কুমিল্লা দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তর লাকসামের এক সময়কার গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সাধারণ মানুষের কাছে শীতল পাটিখ্যাত হোগলা বিছনার এখন আর তেমন কদর নেই। ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে ওই গ্রামীণ সম্পদ হোগলা বিছনা।
হোগলা পাতা ব্যবসায়ীদের একাধিক সূত্র জানায়, এ অঞ্চলের শতবছরের গ্রামীণ ঐতিহ্য হোগলা পাতার বিছনা একটা সময় জেলা দক্ষিণাঞ্চলের লাকসাম, লালমাই, বরুড়া, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার শহর কিংবা গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে ব্যবহার হতো। দারিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের কাছে শীতল পাটি হিসেবে হোগলা চাটাই ছিলো বহুল পরিচিত নাম। ব্যবহার হতো মক্তব, মসজিদ, মাদ্রাসা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ঘুমানোর জন্য ওই পণ্যটি ছিল অন্যতম মাধ্যম। এছাড়া পূজা-অর্চনা, ঘরের ছাউনী, বেড়া ফসল রাখার টুকরী, ক্ষেতের বেড়াসহ নানাহ সাংসারিক কাজে ওইপণ্য ব্যবহার হতো। এ অঞ্চলে হোগলা পাতার চাষাবাদ না হলেও একটি সম্প্রদায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে হোগলা পাতা সংগ্রহ করে বিছনা বানিয়ে উপজেলা ৫টির বিভিন্ন হাটে-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। অথচ আজ যেন ওই গ্রামীণ ঐতিহ্য ডিজিটাল যুগে এসে হারিয়ে যাচ্ছে।
সূত্রগুলো আরও জানায়, এ হোগলা গাছ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে এটেল কিংবা দোআঁশ মাটিতে এবং উর্বর জমির আইলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতো। ওই গাছটি সাধারণত ঃ ৫ থেকে ১২ ফুট লম্বা গাছে ১-২ ইঞ্চি সারি সারি পাতা জাতীয় গাছ। গাছটির পাতা ধীরে ধীরে সবুজ প্রকৃতির রূপ নিয়ে লম্বা হতে থাকে এবং তা তুলে শুকানো পর কাঠ রংয়ের পাশাপাশি সোনালী মিশ্রণে অপরূপ কালারে পরিণত হয়। চলমান সময়ে হোগলা পাতার সঙ্কট, শ্রমিক না পাওয়া, বাজার মূল্যের চাইতে বিছনা বানাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও পরিবহন ব্যয় বেশিসহ নারী শ্রমিকরা ওইকাজে অনীহা প্রকাশ করায় গ্রামীণ এ ক্ষুদ্র শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে।
এছাড়া বর্তমান সরকারের ডিজিটাল যুগে দেশি-বিদেশি প্লাস্টিক, রেকসিনসহ নানাহ দ্রব্যের মিশ্রণে গ্রামীণ হোগলা পাতার মতো বিছনা তৈরি করে বাজারজাত করায় হোগলা পাতার বিছনার কদর দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষও হোগলা পাতার বিছনার চাইতে ওইসব পণ্য কিনতে আগ্রহ বেশি।
অপরদিকে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের লালমাই পাহাড়সহ বিত্তশালীদের বাড়ির পাশে এ অঞ্চলের বহুস্থানে হোগলা গাছের প্রাকৃতিকভাবে বাগান ছিল। ওই সম্প্রদায়ের লোকজন হোগলা গাছের পাতা সংগ্রহ করে নিজেদের বাড়িতে নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরিরা মিলে বিছনা তৈরি করে এলাকার বড় বড় হাটবাজারে পাইকারি কিংবা ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করত। হস্তশিল্প হিসেবে এ হোগলা পাতার বিছানা বিক্রির আয় ছিল ওই শ্রেণির লোকজনের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এবং গ্রাম হবে শহর কিন্তু নানাহ কারণে ওই পণ্যের চাহিদা কমার পাশাপাশি হাটবাজারগুলোতে আড়তদার ও মজুদদার ব্যবসায়ীদের প্রতারণার কারণেও এ ক্ষুদ্র শিল্পটি ধ্বংস হয়ে গেছে।
এছাড়া এ ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার ঘটলে, ছোট-বড় বিছানা, নামাজের মাদুর, কুসন, ঝুড়ি, টুপি, নানাহ ব্যাগ, টুকরী, সাংসারিক মালামাল, হাতপাখাসহ হরেক রকম জিনিস তৈরি করে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য স্থান কিংবা বিদেশে রফতানি করে রাজস্ব আয়ে ব্যাপক সাফল্য আসত বলে অভিমত স্থানীয় পরিবেশ বিদদের। বর্তমানে লাকসাম পৌরশহরের প্রাণকেন্দ্র দৌলতগঞ্জ বাজার বিছনাপট্টিতে ৭-৮টি দোকান ও ফুটপাতে ৮-১০টি ফড়িয়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হোগলা পাতার বিছানা বিক্রি করছেন। আগের তুলনায় বর্তমানে দাম অনেকটা বেশি। প্রতিটি বিছনার সাইজ অনুসারে ৫০-১২০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে জেলা-উপজেলা বিসিক, অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানসহ স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার মুঠোফোনে বার বার চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
শনিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২১ , ২ মাঘ ১৪২৭, ২ জমাদিউস সানি ১৪৪২
সংবাদদাতা, লাকসাম (কুমিল্লা)
কুমিল্লা দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তর লাকসামের এক সময়কার গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সাধারণ মানুষের কাছে শীতল পাটিখ্যাত হোগলা বিছনার এখন আর তেমন কদর নেই। ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে ওই গ্রামীণ সম্পদ হোগলা বিছনা।
হোগলা পাতা ব্যবসায়ীদের একাধিক সূত্র জানায়, এ অঞ্চলের শতবছরের গ্রামীণ ঐতিহ্য হোগলা পাতার বিছনা একটা সময় জেলা দক্ষিণাঞ্চলের লাকসাম, লালমাই, বরুড়া, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার শহর কিংবা গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে ব্যবহার হতো। দারিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের কাছে শীতল পাটি হিসেবে হোগলা চাটাই ছিলো বহুল পরিচিত নাম। ব্যবহার হতো মক্তব, মসজিদ, মাদ্রাসা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ঘুমানোর জন্য ওই পণ্যটি ছিল অন্যতম মাধ্যম। এছাড়া পূজা-অর্চনা, ঘরের ছাউনী, বেড়া ফসল রাখার টুকরী, ক্ষেতের বেড়াসহ নানাহ সাংসারিক কাজে ওইপণ্য ব্যবহার হতো। এ অঞ্চলে হোগলা পাতার চাষাবাদ না হলেও একটি সম্প্রদায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে হোগলা পাতা সংগ্রহ করে বিছনা বানিয়ে উপজেলা ৫টির বিভিন্ন হাটে-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। অথচ আজ যেন ওই গ্রামীণ ঐতিহ্য ডিজিটাল যুগে এসে হারিয়ে যাচ্ছে।
সূত্রগুলো আরও জানায়, এ হোগলা গাছ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে এটেল কিংবা দোআঁশ মাটিতে এবং উর্বর জমির আইলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতো। ওই গাছটি সাধারণত ঃ ৫ থেকে ১২ ফুট লম্বা গাছে ১-২ ইঞ্চি সারি সারি পাতা জাতীয় গাছ। গাছটির পাতা ধীরে ধীরে সবুজ প্রকৃতির রূপ নিয়ে লম্বা হতে থাকে এবং তা তুলে শুকানো পর কাঠ রংয়ের পাশাপাশি সোনালী মিশ্রণে অপরূপ কালারে পরিণত হয়। চলমান সময়ে হোগলা পাতার সঙ্কট, শ্রমিক না পাওয়া, বাজার মূল্যের চাইতে বিছনা বানাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও পরিবহন ব্যয় বেশিসহ নারী শ্রমিকরা ওইকাজে অনীহা প্রকাশ করায় গ্রামীণ এ ক্ষুদ্র শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে।
এছাড়া বর্তমান সরকারের ডিজিটাল যুগে দেশি-বিদেশি প্লাস্টিক, রেকসিনসহ নানাহ দ্রব্যের মিশ্রণে গ্রামীণ হোগলা পাতার মতো বিছনা তৈরি করে বাজারজাত করায় হোগলা পাতার বিছনার কদর দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষও হোগলা পাতার বিছনার চাইতে ওইসব পণ্য কিনতে আগ্রহ বেশি।
অপরদিকে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের লালমাই পাহাড়সহ বিত্তশালীদের বাড়ির পাশে এ অঞ্চলের বহুস্থানে হোগলা গাছের প্রাকৃতিকভাবে বাগান ছিল। ওই সম্প্রদায়ের লোকজন হোগলা গাছের পাতা সংগ্রহ করে নিজেদের বাড়িতে নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরিরা মিলে বিছনা তৈরি করে এলাকার বড় বড় হাটবাজারে পাইকারি কিংবা ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করত। হস্তশিল্প হিসেবে এ হোগলা পাতার বিছানা বিক্রির আয় ছিল ওই শ্রেণির লোকজনের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এবং গ্রাম হবে শহর কিন্তু নানাহ কারণে ওই পণ্যের চাহিদা কমার পাশাপাশি হাটবাজারগুলোতে আড়তদার ও মজুদদার ব্যবসায়ীদের প্রতারণার কারণেও এ ক্ষুদ্র শিল্পটি ধ্বংস হয়ে গেছে।
এছাড়া এ ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার ঘটলে, ছোট-বড় বিছানা, নামাজের মাদুর, কুসন, ঝুড়ি, টুপি, নানাহ ব্যাগ, টুকরী, সাংসারিক মালামাল, হাতপাখাসহ হরেক রকম জিনিস তৈরি করে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য স্থান কিংবা বিদেশে রফতানি করে রাজস্ব আয়ে ব্যাপক সাফল্য আসত বলে অভিমত স্থানীয় পরিবেশ বিদদের। বর্তমানে লাকসাম পৌরশহরের প্রাণকেন্দ্র দৌলতগঞ্জ বাজার বিছনাপট্টিতে ৭-৮টি দোকান ও ফুটপাতে ৮-১০টি ফড়িয়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হোগলা পাতার বিছানা বিক্রি করছেন। আগের তুলনায় বর্তমানে দাম অনেকটা বেশি। প্রতিটি বিছনার সাইজ অনুসারে ৫০-১২০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে জেলা-উপজেলা বিসিক, অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানসহ স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার মুঠোফোনে বার বার চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।