জিন্নার মুখের ওপর ‘না’

মোস্তাফা জব্বার

সাতচল্লিশ সালের আগস্ট মাসে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেবার পরপরই মুসলিম প্রধান পূর্ব পাকিস্তানে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ বা তার রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের বিপক্ষে কোন রাজনৈতিক শক্তির জন্ম নেয়াটা অসাধ্য কাজ ছিল। সেই সময় অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মের ঠিক পর মুহূর্তে জিন্না ও মুসলিম লীগের বিপক্ষে দাঁড়ানো একটি চরম দুঃসাহসের ব্যাপার ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অতি দূরদর্শিতার সঙ্গে সেই কাজটি করেন এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে সামনে এনে একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্যজাত পাকিস্তানের কারাগারে জীবনে প্রথমবারের মতো জেল খেটে বের হয়ে এসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন আরও বেগবান করে তোলার উদ্যোগ নিলেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পুকুর ধারে একটি ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। গাজীউল হক আন্দোলনের ওই পর্বে উক্ত সভার গুরুত্ব মূল্যায়ন করে লিখেছেন, ‘পুলিশি জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ছাত্র জনতার যে সমাবেশ কর্মসূচি ছিল সেটি শুধু প্রতিবাদ সমাবেশ হিসেবে শেষ হতে পারতো। কিন্তু সমাবেশের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সমাবেশ সংক্ষিপ্ত হয় এবং অ্যাসেম্বলি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেওয়া হয়- যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন আরও এগিয়ে যায়।’ ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভা সম্পর্কে তৎকালীন আর একজন ছাত্র নেতা তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়রিতে লিখেছেন, ‘১৬ মার্চ ৪৮ মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা দেড়টায় শুরু হলো। মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করলেন। সভায় নিম্নোক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়।

১। ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় পুলিশি বাড়াবাড়ি সম্পর্কে সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা ২। পরিষদে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব রাখার জন্য দিন ধার্য ৩। সংবিধান সভায় উপরোক্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হইলে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করা।

এ প্রস্তাবনাগুলো গৃহীত হলো এবং অলি আহাদের মাধ্যমে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলো। যদিও সংগ্রাম কমিটির কোন কর্মসূচি ছিল না, তবুও অ্যাসেম্বলি হাউজ অভিমুখে ছাত্রদের একটা বিক্ষোভ মিছিল পরিচালিত হল এবং সরকারি দলের এমএলএদের নিন্দা করে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করল। অনুরোধ সত্ত্বেও ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করা গেল না।’ তৎকালীন ছাত্রনেতা অলি আহাদের লেখাতে ১৬ মার্চের ঘটনাবলির একটি চিত্র ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘আন্দোলন যাহাতে ফাটল বা অনৈক্য সৃষ্টি হইতে না পারে সেজন্য আমরা ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় এক সাধারণ ছাত্র সভা আহ্বান করি। সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করেন। উক্ত সভার বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে পরিষদ ভবন গেটে আমরা প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হইলে কয়েক মিনিটের মধ্যে স্থান পরিত্যাগ করিতে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করিয়া পুলিশবাহিনী হিংস্র মূর্তি ধারণ করে আমাদের ওপর লাঠিচার্জ আরম্ভ করিয়া দেয়। মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হইয়া কিছু অংশ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এবং কিছু অংশ সলিমুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হলের মধ্যবর্তী মাঠে জমায়েত হয়।’ (২৭) এসব ঘটনা এটি স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জন্ম কাঠামোর সূচনাতেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার সংগ্রাম শুরু করেন। পাকিস্তানের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে তার অন্তরের আবেগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে আন্দোলন করাটা ছিল একটি অসাধারণ দূরদর্শিতা। সেই আন্দোলন পাকিস্তানিদের নির্যাতন ও অত্যাচারের চেহারাও ফুটিয়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুসহ ছাত্র নেতাদের জেলে ঢোকানো ছাড়াও গণপরিষদ ভবনের সামনে ছাত্রদের ওপর হামলা করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিরা তাদের স্বৈরাচারী চরিত্রের বহিপ্রকাশ ঘটায়। এই আন্দোলন বেগবান করতে জিন্নাহর ঢাকা সফর অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সাত মাস পর ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসেন। এটি ছিল পূর্ব বাংলায় তার প্রথম এবং শেষ সফর।

২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল পূর্ববাংলার ছাত্র-জনতার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা প্রদান করলে জনগণ বিশেষ করে ছাত্ররা দারুণভাবে হতাশ হয়। জিন্নাহর বক্তৃতা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় বিচ্ছিন্নভাবে। এরপর ২৪ মার্চ সকালে জিন্নাহর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে পুনরায় ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ ঘোষণা দিলে সেখানেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক ছাত্র তরুণ ‘নো’, ‘নো’ বলে প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারণ করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে অন্ধ আবেগ ও মোহ থাকার কারণে সে মুহূর্তে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেলের পূর্ববাংলার আগমন এবং অনুষ্ঠিত জনসভার গুরুত্ব ও পরিবেশেই ছিল আলাদা। এই জনসভায় জিন্নার কোন কথার প্রতিবাদ হতে পারে তা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু পূর্ববাংলার তরুণদের এক অংশ এ জনসভার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর ঘোষণাকে বিনা প্রতিবাদে ছেড়ে দেননি। সেদিন তা মৃদুস্বরে হলেও পরদিন তা ব্যাপকতা লাভ করে। পরদিন অর্থাৎ ২২ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান নির্ধারিত ছিল। তবে ছাত্রনেতারা সমাবর্তনের অনুষ্ঠানেও জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা উর্দু সম্পর্কে যে কোনো বক্তব্যের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত মনে মনে নিয়ে রাখেন। জিন্নাহ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তার ভাষণে আগের দিনের মতো কেবল উর্দ্ইু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, ঘোষণা প্রদান করলে পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছাত্রদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাৎক্ষণিকভাবে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে থাকেন। জিন্নাহর ভাষণ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশ শান্ত হলে তিনি ভাষণ সমাপ্তি করেন, তবে ভাষণের এ অংশের সুর নরম এবং সংযত। পরে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে স্মারকলিপি দাখিল করা হয়।’ কিন্তু জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ছিলেন অনমনীয়। পর পর দু’দিন জিন্নাহর ভাষণে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণাকে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজের প্রতিবাদী অংশ তাৎক্ষণিকভাবে বিরোধিতা করবে এ ধারণা সরকার এবং জিন্নাহর কাছে ছিল অকল্পনীয়। তবে জিন্নার বক্তব্যের প্রকাশ্য প্রতিবাদ যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক চরিত্রের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার উদীয়মান গণতান্ত্রিক শক্তির ক্রমবর্ধমান উত্থানের ¯পষ্ট লক্ষণ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে তা পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সরকার বুঝতে পারেনি। পূর্ব বাংলার তরুণ ছাত্রদের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ একটি শক্তির উন্মেষ ঘটতে শুরু করে যা পরবর্তীকালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।

এদিকে জিন্নার বক্তৃতার কয়েকদিন পর ফজলুল হক হলের সামনে একজন ছাত্রনেতা উর্দুভাষার পক্ষে বক্তৃতা দিলে শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র প্রতিবাদ জানান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানতে পারি: ‘জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করছিল, তার নাম আমার মনে নাই। তবে সে বলেছিল, ‘জিন্নাহ যা বলবেন তাই আমাদের মানতে হবে।’ আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম, আজও আমার এই কথাটা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তা প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপান্ন জন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি। সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল।’ [পৃ ৯৯-১০০]

রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে লাগলো। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেই সব ছাত্রনেতার মধ্যে মুজিব ছিলেন অন্যতম। শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দুবার গ্রেপ্তার হন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। ভাষাসৈনিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন: শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুযারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিযেেছন।’ [তথ্যসূত্র :

——ভালোবাসি মাতৃভাষা- পৃষ্ঠা: ৬২]

পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকেও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি। ১৯৫১ সালের ১৩ নভেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঐদিন সকাল ৯টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আনোয়ারা বেগম এমএনএ, খয়রাত হোসেন এমএনএ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আহমদ হোসাইনসহ ৩০ জনের মতো মেডিকেল ছাত্র তার সঙ্গে দেখা করেন। [খণ্ড-২, পৃ ১১৬]

এরপর প্রতিবেদনের আরেকটি জায়গায় বলা হচ্ছে যে, ১৯৫১ সালের ৩০ নভেম্বর সকাল ৯১৫তে কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান ও জনৈক নজরুল ইসলাম শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা সেখানে ৩০ মিনিট আলাপ করেন। [খণ্ড-২, পৃ ১২৩]

ঢাকা। ২৯ আগস্ট, ২০২০।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ,  কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১১ মহররম ১৪৪২, ১৫ ভাদ্র ১৪২৭

জিন্নার মুখের ওপর ‘না’

মোস্তাফা জব্বার

সাতচল্লিশ সালের আগস্ট মাসে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেবার পরপরই মুসলিম প্রধান পূর্ব পাকিস্তানে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ বা তার রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের বিপক্ষে কোন রাজনৈতিক শক্তির জন্ম নেয়াটা অসাধ্য কাজ ছিল। সেই সময় অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মের ঠিক পর মুহূর্তে জিন্না ও মুসলিম লীগের বিপক্ষে দাঁড়ানো একটি চরম দুঃসাহসের ব্যাপার ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অতি দূরদর্শিতার সঙ্গে সেই কাজটি করেন এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে সামনে এনে একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্যজাত পাকিস্তানের কারাগারে জীবনে প্রথমবারের মতো জেল খেটে বের হয়ে এসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন আরও বেগবান করে তোলার উদ্যোগ নিলেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পুকুর ধারে একটি ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। গাজীউল হক আন্দোলনের ওই পর্বে উক্ত সভার গুরুত্ব মূল্যায়ন করে লিখেছেন, ‘পুলিশি জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে ছাত্র জনতার যে সমাবেশ কর্মসূচি ছিল সেটি শুধু প্রতিবাদ সমাবেশ হিসেবে শেষ হতে পারতো। কিন্তু সমাবেশের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সমাবেশ সংক্ষিপ্ত হয় এবং অ্যাসেম্বলি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেওয়া হয়- যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন আরও এগিয়ে যায়।’ ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভা সম্পর্কে তৎকালীন আর একজন ছাত্র নেতা তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়রিতে লিখেছেন, ‘১৬ মার্চ ৪৮ মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা দেড়টায় শুরু হলো। মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করলেন। সভায় নিম্নোক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়।

১। ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় পুলিশি বাড়াবাড়ি সম্পর্কে সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা ২। পরিষদে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব রাখার জন্য দিন ধার্য ৩। সংবিধান সভায় উপরোক্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হইলে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করা।

এ প্রস্তাবনাগুলো গৃহীত হলো এবং অলি আহাদের মাধ্যমে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলো। যদিও সংগ্রাম কমিটির কোন কর্মসূচি ছিল না, তবুও অ্যাসেম্বলি হাউজ অভিমুখে ছাত্রদের একটা বিক্ষোভ মিছিল পরিচালিত হল এবং সরকারি দলের এমএলএদের নিন্দা করে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করল। অনুরোধ সত্ত্বেও ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করা গেল না।’ তৎকালীন ছাত্রনেতা অলি আহাদের লেখাতে ১৬ মার্চের ঘটনাবলির একটি চিত্র ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘আন্দোলন যাহাতে ফাটল বা অনৈক্য সৃষ্টি হইতে না পারে সেজন্য আমরা ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় এক সাধারণ ছাত্র সভা আহ্বান করি। সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করেন। উক্ত সভার বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে পরিষদ ভবন গেটে আমরা প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হইলে কয়েক মিনিটের মধ্যে স্থান পরিত্যাগ করিতে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করিয়া পুলিশবাহিনী হিংস্র মূর্তি ধারণ করে আমাদের ওপর লাঠিচার্জ আরম্ভ করিয়া দেয়। মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হইয়া কিছু অংশ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এবং কিছু অংশ সলিমুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হলের মধ্যবর্তী মাঠে জমায়েত হয়।’ (২৭) এসব ঘটনা এটি স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জন্ম কাঠামোর সূচনাতেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার সংগ্রাম শুরু করেন। পাকিস্তানের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে তার অন্তরের আবেগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে আন্দোলন করাটা ছিল একটি অসাধারণ দূরদর্শিতা। সেই আন্দোলন পাকিস্তানিদের নির্যাতন ও অত্যাচারের চেহারাও ফুটিয়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুসহ ছাত্র নেতাদের জেলে ঢোকানো ছাড়াও গণপরিষদ ভবনের সামনে ছাত্রদের ওপর হামলা করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিরা তাদের স্বৈরাচারী চরিত্রের বহিপ্রকাশ ঘটায়। এই আন্দোলন বেগবান করতে জিন্নাহর ঢাকা সফর অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সাত মাস পর ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসেন। এটি ছিল পূর্ব বাংলায় তার প্রথম এবং শেষ সফর।

২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল পূর্ববাংলার ছাত্র-জনতার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা প্রদান করলে জনগণ বিশেষ করে ছাত্ররা দারুণভাবে হতাশ হয়। জিন্নাহর বক্তৃতা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় বিচ্ছিন্নভাবে। এরপর ২৪ মার্চ সকালে জিন্নাহর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে পুনরায় ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ ঘোষণা দিলে সেখানেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক ছাত্র তরুণ ‘নো’, ‘নো’ বলে প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারণ করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে অন্ধ আবেগ ও মোহ থাকার কারণে সে মুহূর্তে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেলের পূর্ববাংলার আগমন এবং অনুষ্ঠিত জনসভার গুরুত্ব ও পরিবেশেই ছিল আলাদা। এই জনসভায় জিন্নার কোন কথার প্রতিবাদ হতে পারে তা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু পূর্ববাংলার তরুণদের এক অংশ এ জনসভার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর ঘোষণাকে বিনা প্রতিবাদে ছেড়ে দেননি। সেদিন তা মৃদুস্বরে হলেও পরদিন তা ব্যাপকতা লাভ করে। পরদিন অর্থাৎ ২২ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান নির্ধারিত ছিল। তবে ছাত্রনেতারা সমাবর্তনের অনুষ্ঠানেও জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা উর্দু সম্পর্কে যে কোনো বক্তব্যের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত মনে মনে নিয়ে রাখেন। জিন্নাহ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তার ভাষণে আগের দিনের মতো কেবল উর্দ্ইু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, ঘোষণা প্রদান করলে পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছাত্রদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাৎক্ষণিকভাবে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে থাকেন। জিন্নাহর ভাষণ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশ শান্ত হলে তিনি ভাষণ সমাপ্তি করেন, তবে ভাষণের এ অংশের সুর নরম এবং সংযত। পরে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে স্মারকলিপি দাখিল করা হয়।’ কিন্তু জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ছিলেন অনমনীয়। পর পর দু’দিন জিন্নাহর ভাষণে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণাকে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজের প্রতিবাদী অংশ তাৎক্ষণিকভাবে বিরোধিতা করবে এ ধারণা সরকার এবং জিন্নাহর কাছে ছিল অকল্পনীয়। তবে জিন্নার বক্তব্যের প্রকাশ্য প্রতিবাদ যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক চরিত্রের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার উদীয়মান গণতান্ত্রিক শক্তির ক্রমবর্ধমান উত্থানের ¯পষ্ট লক্ষণ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে তা পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সরকার বুঝতে পারেনি। পূর্ব বাংলার তরুণ ছাত্রদের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ একটি শক্তির উন্মেষ ঘটতে শুরু করে যা পরবর্তীকালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।

এদিকে জিন্নার বক্তৃতার কয়েকদিন পর ফজলুল হক হলের সামনে একজন ছাত্রনেতা উর্দুভাষার পক্ষে বক্তৃতা দিলে শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র প্রতিবাদ জানান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানতে পারি: ‘জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করছিল, তার নাম আমার মনে নাই। তবে সে বলেছিল, ‘জিন্নাহ যা বলবেন তাই আমাদের মানতে হবে।’ আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম, আজও আমার এই কথাটা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তা প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপান্ন জন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি। সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল।’ [পৃ ৯৯-১০০]

রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে লাগলো। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেই সব ছাত্রনেতার মধ্যে মুজিব ছিলেন অন্যতম। শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দুবার গ্রেপ্তার হন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। ভাষাসৈনিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন: শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুযারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিযেেছন।’ [তথ্যসূত্র :

——ভালোবাসি মাতৃভাষা- পৃষ্ঠা: ৬২]

পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকেও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি। ১৯৫১ সালের ১৩ নভেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঐদিন সকাল ৯টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আনোয়ারা বেগম এমএনএ, খয়রাত হোসেন এমএনএ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আহমদ হোসাইনসহ ৩০ জনের মতো মেডিকেল ছাত্র তার সঙ্গে দেখা করেন। [খণ্ড-২, পৃ ১১৬]

এরপর প্রতিবেদনের আরেকটি জায়গায় বলা হচ্ছে যে, ১৯৫১ সালের ৩০ নভেম্বর সকাল ৯১৫তে কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান ও জনৈক নজরুল ইসলাম শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা সেখানে ৩০ মিনিট আলাপ করেন। [খণ্ড-২, পৃ ১২৩]

ঢাকা। ২৯ আগস্ট, ২০২০।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ,  কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com