ইনকন্ট্রেড কনটেইনার ডিপোতে গাড়ির তেলের ট্যাংক ওয়েল্ডিং করার সময় বিস্ফোরণে দগ্ধ আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা এলাকায় গত বুধবার এ ভয়বহ বিস্ফোরণে সর্বমোট চার শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তিনজন ঘটনাস্থলে দগ্ধ হয়ে মারা গেলেও মো. রবিউল নামে আরেক জন বুধবার রাতে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. এস খালেদ জানান, আহত রবিউলের ৯৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল।
গত বুধবার ও গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, ওই ডিপোর ওয়ার্কশপে গত বুধবার ডিজেল ট্যাংক বিস্ফোরণে মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় আগুন। অথচ দুর্ঘটনাস্থলের প্রায় ২০ গজ দূরেই ছিল ডিপোটির ডিজেল পাম্প! তাছাড়া ঘটনাস্থলে থাকা ট্রাক-কন্টেইনারবাহী (এফএলটি) ক্রেনগুলোতে মজুদ ছিল ২০০ থেকে ২৫০ লিটার ডিজেলের ট্যাংক। একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটলে লেবাননের বৈরুতের মতো বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো চট্টগ্রামে। আর ঝুঁকিতে পড়তো আশপাশের চট্টগ্রাম বন্দরসহ পার্শ¦বর্তী অনেক কেপিআই স্থাপনাসমূহ।
অভিযোগ উঠেছে, এই আগুন নেভানোর কাজে ডিপোটির অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো ঠিক মতো কাজ করেনি। ডিপো শ্রমিকদের অভিযোগ, দ্রুতগতির এই আগুন নেভাতে সেখানে মজুদ থাকা যেসব অগ্নিনির্বাপক ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছিল, তার বেশিরভাগই ছিল অকেজো। তাৎক্ষণিক কাজ করেনি ঘটনাস্থলেই থাকা অগ্নিনির্বাপক পানির কলটি। তাছাড়া একে একে ১০টির বেশি অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হলেও সেগুলো ছিল মূলত খালি। ঘটনাস্থলেই আগুনে পুড়ে ৩ জনের বীভৎস মৃত্যুর পর অগ্নিদগ্ধ বাকি ৩ জনকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সহকর্মীরা। ডিপো থেকে একটি গাড়ি (কার/মাইক্রো) চাইলেও তাদের দেয়া হয়েছিল ৩ চাকার একটি টমটম।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানান, চোখের সামনে মুহূর্তেই পুড়ে অঙ্গার হয় মুক্তার, আরমান ও নেওয়াজ। পাশাপাশি আগুনে পোড়া যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করছিলেন-রবিউল, আমির ও আরও একজন। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে একটি গাড়ি চাইলে তাও দেয়া হয়নি। অন্যদিকে ডিপোতে নেই একটিও অ্যাম্বুলেন্স। যদিও রবিউল রাতে মারা যান সেই দুর্ঘটনায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিপোটিতে কর্মরত একজন বলেন, এত বড় ডিপোতে সব পানির কল নষ্ট। ১৪টি অগ্নিনির্বাপন সিলিন্ডার আনা হলেও কাজ করেছে মাত্র দু’টি। শুনলাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িও দেয়নি।
এসব বিষয় তাৎক্ষণিক পরীক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, আগুন নেভাতে পানি আনা হয়েছিল মেইন গেটের ওদিক থেকে। যা ছিল ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে। অথচ কাজ করেনি ঘটনাস্থলের পাশেই থাকা অগ্নিনির্বাপক কলটি। এতে করে আগুন নেভানোর পানি টানতেই লেগে যায় ১৫/২০ মিনিট। অথচ তাৎক্ষণিক পানি কিংবা অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার পেলে বাঁচানো যেত অন্তত আরও তাজা ১টি প্রাণ। তাছাড়া ডিপোটির ভেতরে থাকা সব মেয়াদোত্তীর্ণ অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সরিয়ে ফেলেছে কর্তৃপক্ষ। রয়েছে এমন অভিযোগও।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের একটি সূত্র বলছে, ওই ডিজেলে ট্যাংকটির মুখ বন্ধ রেখেই ঝালাই কাজ করা হচ্ছিল। ফলে ট্যাংকে জমে থাকা গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। পুলিশের বক্তব্যও একই। তবে ফায়ার সার্ভিসের ওই সূত্রটি বলছে, শুধুমাত্র ট্যাংকের গ্যাসে এতো ভয়াবহ বিস্ফোরণের সম্ভবনা কম। পাশাপাশি দুর্ঘটনার স্থানেই নিচে পড়ন্ত তেল, ডিজেল, আবদ্ধ ডিজেল ট্যাংক এবং ওয়েল্ডিংয়ের আগুনে শিখা একযোগে এই দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
সংস্থাটির প্রাথমিক বিবরণীতে বলা হয়েছে- বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বুধবার সাড়ে ১১টায়। তারা এই খবর পায় ১১টা ৩৫ মিনিটে। ঠিক ১৩ মিনিট পর অর্থাৎ ১১টা ৪৮ মিনিটে পৌঁছায় সংস্থাটির ১টি অ্যাম্বুলেন্সসহ দুইটি অগ্নিনির্বাপক গাড়ি। এদিকে ডিপোটির এতো সব স্পর্শকাতর অভিযোগের পরেও নিহত হওয়া শ্রমিকদের উপরই সব দায় ঠেলে দেয় কর্তৃপক্ষ। এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইনকন্ট্রেড কনটেইনার ডিপোর ব্যবস্থাপক (ওয়ার্কশপ) মো. ইয়াসিন বলেন, যে মিস্ত্রি কাজ করছে ঢাকনাটা (ডিজেল ট্যাংকের মুখ) খুলে নাই। ওর গাফিলতিটাই এখানে মূল (কারণ)।
ডিপোর অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার এবং ঘটনাস্থলের কাছেই থাকা অগ্নিনির্বাপক কলটি অকেজো থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা ওগুলা দিয়েই তো নিভিয়েছি। তবে গেইটের কাছে থাকা অন্য একটি অগ্নিনির্বাপক কল থেকে পানি টেনে এনে আগুন নিভানো হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওইখানে (দুর্ঘটনাস্থানেই) যে ফায়ার সেইফটি কলটা ছিল ওইটা স্টার্ট (চালু) হয়তে একটু সময় লাগছে। অগ্নিদগ্ধ শ্রমিকদের গাড়ি (কার/মাইক্রো) না দিয়ে তিন চাকার টমটম দেয়ার ব্যাপারটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাড়ি মানে... তাৎক্ষণিক যেটা ছিল ওইটা দিয়েছি আরকি। ওই টমটমটিও আমাদের নিজস্ব গাড়ি।
পতেঙ্গা থানার ওসি মোহাম্মদ জোবাইর সৈয়দ বলেন, আহত রবিউল ঢাকায় একটি হাসপাতালে রাতে মারা গেছেন বলে শুনেছি। তবে তাদের আত্মীয়-স্বজনের মোবাইল নাম্বার বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করতে পারছি না।
শুক্রবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ১৪ মহররম ১৪৪২, ১৮ ভাদ্র ১৪২৭
নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ইনকন্ট্রেড কনটেইনার ডিপোতে গাড়ির তেলের ট্যাংক ওয়েল্ডিং করার সময় বিস্ফোরণে দগ্ধ আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা এলাকায় গত বুধবার এ ভয়বহ বিস্ফোরণে সর্বমোট চার শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তিনজন ঘটনাস্থলে দগ্ধ হয়ে মারা গেলেও মো. রবিউল নামে আরেক জন বুধবার রাতে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. এস খালেদ জানান, আহত রবিউলের ৯৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল।
গত বুধবার ও গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, ওই ডিপোর ওয়ার্কশপে গত বুধবার ডিজেল ট্যাংক বিস্ফোরণে মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় আগুন। অথচ দুর্ঘটনাস্থলের প্রায় ২০ গজ দূরেই ছিল ডিপোটির ডিজেল পাম্প! তাছাড়া ঘটনাস্থলে থাকা ট্রাক-কন্টেইনারবাহী (এফএলটি) ক্রেনগুলোতে মজুদ ছিল ২০০ থেকে ২৫০ লিটার ডিজেলের ট্যাংক। একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটলে লেবাননের বৈরুতের মতো বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো চট্টগ্রামে। আর ঝুঁকিতে পড়তো আশপাশের চট্টগ্রাম বন্দরসহ পার্শ¦বর্তী অনেক কেপিআই স্থাপনাসমূহ।
অভিযোগ উঠেছে, এই আগুন নেভানোর কাজে ডিপোটির অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো ঠিক মতো কাজ করেনি। ডিপো শ্রমিকদের অভিযোগ, দ্রুতগতির এই আগুন নেভাতে সেখানে মজুদ থাকা যেসব অগ্নিনির্বাপক ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছিল, তার বেশিরভাগই ছিল অকেজো। তাৎক্ষণিক কাজ করেনি ঘটনাস্থলেই থাকা অগ্নিনির্বাপক পানির কলটি। তাছাড়া একে একে ১০টির বেশি অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হলেও সেগুলো ছিল মূলত খালি। ঘটনাস্থলেই আগুনে পুড়ে ৩ জনের বীভৎস মৃত্যুর পর অগ্নিদগ্ধ বাকি ৩ জনকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সহকর্মীরা। ডিপো থেকে একটি গাড়ি (কার/মাইক্রো) চাইলেও তাদের দেয়া হয়েছিল ৩ চাকার একটি টমটম।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানান, চোখের সামনে মুহূর্তেই পুড়ে অঙ্গার হয় মুক্তার, আরমান ও নেওয়াজ। পাশাপাশি আগুনে পোড়া যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করছিলেন-রবিউল, আমির ও আরও একজন। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে একটি গাড়ি চাইলে তাও দেয়া হয়নি। অন্যদিকে ডিপোতে নেই একটিও অ্যাম্বুলেন্স। যদিও রবিউল রাতে মারা যান সেই দুর্ঘটনায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিপোটিতে কর্মরত একজন বলেন, এত বড় ডিপোতে সব পানির কল নষ্ট। ১৪টি অগ্নিনির্বাপন সিলিন্ডার আনা হলেও কাজ করেছে মাত্র দু’টি। শুনলাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িও দেয়নি।
এসব বিষয় তাৎক্ষণিক পরীক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, আগুন নেভাতে পানি আনা হয়েছিল মেইন গেটের ওদিক থেকে। যা ছিল ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে। অথচ কাজ করেনি ঘটনাস্থলের পাশেই থাকা অগ্নিনির্বাপক কলটি। এতে করে আগুন নেভানোর পানি টানতেই লেগে যায় ১৫/২০ মিনিট। অথচ তাৎক্ষণিক পানি কিংবা অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার পেলে বাঁচানো যেত অন্তত আরও তাজা ১টি প্রাণ। তাছাড়া ডিপোটির ভেতরে থাকা সব মেয়াদোত্তীর্ণ অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সরিয়ে ফেলেছে কর্তৃপক্ষ। রয়েছে এমন অভিযোগও।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের একটি সূত্র বলছে, ওই ডিজেলে ট্যাংকটির মুখ বন্ধ রেখেই ঝালাই কাজ করা হচ্ছিল। ফলে ট্যাংকে জমে থাকা গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। পুলিশের বক্তব্যও একই। তবে ফায়ার সার্ভিসের ওই সূত্রটি বলছে, শুধুমাত্র ট্যাংকের গ্যাসে এতো ভয়াবহ বিস্ফোরণের সম্ভবনা কম। পাশাপাশি দুর্ঘটনার স্থানেই নিচে পড়ন্ত তেল, ডিজেল, আবদ্ধ ডিজেল ট্যাংক এবং ওয়েল্ডিংয়ের আগুনে শিখা একযোগে এই দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
সংস্থাটির প্রাথমিক বিবরণীতে বলা হয়েছে- বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বুধবার সাড়ে ১১টায়। তারা এই খবর পায় ১১টা ৩৫ মিনিটে। ঠিক ১৩ মিনিট পর অর্থাৎ ১১টা ৪৮ মিনিটে পৌঁছায় সংস্থাটির ১টি অ্যাম্বুলেন্সসহ দুইটি অগ্নিনির্বাপক গাড়ি। এদিকে ডিপোটির এতো সব স্পর্শকাতর অভিযোগের পরেও নিহত হওয়া শ্রমিকদের উপরই সব দায় ঠেলে দেয় কর্তৃপক্ষ। এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইনকন্ট্রেড কনটেইনার ডিপোর ব্যবস্থাপক (ওয়ার্কশপ) মো. ইয়াসিন বলেন, যে মিস্ত্রি কাজ করছে ঢাকনাটা (ডিজেল ট্যাংকের মুখ) খুলে নাই। ওর গাফিলতিটাই এখানে মূল (কারণ)।
ডিপোর অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার এবং ঘটনাস্থলের কাছেই থাকা অগ্নিনির্বাপক কলটি অকেজো থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা ওগুলা দিয়েই তো নিভিয়েছি। তবে গেইটের কাছে থাকা অন্য একটি অগ্নিনির্বাপক কল থেকে পানি টেনে এনে আগুন নিভানো হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওইখানে (দুর্ঘটনাস্থানেই) যে ফায়ার সেইফটি কলটা ছিল ওইটা স্টার্ট (চালু) হয়তে একটু সময় লাগছে। অগ্নিদগ্ধ শ্রমিকদের গাড়ি (কার/মাইক্রো) না দিয়ে তিন চাকার টমটম দেয়ার ব্যাপারটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাড়ি মানে... তাৎক্ষণিক যেটা ছিল ওইটা দিয়েছি আরকি। ওই টমটমটিও আমাদের নিজস্ব গাড়ি।
পতেঙ্গা থানার ওসি মোহাম্মদ জোবাইর সৈয়দ বলেন, আহত রবিউল ঢাকায় একটি হাসপাতালে রাতে মারা গেছেন বলে শুনেছি। তবে তাদের আত্মীয়-স্বজনের মোবাইল নাম্বার বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করতে পারছি না।