করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না যেসব দেশ

প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণে (কোভিড-১৯) মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশে্বর পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী দেশ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত। যুক্তরাজ্যও নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এই চার দেশও করোনাভাইরাসকে প্রথমে খুব একটা আমলে নেয়নি, এর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। চরম সংকটে পড়ে দেশগুলো পর্যায়ক্রমে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রতিযোগিতা এখনও থামাতে পারছে না। ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসেবে, গতকাল দুপুর পর্যন্ত সারাবিশে্ব করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছে ২৩ লাখ ৪৭ হাজার ৮১৫ জন। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ১২৮ জনের। বিশে্ব মোট মৃত্যুর প্রায় ৮০ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে।

করোনায় মহাবিপর্যয়ের মুখে যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছে সাত লাখ ৩৮ হাজার ৯২৩ জন। এরমধ্যে দেশটিতে মারা গেছে বিশে্বর সর্বোচ্চ ৩৯ হাজার ১৫ জন। করোনায় চিকিৎসায় দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভেঙে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তি মালিকানাধীন। এসবের ৫৮ শতাংশ অলাভজনক। দেশটির চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ বহন করে সরকার। দেশটির সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশাস (সিডিসি) ফেডারেল সরকারের একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি সংক্রামক ব্যাধি ইবোলা, জিকা, সিডিসিসহ বিভিন্ন ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। এতো সাফল্য থাকা সত্ত্বেও করোনা মহামারী রুখতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরুতেই আমলে নেননি করোনাভাইরাসের বিষয়টি। উদ্যোগও নেয়া হয়নি করোনা প্রতিরোধে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনার রোগী শনাক্ত হয় গত ২০ জানুয়ারি ওয়াশিংটন রাজ্যের সিয়াটল শহরে। ১৫ জানুয়ারি ওই ব্যক্তি চীনের উহান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন।

চীনের উহানে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি। জানুয়ারিতেই বিশ্বের ২১টি দেশে করোনায় আক্রান্ত হয় বিপুলসংখ্যক মানুষ। এ সময়ে কয়েকবার সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে দাবি করেন। যদিও এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। পরবর্তীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেও করোনা আর নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা বলেন, সময়মতো করোনা টেস্টের অনুমতি প্রদান, হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্সসহ জনগণকে সতর্ক ও সচেতন করলে পরিণতি এমন ভয়াবহ হতো না। যা করেছে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একাধিকবার করোনাভাইরাসকে ‘চায়না ভাইরাস’ বলে। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করলে ট্রাম্প তিনি জানান, ‘করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই লাখে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে তা হবে তার সরকারের সাফল্য।’

আক্রান্ত ও মৃত্যুতে দ্বিতীয় স্থানে স্পেন

ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসেবে, গতকাল পর্যন্ত স্পেনে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন। আর দেশটিতে মারা গেছেন ২০ হাজার ৪৫৩ জন।

করোনাভাইরাসের মহামারী থেকে জনগণকে রক্ষায় গত ১৪ মার্চ জরুরি অবস্থা জারি করে স্পেন সরকার। ওই সময় থেকে করোনার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ প্রস্তুতিও নেন চিকিৎসকেরা। এতদিনে পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় রূপ নেয়।

স্পেনে মৃত্যুর বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো। সেটি হলো জনস্বাস্থ্যসেবার মানহীনতা ও রোগ নির্ণয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সম্পদের অভাব। যদিও স্পেনের বিশেষজ্ঞরা জানান, এই মৃত্যুর মিছিলের পেছনে আরও অনেক বিষয় জড়িত।

স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব নাভারার জনস্বাস্থ্য ও প্রতিষেধক ওষুধ বিভাগের অধ্যাপক সিলভিয়া কার্লোস চিলারসন বলেছেন, সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানবসম্পদ ও যন্ত্রপাতি পর্যাপ্ত না থাকে, তাহলে এর প্রভাব হবে অনেক বেশি ভয়ানক। এই কারণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একটি বিরাট অংশ সমাজের সবচেয়ে অরক্ষিত মানুষ। এর মধ্যে চিকিৎসা পেশায় যুক্ত ব্যক্তিরাও আছেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে যত দ্রুত সম্ভব সুরক্ষা যন্ত্রপাতির দাবি জানিয়ে সম্প্রতি স্পেনের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে দেশটির চিকিৎসা কর্মীদের সংগঠন স্টেট কনফেডারেশন অব মেডিকেল ইউনিয়ন (সিইএসএম)। এতে অভিযোগ করা হয়, করোনাভাইরাসের ঝুঁকি কমানোর কাজে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যদিও মন্ত্রণালয় ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

করোনাভাইরাসের বিষয়ে জনসচেতনতামূলক তথ্য প্রচারের অভাবকে দায়ী করেছেন কর্ডোভা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক হোসে হার্নান্দেজ। তিনি বলেন, জরুরি অবস্থা জারির আগে করোনার বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার তেমন দেখা যায়নি। জরুরি অবস্থা জারির আগে মানুষের একটি বিরাট অংশের মধ্যে করোনাভাইরাসের ঝুঁকির বিষয়ে তেমন কোন ধারণাই ছিল না।

ইতালির বিপর্যয়ের কারণ

ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, গতকাল পর্যন্ত ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৭৫ হাজার ৯২৫ জন। এরমধ্যে মারা গেছেন ২৩ হাজার ২২৭ জন।

কেন দেশটিতে মৃত্যুর হার এতো বেশি- এ নিয়ে নানা কারণ উৎঘাটন করেছেন দেশটির চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

ইতালিতে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে সেখানকার বয়স্ক মানুষের সংখ্যাধিক্য। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের বসবাস। দেশটির অধিবাসীদের ২৩ শতাংশই ৬৫ কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সী। ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অনেকেরই বয়স ৮০ ও ৯০-এর ঘরে।

এছাড়াও একই অঞ্চলে বেশি সংখ্যক আক্রান্ত থাকা, পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাপনায় সংকট এবং মৃদুভাবে আক্রান্তদের শনাক্ত না করা। দেশটিতে করোনাভাইরাসে মৃদুভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন মানুষদের শনাক্ত করা কিংবা আক্রান্তের তালিকায় যুক্ত করা হয়নি। এ কারণে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। মারাত্মকভাবে আক্রান্তদের সংখ্যাই কেবল জানা যাচ্ছে।

ইতালির বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, ইতালিজুড়ে নতুন করে আরও যেসব কড়াকড়িমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা কেবল নজিরবিহীনই নয়, অস্থিতিশীলও।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক জন এডমুন্ড বলেছেন, এ ধরনের বিধি-নিষেধের প্রভাব খুব স্বল্পমেয়াদি হবে। দীর্ঘমেয়াদে এগুলোর বাস্তবায়ন না হলে মহামারী অবস্থা আরও বেশিদিন থেকে যাবে।

যদিও ইতালির বতমান পদক্ষেপগুলোকে ‘অসাধারণ’ ও ‘পুরোপুরি যথার্থ’ বলে উল্লেখ দেশটির ওই অধ্যাপক বলেন, প্রাথমিকভাবে সরকারের প্রতিক্রিয়া খুব ধীর ছিল।

ফ্রান্সেও অপ্রতিযোধ্য করোনার সংক্রমণ

ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, ফ্রান্সে গতকাল পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৫১ হাজার ৭৯৩ জন। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৯ হাজার ৩২৩ জনের। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ইতালিতে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই অবস্থা দেখেও খুব একটা সতর্ক হয়নি ফ্রান্স।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সে করোনা রোগী একে একে বাড়তে থাকে। তবু ফ্রান্স সরকারের সেদিকে খুব একটা নজর ছিল না। আগাম কোন পদক্ষেপও নেয়নি। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে লকডাউনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় ফ্রান্স সরকার।

করোনা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাজ্যের ভুল স্বীকার

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক সুযোগ যুক্তরাজ্য সরকার হাতছাড়া করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একটি ইমার্জেন্সি কমিটির সঙ্গে পাঁচটি বৈঠকে অংশ নেননি, যদিও তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

করোনাভাইরাস পরীক্ষার সংখ্যা কম করা, লকডাউনের মেয়াদ কমিয়ে আনা নিয়ে আলোচনা ও চিকিৎসকদের যথেষ্ট পরিমাণ পিপিই না দেয়ার বিষয়গুলোর কারণে বেশ সমালোচনা হয়েছে যুক্তরাজ্যের সরকারের।

যুক্তরাজ্যের সিনিয়র মন্ত্রী মাইকেল গোভ স্বীকার করেছেন, করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকার ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘সব সরকারই ভুল করে, আমাদের সরকারও। আমরা নতুন শিক্ষা নিয়ে প্রতিদিন পরিস্থিতির অগ্রগতি চাই।’

ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, গতকাল নাগাদ যুক্তরাজ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ১৪ হাজার ২১৭ জন। এরমধ্যে মারা গেছেন ১৫ হাজার ৪৬৪ জন।

সোমবার, ২০ এপ্রিল ২০২০ , ৭ বৈশাখ ১৪২৭, ২৫ শাবান ১৪৪১

করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না যেসব দেশ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণে (কোভিড-১৯) মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশে্বর পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী দেশ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত। যুক্তরাজ্যও নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এই চার দেশও করোনাভাইরাসকে প্রথমে খুব একটা আমলে নেয়নি, এর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। চরম সংকটে পড়ে দেশগুলো পর্যায়ক্রমে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রতিযোগিতা এখনও থামাতে পারছে না। ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসেবে, গতকাল দুপুর পর্যন্ত সারাবিশে্ব করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছে ২৩ লাখ ৪৭ হাজার ৮১৫ জন। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ১২৮ জনের। বিশে্ব মোট মৃত্যুর প্রায় ৮০ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে।

করোনায় মহাবিপর্যয়ের মুখে যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছে সাত লাখ ৩৮ হাজার ৯২৩ জন। এরমধ্যে দেশটিতে মারা গেছে বিশে্বর সর্বোচ্চ ৩৯ হাজার ১৫ জন। করোনায় চিকিৎসায় দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভেঙে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তি মালিকানাধীন। এসবের ৫৮ শতাংশ অলাভজনক। দেশটির চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ বহন করে সরকার। দেশটির সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশাস (সিডিসি) ফেডারেল সরকারের একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি সংক্রামক ব্যাধি ইবোলা, জিকা, সিডিসিসহ বিভিন্ন ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। এতো সাফল্য থাকা সত্ত্বেও করোনা মহামারী রুখতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরুতেই আমলে নেননি করোনাভাইরাসের বিষয়টি। উদ্যোগও নেয়া হয়নি করোনা প্রতিরোধে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনার রোগী শনাক্ত হয় গত ২০ জানুয়ারি ওয়াশিংটন রাজ্যের সিয়াটল শহরে। ১৫ জানুয়ারি ওই ব্যক্তি চীনের উহান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন।

চীনের উহানে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি। জানুয়ারিতেই বিশ্বের ২১টি দেশে করোনায় আক্রান্ত হয় বিপুলসংখ্যক মানুষ। এ সময়ে কয়েকবার সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে দাবি করেন। যদিও এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। পরবর্তীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেও করোনা আর নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা বলেন, সময়মতো করোনা টেস্টের অনুমতি প্রদান, হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্সসহ জনগণকে সতর্ক ও সচেতন করলে পরিণতি এমন ভয়াবহ হতো না। যা করেছে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একাধিকবার করোনাভাইরাসকে ‘চায়না ভাইরাস’ বলে। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করলে ট্রাম্প তিনি জানান, ‘করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই লাখে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে তা হবে তার সরকারের সাফল্য।’

আক্রান্ত ও মৃত্যুতে দ্বিতীয় স্থানে স্পেন

ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসেবে, গতকাল পর্যন্ত স্পেনে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন। আর দেশটিতে মারা গেছেন ২০ হাজার ৪৫৩ জন।

করোনাভাইরাসের মহামারী থেকে জনগণকে রক্ষায় গত ১৪ মার্চ জরুরি অবস্থা জারি করে স্পেন সরকার। ওই সময় থেকে করোনার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ প্রস্তুতিও নেন চিকিৎসকেরা। এতদিনে পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় রূপ নেয়।

স্পেনে মৃত্যুর বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো। সেটি হলো জনস্বাস্থ্যসেবার মানহীনতা ও রোগ নির্ণয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সম্পদের অভাব। যদিও স্পেনের বিশেষজ্ঞরা জানান, এই মৃত্যুর মিছিলের পেছনে আরও অনেক বিষয় জড়িত।

স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব নাভারার জনস্বাস্থ্য ও প্রতিষেধক ওষুধ বিভাগের অধ্যাপক সিলভিয়া কার্লোস চিলারসন বলেছেন, সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানবসম্পদ ও যন্ত্রপাতি পর্যাপ্ত না থাকে, তাহলে এর প্রভাব হবে অনেক বেশি ভয়ানক। এই কারণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একটি বিরাট অংশ সমাজের সবচেয়ে অরক্ষিত মানুষ। এর মধ্যে চিকিৎসা পেশায় যুক্ত ব্যক্তিরাও আছেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে যত দ্রুত সম্ভব সুরক্ষা যন্ত্রপাতির দাবি জানিয়ে সম্প্রতি স্পেনের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে দেশটির চিকিৎসা কর্মীদের সংগঠন স্টেট কনফেডারেশন অব মেডিকেল ইউনিয়ন (সিইএসএম)। এতে অভিযোগ করা হয়, করোনাভাইরাসের ঝুঁকি কমানোর কাজে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যদিও মন্ত্রণালয় ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

করোনাভাইরাসের বিষয়ে জনসচেতনতামূলক তথ্য প্রচারের অভাবকে দায়ী করেছেন কর্ডোভা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক হোসে হার্নান্দেজ। তিনি বলেন, জরুরি অবস্থা জারির আগে করোনার বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার তেমন দেখা যায়নি। জরুরি অবস্থা জারির আগে মানুষের একটি বিরাট অংশের মধ্যে করোনাভাইরাসের ঝুঁকির বিষয়ে তেমন কোন ধারণাই ছিল না।

ইতালির বিপর্যয়ের কারণ

ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, গতকাল পর্যন্ত ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৭৫ হাজার ৯২৫ জন। এরমধ্যে মারা গেছেন ২৩ হাজার ২২৭ জন।

কেন দেশটিতে মৃত্যুর হার এতো বেশি- এ নিয়ে নানা কারণ উৎঘাটন করেছেন দেশটির চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

ইতালিতে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে সেখানকার বয়স্ক মানুষের সংখ্যাধিক্য। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের বসবাস। দেশটির অধিবাসীদের ২৩ শতাংশই ৬৫ কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সী। ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অনেকেরই বয়স ৮০ ও ৯০-এর ঘরে।

এছাড়াও একই অঞ্চলে বেশি সংখ্যক আক্রান্ত থাকা, পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাপনায় সংকট এবং মৃদুভাবে আক্রান্তদের শনাক্ত না করা। দেশটিতে করোনাভাইরাসে মৃদুভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন মানুষদের শনাক্ত করা কিংবা আক্রান্তের তালিকায় যুক্ত করা হয়নি। এ কারণে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। মারাত্মকভাবে আক্রান্তদের সংখ্যাই কেবল জানা যাচ্ছে।

ইতালির বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, ইতালিজুড়ে নতুন করে আরও যেসব কড়াকড়িমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা কেবল নজিরবিহীনই নয়, অস্থিতিশীলও।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক জন এডমুন্ড বলেছেন, এ ধরনের বিধি-নিষেধের প্রভাব খুব স্বল্পমেয়াদি হবে। দীর্ঘমেয়াদে এগুলোর বাস্তবায়ন না হলে মহামারী অবস্থা আরও বেশিদিন থেকে যাবে।

যদিও ইতালির বতমান পদক্ষেপগুলোকে ‘অসাধারণ’ ও ‘পুরোপুরি যথার্থ’ বলে উল্লেখ দেশটির ওই অধ্যাপক বলেন, প্রাথমিকভাবে সরকারের প্রতিক্রিয়া খুব ধীর ছিল।

ফ্রান্সেও অপ্রতিযোধ্য করোনার সংক্রমণ

ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, ফ্রান্সে গতকাল পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৫১ হাজার ৭৯৩ জন। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৯ হাজার ৩২৩ জনের। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ইতালিতে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই অবস্থা দেখেও খুব একটা সতর্ক হয়নি ফ্রান্স।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সে করোনা রোগী একে একে বাড়তে থাকে। তবু ফ্রান্স সরকারের সেদিকে খুব একটা নজর ছিল না। আগাম কোন পদক্ষেপও নেয়নি। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে লকডাউনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় ফ্রান্স সরকার।

করোনা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাজ্যের ভুল স্বীকার

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক সুযোগ যুক্তরাজ্য সরকার হাতছাড়া করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একটি ইমার্জেন্সি কমিটির সঙ্গে পাঁচটি বৈঠকে অংশ নেননি, যদিও তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

করোনাভাইরাস পরীক্ষার সংখ্যা কম করা, লকডাউনের মেয়াদ কমিয়ে আনা নিয়ে আলোচনা ও চিকিৎসকদের যথেষ্ট পরিমাণ পিপিই না দেয়ার বিষয়গুলোর কারণে বেশ সমালোচনা হয়েছে যুক্তরাজ্যের সরকারের।

যুক্তরাজ্যের সিনিয়র মন্ত্রী মাইকেল গোভ স্বীকার করেছেন, করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকার ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘সব সরকারই ভুল করে, আমাদের সরকারও। আমরা নতুন শিক্ষা নিয়ে প্রতিদিন পরিস্থিতির অগ্রগতি চাই।’

ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে, গতকাল নাগাদ যুক্তরাজ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ১৪ হাজার ২১৭ জন। এরমধ্যে মারা গেছেন ১৫ হাজার ৪৬৪ জন।