সোয়া ৩ লাখের বেশি। এর মাঝে মৃত্যু হয়েছে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। (সূত্র : জনস হফকিন্স ইউনিভার্সিটি; ২৩ মার্চ ২০২০)

এ অবস্থায় কয়েকটি দেশে জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করা হয়েছে। দেশে দেশে সব কিছু অচল করে ঘরের ভেতর দিনরাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। তবুও রেহাই মিলছে না।

দেশে দেশে সরকার করোনা মোকাবিলার জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দিচ্ছে। বাংলাদেশেও স্বাস্থ্যখাতে প্রাথমিকভাবে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার।

এছাড়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক ফান্ডেও অর্থ দিচ্ছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। বাংলাদেশ দিচ্ছে ১৫ লাখ ডলার।

দেশের অর্থনীতির সব খাতেই এই ভাইরাসের প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করেছে গবেষণা সংস্থা সিপিডি। এ অবস্থায় দিন যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই আসছে মন খারাপ করা খবর। ইউরোপ থেকে এশিয়া, কিংবা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা-সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে করোনা। অতীতে কোনো বিশ্বযুদ্ধও সাধারণ মানুষকে এত উদ্বিগ্ন বা ভাবিয়ে তুলেছে কি না সন্দেহ রয়েছে! অথচ তিন মাসেরও কম সময়ে দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বিস্তার করে মানুষকে কাবু করে ফেলেছে করোনা।

এশিয়ার অন্যান্য দেশে আগেই হানা দিয়েছে। অন্যান্য দেশে তীব্রতা এখন না থাকলেও বাংলাদেশ-ভারতে বিস্তৃত হচ্ছে চলতি মাসের শুরু থেকে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে শরীয়তপুরের শিবচরে ‘লকডাউন’ করা হয়েছে।

আর ২২ মার্চ পুরো ভারতে ছিল জনতার কারফিউ। বিভিন্ন জেলায়ও লকডাউন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আহ্বানে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী থেকে এ কারফিউ পালন করেন ভারতবাসী।

এ অবস্থায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করেন। আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন।

জনসমাগম এড়িয়ে চলতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পাশাপাশি স্থগিত করে দেয়া হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। বাতিল করা হয়েছে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানমালা; স্থগিত হয়েছে স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠান।

সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ গণজমায়েত ঘটে এমন কর্মসূচিতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে কোন কোন এলাকায় বেশ সমারোহে বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে বলেও গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপত্তা ও বৃহত্তর স্বার্থে তা বাতিল করা একান্তই উচিত।

করোনা পরিস্থিতিকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন- এটা খুবই ঘৃণ্য কাজ। এ অবস্থায় মুনাফা অর্জন কিংবা যাচ্ছেতাইভাবে চলাফেরা করে পরিবার, স্বজন কিংবা আশপাশের মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলা ঠিক হবে না। কারণ চীনে উৎপত্তিস্থল উহানে অল্প সময়ে এই রোগের গতিরোধ করায় যে সাফল্য পাওয়া গেছে তা উচ্চমাত্রায় আক্রান্ত ইতালি ও স্পেন কিংবা ইরানে দেখা যাচ্ছে না।

এভাবে চলতে থাকলে তা মানবসভ্যতার এক নতুন ট্র্যাজেডি রচিত হতে পারে। কেননা রোগ বিস্তার স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি ব্যাপক সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটও ক্রমে ঘনীভূত হবে। রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সংক্রমণ রোধই সব ধরনের সংকট মোচনের প্রধান উপায়।

এই সত্য থেকে বিচ্যুত হলে খাদের কিনারা থেকে গর্তে পড়ে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এ রোগের লক্ষণ যেহেতু অনেকটা সর্দি-কাশির মতো। তাই এ ধরনের লক্ষণ যাদের মধ্যে রয়েছে তাদের সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকতে হবে।

কোভিড-১৯ স্বভাবগতভাবেই অতিশয় সংক্রমণশীল এবং এর ঝুঁকিতে থাকা সর্বসাধারণের কোন প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা নেই। ফলে কেউ-ই যে সংক্রমণের ঝুঁকির বাইরে নেই, তা সবার মনে রাখতে হবে।

বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি দেখে অনেক দেশ নিজেদের সুরক্ষিত করেছে। এর মাঝে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার নাম আসতে পারে।

এসব দেশের কৌশল ছিল একটাই। তা হচ্ছে- যে যখনই আক্রান্ত হচ্ছে তাকে চিহ্নিত করা। কোয়ারেন্টিনে কিংবা আলাদা জায়গায় রাখো। তাহলে সংক্রমণ থেকে অন্যরা রেহাই পাবে। সংক্রমণ থামাতে পারলেই রোগের বিস্তার হতে পারবে না। হয়েছেও তাই!

বিভিন্ন তথ্য অনুসারে, করোনার বিস্তার সারণিতে একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে- ধরা যাক, একজন আক্রান্ত যদি প্রতি ৫ দিনে ২.৫ জনকে আক্রান্ত করে তাহলে ৩০ দিনে সে একাই ৪০৬ জনকে আক্রান্ত করবে। এভাবে চলতে থাকলে ভাবুন তো কোন পর্যায়ে দাঁড়াবে অবস্থা!

এ বিষয়টা বুঝতে পেরেই এশিয়ার ওইসব দেশ তাদের সব শক্তি দিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত করতে পেরেছে। আর যারা করতে পারছে না বা পারেনি- তাদের অবস্থা তো দেখাই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথমে আসবে ইতালির নাম।

২২ মার্চে দেশটিতে ৬০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মাঝে বাংলাদেশিও রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন কিংবা ইরানের নামও আসতে পারে।

এ অবস্থায় আমাদের উচিত হবে, সবার আগে নিজেদের সুরক্ষা করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এরই মধ্যে প্লেন যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।

দু-একটি দেশের সঙ্গে এখনও ফ্লাইট চালু রয়েছে। এসব ফ্লাইটে প্রতিনিয়তই আসছেন প্রবাসীরা। তাদের অনেকেই আক্রান্ত দেশ কিংবা ওইসব দেশের নাগরিকদের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন- এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। তাই এসব ফ্লাইটও এখন বন্ধ করে দেয়া উচিত। সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি হলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্ত করে তা করতেই হবে। আর যারা বিদেশ ফেরত আছেন- তারা ফেরার পর স্বউদ্যোগেই নিজেকে গৃহবন্দী করুন।

মনে রাখতে হবে, কোন সংকটই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই এই সংকটে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হবেন না। সবাই নিরাপদে থাকুন, সুস্থ থাকুন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। আর দেরি নয়, এখনই সময় নিজেকে করোনা থেকে আড়াল করার। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যলয় যেহেতু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেহেতু আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের উচিত হবে, মানুষকে সচেতন করা।

যাতে সাধারণ মানুষ যেন কোন ভুল কিংবা অর্ধসত্য বার্তা পেয়ে আতঙ্কিত না হয়ে পড়েন। সঠিক তথ্য পরিবেশন করে তাদের নিরাপদে রাখতে হবে। আর এ কাজটা শুধু তরুণেরাই সুচারুরূপে করতে পারে। পাশাপাশি ডব্লিউএইচও ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেও মানুষকে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে নিজ নিজ জায়গা থেকে। তবে সবার আগে নিজের সুরক্ষা।

দেশজুড়ে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক-নার্সদেরও পিপিই সরবরাহ করতে হবে। কেননা বাংলাদেশে আক্রান্তদের মধ্যে একজন চিকিৎসক ও দু’জন নার্সও রয়েছেন।

দেশজুড়ে করোনা কিট সরবরাহ করতে হবে। বলা হচ্ছে- পিপিই ও কিট রয়েছে পর্যাপ্ত। তাই যত দ্রুত সম্ভব তা সরবরাহ করতে হবে। কেননা যে দেশে করোনা ঢুকছে একেবারে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, আমরা অবশ্যই চাইব আমাদের দেশে সেভাবে দেখা না দিক। তাই সবার আগে সচেতন হই।

‘হোম কোয়ারেন্টিন’ মেনে চলতে হবে। নয়তো ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যাবে। তখন শত প্রস্তুতি নিয়েও মোকাবিলা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে বিদেশ প্রত্যাগত হাজার হাজার মানুষ দেশে ফিরে জনজীবনে মিশে গেছেন। তাই চোর পালানোর পর গৃহস্থের হুঁশ ফিরে এলে কোন লাভ হবে না। যথাসময়েই সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা জরুরি। আসুন, এ পরিস্থিতিতে আমরা নিজেরা নিরাপদ থাকি, অন্যদেরও সুরক্ষিত রাখি।

[লেখক : ভিসি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জামালপুর]

শনিবার, ২৮ মার্চ ২০২০ , ১৪ চৈত্র ১৪২৬, ২৮ রজব সানি ১৪৪১

করোনা মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব

ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ

উপসর্গটি চীনে দেখা দিলেও এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মরণঘাতী ভাইরাস করোনা (কোভিড-১৯)। দিনকে দিন অবস্থার অবনতি হচ্ছে। চীন করোনার ধাক্কা সামলে উঠলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেনের অবস্থা এখন ভয়াবহ। মৃতের মিছিল প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হওয়া এ ভাইরাস থাবা বসিয়েছে বাংলাদেশেও। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দেশে তিনজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। আর আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন পাঁচজন। তবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ রোগের লক্ষণগুলো বহন করে দু-একজন মারা গেছেন বলেও খবর এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষও চরম ঝুঁকিতে। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার।

এ অবস্থায় জরুরি প্রয়োজন বিশেষ করে ওষুধ, খাদ্যপণ্য কেনা বাদে ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গত ১৬ মার্চ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া আসন্ন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও অনেক প্রতিষ্ঠানে বাসা থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন কর্মীরা।

নিজের, পরিবার এবং সমাজের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে স্বেচ্ছায় গৃহে অবস্থান বা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে দেশজুড়ে অনেক মানুষকে। তবে এই নির্দেশ মানছেন না অনেক মানুষ। যা এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কখনই কাম্য নয়।

পত্রিকার খবর, বিদেশ ফেরত অনেক প্রবাসী রয়েছেন; যারা হোম কোয়ারেন্টিন না মেনে বাজারে ঘুরছেন, মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশছেন। এ অবস্থায় কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, ভোলা, চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, ঝালকাঠি, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, জামালপুর, ময়মনসিংহে গত ১৮ ও ১৯ মার্চ ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ না মানায় বিদেশ ফেরত ১৭ প্রবাসীকে জরিমানা করা হয়েছে। এরপরও থেমে নেই, অনেকে প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টিন থেকেও পালিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে।

এমন একটা পরিস্থিতিতে আমাদের সবার উচিত, কোনোভাবে আতঙ্কিত না হয়ে বরং নিজে সতর্ক হতে হবে, পরিবারকে সচেতন করতে হবে, সচেতন করতে হবে প্রতিবেশীকে। আর কোন গুজবে কিংবা ভুল তথ্যে আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক তথ্যটি জানতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও করোনা মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

এ মহামারী রোধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও সাধ্য অনুযায়ী মানবসেবার উদ্দেশ্যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

করোনার উৎপত্তি মূলত চীনের উহান শহরে। গতবছরের ৩১ ডিসেম্বর একটি অচেনা রোগের কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএইচও) জানায় চীন। এরই মাঝে ৯০ দিনেরও কম সময়ে ১৮৭টি দেশকে আক্রান্ত করে ফেলেছে এই ভাইরাস। বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা সোয়া ৩ লাখের বেশি। এর মাঝে মৃত্যু হয়েছে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। (সূত্র : জনস হফকিন্স ইউনিভার্সিটি; ২৩ মার্চ ২০২০)

এ অবস্থায় কয়েকটি দেশে জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করা হয়েছে। দেশে দেশে সব কিছু অচল করে ঘরের ভেতর দিনরাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। তবুও রেহাই মিলছে না।

দেশে দেশে সরকার করোনা মোকাবিলার জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দিচ্ছে। বাংলাদেশেও স্বাস্থ্যখাতে প্রাথমিকভাবে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার।

এছাড়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক ফান্ডেও অর্থ দিচ্ছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। বাংলাদেশ দিচ্ছে ১৫ লাখ ডলার।

দেশের অর্থনীতির সব খাতেই এই ভাইরাসের প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করেছে গবেষণা সংস্থা সিপিডি। এ অবস্থায় দিন যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই আসছে মন খারাপ করা খবর। ইউরোপ থেকে এশিয়া, কিংবা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা-সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে করোনা। অতীতে কোনো বিশ্বযুদ্ধও সাধারণ মানুষকে এত উদ্বিগ্ন বা ভাবিয়ে তুলেছে কি না সন্দেহ রয়েছে! অথচ তিন মাসেরও কম সময়ে দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বিস্তার করে মানুষকে কাবু করে ফেলেছে করোনা।

এশিয়ার অন্যান্য দেশে আগেই হানা দিয়েছে। অন্যান্য দেশে তীব্রতা এখন না থাকলেও বাংলাদেশ-ভারতে বিস্তৃত হচ্ছে চলতি মাসের শুরু থেকে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে শরীয়তপুরের শিবচরে ‘লকডাউন’ করা হয়েছে।

আর ২২ মার্চ পুরো ভারতে ছিল জনতার কারফিউ। বিভিন্ন জেলায়ও লকডাউন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আহ্বানে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী থেকে এ কারফিউ পালন করেন ভারতবাসী।

এ অবস্থায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করেন। আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন।

জনসমাগম এড়িয়ে চলতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পাশাপাশি স্থগিত করে দেয়া হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। বাতিল করা হয়েছে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানমালা; স্থগিত হয়েছে স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠান।

সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ গণজমায়েত ঘটে এমন কর্মসূচিতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে কোন কোন এলাকায় বেশ সমারোহে বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে বলেও গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপত্তা ও বৃহত্তর স্বার্থে তা বাতিল করা একান্তই উচিত।

করোনা পরিস্থিতিকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন- এটা খুবই ঘৃণ্য কাজ। এ অবস্থায় মুনাফা অর্জন কিংবা যাচ্ছেতাইভাবে চলাফেরা করে পরিবার, স্বজন কিংবা আশপাশের মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলা ঠিক হবে না। কারণ চীনে উৎপত্তিস্থল উহানে অল্প সময়ে এই রোগের গতিরোধ করায় যে সাফল্য পাওয়া গেছে তা উচ্চমাত্রায় আক্রান্ত ইতালি ও স্পেন কিংবা ইরানে দেখা যাচ্ছে না।

এভাবে চলতে থাকলে তা মানবসভ্যতার এক নতুন ট্র্যাজেডি রচিত হতে পারে। কেননা রোগ বিস্তার স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি ব্যাপক সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটও ক্রমে ঘনীভূত হবে। রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সংক্রমণ রোধই সব ধরনের সংকট মোচনের প্রধান উপায়।

এই সত্য থেকে বিচ্যুত হলে খাদের কিনারা থেকে গর্তে পড়ে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এ রোগের লক্ষণ যেহেতু অনেকটা সর্দি-কাশির মতো। তাই এ ধরনের লক্ষণ যাদের মধ্যে রয়েছে তাদের সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকতে হবে।

কোভিড-১৯ স্বভাবগতভাবেই অতিশয় সংক্রমণশীল এবং এর ঝুঁকিতে থাকা সর্বসাধারণের কোন প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা নেই। ফলে কেউ-ই যে সংক্রমণের ঝুঁকির বাইরে নেই, তা সবার মনে রাখতে হবে।

বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি দেখে অনেক দেশ নিজেদের সুরক্ষিত করেছে। এর মাঝে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার নাম আসতে পারে।

এসব দেশের কৌশল ছিল একটাই। তা হচ্ছে- যে যখনই আক্রান্ত হচ্ছে তাকে চিহ্নিত করা। কোয়ারেন্টিনে কিংবা আলাদা জায়গায় রাখো। তাহলে সংক্রমণ থেকে অন্যরা রেহাই পাবে। সংক্রমণ থামাতে পারলেই রোগের বিস্তার হতে পারবে না। হয়েছেও তাই!

বিভিন্ন তথ্য অনুসারে, করোনার বিস্তার সারণিতে একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে- ধরা যাক, একজন আক্রান্ত যদি প্রতি ৫ দিনে ২.৫ জনকে আক্রান্ত করে তাহলে ৩০ দিনে সে একাই ৪০৬ জনকে আক্রান্ত করবে। এভাবে চলতে থাকলে ভাবুন তো কোন পর্যায়ে দাঁড়াবে অবস্থা!

এ বিষয়টা বুঝতে পেরেই এশিয়ার ওইসব দেশ তাদের সব শক্তি দিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত করতে পেরেছে। আর যারা করতে পারছে না বা পারেনি- তাদের অবস্থা তো দেখাই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথমে আসবে ইতালির নাম।

২২ মার্চে দেশটিতে ৬০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মাঝে বাংলাদেশিও রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন কিংবা ইরানের নামও আসতে পারে।

এ অবস্থায় আমাদের উচিত হবে, সবার আগে নিজেদের সুরক্ষা করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এরই মধ্যে প্লেন যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।

দু-একটি দেশের সঙ্গে এখনও ফ্লাইট চালু রয়েছে। এসব ফ্লাইটে প্রতিনিয়তই আসছেন প্রবাসীরা। তাদের অনেকেই আক্রান্ত দেশ কিংবা ওইসব দেশের নাগরিকদের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন- এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। তাই এসব ফ্লাইটও এখন বন্ধ করে দেয়া উচিত। সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি হলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্ত করে তা করতেই হবে। আর যারা বিদেশ ফেরত আছেন- তারা ফেরার পর স্বউদ্যোগেই নিজেকে গৃহবন্দী করুন।

মনে রাখতে হবে, কোন সংকটই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই এই সংকটে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হবেন না। সবাই নিরাপদে থাকুন, সুস্থ থাকুন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। আর দেরি নয়, এখনই সময় নিজেকে করোনা থেকে আড়াল করার। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যলয় যেহেতু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেহেতু আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের উচিত হবে, মানুষকে সচেতন করা।

যাতে সাধারণ মানুষ যেন কোন ভুল কিংবা অর্ধসত্য বার্তা পেয়ে আতঙ্কিত না হয়ে পড়েন। সঠিক তথ্য পরিবেশন করে তাদের নিরাপদে রাখতে হবে। আর এ কাজটা শুধু তরুণেরাই সুচারুরূপে করতে পারে। পাশাপাশি ডব্লিউএইচও ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেও মানুষকে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে নিজ নিজ জায়গা থেকে। তবে সবার আগে নিজের সুরক্ষা।

দেশজুড়ে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক-নার্সদেরও পিপিই সরবরাহ করতে হবে। কেননা বাংলাদেশে আক্রান্তদের মধ্যে একজন চিকিৎসক ও দু’জন নার্সও রয়েছেন।

দেশজুড়ে করোনা কিট সরবরাহ করতে হবে। বলা হচ্ছে- পিপিই ও কিট রয়েছে পর্যাপ্ত। তাই যত দ্রুত সম্ভব তা সরবরাহ করতে হবে। কেননা যে দেশে করোনা ঢুকছে একেবারে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, আমরা অবশ্যই চাইব আমাদের দেশে সেভাবে দেখা না দিক। তাই সবার আগে সচেতন হই।

‘হোম কোয়ারেন্টিন’ মেনে চলতে হবে। নয়তো ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যাবে। তখন শত প্রস্তুতি নিয়েও মোকাবিলা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে বিদেশ প্রত্যাগত হাজার হাজার মানুষ দেশে ফিরে জনজীবনে মিশে গেছেন। তাই চোর পালানোর পর গৃহস্থের হুঁশ ফিরে এলে কোন লাভ হবে না। যথাসময়েই সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা জরুরি। আসুন, এ পরিস্থিতিতে আমরা নিজেরা নিরাপদ থাকি, অন্যদেরও সুরক্ষিত রাখি।

[লেখক : ভিসি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জামালপুর]