জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এ পর্যন্ত বিশ্বের ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে; আক্রান্ত হয়েছে ১৮ লাখের বেশি। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও মৃত্যুর হার বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর হার চার শতাংশের কম; বাংলাদেশে মৃত্যুর হার প্রায় ৫ শতাংশ। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর কোন ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। মানুষ থেকে মানুষে ব্যাপক হারে ছড়ানো এই ভাইরাসটি প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাই আপাতত সর্বোত্তম উপায়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারছে না প্রশাসন। ফলে ব্যাপক হারে করোনা সংক্রমণের শঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘প্রশাসনের কঠোর অবস্থান’ প্রয়োজন- অনেকে এমন মনে করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা সংকটে জনপ্রতিনিধিদের পাশে পাচ্ছে না স্থানীয় জনগণ; এমন অভিযোগ গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। অথচ ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ৬৮ হাজারের বেশি; নেতা অসংখ্য। বিশ্লেষকদের মতে, তৃণমূল পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হলে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনীতিকরাও বলছেন, দলমত নির্বিশেষে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার ৩৫ দিনের মাথায় প্রাণঘাতী এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে অন্তত ৩৮ জেলায়। সরকারি ছুটি ঘোষণা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, অনেকগুলো জেলা ‘লকডাউন (অবরুদ্ধ)’ ঘোষণা করা, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করাসহ প্রশাসনের নানা পদক্ষেপে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোতে জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত করা গেছে। তবে লকডাউনের প্রভাব দেশের শহরতলী, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ে পড়েনি। গ্রামপর্যায়ে করোনা আতঙ্ক থাকলেও, সচেতনতার অভাবে অসতর্ক জীবনযাপন করছেন অধিকাংশ মানুষ। অযথা বাড়ির বাইরে বের হওয়া, একে-অন্যের বাড়িতে যাওয়া, চায়ের দোকানে আড্ডা, মুদি দোকান ও বাজারে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা, সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া, আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া- এসব প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র।

সারাদেশে তিনশ’ সংসদীয় আসনে নির্বাচিত ৩শ’ এবং সংরক্ষিত পঞ্চাশ মিলে সাড়ে তিনশ’ জন সংসদ সদস্য (এমপি) রয়েছেন। স্থানীয় সরকারের অধীনে ৬৪ জেলা, ১১টি সিটি করপোরেশন, ৪৯২টি উপজেলা, ৩১৬টি পৌরসভা এবং চার হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদে মোট (চেয়ারম্যান, মেয়র, ভাইস চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা আসন) জনপ্রতিনিধির সংখ্যা প্রায় ৬৭ হাজার ৯শ’। দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য, স্থানীয় সূত্র এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্র অনুযায়ী, করোনা দুর্যোগে লকডাউনে আটকেপড়া কর্মহীন সাধারণ মানুষ নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এলাকায় করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা খুবই কম। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী যতটুকু সম্ভব কাজ করে যাচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের আলাদা প্রভাব রয়েছে। যেটা প্রশাসন কিংবা পুলিশের নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পছন্দের নেতাদের কথা আমলে নেবে; যেটা প্রশাসন বা পুলিশ পারবে না। তাই এই মুহূর্তে মানুষকে ঘরে রাখতে, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগাতে হবে; এর বিকল্প নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, করোনা সংকট মোকাবিলায় দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমও এই দুর্যোগে সব রাজনৈতিকদলকে ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই ঘরে বসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উদ্দেশে নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে নিজ এলাকায় স্বশরীরে যাচ্ছেন না। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা সংবাদকে বলেন, কোন কোন এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের দেখা যাচ্ছে না, এটা যেমন ঠিক; তেমনি বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রতিনিধিরা খাদ্যসমাগ্রী, ত্রাণ দিচ্ছেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন, এমন নজিরও কম নেই। তিনি বলেন, নেত্রীর নির্দেশে কয়েকজন মন্ত্রী বাসায় থেকে দেশের কাজও করছেন, আবার নিজ এলাকার কাজও করছেন। অনেকে নিজে না গিয়ে ত্রাণ বা যা যা দরকার পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। এটা তো ডিজিটাল যুগ। ঘরে বসেই অনেক কিছু করা সম্ভব। তবে এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া যায়, কিন্তু কোন বিষয়ে মানুষকে সচেতন এবং সক্রিয় করতে জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মানুষের কাছে যেতে হবে। প্রত্যক্ষভাবে মানুষকে না বোঝালে তাদের সচেতন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

সরকারি দলের এক সদস্য সংবাদকে বলেন, কে যাচ্ছে বা যাচ্ছে না, এটা তো স্থানীয় জনগণ দেখছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরও রয়েছে। যে যেমন কর্ম করবে, নেত্রীর কাছ থেকে পরবর্তীতে তেমন ফল পাবে। সংসদ সদস্যদের বর্তমান কর্মকাণ্ডের তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া হচ্ছে। যারা ঘরে বসে আছেন, তাদের দ্রুতই তাগাদা দিয়ে মাঠে পাঠানো হবে।

রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা গেলেও মাতুয়াইল, ডেমরা, দক্ষিণখান, নন্দীপাড়া, মেরাদিয়াসহ শহরতলী এবং নতুন ও পুরান ঢাকার অলি-গলিতে লকডাউন কার্যকর হচ্ছে না। শুধু পুরান ঢাকায় করোনা আক্রান্ত মানুষ আছে পঞ্চাশের বেশি; মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখলে সাধারণ মানুষ দূরে সরে গেলেও, আবার তারা জটলা তৈরি করে। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের অবস্থাও খুবই নাজুক। জেলাটিতে ১ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জও করোনা সংক্রমণের বড় ঝুঁকিতে আছে। এদিকে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার কারণে কক্সবাজার জেলাও ঝুঁকিতে আছে।

সংবাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মার্চ মাসজুড়ে নারায়ণগঞ্জে বিদেশ ফেরতদের সংখ্যা ছিল ৬০০৮ জন। তবে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা গেছে মাত্র ১১৮৮ জনের। বাকিদের খুঁজেই পায়নি প্রশাসন। এমনকি হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীদের প্রতিও ছিল না তেমন নজরদারি। অনেক প্রবাসীকেই দেখা গেছে, তারা দিব্যি বাইরে ঘুরে বেরিয়েছেন, দোকানদারি করছেন কিংবা বাজার করতে চলে গেছেন। এমন অপরাধে বেশ কয়েকজন প্রবাসীকে জরিমানাও করা হয়। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের প্রশাসনিকভাবে যে সহযোগিতা করার কথা ছিল তেমনটাও করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জনসমাগমপূর্ণ অনুষ্ঠান বাদ যায়নি। প্রথম সংক্রমণ পাওয়ার এক সপ্তাহ পরেও শহরের বিভিন্ন স্থানে বিয়ে, ওয়াজ-মাহফিলের মতো জনসমাগম হয় এমন কার্যক্রম চলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেও বন্ধ করা যায়নি কোচিং সেন্টারগুলো। চলেছে অপ্রয়োজনীয় ঘোরাঘুরি।

গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সংলগ্ন এই জেলাটিতে ইতোমধ্যে ১৪ জন করোনায় আক্রন্তের খবর পাওয়া গেছে; এরমধ্যে গজারিয়ায় করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ৪ জন। উপজেলার হোসেন্দি, জামালদি, মেঘনা ঘাট, বাউশিয়া, সোলআনি, বাগাইয়াকান্দিসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, লকডাউনে আগ্রহ নেই স্থানীয়দের। বাজারগুলোতে ভিড় হচ্ছে। গ্রামগুলোতে মানুষের আড্ডা হচ্ছে। অন্যান্য জেলা থেকেও আত্মীয়স্বজন আসা অব্যাহত আছে। তিনি জানান, কয়েকটি গ্রামে নারায়ণগঞ্জ থেকেও লোক এসে বেড়াচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে জনবল সংকটের কারণে প্রশাসন ও পুলিশ অভিযোগ পেলেও সব জায়গায় গিয়ে ব্যবস্থা নিতে হিমশিম খাচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে জেলাটিতে ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি জানান, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কুমিল্লা জেলাকে লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হলেও তা মানছে না সাধারণ মানুষ। সরেজমিন নগরীর রাজগঞ্জ, চকবাজার, রানীরবাজার, জেলার আদর্শ সদর উপজেলার দুর্গাপুর বাজার, জেলার বুড়িচং উপজেলার নিমসার বাজার ঘুরে দেখা যায়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হলেও তা যেন কেউই মানছেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে আসা লোকজন বাজারে ভিড় জমাচ্ছেন। এদিকে সরকারের সাধারণ ছুটির ফলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ফুটবল, ক্রিকেট খেলায় মগ্ন হয়ে ওঠেছে। আবার কেউ কেউ বন্ধুদের সঙ্গে এবং বিভিন্ন স্থানে অযথা ঘোরাঘুরি করছে। অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে এসব শিক্ষার্থীরা বের হয়ে পড়ছে। এদিকে কেউ কেউ মোটরসাইকেল, গাড়িতে জরুরি সেবার আওতায় থাকা ভুয়া স্টিকার লাগিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন যানবাহনে লোকজনের সংখ্যার আধিক্যতা দেখে তাৎক্ষণিক তা নিয়ন্ত্রণে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ ঠেকাতে যেসব এলাকায় সংক্রমণ ধরা পড়েছে, সেখান থেকে লোকজন যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি যাদের সংস্পর্শে গিয়েছেন, তাদের শনাক্ত করা (কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং) ও কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে যেসব জেলায় এখনো রোগী পাওয়া যায়নি, সেসব এলাকায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ সুরক্ষায় জোর দিতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন চলছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তড়িঘড়ি লকডাউন তুলে নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। বাংলাদেশেও লকডাউন বলা না হলেও ২৬ মার্চ থেকে সরকারি, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে। ইতোমধ্যে ১৮টি জেলা পুরোপুরি লকডাউন (অবরুদ্ধ) করা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, ভবন ও গলি লকডাউন করা হয়েছে। বাস্তব চিত্র- কোন জেলাই পুরোপুরি লকডাউন হয়নি।

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল ২০২০ , ১ বৈশাখ ১৪২৭, ১৯ শাবান ১৪৪১

লকডাউন কার্যকর করতে

জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে

ফয়েজ আহমেদ তুষার |

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এ পর্যন্ত বিশ্বের ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে; আক্রান্ত হয়েছে ১৮ লাখের বেশি। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও মৃত্যুর হার বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর হার চার শতাংশের কম; বাংলাদেশে মৃত্যুর হার প্রায় ৫ শতাংশ। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর কোন ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। মানুষ থেকে মানুষে ব্যাপক হারে ছড়ানো এই ভাইরাসটি প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাই আপাতত সর্বোত্তম উপায়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারছে না প্রশাসন। ফলে ব্যাপক হারে করোনা সংক্রমণের শঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘প্রশাসনের কঠোর অবস্থান’ প্রয়োজন- অনেকে এমন মনে করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা সংকটে জনপ্রতিনিধিদের পাশে পাচ্ছে না স্থানীয় জনগণ; এমন অভিযোগ গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। অথচ ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ৬৮ হাজারের বেশি; নেতা অসংখ্য। বিশ্লেষকদের মতে, তৃণমূল পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হলে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনীতিকরাও বলছেন, দলমত নির্বিশেষে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার ৩৫ দিনের মাথায় প্রাণঘাতী এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে অন্তত ৩৮ জেলায়। সরকারি ছুটি ঘোষণা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, অনেকগুলো জেলা ‘লকডাউন (অবরুদ্ধ)’ ঘোষণা করা, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করাসহ প্রশাসনের নানা পদক্ষেপে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোতে জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত করা গেছে। তবে লকডাউনের প্রভাব দেশের শহরতলী, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ে পড়েনি। গ্রামপর্যায়ে করোনা আতঙ্ক থাকলেও, সচেতনতার অভাবে অসতর্ক জীবনযাপন করছেন অধিকাংশ মানুষ। অযথা বাড়ির বাইরে বের হওয়া, একে-অন্যের বাড়িতে যাওয়া, চায়ের দোকানে আড্ডা, মুদি দোকান ও বাজারে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা, সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া, আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া- এসব প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র।

সারাদেশে তিনশ’ সংসদীয় আসনে নির্বাচিত ৩শ’ এবং সংরক্ষিত পঞ্চাশ মিলে সাড়ে তিনশ’ জন সংসদ সদস্য (এমপি) রয়েছেন। স্থানীয় সরকারের অধীনে ৬৪ জেলা, ১১টি সিটি করপোরেশন, ৪৯২টি উপজেলা, ৩১৬টি পৌরসভা এবং চার হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদে মোট (চেয়ারম্যান, মেয়র, ভাইস চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা আসন) জনপ্রতিনিধির সংখ্যা প্রায় ৬৭ হাজার ৯শ’। দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য, স্থানীয় সূত্র এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্র অনুযায়ী, করোনা দুর্যোগে লকডাউনে আটকেপড়া কর্মহীন সাধারণ মানুষ নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এলাকায় করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা খুবই কম। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী যতটুকু সম্ভব কাজ করে যাচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের আলাদা প্রভাব রয়েছে। যেটা প্রশাসন কিংবা পুলিশের নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পছন্দের নেতাদের কথা আমলে নেবে; যেটা প্রশাসন বা পুলিশ পারবে না। তাই এই মুহূর্তে মানুষকে ঘরে রাখতে, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগাতে হবে; এর বিকল্প নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, করোনা সংকট মোকাবিলায় দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমও এই দুর্যোগে সব রাজনৈতিকদলকে ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই ঘরে বসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উদ্দেশে নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে নিজ এলাকায় স্বশরীরে যাচ্ছেন না। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা সংবাদকে বলেন, কোন কোন এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের দেখা যাচ্ছে না, এটা যেমন ঠিক; তেমনি বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রতিনিধিরা খাদ্যসমাগ্রী, ত্রাণ দিচ্ছেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন, এমন নজিরও কম নেই। তিনি বলেন, নেত্রীর নির্দেশে কয়েকজন মন্ত্রী বাসায় থেকে দেশের কাজও করছেন, আবার নিজ এলাকার কাজও করছেন। অনেকে নিজে না গিয়ে ত্রাণ বা যা যা দরকার পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। এটা তো ডিজিটাল যুগ। ঘরে বসেই অনেক কিছু করা সম্ভব। তবে এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া যায়, কিন্তু কোন বিষয়ে মানুষকে সচেতন এবং সক্রিয় করতে জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মানুষের কাছে যেতে হবে। প্রত্যক্ষভাবে মানুষকে না বোঝালে তাদের সচেতন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

সরকারি দলের এক সদস্য সংবাদকে বলেন, কে যাচ্ছে বা যাচ্ছে না, এটা তো স্থানীয় জনগণ দেখছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরও রয়েছে। যে যেমন কর্ম করবে, নেত্রীর কাছ থেকে পরবর্তীতে তেমন ফল পাবে। সংসদ সদস্যদের বর্তমান কর্মকাণ্ডের তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া হচ্ছে। যারা ঘরে বসে আছেন, তাদের দ্রুতই তাগাদা দিয়ে মাঠে পাঠানো হবে।

রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা গেলেও মাতুয়াইল, ডেমরা, দক্ষিণখান, নন্দীপাড়া, মেরাদিয়াসহ শহরতলী এবং নতুন ও পুরান ঢাকার অলি-গলিতে লকডাউন কার্যকর হচ্ছে না। শুধু পুরান ঢাকায় করোনা আক্রান্ত মানুষ আছে পঞ্চাশের বেশি; মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখলে সাধারণ মানুষ দূরে সরে গেলেও, আবার তারা জটলা তৈরি করে। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের অবস্থাও খুবই নাজুক। জেলাটিতে ১ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জও করোনা সংক্রমণের বড় ঝুঁকিতে আছে। এদিকে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার কারণে কক্সবাজার জেলাও ঝুঁকিতে আছে।

সংবাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মার্চ মাসজুড়ে নারায়ণগঞ্জে বিদেশ ফেরতদের সংখ্যা ছিল ৬০০৮ জন। তবে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা গেছে মাত্র ১১৮৮ জনের। বাকিদের খুঁজেই পায়নি প্রশাসন। এমনকি হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীদের প্রতিও ছিল না তেমন নজরদারি। অনেক প্রবাসীকেই দেখা গেছে, তারা দিব্যি বাইরে ঘুরে বেরিয়েছেন, দোকানদারি করছেন কিংবা বাজার করতে চলে গেছেন। এমন অপরাধে বেশ কয়েকজন প্রবাসীকে জরিমানাও করা হয়। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের প্রশাসনিকভাবে যে সহযোগিতা করার কথা ছিল তেমনটাও করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জনসমাগমপূর্ণ অনুষ্ঠান বাদ যায়নি। প্রথম সংক্রমণ পাওয়ার এক সপ্তাহ পরেও শহরের বিভিন্ন স্থানে বিয়ে, ওয়াজ-মাহফিলের মতো জনসমাগম হয় এমন কার্যক্রম চলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেও বন্ধ করা যায়নি কোচিং সেন্টারগুলো। চলেছে অপ্রয়োজনীয় ঘোরাঘুরি।

গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সংলগ্ন এই জেলাটিতে ইতোমধ্যে ১৪ জন করোনায় আক্রন্তের খবর পাওয়া গেছে; এরমধ্যে গজারিয়ায় করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ৪ জন। উপজেলার হোসেন্দি, জামালদি, মেঘনা ঘাট, বাউশিয়া, সোলআনি, বাগাইয়াকান্দিসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, লকডাউনে আগ্রহ নেই স্থানীয়দের। বাজারগুলোতে ভিড় হচ্ছে। গ্রামগুলোতে মানুষের আড্ডা হচ্ছে। অন্যান্য জেলা থেকেও আত্মীয়স্বজন আসা অব্যাহত আছে। তিনি জানান, কয়েকটি গ্রামে নারায়ণগঞ্জ থেকেও লোক এসে বেড়াচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে জনবল সংকটের কারণে প্রশাসন ও পুলিশ অভিযোগ পেলেও সব জায়গায় গিয়ে ব্যবস্থা নিতে হিমশিম খাচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে জেলাটিতে ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি জানান, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কুমিল্লা জেলাকে লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হলেও তা মানছে না সাধারণ মানুষ। সরেজমিন নগরীর রাজগঞ্জ, চকবাজার, রানীরবাজার, জেলার আদর্শ সদর উপজেলার দুর্গাপুর বাজার, জেলার বুড়িচং উপজেলার নিমসার বাজার ঘুরে দেখা যায়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হলেও তা যেন কেউই মানছেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে আসা লোকজন বাজারে ভিড় জমাচ্ছেন। এদিকে সরকারের সাধারণ ছুটির ফলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ফুটবল, ক্রিকেট খেলায় মগ্ন হয়ে ওঠেছে। আবার কেউ কেউ বন্ধুদের সঙ্গে এবং বিভিন্ন স্থানে অযথা ঘোরাঘুরি করছে। অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে এসব শিক্ষার্থীরা বের হয়ে পড়ছে। এদিকে কেউ কেউ মোটরসাইকেল, গাড়িতে জরুরি সেবার আওতায় থাকা ভুয়া স্টিকার লাগিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন যানবাহনে লোকজনের সংখ্যার আধিক্যতা দেখে তাৎক্ষণিক তা নিয়ন্ত্রণে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ ঠেকাতে যেসব এলাকায় সংক্রমণ ধরা পড়েছে, সেখান থেকে লোকজন যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি যাদের সংস্পর্শে গিয়েছেন, তাদের শনাক্ত করা (কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং) ও কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে যেসব জেলায় এখনো রোগী পাওয়া যায়নি, সেসব এলাকায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ সুরক্ষায় জোর দিতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন চলছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তড়িঘড়ি লকডাউন তুলে নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। বাংলাদেশেও লকডাউন বলা না হলেও ২৬ মার্চ থেকে সরকারি, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে। ইতোমধ্যে ১৮টি জেলা পুরোপুরি লকডাউন (অবরুদ্ধ) করা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, ভবন ও গলি লকডাউন করা হয়েছে। বাস্তব চিত্র- কোন জেলাই পুরোপুরি লকডাউন হয়নি।