ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিসত্তা বিনির্মাণের রক্তাক্ত সিঁড়ি

সাদেকুর রহমান

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত মাস ফেব্রুয়ারির পঞ্চদশ দিবস আজ। ১৯৫২ সালে দিনটি ছিল শুক্রবার। এদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে বিরাজ করছিল দিগি্বদিক তোলপাড় করা প্রতিবাদের নানা রকম ভাষা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুঞ্জীভূত নিগ্রহের বিপরীতে অধিকার আর অসাম্যকে জয় করার দুর্বিনীত সাহস এবং অটুট প্রত্যয়ে এ ভূখ-ের প্রতিটি মানুষ ছিল উন্মুখ, অধীর।

বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষাকে রক্ষার সংগ্রামই ছিল না, বরং তা ছিল আমাদের সব স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম যুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতার সূচনা পর্ব। অবশেষে আমরা ‘অ আ ক খ’-কে পেয়েছি রক্তের আখরে। লজ্জার বিষয়, যে ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবোধের প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও স্ফূরণ ঘটাল, যে ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশি জাতিসত্তা বিনির্মাণের এক রক্তাক্ত সিঁড়ি, দীর্ঘ প্রায় সাত দশকেও সেই ভাষা আন্দোলনের যথাযথ ও সঠিক ইতিহাস নিরূপিত হয়নি। প্রণীত হয়নি কোন সম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য দলিল। বরারবরই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করে চলেছে।

ভাষা আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে গবেষকরা তাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। যথা : মানসিক পর্ব, সাংগঠনিক পর্ব, সংগ্রাম পর্ব ও বিজয় পর্ব। মানসিক পর্বের সূচনাকাল হিসেবে গবেষকরা ১৯১১ সালকে চিহ্নিত করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করেছেন। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’, শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের সাংগঠনিক পর্ব। তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক (পরে প্রিন্সিপাল) আবুল কাসেম, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর, অধ্যাপক ড. এএসএম নুরুল হক ভূঁইয়া প্রমুখ। তাদের উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ‘প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হলে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে।

প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের সন্তান ড. এএসএম নূরুল হক ভূঁইয়া। অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সামসুল আলম, আবুল খয়ের, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী এবং অলি আহাদ। পরবর্তীতে এই কমিটি সম্প্রসারণ করা হয় এবং মোহাম্মদ তোয়াহা ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম কমিটিতে যোগ দেন।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কে ‘সংগ্রাম পর্ব’ ধরা হয়। সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয় ক’মাসের মধ্যেই। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হন তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, জিল্লুর রহমান প্রমুখ। বিজয় পর্ব ছিল মাত্র তিন সপ্তাহ ব্যাপ্তির।

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২’র ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেপ্তার হয়ে ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হন। অবশ্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের সঙ্গে এক বৈঠকে দেশব্যাপী বাংলাকে আরও গুরুত্ব দেয়ার কথা আলোচনা করা হয়। বৈঠকে বাংলাকে শিক্ষার প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে কামরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রসমাজ এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিনই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সম্প্রসারণ করে প্রথম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘ভালবাসি মাতৃভাষা’ শীর্ষক একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে। ওই গ্রন্থে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান বর্ণনা করে বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও দিক-নির্দেশনা না থাকলে ভাষা আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো।’ কিন্তু দীর্ঘ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ অবদানের কথা অজানা ছিল।

সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২ ফাল্গুন ১৪২৭ ২ রজব ১৪৪২

আ-মরি বাংলা ভাষা

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিসত্তা বিনির্মাণের রক্তাক্ত সিঁড়ি

সাদেকুর রহমান

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত মাস ফেব্রুয়ারির পঞ্চদশ দিবস আজ। ১৯৫২ সালে দিনটি ছিল শুক্রবার। এদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে বিরাজ করছিল দিগি্বদিক তোলপাড় করা প্রতিবাদের নানা রকম ভাষা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুঞ্জীভূত নিগ্রহের বিপরীতে অধিকার আর অসাম্যকে জয় করার দুর্বিনীত সাহস এবং অটুট প্রত্যয়ে এ ভূখ-ের প্রতিটি মানুষ ছিল উন্মুখ, অধীর।

বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষাকে রক্ষার সংগ্রামই ছিল না, বরং তা ছিল আমাদের সব স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম যুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতার সূচনা পর্ব। অবশেষে আমরা ‘অ আ ক খ’-কে পেয়েছি রক্তের আখরে। লজ্জার বিষয়, যে ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবোধের প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও স্ফূরণ ঘটাল, যে ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশি জাতিসত্তা বিনির্মাণের এক রক্তাক্ত সিঁড়ি, দীর্ঘ প্রায় সাত দশকেও সেই ভাষা আন্দোলনের যথাযথ ও সঠিক ইতিহাস নিরূপিত হয়নি। প্রণীত হয়নি কোন সম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য দলিল। বরারবরই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করে চলেছে।

ভাষা আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে গবেষকরা তাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। যথা : মানসিক পর্ব, সাংগঠনিক পর্ব, সংগ্রাম পর্ব ও বিজয় পর্ব। মানসিক পর্বের সূচনাকাল হিসেবে গবেষকরা ১৯১১ সালকে চিহ্নিত করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করেছেন। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’, শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের সাংগঠনিক পর্ব। তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক (পরে প্রিন্সিপাল) আবুল কাসেম, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর, অধ্যাপক ড. এএসএম নুরুল হক ভূঁইয়া প্রমুখ। তাদের উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ‘প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হলে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে।

প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের সন্তান ড. এএসএম নূরুল হক ভূঁইয়া। অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সামসুল আলম, আবুল খয়ের, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী এবং অলি আহাদ। পরবর্তীতে এই কমিটি সম্প্রসারণ করা হয় এবং মোহাম্মদ তোয়াহা ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম কমিটিতে যোগ দেন।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কে ‘সংগ্রাম পর্ব’ ধরা হয়। সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয় ক’মাসের মধ্যেই। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হন তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, জিল্লুর রহমান প্রমুখ। বিজয় পর্ব ছিল মাত্র তিন সপ্তাহ ব্যাপ্তির।

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২’র ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেপ্তার হয়ে ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হন। অবশ্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের সঙ্গে এক বৈঠকে দেশব্যাপী বাংলাকে আরও গুরুত্ব দেয়ার কথা আলোচনা করা হয়। বৈঠকে বাংলাকে শিক্ষার প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে কামরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রসমাজ এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিনই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সম্প্রসারণ করে প্রথম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘ভালবাসি মাতৃভাষা’ শীর্ষক একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে। ওই গ্রন্থে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান বর্ণনা করে বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও দিক-নির্দেশনা না থাকলে ভাষা আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো।’ কিন্তু দীর্ঘ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ অবদানের কথা অজানা ছিল।