ঋণ শোধ করতে না পারায়

মা-মেয়েকে গাছে বেঁধে নির্যাতন

মামলা দায়ের, একজন গ্রেপ্তার

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের পোশাক কারখানার কর্মী মমতাজ বেগমের অভাবের সংসার। স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে বন বিভাগের জমিতে থাকেন। পোশাক কারখানায় চাকরি করে মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে আসছেন। অভাব-অনটনের মধ্যে কোনোরকমে মা-মেয়ের সংসার চলছে। সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে সিরাজপুর এলাকার আবদুল গফুর মিয়ার স্ত্রী সুদ ব্যবসায়ী কুলসুম বেগমের কাছ থেকে মমতাজ বেগম গত দুই মাস আগে সুদে ১৭ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। সে টাকা ফেরত দিতে না পারায় গত বৃহস্পতিবার মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বর নির্যাতনের শিকার হন তিনি। মমতাজ বেগম এবং তার স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে কাঠাল গাছের সঙ্গে বেঁধে বেদম মারধর এবং শারীরিক নির্যাতন করা হয়।

সুদ ব্যবসায়ী কুলসুম বেগমের কাছ থেকে মমতাজ বেগমের নেয়া ঋণের টাকা সুদসহ গত দুই মাসের মধ্যে দিতে না পারায় কুলসুম বেগম একাধিবার তাগিদ দেন। পরে মমতাজ বেগম আগামী মাসের ৩ তারিখে (গ্রাম্য মাতাব্বরদের দেয়া তারিখ) সুদের টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা মানতে নারাজ সুদখোর পাওনাদাররা। একপর্যায়ে গত বৃহস্পতিবার পাওনাদার আবদুল গফুর ও তার স্ত্রী কুলসুম বেগমসহ ৭-৮ জন ব্যক্তি মিলে সকাল সাড়ে দশটার দিকে মমতাজ বেগমের বাড়িতে এসে সুদের টাকা চায়। পরে সুদের টাকা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে মমতাজ বেগমকে বিভিন্নভাবে বকাঝকা করতে থাকেন। এ সময় টাকা দিতে মমতাজ বেগম অপারাগতা প্রকাশ করলে গফুর মিয়া ও তার স্ত্রী কুলসুম বেগম রশি দিয়ে কাঁঠাল গাছের সঙ্গে প্রথমে মমতাজ বেগম ও মেয়ে ঝুমা আক্তাকে বেঁধে ফেলেন। এ সময় তাদের শারীরিক নির্যাতন করতে কিলঘুসি মারতে থাকে কুলসুম। পরে তার সঙ্গে মিলে আবদুল গফুর, শিল্পী, মুক্তা এক সঙ্গে জুতা দিয়ে মারধর করতে থাকে। এক পর্যায় মমতাজ বেগমের মেয়ে ঝুমা আক্তারের শরীর থেকে উড়না সরিয়ে নিয়ে নির্যাতনের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করেন তারা। এরপর নিযার্তনকারীরা সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। খবর পেয়ে গ্রামবাসী এগিয়ে এসে মারধর করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করে স্থানীয় ইউপি সদস্য ইব্রাহিমকে খবর পাঠান। খবর পেয়ে দুপুরের দিকে স্থানীয় ইউপি সদস্য ইব্রাহিম ঘটনাস্থলে গিয়ে বেঁধে রাখা দুই নারীকে মুক্ত করেন।

পরে মামলার মমতাজ বেগমের ছোট বোন মেহেরিন সুলতানা নুর মীম ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিলে ফুলবাড়িয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসঅই মো. জামাল উদ্দিন ঘটনান্থলে না গিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্যকে ঘটনাস্থলে পাঠান। পরে ইউপি সদস্য ইব্রাহিম ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্যাতিত মা ও মেয়েকে উদ্ধার করেন। পরে এ বিষয়ে থানায় মামলা দেয়া হয়।

পুলিশ গতকাল দুপুরে সিরাজপুর গ্রাম থেকে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঘটনার মূল হোতা সবুজ উদ্দিনকে (৫০) গ্রেপ্তার করেছে থানা পুলিশ।

গ্রেপ্তারকৃত সবুজ উদ্দিন হলেন একই গ্রামের মোক্তার হোসেনের ছেলে। তার বিরুদ্ধে সুদের টাকার জন্য মা মমতাজ বেগম ও মেয়ে ঝুমা আক্তারকে কাঁঠাল গাছের সঙ্গে বেঁধে সরাসরি নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলো- একই গ্রামের আবদুল গফুর, কুলসুম বেগম, শিল্পী আক্তার, মুক্তা আক্তার, মনির হোসনে, রিপন, শহীদ ও নয়ন সিকদার।

অভিযুক্ত আবদুল গফুর ড্রাইভার বলেন, ‘তাদের টাকা আদায়ের জন্য চাপ দেয়া হয়েছে। কাউকে মারধর বা গাছে বেঁধে নির্যাতন করা হয়নি। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে।’

ফুলবাড়িয়া ইউপি সদস্য (ওই ওয়ার্ডের) ইব্রাহিম মিয়া ঘটনাটিকে খুবই ন্যক্কারজনক ও অমানবিক হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, বিষয়টি জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছে বেঁধে নির্যাতিত মা ও মেয়েকে উদ্ধার করি।

কালিয়াকৈর থানার ওসি মনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, ঘটনাটি জানার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এছাড়া ওইদিন রাতেই নির্যাতিতার পক্ষ থেকে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। পরে অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত মূল হোতা সবুজ উদ্দিন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে থানাহাজতে রাখা হয়েছে। এছাড়া অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে।

গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আশা করি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ৩০ মাঘ ১৪২৭, ৩০ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ঋণ শোধ করতে না পারায়

মা-মেয়েকে গাছে বেঁধে নির্যাতন

মামলা দায়ের, একজন গ্রেপ্তার

আলমগীর হোসেন, কালিয়াকৈর (গাজীপুর)

image

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের পোশাক কারখানার কর্মী মমতাজ বেগমের অভাবের সংসার। স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে বন বিভাগের জমিতে থাকেন। পোশাক কারখানায় চাকরি করে মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে আসছেন। অভাব-অনটনের মধ্যে কোনোরকমে মা-মেয়ের সংসার চলছে। সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে সিরাজপুর এলাকার আবদুল গফুর মিয়ার স্ত্রী সুদ ব্যবসায়ী কুলসুম বেগমের কাছ থেকে মমতাজ বেগম গত দুই মাস আগে সুদে ১৭ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। সে টাকা ফেরত দিতে না পারায় গত বৃহস্পতিবার মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বর নির্যাতনের শিকার হন তিনি। মমতাজ বেগম এবং তার স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে কাঠাল গাছের সঙ্গে বেঁধে বেদম মারধর এবং শারীরিক নির্যাতন করা হয়।

সুদ ব্যবসায়ী কুলসুম বেগমের কাছ থেকে মমতাজ বেগমের নেয়া ঋণের টাকা সুদসহ গত দুই মাসের মধ্যে দিতে না পারায় কুলসুম বেগম একাধিবার তাগিদ দেন। পরে মমতাজ বেগম আগামী মাসের ৩ তারিখে (গ্রাম্য মাতাব্বরদের দেয়া তারিখ) সুদের টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা মানতে নারাজ সুদখোর পাওনাদাররা। একপর্যায়ে গত বৃহস্পতিবার পাওনাদার আবদুল গফুর ও তার স্ত্রী কুলসুম বেগমসহ ৭-৮ জন ব্যক্তি মিলে সকাল সাড়ে দশটার দিকে মমতাজ বেগমের বাড়িতে এসে সুদের টাকা চায়। পরে সুদের টাকা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে মমতাজ বেগমকে বিভিন্নভাবে বকাঝকা করতে থাকেন। এ সময় টাকা দিতে মমতাজ বেগম অপারাগতা প্রকাশ করলে গফুর মিয়া ও তার স্ত্রী কুলসুম বেগম রশি দিয়ে কাঁঠাল গাছের সঙ্গে প্রথমে মমতাজ বেগম ও মেয়ে ঝুমা আক্তাকে বেঁধে ফেলেন। এ সময় তাদের শারীরিক নির্যাতন করতে কিলঘুসি মারতে থাকে কুলসুম। পরে তার সঙ্গে মিলে আবদুল গফুর, শিল্পী, মুক্তা এক সঙ্গে জুতা দিয়ে মারধর করতে থাকে। এক পর্যায় মমতাজ বেগমের মেয়ে ঝুমা আক্তারের শরীর থেকে উড়না সরিয়ে নিয়ে নির্যাতনের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করেন তারা। এরপর নিযার্তনকারীরা সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। খবর পেয়ে গ্রামবাসী এগিয়ে এসে মারধর করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করে স্থানীয় ইউপি সদস্য ইব্রাহিমকে খবর পাঠান। খবর পেয়ে দুপুরের দিকে স্থানীয় ইউপি সদস্য ইব্রাহিম ঘটনাস্থলে গিয়ে বেঁধে রাখা দুই নারীকে মুক্ত করেন।

পরে মামলার মমতাজ বেগমের ছোট বোন মেহেরিন সুলতানা নুর মীম ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিলে ফুলবাড়িয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসঅই মো. জামাল উদ্দিন ঘটনান্থলে না গিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্যকে ঘটনাস্থলে পাঠান। পরে ইউপি সদস্য ইব্রাহিম ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্যাতিত মা ও মেয়েকে উদ্ধার করেন। পরে এ বিষয়ে থানায় মামলা দেয়া হয়।

পুলিশ গতকাল দুপুরে সিরাজপুর গ্রাম থেকে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঘটনার মূল হোতা সবুজ উদ্দিনকে (৫০) গ্রেপ্তার করেছে থানা পুলিশ।

গ্রেপ্তারকৃত সবুজ উদ্দিন হলেন একই গ্রামের মোক্তার হোসেনের ছেলে। তার বিরুদ্ধে সুদের টাকার জন্য মা মমতাজ বেগম ও মেয়ে ঝুমা আক্তারকে কাঁঠাল গাছের সঙ্গে বেঁধে সরাসরি নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলো- একই গ্রামের আবদুল গফুর, কুলসুম বেগম, শিল্পী আক্তার, মুক্তা আক্তার, মনির হোসনে, রিপন, শহীদ ও নয়ন সিকদার।

অভিযুক্ত আবদুল গফুর ড্রাইভার বলেন, ‘তাদের টাকা আদায়ের জন্য চাপ দেয়া হয়েছে। কাউকে মারধর বা গাছে বেঁধে নির্যাতন করা হয়নি। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে।’

ফুলবাড়িয়া ইউপি সদস্য (ওই ওয়ার্ডের) ইব্রাহিম মিয়া ঘটনাটিকে খুবই ন্যক্কারজনক ও অমানবিক হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, বিষয়টি জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছে বেঁধে নির্যাতিত মা ও মেয়েকে উদ্ধার করি।

কালিয়াকৈর থানার ওসি মনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, ঘটনাটি জানার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এছাড়া ওইদিন রাতেই নির্যাতিতার পক্ষ থেকে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। পরে অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত মূল হোতা সবুজ উদ্দিন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে থানাহাজতে রাখা হয়েছে। এছাড়া অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে।

গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আশা করি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।