করোনা প্রাদুর্ভাবকালে সবজি চাষিদের বাঁচাতে হবে

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এখন করোনা প্রাদুর্ভাব মহামারী আকারে দেখা দিতে শুরু করেছে। এমন সময় প্রাদুর্ভাবের গভীরতা অনুযায়ী একেক এলাকা একেক সময় লকডাউনের আওতায় আসছে। যেহেতু বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে। সে সময় থেকে সীমিত আকারে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকলেও এপ্রিল মাসের এ পর্যায়ে এসে সারাদেশজুড়েই কার্যত লকডাউনের আওতায় চলে এসেছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে বর্তমানে সবজি উৎপাদনকারী কৃষকবৃন্দ।

আমরা জানি এখনও শীতকালীন শাকসবজির মৌসুম পুরোপুরি শেষ হয়ে সারেনি। টমেটো, বাঁধাকপি, সিম, গোল আলু, লাউ, বেগুন, গাজর ইত্যাদি সবজি এখনও কৃষকের জমিতে রয়ে গেছে। যদিও রবিকালীন সবজির সময় শেষ হয়েছে তারপরও কৃষক এ সময়ে বেশি মূল্য পাওয়ার জন্য কিছু সবজি বিশেষ যত্নে রেখে দেয়। সেজন্য বাজারে এখনও রবি সবজি পাওয়া যাচ্ছে। সে সঙ্গে খরিপ মৌসুমের বাহারি জাতের সবজি এখন বাজারে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে পাট শাক, লাল লাক, ডাঁটা শাক, করলা, ঢ়েঁড়শ, পুঁইশাক, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, চিচিঙ্গা, বিভিন্ন জাতের বেগুন, সজনা ইত্যাদি প্রধান।

এখন মাঠে কৃষকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোরো ধান ফসল রয়েছে। হয়তো আগামী আর কয়েকদিনের মধ্যেই সেটি মাড়াই শুরু করতে হবে। তাছাড়া তিন মৌসুমের ধান উৎপাদনের মধ্যে বোরো ধান উৎপাদানই সবচেয়ে বেশি খরচ করতে হয় কৃষককে। সে ধান মাড়াই করার জন্যও প্রচুর শ্রমিক খরচের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে বছরের শেষে এসে কৃষকের ঘরে খাবারও থাকে না। কারণ আমাদের দেশের বেশিরভাগ কৃষকই হলো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। কাজেই এ সময়ে এসে তাদের ঘরে খাবার থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেজন্য তাদের হাতে প্রয়োজন নগদ টাকা। আর সেই টাকা পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন হলো তাদেরই জমিতে উৎপাদিত শাকসবজি। কিন্তু এ করোনাকালে পরিবহন সুবিধার অভাবে তাদের জমির উৎপাদিত কৃষিপণ্য কাক্সিক্ষত মূল্যে বিক্রি করতে পারছে না। যদিও সরকার কৃষিপণ্য পরিবহনের আওতার বাহিরে রেখেছে কিন্তু এগুলো এখন নিবে কোথায়!

করোনা পরিস্থিতির কারণে শহরাঞ্চলের মানুষের বেশিরভাগই এখন গ্রামাঞ্চলে। সেজন্য রাজধানী ঢাকাসহ বড়বড় শহরসমূহ প্রায় ফাঁকা। তাছাড়া যারাও বা আছে তারাও বাড়িতে থাকার বাধ্যবাধকতার জন্য বাজার করতে বের হতে পারছে না। কাজেই কে খাবে কৃষকের যত্নে উৎপাদিত এ শাকসবজিগুলো। গ্রামে যারা গিয়েছেন তারা তো গ্রামেরই সন্তান। কাজেই তাদের প্রত্যেকের বাড়িতেই কিছু না কিছু শাকসবজি উৎপাদিত হয়। সেজন্য তাদেও সবজি কিনে খেতে হয় না। তাই কৃষকের সবজি বিক্রির বাজার নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর শাকসবজি এমন একটি পচনশীল কৃষিপণ্য যা দীর্ঘদিন বাড়িতে সংরক্ষণ করা যায় না।

তাই উৎপাদিত পচনশীল শাকসবজি স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিক্রি করতে হয়। অথচ দেশের এমন পরিস্থিতিতে কৃষক দিশেহারা। তারা না পারছে তাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতে, না পারছে নগদ অর্থ দিয়ে তাদের জীবনমান চালু রেখে বোরো ধান উৎপাদন, মাড়াইসহ অন্যান্য কার্যক্রম চালু রাখতে। গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে আমরা দেখছি কৃষক দাম না পেয়ে মুরগির খামারে বাচ্চা মাটিতে পুঁতে ফেলছে, গরুর দুধ বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ঢেলে দিচ্ছে। মাছের খামারিরা মাছের পোনা বিক্রি করতে পারছে না। সরকার যদিও তাদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এ মুহূর্তে আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

এ সময়ে এ সব কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেটি সহজেই করার একটি পন্থা হলো বর্তমানে প্রদেয় ত্রাণ কাজের জন্য ক্রয়কৃত চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান ইত্যাদি আইটেমের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে কৃষকের নিকট থেকে সংগৃহীত শাকসবজি দেয়া যেতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমন তার ভিডিও কনফারেন্সে প্রদত্ত বক্তৃতায় দুধের কথা শুনে ত্রাণকাজের সঙ্গে শিশুখাদ্য হিসেবে দুধ দেয়ার কথা বলেছেন। এতে দুধের খামারিদের সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান হতে পারে। এভাবেই আমাদের সবাইকে নিয়েই করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই করোনা মহামারী প্রতিরোধ পূর্বক এর ভয়াবহতা থেকে জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব।

[লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

kbdhumayun08@gmail.com

সোমবার, ১৩ এপ্রিল ২০২০ , ৩০ চৈত্র ১৪২৬, ১৮শাবান ১৪৪১

করোনা প্রাদুর্ভাবকালে সবজি চাষিদের বাঁচাতে হবে

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এখন করোনা প্রাদুর্ভাব মহামারী আকারে দেখা দিতে শুরু করেছে। এমন সময় প্রাদুর্ভাবের গভীরতা অনুযায়ী একেক এলাকা একেক সময় লকডাউনের আওতায় আসছে। যেহেতু বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে। সে সময় থেকে সীমিত আকারে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকলেও এপ্রিল মাসের এ পর্যায়ে এসে সারাদেশজুড়েই কার্যত লকডাউনের আওতায় চলে এসেছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে বর্তমানে সবজি উৎপাদনকারী কৃষকবৃন্দ।

আমরা জানি এখনও শীতকালীন শাকসবজির মৌসুম পুরোপুরি শেষ হয়ে সারেনি। টমেটো, বাঁধাকপি, সিম, গোল আলু, লাউ, বেগুন, গাজর ইত্যাদি সবজি এখনও কৃষকের জমিতে রয়ে গেছে। যদিও রবিকালীন সবজির সময় শেষ হয়েছে তারপরও কৃষক এ সময়ে বেশি মূল্য পাওয়ার জন্য কিছু সবজি বিশেষ যত্নে রেখে দেয়। সেজন্য বাজারে এখনও রবি সবজি পাওয়া যাচ্ছে। সে সঙ্গে খরিপ মৌসুমের বাহারি জাতের সবজি এখন বাজারে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে পাট শাক, লাল লাক, ডাঁটা শাক, করলা, ঢ়েঁড়শ, পুঁইশাক, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, চিচিঙ্গা, বিভিন্ন জাতের বেগুন, সজনা ইত্যাদি প্রধান।

এখন মাঠে কৃষকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোরো ধান ফসল রয়েছে। হয়তো আগামী আর কয়েকদিনের মধ্যেই সেটি মাড়াই শুরু করতে হবে। তাছাড়া তিন মৌসুমের ধান উৎপাদনের মধ্যে বোরো ধান উৎপাদানই সবচেয়ে বেশি খরচ করতে হয় কৃষককে। সে ধান মাড়াই করার জন্যও প্রচুর শ্রমিক খরচের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে বছরের শেষে এসে কৃষকের ঘরে খাবারও থাকে না। কারণ আমাদের দেশের বেশিরভাগ কৃষকই হলো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। কাজেই এ সময়ে এসে তাদের ঘরে খাবার থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেজন্য তাদের হাতে প্রয়োজন নগদ টাকা। আর সেই টাকা পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন হলো তাদেরই জমিতে উৎপাদিত শাকসবজি। কিন্তু এ করোনাকালে পরিবহন সুবিধার অভাবে তাদের জমির উৎপাদিত কৃষিপণ্য কাক্সিক্ষত মূল্যে বিক্রি করতে পারছে না। যদিও সরকার কৃষিপণ্য পরিবহনের আওতার বাহিরে রেখেছে কিন্তু এগুলো এখন নিবে কোথায়!

করোনা পরিস্থিতির কারণে শহরাঞ্চলের মানুষের বেশিরভাগই এখন গ্রামাঞ্চলে। সেজন্য রাজধানী ঢাকাসহ বড়বড় শহরসমূহ প্রায় ফাঁকা। তাছাড়া যারাও বা আছে তারাও বাড়িতে থাকার বাধ্যবাধকতার জন্য বাজার করতে বের হতে পারছে না। কাজেই কে খাবে কৃষকের যত্নে উৎপাদিত এ শাকসবজিগুলো। গ্রামে যারা গিয়েছেন তারা তো গ্রামেরই সন্তান। কাজেই তাদের প্রত্যেকের বাড়িতেই কিছু না কিছু শাকসবজি উৎপাদিত হয়। সেজন্য তাদেও সবজি কিনে খেতে হয় না। তাই কৃষকের সবজি বিক্রির বাজার নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর শাকসবজি এমন একটি পচনশীল কৃষিপণ্য যা দীর্ঘদিন বাড়িতে সংরক্ষণ করা যায় না।

তাই উৎপাদিত পচনশীল শাকসবজি স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিক্রি করতে হয়। অথচ দেশের এমন পরিস্থিতিতে কৃষক দিশেহারা। তারা না পারছে তাদের উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতে, না পারছে নগদ অর্থ দিয়ে তাদের জীবনমান চালু রেখে বোরো ধান উৎপাদন, মাড়াইসহ অন্যান্য কার্যক্রম চালু রাখতে। গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে আমরা দেখছি কৃষক দাম না পেয়ে মুরগির খামারে বাচ্চা মাটিতে পুঁতে ফেলছে, গরুর দুধ বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ঢেলে দিচ্ছে। মাছের খামারিরা মাছের পোনা বিক্রি করতে পারছে না। সরকার যদিও তাদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এ মুহূর্তে আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

এ সময়ে এ সব কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেটি সহজেই করার একটি পন্থা হলো বর্তমানে প্রদেয় ত্রাণ কাজের জন্য ক্রয়কৃত চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান ইত্যাদি আইটেমের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে কৃষকের নিকট থেকে সংগৃহীত শাকসবজি দেয়া যেতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমন তার ভিডিও কনফারেন্সে প্রদত্ত বক্তৃতায় দুধের কথা শুনে ত্রাণকাজের সঙ্গে শিশুখাদ্য হিসেবে দুধ দেয়ার কথা বলেছেন। এতে দুধের খামারিদের সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান হতে পারে। এভাবেই আমাদের সবাইকে নিয়েই করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই করোনা মহামারী প্রতিরোধ পূর্বক এর ভয়াবহতা থেকে জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব।

[লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

kbdhumayun08@gmail.com