করোনার প্রভাব ও আসন্ন বাজেট

ড. জাহাঙ্গীর আলম

মহামারী করোনার অভিঘাতে পৃথিবী এখন টালমাটাল। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এর ভয়াবহ আঘাত লেগেছে অর্থনীতিতে। শিল্পের চাকা ঘুরছে না। কলকারখানা অচল। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। হোটেল-রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট খুলছে না। বাস, ট্রেন, এরোপ্লেন চলছে না। দেশে দেশে মানুষ গৃহবন্দী। এর প্রভাবে বিশ্বের প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে বলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। মোট ৩৩০ কোটি শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে। এদের প্রায় ৬০ শতাংশ মজুরি ইতোমধ্যে হাতছাড়া হয়ে গেছে। তাতে দারিদ্র্য বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি নেমে যাবে শূন্যের কোঠায়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক আশঙ্কা করছে, করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ ৫.৮ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ৮.৮ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ হবে প্রায় ৪৯৩ লাখ থেকে ৭৪৮ লাখ কোটি টাকা। সব মিলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে বিশ্ব জিডিপির ৪ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে তার হিসাবনিকাশ করা সময়ের ব্যাপার। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, করোনার এক ভয়াবহ আঘাত লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। দিনের পর দিন দেশে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। একমাত্র কৃষি ছাড়া আমাদের অর্থনীতির অন্যান্য খাতে এখন দারুণ স্থবিরতা বিরাজ করছে। পোশাক শিল্পের রফতানি আয় কমে গেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আয়ও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ভারি ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো লকডাউনের কবলে পড়ে অনেকটাই নিশ্চল। প্রাণহীন হয়ে পড়েছে সেবা খাত। লাখ লাখ মানুষের অভিপ্রয়াণ ঘটেছে শহর থেকে গ্রামে। অনানুষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত অধিকাংশ মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মহীন। তাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে প্রায় ৬ কোটি মানুষ। তারা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে। অনেকেই হবে ব্যাধি ও ক্ষুধায় শিকার। এমন এক বৈশ্বিক ও রাষ্ট্রিক বেহাল অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে প্রণীত হচ্ছে আমাদের আসন্ন বাজেট। আগামী ১০ জুন মহান জাতীয় সংসদে পেশ করা হবে ২০২০-২১ সালের নয়া বাজেট। এ নিয়ে অনেকেই দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছেন। ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে পেশ করছেন তাদের সুপারিশ। আমার বিবেচনায় এবারের বাজেট হতে হবে গতানুগতিকতার বাইরে। ধারাবাহিকতার ছেদ ঘটিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও নতুন আঙ্গিকে প্রণয়ন করতে হবে এবারের বাজেট। বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং মানুষের জীবন বাঁচানো ও জীবিকার পথ খোলে দেয়াই হবে বাজেটের প্রধান উদ্দেশ্য। জীবন বাঁচানোর জন্য দরকার চিকিৎসা ও খাদ্যের সংস্থান। জীবিকার জন্য দরকার কর্মসংস্থান। সেই সঙ্গে উপনির্বাচনহীন ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর সম্প্রসারণ। দেশের নাগরিকদের মানবিক উন্নয়নের জন্যও থাকতে হবে প্রয়োজনীয় অগ্রাধিকার। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

করোনার প্রভাবে আমাদের চলতি বছরের অর্থনীতির গতি অনেকটাই শ্লথ হয়ে যাবে। তাতে হ্রাস পাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে টানা প্রায় ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। গত বছর ওই ৮ শতাংশের ঘর টপকে উন্নীত হয়েছে ৮.২ শতাংশে। এবার তা অনেকটাই নেমে যাবে বলে ধারণা অনেকের। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন হচ্ছে এবার প্রবৃদ্ধি হবে ২ থেকে ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মাত্র ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছে। তবে উল্লিখিত দুটো উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন গ্রহণ করছেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। তিনি মনে করছেন, এ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ৬ শতাংশ হবে। তবে তার এই প্রাক্কলনও প্রশ্নাতীত নয়। আমাদের দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উল্লম্ফন ঘটে প্রধানত এপ্রিল, মে ও জুন মাসে। অথচ এই ৩ মাসের ২ মাসই দেশের অর্থনীতি লকডাউনে রয়েছে। এ সময় দেশের বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, কর্মহীনতা, আয় ও চাহিদা হ্রাস এবং আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে অনেক বেশি চাপের কারণে আমরা এখন মন্দার মুখোমুখি। তবে এই মন্দাকাল মাত্র ২ থেকে আড়াই মাস পর্যন্ত স্থায়ী হলে অর্থাৎ জুন থেকে অর্থনীতির চাকা সচল হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের উপরে হতে পারে। এবার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮.২৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রসারিত হচ্ছে মূলত দুটো ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। এর একটা পোশাক খাত এবং অন্যটি রেমিটেন্স আয়। বাংলাদেশে যে রফতানি আয় হয় তার শতকরা ৮০ ভাগই আসে পোশাক রফতানি থেকে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রফতানি খাতে স্থবিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আয় হয়েছে ২ হাজার ৯৫০ কোটি ডলার, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম। গত এপ্রিলে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে মাত্র ৫২ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮২ শতাংশ কম। আমাদের তৈরি পোশাকের বড় বাজার আমেরিকা ও ইউরোপে এখন ব্যাপক মন্দা। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রফতানি। করোনার প্রভাব চলে গেলে আমাদের চিরায়ত বাজার পুনরুদ্ধার করতে হবে। নতুন বাজার খুঁজতে হবে। তাছাড়া পোশাক তৈরিতে আমাদের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুলে ধরতে হবে। অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অপর গুরুত্বপূর্ণ খাত রেমিট্যান্স প্রবাহ সম্প্রতি দারুণভাবে কমে গেছে। গত এপ্রিল মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা মাত্র ১০৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৩৫ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ কম। করোনার প্রভাবে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কমতে শুরু করে রেমিটেন্স প্রবাহ। ওই মাসে বিদেশ থেকে আসে ১৪৫ কোটি ডলার। মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ১১৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার ৫শ’ থেকে ১ হাজার ৬শ’ কোটি ডলার রেমিটেন্স আসে। এর ৫৮ শতাংশই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। করোনার প্রভাবে সেখানে এখন মন্দা চলছে। তাছাড়া জ্বালানি আয় কমে যাওয়ায় ওই দেশগুলোর আয় কমে গেছে। ফলে সেখানে ছাঁটাই চলছে বাংলাদেশি শ্রমিকের। ইউরোপ ও আমেরিকাতেও অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। তাছাড়া সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় কর্মরত শ্রমিকরাও কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কোভিড-১৯ ওই সব দেশে হানা দিলে জীবন বাঁচাতে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরা শুরু হয়। এ সময় ২ লাখেরও বেশি প্রবাসী দেশে ফিরে আসেন। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক আশঙ্কা করছে, অন্তত ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক করোনার প্রভাবে কর্মচ্যুত হবেন। করোনা পরবর্তীকালে এদের জন্য নতুন বাজার খুঁজতে হবে। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। আপাতত এদেরকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে দেশের ভেতর আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। গত বাজেটে চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ৮.২৫ শতাংশ। এার ধারাবাহিকতায় আগামী বছর তা হতে ৮.৫ শতাংশ। তবে করোনার প্রভাবে এখন অর্থনীতির যে বেহাল দশা তা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগবে। আগামী বাজেটে তাই পরিমিতিবোধ সম্পন্ন একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। সে লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৭.৫ শতাংশ।

খাতওয়ারি বরাদ্দের ক্ষেত্রে এবার নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া উচিত স্বাস্থ্য খাতের। দীর্ঘ দিনের অবহেলা ও স্বল্প বরাদ্দের কারণে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা খুবই নাজুক। করোনাভাইরাসসহ যেকোন রোগ ও মহামারীতে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে এ খাত অনেকটাই সক্ষম। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে দ্রুত বিনিয়োগ বাড়িয়ে একে আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের উপযোগী করে তোলা এখন সময়ের দাবি। বর্তমানে এ খাতে আমাদের বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপির এক শতাংশেরও কম। সেটা ৪ থেকে ৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা দরকার। সম্প্রতি আগামী অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্যেরই উন্নয়ন খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা খুবই সীমিত। খাতওয়ারি বিভাজনে স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান সপ্তম স্থানে। আগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কারণেই এ খাতটিকে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির সময়ও দারুণভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে এ খাতে অনেক বড় অংকের থোক বরাদ্দ রেখে সার্বিক বাজেট স্বল্পতাকে মোকাবিলার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। জনগণের জন্য স্বাস্থ্য বীমা নীতি প্রণয়ন ও প্রকল্প চালু করা হবে একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য প্রিমিয়ামে ভর্তুকির বিধান রাখা বাজেট যুক্তিসঙ্গত হবে। এবার বাজেটে বরাদ্দের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেতে পারে কৃষি খাত। করোনার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। অনেক দেশ খাদ্য রফতানি বন্ধ করে দেবে। ফলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংম্ভর হতে হবে। অবশ্য অত্যন্ত আশার কথা যে সম্প্রতি আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে আমাদের খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি। চলতি অর্থবছরে আউশ, আমন ও বোরো ধানের ফলন খুবই ভালো হয়েছে। ফলে আমাদের মোট খাদ্য উৎপাদন ইন্দোনেশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের খাদ্যশস্য উৎপাদনে এখন আমরা চীন ও ভারতের পর তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছি। করোনার প্রভাবে যখন সারা বিশ্বে খাদ্যোৎপাদন স্থবির হয়ে পড়েছে তখন এক্ষেত্রে আমাদের সুদৃঢ় অবস্থান আশার সঞ্চার করবে বৈকি? ভবিষ্যতেও এ অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব। এর জন্য গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উপকরণ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। এই করোনাকালে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষিকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য মোট বাজেটের ন্যূনপক্ষে ১৫ শতাংশ অর্থ বৃহত্তর কৃষি খাতের জন্য (কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, পরিবেশ ও বন, ভূমি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়) বরাদ্দ করা উচিত। বর্তমানে তা ৫.৪ শতাংশ, যা হ্রাস পাচ্ছে বছরের পর বছর।

কৃষি ভর্তুকি খাতে খুবই অনীহা দৃশ্যমান সরকারের বাজেট বরাদ্দের নীতিমালায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ফসল খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। এটি ছিল মোট বাজেটের ৬.৮৯ শতাংশ। এর পর থেকে গত ৭টি বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ স্থির রাখা হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরেও (২০১৯-২০) কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ রাখা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। মোট বাজেটের অংশ হিসেবে তা খুব কিঞ্চিতকর, মাত্র ১.৭ শতাংশ। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারি সহায়তা বাদ দিয়ে উৎপাদিত কৃষিপণ্য মূল্যের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ভর্তুকি দিতে পারে। একটি কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে এর পরিমাণ ১০ শতাংশ ধরে নেয়া হলে আগামী অর্থবছর বৃহত্তর কৃষি খাতে ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা হবে বাজেটের প্রায় ৭ শতাংশ। এ ভর্তুকি দেয়া উচিত দৃশ্যমান পদ্ধতিতে, নগদ টাকা হিসেবে। বর্তমানে প্রচলিত আচ্ছাদিত বা অদৃশ্যমান ভর্তুকি সম্পর্কে সাধারণ কৃষক অবহিত হতে পারে না। এর স্বচ্ছতা সম্পর্কেও প্রশ্ন থাকে। এখন আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি মূলত কৃষি উপকরণ বিতরণের ক্ষেত্রে। কৃষিপণ্যের বিপণনেও এ ভর্তুকি সমভাবে প্রযোজ্য। কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্যও উদারভাবে ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন। কৃষিপণ্যের উৎপাদনে কৃষকের লাভজনকতা নিশ্চিত করতে হলে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। বর্তমান জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। সারের দাম হ্রাস পেয়েছে। তাতে সরকারের যে সাশ্রয় হবে তার পুরোটাই কৃষি বাবদ খরচ করা উচিত।

করোনার প্রভাবে অর্থনীতিতে ধস, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং গরিব মানুষের আয়-রোজগার হ্রাসের কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে। কমপক্ষে দেড় কোটি নিম্নআয়ের পরিবার বা ৬ কোটি মানুষ এখন দারিদ্র্য সীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এদের সবাইকে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দিতে হবে নগদ সহায়তা। বয়স্ক ভাতা বিধবা ভাতার পরিমাণ বাড়াতে হবে। খাদ্য সহায়তা বাড়াতে হবে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য কমপক্ষে আরও শতভাগ সম্প্রসারিত করতে হবে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতা। ভারি ও মাঝারি শিল্পে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলো পুরোদমে চালু করে তাতে মানুষের কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক ইপিজেডগুলো চালু করতে হবে পুরোদমে। গ্রামীণ রাস্তাঘাট মেরামত, খাল খনন, পুকুর খনন, পানি সেচের নালা খনন ইত্যাদি কাজের পরিধি বাড়িয়ে বেকার শ্রমিকদের কাজে লাগাতে হবে। সরকার সম্প্রতি প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চালনের জন্য। এটা আমাদের বর্তমান জিডিপির মাত্র প্রায় চার শতাংশ। অন্যদিকে আমাদের নিকটবর্তী দেশ ভারতের সরকার ঘোষণা করেছে ২০ লক্ষ কোটি রুপির প্রণোদনা প্যাকেজ। সেটা ভারতের জিডিপির ১০ শতাংশ। এ উদাহরণ থেকে আমাদের দুর্দশাগ্রস্ত নাগরিকদের জন্য আরও কত বেশি সহায়তা দেয়া প্রয়োজন তার একটা আভাস পাওয়া যায়। শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাজেট বাড়ানো দরকার। আমাদের শিক্ষা বাজেট ন্যূনপক্ষে জিডিপির চার শতাংশ হওয়া উচিত। তবে এখন করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলে দেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংযত থাকা দরকার। এ ভাইরাসের সহজ চিকিৎসা ও প্রতিশেধক আমাদের করায়ত্ব না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সংযম পালন করতে হবে।

শিল্পে, কলে-কারখানায় ও মাঠে উৎপাদন স্থবিরতার মাঝে প্রণোদনার অর্থ ছড়িয়ে দিলে কিছুটা মূল্যস্ফীতি দেখা দিতে পারে। সরকারের রাজস্ব ঘাটতির মূলে অতিমাত্রায় ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতাও মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিতে পারে। এরই মাঝে অতিমাত্রায় নতুন টাকা বাজারে ছাড়া হলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে ও মূল্যস্ফীতি হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৫ হাজার কোটি টাকা বাজারে ছাড়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে তাই সংযতভাবে বিবেচনা করতে হবে।

আমাদের সাম্প্রতিককালের মূল্যস্ফীতির হার কমবেশি ৬ শতাংশ। এটা খুবই বেশি। ক্রমেই তা ২/৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে উৎপাদনমুখী ও কর্মমুখী খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হলে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।

যতটা জানা যায়, এবারের বাজেটের আকার হতে পারে ৫ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যাবে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। অনুন্নয়ন বাজেটের আকার হবে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের মূল বাজেটের চেয়ে এবারের প্রস্তাবিত বাজেট হবে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা বা ৮ শতাংশ বেশি। এটি খুব বড় প্রবৃদ্ধি নয়। অন্যান্য বছরের ১৫/১৬ শতাংশের তুলনায় এবারের বাজেট বৃদ্ধির হার হবে প্রায় অর্ধেক কম। আমাদের যেখানে চাহিদা অনেক বেশি সেখানে এ বাজেটটি যথেষ্ট আঁটসাঁট হবে মনে হয়। তাতে অপচয়ের আশঙ্কা থাকবে কম। জনগণের অর্থ খরচের গুণগত মান বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে বেশি। সেক্ষেত্রে করোনা বিপর্যস্ত দেশের অভ্যন্তরীণ কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন বৃদ্ধিকেই বেছে নিতে হবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়ানোর একমাত্র পন্থা হিসেবে। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে। তাতে সত্যিকারভাবেই সুরক্ষিত হবে জীবন ও জীবিকা। উন্নত হবে নাগরিক জীবন।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ]

সোমবার, ০১ জুন ২০২০ , ১৮ জৈষ্ঠ ১৪২৭, ৮ শাওয়াল ১৪৪১

করোনার প্রভাব ও আসন্ন বাজেট

ড. জাহাঙ্গীর আলম

মহামারী করোনার অভিঘাতে পৃথিবী এখন টালমাটাল। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এর ভয়াবহ আঘাত লেগেছে অর্থনীতিতে। শিল্পের চাকা ঘুরছে না। কলকারখানা অচল। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। হোটেল-রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট খুলছে না। বাস, ট্রেন, এরোপ্লেন চলছে না। দেশে দেশে মানুষ গৃহবন্দী। এর প্রভাবে বিশ্বের প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে বলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। মোট ৩৩০ কোটি শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে। এদের প্রায় ৬০ শতাংশ মজুরি ইতোমধ্যে হাতছাড়া হয়ে গেছে। তাতে দারিদ্র্য বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি নেমে যাবে শূন্যের কোঠায়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক আশঙ্কা করছে, করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ ৫.৮ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ৮.৮ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ হবে প্রায় ৪৯৩ লাখ থেকে ৭৪৮ লাখ কোটি টাকা। সব মিলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে বিশ্ব জিডিপির ৪ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে তার হিসাবনিকাশ করা সময়ের ব্যাপার। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, করোনার এক ভয়াবহ আঘাত লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। দিনের পর দিন দেশে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। একমাত্র কৃষি ছাড়া আমাদের অর্থনীতির অন্যান্য খাতে এখন দারুণ স্থবিরতা বিরাজ করছে। পোশাক শিল্পের রফতানি আয় কমে গেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আয়ও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ভারি ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো লকডাউনের কবলে পড়ে অনেকটাই নিশ্চল। প্রাণহীন হয়ে পড়েছে সেবা খাত। লাখ লাখ মানুষের অভিপ্রয়াণ ঘটেছে শহর থেকে গ্রামে। অনানুষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত অধিকাংশ মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মহীন। তাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে প্রায় ৬ কোটি মানুষ। তারা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে। অনেকেই হবে ব্যাধি ও ক্ষুধায় শিকার। এমন এক বৈশ্বিক ও রাষ্ট্রিক বেহাল অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে প্রণীত হচ্ছে আমাদের আসন্ন বাজেট। আগামী ১০ জুন মহান জাতীয় সংসদে পেশ করা হবে ২০২০-২১ সালের নয়া বাজেট। এ নিয়ে অনেকেই দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছেন। ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে পেশ করছেন তাদের সুপারিশ। আমার বিবেচনায় এবারের বাজেট হতে হবে গতানুগতিকতার বাইরে। ধারাবাহিকতার ছেদ ঘটিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও নতুন আঙ্গিকে প্রণয়ন করতে হবে এবারের বাজেট। বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং মানুষের জীবন বাঁচানো ও জীবিকার পথ খোলে দেয়াই হবে বাজেটের প্রধান উদ্দেশ্য। জীবন বাঁচানোর জন্য দরকার চিকিৎসা ও খাদ্যের সংস্থান। জীবিকার জন্য দরকার কর্মসংস্থান। সেই সঙ্গে উপনির্বাচনহীন ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর সম্প্রসারণ। দেশের নাগরিকদের মানবিক উন্নয়নের জন্যও থাকতে হবে প্রয়োজনীয় অগ্রাধিকার। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

করোনার প্রভাবে আমাদের চলতি বছরের অর্থনীতির গতি অনেকটাই শ্লথ হয়ে যাবে। তাতে হ্রাস পাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে টানা প্রায় ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। গত বছর ওই ৮ শতাংশের ঘর টপকে উন্নীত হয়েছে ৮.২ শতাংশে। এবার তা অনেকটাই নেমে যাবে বলে ধারণা অনেকের। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন হচ্ছে এবার প্রবৃদ্ধি হবে ২ থেকে ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মাত্র ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছে। তবে উল্লিখিত দুটো উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন গ্রহণ করছেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। তিনি মনে করছেন, এ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ৬ শতাংশ হবে। তবে তার এই প্রাক্কলনও প্রশ্নাতীত নয়। আমাদের দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উল্লম্ফন ঘটে প্রধানত এপ্রিল, মে ও জুন মাসে। অথচ এই ৩ মাসের ২ মাসই দেশের অর্থনীতি লকডাউনে রয়েছে। এ সময় দেশের বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, কর্মহীনতা, আয় ও চাহিদা হ্রাস এবং আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে অনেক বেশি চাপের কারণে আমরা এখন মন্দার মুখোমুখি। তবে এই মন্দাকাল মাত্র ২ থেকে আড়াই মাস পর্যন্ত স্থায়ী হলে অর্থাৎ জুন থেকে অর্থনীতির চাকা সচল হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের উপরে হতে পারে। এবার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮.২৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রসারিত হচ্ছে মূলত দুটো ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। এর একটা পোশাক খাত এবং অন্যটি রেমিটেন্স আয়। বাংলাদেশে যে রফতানি আয় হয় তার শতকরা ৮০ ভাগই আসে পোশাক রফতানি থেকে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রফতানি খাতে স্থবিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আয় হয়েছে ২ হাজার ৯৫০ কোটি ডলার, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম। গত এপ্রিলে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে মাত্র ৫২ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮২ শতাংশ কম। আমাদের তৈরি পোশাকের বড় বাজার আমেরিকা ও ইউরোপে এখন ব্যাপক মন্দা। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রফতানি। করোনার প্রভাব চলে গেলে আমাদের চিরায়ত বাজার পুনরুদ্ধার করতে হবে। নতুন বাজার খুঁজতে হবে। তাছাড়া পোশাক তৈরিতে আমাদের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুলে ধরতে হবে। অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অপর গুরুত্বপূর্ণ খাত রেমিট্যান্স প্রবাহ সম্প্রতি দারুণভাবে কমে গেছে। গত এপ্রিল মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা মাত্র ১০৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৩৫ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ কম। করোনার প্রভাবে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কমতে শুরু করে রেমিটেন্স প্রবাহ। ওই মাসে বিদেশ থেকে আসে ১৪৫ কোটি ডলার। মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ১১৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার ৫শ’ থেকে ১ হাজার ৬শ’ কোটি ডলার রেমিটেন্স আসে। এর ৫৮ শতাংশই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। করোনার প্রভাবে সেখানে এখন মন্দা চলছে। তাছাড়া জ্বালানি আয় কমে যাওয়ায় ওই দেশগুলোর আয় কমে গেছে। ফলে সেখানে ছাঁটাই চলছে বাংলাদেশি শ্রমিকের। ইউরোপ ও আমেরিকাতেও অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। তাছাড়া সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় কর্মরত শ্রমিকরাও কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কোভিড-১৯ ওই সব দেশে হানা দিলে জীবন বাঁচাতে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরা শুরু হয়। এ সময় ২ লাখেরও বেশি প্রবাসী দেশে ফিরে আসেন। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক আশঙ্কা করছে, অন্তত ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক করোনার প্রভাবে কর্মচ্যুত হবেন। করোনা পরবর্তীকালে এদের জন্য নতুন বাজার খুঁজতে হবে। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। আপাতত এদেরকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে দেশের ভেতর আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। গত বাজেটে চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ৮.২৫ শতাংশ। এার ধারাবাহিকতায় আগামী বছর তা হতে ৮.৫ শতাংশ। তবে করোনার প্রভাবে এখন অর্থনীতির যে বেহাল দশা তা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগবে। আগামী বাজেটে তাই পরিমিতিবোধ সম্পন্ন একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। সে লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৭.৫ শতাংশ।

খাতওয়ারি বরাদ্দের ক্ষেত্রে এবার নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া উচিত স্বাস্থ্য খাতের। দীর্ঘ দিনের অবহেলা ও স্বল্প বরাদ্দের কারণে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা খুবই নাজুক। করোনাভাইরাসসহ যেকোন রোগ ও মহামারীতে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে এ খাত অনেকটাই সক্ষম। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে দ্রুত বিনিয়োগ বাড়িয়ে একে আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের উপযোগী করে তোলা এখন সময়ের দাবি। বর্তমানে এ খাতে আমাদের বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপির এক শতাংশেরও কম। সেটা ৪ থেকে ৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা দরকার। সম্প্রতি আগামী অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্যেরই উন্নয়ন খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা খুবই সীমিত। খাতওয়ারি বিভাজনে স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান সপ্তম স্থানে। আগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কারণেই এ খাতটিকে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির সময়ও দারুণভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে এ খাতে অনেক বড় অংকের থোক বরাদ্দ রেখে সার্বিক বাজেট স্বল্পতাকে মোকাবিলার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। জনগণের জন্য স্বাস্থ্য বীমা নীতি প্রণয়ন ও প্রকল্প চালু করা হবে একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য প্রিমিয়ামে ভর্তুকির বিধান রাখা বাজেট যুক্তিসঙ্গত হবে। এবার বাজেটে বরাদ্দের দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেতে পারে কৃষি খাত। করোনার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। অনেক দেশ খাদ্য রফতানি বন্ধ করে দেবে। ফলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংম্ভর হতে হবে। অবশ্য অত্যন্ত আশার কথা যে সম্প্রতি আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে আমাদের খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি। চলতি অর্থবছরে আউশ, আমন ও বোরো ধানের ফলন খুবই ভালো হয়েছে। ফলে আমাদের মোট খাদ্য উৎপাদন ইন্দোনেশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের খাদ্যশস্য উৎপাদনে এখন আমরা চীন ও ভারতের পর তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছি। করোনার প্রভাবে যখন সারা বিশ্বে খাদ্যোৎপাদন স্থবির হয়ে পড়েছে তখন এক্ষেত্রে আমাদের সুদৃঢ় অবস্থান আশার সঞ্চার করবে বৈকি? ভবিষ্যতেও এ অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব। এর জন্য গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উপকরণ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। এই করোনাকালে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষিকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য মোট বাজেটের ন্যূনপক্ষে ১৫ শতাংশ অর্থ বৃহত্তর কৃষি খাতের জন্য (কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, পরিবেশ ও বন, ভূমি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়) বরাদ্দ করা উচিত। বর্তমানে তা ৫.৪ শতাংশ, যা হ্রাস পাচ্ছে বছরের পর বছর।

কৃষি ভর্তুকি খাতে খুবই অনীহা দৃশ্যমান সরকারের বাজেট বরাদ্দের নীতিমালায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ফসল খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। এটি ছিল মোট বাজেটের ৬.৮৯ শতাংশ। এর পর থেকে গত ৭টি বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ স্থির রাখা হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরেও (২০১৯-২০) কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ রাখা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। মোট বাজেটের অংশ হিসেবে তা খুব কিঞ্চিতকর, মাত্র ১.৭ শতাংশ। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারি সহায়তা বাদ দিয়ে উৎপাদিত কৃষিপণ্য মূল্যের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ভর্তুকি দিতে পারে। একটি কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে এর পরিমাণ ১০ শতাংশ ধরে নেয়া হলে আগামী অর্থবছর বৃহত্তর কৃষি খাতে ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা হবে বাজেটের প্রায় ৭ শতাংশ। এ ভর্তুকি দেয়া উচিত দৃশ্যমান পদ্ধতিতে, নগদ টাকা হিসেবে। বর্তমানে প্রচলিত আচ্ছাদিত বা অদৃশ্যমান ভর্তুকি সম্পর্কে সাধারণ কৃষক অবহিত হতে পারে না। এর স্বচ্ছতা সম্পর্কেও প্রশ্ন থাকে। এখন আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি মূলত কৃষি উপকরণ বিতরণের ক্ষেত্রে। কৃষিপণ্যের বিপণনেও এ ভর্তুকি সমভাবে প্রযোজ্য। কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্যও উদারভাবে ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন। কৃষিপণ্যের উৎপাদনে কৃষকের লাভজনকতা নিশ্চিত করতে হলে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। বর্তমান জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। সারের দাম হ্রাস পেয়েছে। তাতে সরকারের যে সাশ্রয় হবে তার পুরোটাই কৃষি বাবদ খরচ করা উচিত।

করোনার প্রভাবে অর্থনীতিতে ধস, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং গরিব মানুষের আয়-রোজগার হ্রাসের কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে। কমপক্ষে দেড় কোটি নিম্নআয়ের পরিবার বা ৬ কোটি মানুষ এখন দারিদ্র্য সীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এদের সবাইকে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দিতে হবে নগদ সহায়তা। বয়স্ক ভাতা বিধবা ভাতার পরিমাণ বাড়াতে হবে। খাদ্য সহায়তা বাড়াতে হবে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য কমপক্ষে আরও শতভাগ সম্প্রসারিত করতে হবে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতা। ভারি ও মাঝারি শিল্পে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলো পুরোদমে চালু করে তাতে মানুষের কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক ইপিজেডগুলো চালু করতে হবে পুরোদমে। গ্রামীণ রাস্তাঘাট মেরামত, খাল খনন, পুকুর খনন, পানি সেচের নালা খনন ইত্যাদি কাজের পরিধি বাড়িয়ে বেকার শ্রমিকদের কাজে লাগাতে হবে। সরকার সম্প্রতি প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চালনের জন্য। এটা আমাদের বর্তমান জিডিপির মাত্র প্রায় চার শতাংশ। অন্যদিকে আমাদের নিকটবর্তী দেশ ভারতের সরকার ঘোষণা করেছে ২০ লক্ষ কোটি রুপির প্রণোদনা প্যাকেজ। সেটা ভারতের জিডিপির ১০ শতাংশ। এ উদাহরণ থেকে আমাদের দুর্দশাগ্রস্ত নাগরিকদের জন্য আরও কত বেশি সহায়তা দেয়া প্রয়োজন তার একটা আভাস পাওয়া যায়। শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাজেট বাড়ানো দরকার। আমাদের শিক্ষা বাজেট ন্যূনপক্ষে জিডিপির চার শতাংশ হওয়া উচিত। তবে এখন করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলে দেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংযত থাকা দরকার। এ ভাইরাসের সহজ চিকিৎসা ও প্রতিশেধক আমাদের করায়ত্ব না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সংযম পালন করতে হবে।

শিল্পে, কলে-কারখানায় ও মাঠে উৎপাদন স্থবিরতার মাঝে প্রণোদনার অর্থ ছড়িয়ে দিলে কিছুটা মূল্যস্ফীতি দেখা দিতে পারে। সরকারের রাজস্ব ঘাটতির মূলে অতিমাত্রায় ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতাও মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিতে পারে। এরই মাঝে অতিমাত্রায় নতুন টাকা বাজারে ছাড়া হলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে ও মূল্যস্ফীতি হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৫ হাজার কোটি টাকা বাজারে ছাড়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে তাই সংযতভাবে বিবেচনা করতে হবে।

আমাদের সাম্প্রতিককালের মূল্যস্ফীতির হার কমবেশি ৬ শতাংশ। এটা খুবই বেশি। ক্রমেই তা ২/৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে উৎপাদনমুখী ও কর্মমুখী খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হলে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।

যতটা জানা যায়, এবারের বাজেটের আকার হতে পারে ৫ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যাবে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। অনুন্নয়ন বাজেটের আকার হবে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের মূল বাজেটের চেয়ে এবারের প্রস্তাবিত বাজেট হবে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা বা ৮ শতাংশ বেশি। এটি খুব বড় প্রবৃদ্ধি নয়। অন্যান্য বছরের ১৫/১৬ শতাংশের তুলনায় এবারের বাজেট বৃদ্ধির হার হবে প্রায় অর্ধেক কম। আমাদের যেখানে চাহিদা অনেক বেশি সেখানে এ বাজেটটি যথেষ্ট আঁটসাঁট হবে মনে হয়। তাতে অপচয়ের আশঙ্কা থাকবে কম। জনগণের অর্থ খরচের গুণগত মান বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে বেশি। সেক্ষেত্রে করোনা বিপর্যস্ত দেশের অভ্যন্তরীণ কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন বৃদ্ধিকেই বেছে নিতে হবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়ানোর একমাত্র পন্থা হিসেবে। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে। তাতে সত্যিকারভাবেই সুরক্ষিত হবে জীবন ও জীবিকা। উন্নত হবে নাগরিক জীবন।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ]