আট আসামির সাজা ৩ জনের আমৃত্যু কারাদন্ড

৫ জনের ২০ বছর করে

এক বছরেরও বেশি সময় বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর যুদ্ধপরাধের এক মামলায় রায় হলো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আদালতে। গতকাল জরাকীর্ণ আদালতে বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি আবু আহমেদ জমদারসহ তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় ঘোষণা করে। যুদ্ধাপরাধ মামলায় সর্বশেষ রায়টি হয়েছে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর।

গতকালের রায়ে ১১ আসামির মধ্যে বেঁচে থাকা ৮ আসামির ৩ জনকে আমৃত্যু কারাদন্ড আর ৫ জনকে ২০ বছর করে সাজা দেয়া হয়েছে। খালাস দেয়া হয়েছে ১ জনকে। আমৃত্যু কারাদন্ড পাওয়া ৩ জনই ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও ভালুকার। এ মামলায় ১১ আসামির মধ্যে একজন বন্দী থাকাকালীন অন্যজন পলাতক অবস্থায় মারা গেছেন। তবে রায়ে ১ আসামিকে বেকুসুর খালাস দেয়া ঘটনা এই প্রথম।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, গতকাল যুদ্ধপরাধের এক মামলায় ৯ আসামির রায়ের দিন ধার্য ছিল। রায়ে এক আসামিকে তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে খালাস দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় দেয়া ৪২টি মামলার ১২৪ জন আসামির মধ্যে এই প্রথম কেউ বেকসুর খালাস পেলেন। আসামিদের মধ্যে গ্রেপ্তার পাঁচজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আর বাকি চার আসামিকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে। পলাতক চার আসামির একজন রায় চলাকালে আদালতের বাইরে এসে ধরা দেন পুলিশের কাছে। এই ৯ আসামি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে ময়মনসিংহের বিভিন্ন গ্রামে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মতো অপরাধে যুক্ত হন বলে এ মামলায় অভিযোগ করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি ঘটনায় অভিযুক্ত করে ২০১৮ সালের মার্চে তাদের বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিল আদালত। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত বছরের ২৬ জানুয়ারি মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গতবছর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোন মামলারই রায় দিতে পারেনি ট্রাইব্যুনাল। শেষ পর্যন্ত গত মঙ্গলবার মামলার রায়ের জন্য এ দিন ঠিক করে দেয়। সে অনুযায়ী গতকাল এ ট্রাইব্যুনালে সকাল সাড়ে ১০টার পর রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়।

রায়ের পর প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রসিকিউশন এ মামলার চারটি অভিযোগই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রসিকিউশন রায়ে সন্তুষ্ট। আর ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম খালাস পাওয়া আসামির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসামি আবদুল লতিফ খালাস পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন দুটি অভিযোগ এনেছিল। দুটি অভিযোগে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার অপরাধ ছিল। কিন্তু প্রসিকিউশন এসব অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। আর যে তিনজন দন্ডিত হয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।’

যাদের সাজা দেয়া হয়েছে

কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে মো. শামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালামকে ১ ও ৪ নম্বর অভিযোগে এবং পলাতক এএফএম ফয়জুল্লাহ ও আবদুর রাজ্জাক মন্ডলকে চারটি অভিযোগের সবগুলেতেই আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। আর কারাগারে থাকা মো. খলিলুর রহমান মীরকে ১ ও ৪ নম্বর অভিযোগে, মো. আবদুল্লাহকে ১ নম্বর অভিযোগে, মো. রইছ উদ্দিন আজাদী ওরফে আক্কেল আলীকে ১, ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে এবং পলাতক সিরাজুল ইসলাম তোতাকে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে, আলিম উদ্দিন খানকে ১, ২ ও ৩ নম্বরে ২০ বছর করে কারাদন্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় অভিযুক্ত অন্য আসামি আবদুল লতিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

মামলার নয় আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা পাঁচজনকে সকাল পৌনে ৯টায় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে আসা হয়। পরে তাদের এজলাসে হাজির করে দূরত্ব বজায় রেখে বসানো হয়। আদালতের নির্দেশে তারা একে একে নিজেদের নাম বলেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের বক্তব্যের পর বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ২২২ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন। রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি আমির হোসেন। সব শেষে বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম সাজা ঘোষণা করেন।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলাটি পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। এছাড়া প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, জেয়াদ আল মালুম, ঋষিকেশ সাহা, মোখলেছুর রহমান বাদল, সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নী, রেজিয়া সুলতানা চমন, তাপস কান্তি বল রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন। আসামি আবদুল লতিফ, মো. শামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালাম, মো. রইছ উদ্দিন আজাদী ওরফে আক্কেল আলী ও মো. আবদুল্লাহর আইনজীবী ছিলেন আবদুস সাত্তার পালোয়ান। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান রায়ের সময় ট্রাইব্যুনালে ছিলেন না।

আসামি দাবি করে রায়ের আগে এক ব্যক্তির আদালতে প্রবেশের চেষ্টা

সকালে ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরুর আগেই এক ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের গেইটে এসে দাবি করেন, তিনি এ মামলার আসামি, তার নাম এএফএম ফয়জুল্লাহ। তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন। পরে কিন্তু ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে ট্রাইব্যুনালে ঢুকতে দেয়নি। রায়ের পর ওই ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা কক্ষে বসে থাকতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা কক্ষে বসে থাকা ব্যক্তি নিজেকে এ মামলার পলাতক আসামি এএফএম ফয়জুল্লাহ বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আজ এখানে এসেছেন আত্মসমর্পণ করতে। কিন্তু তাকে ট্রাইব্যুনালে ঢুকতে দেয়নি। আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার মতো সামর্থ্য তার নেই। ট্রাইব্যুনাল যে তিনজনকে আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়েছে, তাদের মধ্যে এএফএম ফয়জুল্লাহ একজন।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের উপকমিশনার মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘এএফএম ফয়জুল্লাহকে শাহবাগ থানায় পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। আমরা তাকে প্রাথমিকভাবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। পরে সংশ্লিষ্ট থানায় (গফরগাঁও অথবা ভালুকা) হস্তান্তর করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর এ মামলার তদন্ত শুরু হয়। পরে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনে ট্রাইব্যুনাল ওই বছরের ২৫ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। প্রায় ৪ বছর পর ২০১৮ সালে এ মামলায় মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছিল ট্রাইব্যুনাল। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে মো. আবদুল মালেক আকন্দ ওরফে আবুল হোসেন ওরফে আবুল মেম্বার গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিচার চলাকালে মারা যান। আর আসামি নুরুল আমিন শাজাহান মারা যান পলাতক অবস্থায়। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১১ আসামির মধ্যে ৯ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের মতো অপরাধের তিনটি অভিযোগ এনে ২০১৮ সালের ৪ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনের পর ওই বছরের ১০ মে থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি শুরু হয়। মোট ১৮ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্ক শুরু হয়ে শেষ হয় গত বছরের ২৬ জানুয়ারি। ওই দিনই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষায় রাখা হয়। এরপর নানা নাটকিয়তায় রায় পিছিয়ে পড়ে। গত বছর রায় ঘোষণার কথা থাকলেও করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে গতকাল রায়টি দেয়া হলো।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধেল অভিযোগে এ পর্যন্ত ৪২টি মামলা রায় হয়েছে। সর্বশেষ রায়টি হয়েছে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর। রাজশাহীর বোয়ালিয়ার সাবেক শিবির নেতা মো. আবদুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতানের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় ছিল সেটি। রায়ে টিপু সুলতানকে মৃত্যুদন্ড দেয় যুদ্ধাপরাধ আদালত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৪২টি মামলার ১২৪ জন আসামির মধ্যে ১২ জন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট সাজা হয়েছে ১১১ জনের। এরমধ্যে ৬৯ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড সাজা হয়েছে। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাশেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ উল্লেখযোগ্য আসামির সাজা কার্যকর হয়েছে।

শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৯ মাঘ ১৪২৭, ২৯ জমাদিউস সানি ১৪৪২

যুদ্ধাপরাধ মামলা

আট আসামির সাজা ৩ জনের আমৃত্যু কারাদন্ড

৫ জনের ২০ বছর করে

আদালত বার্তা পরিবেশক

এক বছরেরও বেশি সময় বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর যুদ্ধপরাধের এক মামলায় রায় হলো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আদালতে। গতকাল জরাকীর্ণ আদালতে বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি আবু আহমেদ জমদারসহ তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় ঘোষণা করে। যুদ্ধাপরাধ মামলায় সর্বশেষ রায়টি হয়েছে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর।

গতকালের রায়ে ১১ আসামির মধ্যে বেঁচে থাকা ৮ আসামির ৩ জনকে আমৃত্যু কারাদন্ড আর ৫ জনকে ২০ বছর করে সাজা দেয়া হয়েছে। খালাস দেয়া হয়েছে ১ জনকে। আমৃত্যু কারাদন্ড পাওয়া ৩ জনই ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও ভালুকার। এ মামলায় ১১ আসামির মধ্যে একজন বন্দী থাকাকালীন অন্যজন পলাতক অবস্থায় মারা গেছেন। তবে রায়ে ১ আসামিকে বেকুসুর খালাস দেয়া ঘটনা এই প্রথম।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, গতকাল যুদ্ধপরাধের এক মামলায় ৯ আসামির রায়ের দিন ধার্য ছিল। রায়ে এক আসামিকে তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে খালাস দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় দেয়া ৪২টি মামলার ১২৪ জন আসামির মধ্যে এই প্রথম কেউ বেকসুর খালাস পেলেন। আসামিদের মধ্যে গ্রেপ্তার পাঁচজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আর বাকি চার আসামিকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে। পলাতক চার আসামির একজন রায় চলাকালে আদালতের বাইরে এসে ধরা দেন পুলিশের কাছে। এই ৯ আসামি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে ময়মনসিংহের বিভিন্ন গ্রামে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মতো অপরাধে যুক্ত হন বলে এ মামলায় অভিযোগ করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি ঘটনায় অভিযুক্ত করে ২০১৮ সালের মার্চে তাদের বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিল আদালত। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত বছরের ২৬ জানুয়ারি মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গতবছর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোন মামলারই রায় দিতে পারেনি ট্রাইব্যুনাল। শেষ পর্যন্ত গত মঙ্গলবার মামলার রায়ের জন্য এ দিন ঠিক করে দেয়। সে অনুযায়ী গতকাল এ ট্রাইব্যুনালে সকাল সাড়ে ১০টার পর রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়।

রায়ের পর প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রসিকিউশন এ মামলার চারটি অভিযোগই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রসিকিউশন রায়ে সন্তুষ্ট। আর ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম খালাস পাওয়া আসামির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসামি আবদুল লতিফ খালাস পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন দুটি অভিযোগ এনেছিল। দুটি অভিযোগে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার অপরাধ ছিল। কিন্তু প্রসিকিউশন এসব অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। আর যে তিনজন দন্ডিত হয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।’

যাদের সাজা দেয়া হয়েছে

কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে মো. শামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালামকে ১ ও ৪ নম্বর অভিযোগে এবং পলাতক এএফএম ফয়জুল্লাহ ও আবদুর রাজ্জাক মন্ডলকে চারটি অভিযোগের সবগুলেতেই আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। আর কারাগারে থাকা মো. খলিলুর রহমান মীরকে ১ ও ৪ নম্বর অভিযোগে, মো. আবদুল্লাহকে ১ নম্বর অভিযোগে, মো. রইছ উদ্দিন আজাদী ওরফে আক্কেল আলীকে ১, ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে এবং পলাতক সিরাজুল ইসলাম তোতাকে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে, আলিম উদ্দিন খানকে ১, ২ ও ৩ নম্বরে ২০ বছর করে কারাদন্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় অভিযুক্ত অন্য আসামি আবদুল লতিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

মামলার নয় আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা পাঁচজনকে সকাল পৌনে ৯টায় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে আসা হয়। পরে তাদের এজলাসে হাজির করে দূরত্ব বজায় রেখে বসানো হয়। আদালতের নির্দেশে তারা একে একে নিজেদের নাম বলেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের বক্তব্যের পর বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ২২২ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন। রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি আমির হোসেন। সব শেষে বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম সাজা ঘোষণা করেন।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলাটি পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। এছাড়া প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, জেয়াদ আল মালুম, ঋষিকেশ সাহা, মোখলেছুর রহমান বাদল, সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নী, রেজিয়া সুলতানা চমন, তাপস কান্তি বল রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন। আসামি আবদুল লতিফ, মো. শামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালাম, মো. রইছ উদ্দিন আজাদী ওরফে আক্কেল আলী ও মো. আবদুল্লাহর আইনজীবী ছিলেন আবদুস সাত্তার পালোয়ান। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান রায়ের সময় ট্রাইব্যুনালে ছিলেন না।

আসামি দাবি করে রায়ের আগে এক ব্যক্তির আদালতে প্রবেশের চেষ্টা

সকালে ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরুর আগেই এক ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের গেইটে এসে দাবি করেন, তিনি এ মামলার আসামি, তার নাম এএফএম ফয়জুল্লাহ। তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন। পরে কিন্তু ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে ট্রাইব্যুনালে ঢুকতে দেয়নি। রায়ের পর ওই ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা কক্ষে বসে থাকতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা কক্ষে বসে থাকা ব্যক্তি নিজেকে এ মামলার পলাতক আসামি এএফএম ফয়জুল্লাহ বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আজ এখানে এসেছেন আত্মসমর্পণ করতে। কিন্তু তাকে ট্রাইব্যুনালে ঢুকতে দেয়নি। আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার মতো সামর্থ্য তার নেই। ট্রাইব্যুনাল যে তিনজনকে আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়েছে, তাদের মধ্যে এএফএম ফয়জুল্লাহ একজন।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের উপকমিশনার মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘এএফএম ফয়জুল্লাহকে শাহবাগ থানায় পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। আমরা তাকে প্রাথমিকভাবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। পরে সংশ্লিষ্ট থানায় (গফরগাঁও অথবা ভালুকা) হস্তান্তর করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর এ মামলার তদন্ত শুরু হয়। পরে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনে ট্রাইব্যুনাল ওই বছরের ২৫ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। প্রায় ৪ বছর পর ২০১৮ সালে এ মামলায় মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছিল ট্রাইব্যুনাল। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে মো. আবদুল মালেক আকন্দ ওরফে আবুল হোসেন ওরফে আবুল মেম্বার গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিচার চলাকালে মারা যান। আর আসামি নুরুল আমিন শাজাহান মারা যান পলাতক অবস্থায়। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১১ আসামির মধ্যে ৯ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের মতো অপরাধের তিনটি অভিযোগ এনে ২০১৮ সালের ৪ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনের পর ওই বছরের ১০ মে থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি শুরু হয়। মোট ১৮ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্ক শুরু হয়ে শেষ হয় গত বছরের ২৬ জানুয়ারি। ওই দিনই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষায় রাখা হয়। এরপর নানা নাটকিয়তায় রায় পিছিয়ে পড়ে। গত বছর রায় ঘোষণার কথা থাকলেও করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে গতকাল রায়টি দেয়া হলো।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধেল অভিযোগে এ পর্যন্ত ৪২টি মামলা রায় হয়েছে। সর্বশেষ রায়টি হয়েছে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর। রাজশাহীর বোয়ালিয়ার সাবেক শিবির নেতা মো. আবদুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতানের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় ছিল সেটি। রায়ে টিপু সুলতানকে মৃত্যুদন্ড দেয় যুদ্ধাপরাধ আদালত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৪২টি মামলার ১২৪ জন আসামির মধ্যে ১২ জন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট সাজা হয়েছে ১১১ জনের। এরমধ্যে ৬৯ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড সাজা হয়েছে। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাশেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ উল্লেখযোগ্য আসামির সাজা কার্যকর হয়েছে।