ব্যাংক ঋণ চাই

এমআর খায়রুল উমাম

বাংলাদেশের যে কোন ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে চাই। এমন কোন ব্যাংক কি দেশে আছে যারা এই সামান্য টাকাটা ঋণ দেবে? ব্যাংকে গেলে ঋণের কথা শুনলে যেসব নিয়মকানুন, বিধিবিধান, সীমাবদ্ধতার কথা শুনতে হয় তাতে আগামী ১০০ বছরের প্রচেষ্টায় সফল হওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। পত্রিকায় দেখি ব্যাংক ব্যক্তিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে, লক্ষ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পড়ে আছে, শত শত কোটি টাকা সুদ মওকুফ করছে, খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের আবার ঋণ দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোর এই বিশাল ঋণ কার্যক্রমের মধ্যে ১০০ কোটি টাকা খুব বেশি টাকা কি? এই অঙ্কের টাকা চাওয়া কি খুব অন্যায় হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ বিবেচনায় অনেকের কাছে অন্যায় আবদার মনে হলেও বিশ্বাস করি ব্যাংকের কাছে এটি অন্যায় আবদার নয়। দেশের সরল বিশ্বাসে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায় করলে তা অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হয় না। ব্যাংকের প্রচলিত আইনের পরিপন্থি হলেও সরল বিশ্বাসে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দিতে পারে, অবশ্যই পারে।

সত্যিকার অর্থে টাকাটা খুব দরকার। একসময় দেশের প্রকৌশলীদের মিস্টার টেন পারসেন্ট বলা হতো। পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারি এখন কেউ আর টেন পারসেন্টে আর আটকে নেই। ৩১ কোটি টাকার হাসপাতাল ধুমধাম করে ফিতে কাটার পর এখন যেভাবে ফাঁকা মাঠ হয়ে গিয়েছে তাতে বিশ্বাস করতেই পারি বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। তাই ভরসা করতেই পারি ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া সম্ভব। তবে কথা দিতে পারি ঋণের টাকা হাতে পাওয়ার আগে সব রকমের চাহিদা মিটিয়ে তারপর বাকি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরব। সবার চাহিদা পূরণের পর নিজের প্রয়োজন মেটাবো। ব্যাংক থেকে মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা নিচ্ছে। পিকে হালদার মহাশয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে এখন কানাডায় বাতাস খাচ্ছে। শস্য শ্যামলা সোনার বাংলা ছেড়ে কোথাও যেতে মন চায় না, সে কারণেই শত শত কোটি টাকা, সহস্র কোটি টাকার প্রয়োজন আমার নেই।

দেশের যে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য যেসব গুণাবলির প্রয়োজন তার কিছুই আমার নেই। পৈত্রিক সম্পত্তি নেই, বিবাহসূত্রে সম্পদ প্রাপ্তির কোন সুযোগ নেই, রাজনৈতিক কোন পরিচয় নেই, প্রভাবশালী কোন ব্যক্তি নই, প্রভাবশালী কোন ব্যক্তির সুপারিশ পাওয়ার যোগ্যতা নেই, দখল করার সাহস নেই, দখল করে দেয়ার কোন লোক নেই, ব্যাংকে ন্যূনতম যোগাযোগ নেই, ব্যাংকের কোন কর্মচারীর সঙ্গে হৃদ্যতা নেই। ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির একমাত্র যোগ্যতা আমি এ দেশের একজন নাগরিক। এই নাগরিকত্বের মধ্যে কৃত্রিমতার লেশমাত্র নেই। কোনো সেকেন্ড হোম নেই, বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার কোন বাসনাও নেই। জীবনের শেষদিনগুলো দেশের মাটিতে কাটাতে চাই। তাই ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিলে তা পাচারের সম্ভাবনা নেই বা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছাও নেই। ঋণটা খুব প্রয়োজন এবং দেশের চলমান পরিবেশ পরিস্থিতি ঋণ চাইতে সাহসী করে।

দেশের ব্যাংকগুলোতে ঋণ প্রদানের অবস্থা দেখে ছোটবেলায় পড়া একটা গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। শিয়াল প-িত আর কুমিরের গল্প। এক সকালে কুমির তার সাত বাচ্চা নিয়ে শিয়ালের বাড়িতে হাজির। লেখাপড়া না শিখলে তার বাচ্চারা কি করে খাবে সে ভাবনায় অস্থির কুমির তাই ভাবে শিয়াল প-িত যদি কুমির ছানাদের একটু শিক্ষা দিয়ে দেয়। এদিকে খাবার বাড়ি এসে হাজির হওয়ার আনন্দে শিয়াল তৎক্ষণাৎ কুমিরের কথায় রাজি হয়ে গেল। কুমির ছানাগুলোকে পেয়ে শিয়ালের বাড়িতে ভোজ শুরু হয়ে গেল। প্রতিদিন একটা করে কুমির ছানা খায়। এদিকে প্রতিদিন সকালে কুমির আসে ছানাদের দেখতে আর শিয়াল তার গর্তের ভেতর থেকে একটা একটা করে ছানা এনে দেখায়। প্রথমদিন পাঁচটা ছানাকে একবার এবং শেষের ছানাকে দুবার দেখায়। তারপরের দিন শেষের ছানাকে তিনবার দেখায়। কুমিরও তার ছানারা ভালো আছে দেখে ফেরত চলে যায়। দেশের ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বোধকরি একই ছানা বারবার দেখে। জীবকুলে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান হওয়ার কারণে কার ছানা দেখছে তা ভাবার সময় পায় না। কুমির নিজের সন্তানদের চেনে কিন্তু আমাদের ব্যাংক তাও জানে না।

জাতীয় দৈনিক বণিক বার্তা ৬ এপিল ২০২১ মঙ্গলবার লিড নিউজ করেছিল এক জনপ্রতিনিধির ব্যাংক ঋণ নিয়ে। নির্বাচন কমিশনে দেয়া তথ্যমতে ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে আমিন বাজার এলাকায় তার সাড়ে তিন বিঘা জমি ছিল। ২০১৩ সালের নির্বাচনের হলফনামায় তিনি জমির পরিমাণ ১৪১ একরের বেশি দেখান। অপরদিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে অভিযোগ তোলা হয়েছে শুধু বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ পাড়েরই জমি দখল হয়েছে ৫৪ একরের বেশি। বিদ্যুৎকেন্দ্র, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার নামে এ দখল কাজ করা হয়েছে। ব্যাংক এসব জমির ওপর ঋণ প্রদান করেছে। শুধু তাই নয় বিশেষজ্ঞদের মতে যেখানে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ৩৫০-৪০০ কোটি টাকার প্রয়োজন পড়ে সেখানে তার চারগুণ অর্থঋণ প্রদান করা হয়েছে। একে জনগণের জমি তার ওপর প্রয়োজনের চারগুণ অর্থ। এ প্রকল্প থেকে ঋণ আদায় সম্ভব নয় বলেই অনেকে মনে করেন এবং সেটাই হয়েছে। ঋণ ইতোমধ্যে খেলাপি হয়েছে এখন সুদ মওকুফ করে ও আসলটা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অথচ ব্যাংক শিয়াল প-িতের মতো কুমির ছানা দেখছে আর ঋণ দিয়ে চলেছে।

গ্রাম বাংলার একটা কথা আছে ‘আশায় মরে চাষা’। ব্যাংক দখলকৃত জমির বিপরীতে ঋণ দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্ধার অভিযান চলার পরও মামলা চলছে বলে ঋণ পরিশোধের আশায় ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল করে চলেছে। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাকারীদের কত অসীম ক্ষমতা। এই ক্ষমতার জন্যই অনেকে বাংলাদেশকে সব সম্ভবের দেশ ভাবতে পারে। সে সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই ১০০ কোটি টাকা ঋণ চাই। প্রজাতন্ত্রের মালিকের অংশ হিসেবে একজন সাধারণ নাগরিক নিশ্চয়ই নিজে সম্পদহীন হয়েও ব্যাংক ঋণ পাওয়া যেতে পারে, যেখানে ব্যাংকের রয়েছে অসীম ক্ষমতা। সেখানে সামান্য অনুগ্রহ করলেই ঋণ প্রাপ্তি ঘটতে পারে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের শুধু ইচ্ছার প্রয়োজন। তারা একজন সাধারণ নাগরিকের প্রতি ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটালেই হয়। কুমিরের ছানা দেখে ঋণ দেয়া আর সম্পদহীন, যোগ্যতাহীন জেনে ঋণ দেয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দেশের ব্যাংকগুলোতে সারা বছর সুদ মওকুফের যে খেলা চলে তার থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেখালে ব্যাংকের আপাতদৃষ্টিতে কোন ক্ষতি হবে না। দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন এক লক্ষ হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ রয়েছে। প্রতি বছর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কলাকৌশল করে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ উদ্ধার করে তার থেকে বেশি পরিমাণ খেলাপি হয়ে যায়। সে কারণে প্রতি বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ক্রমাগত বেড়ে চলা খেলাপি ঋণের সঙ্গে ১০০ কোটি টাকা যোগ হলে ব্যাংকের কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে? তাই পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় ১০০ কোটি টাকার ঋণ চাওয়া যেতেই পারে এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দ্বিধাহীন চিত্তে এই টাকা দিয়েও দিতে পারে।

বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষরা রাজার রাজা। সাংবিধানিকভাবে এরা কর্মচারী বলে আখ্যায়িত হলেও নিজেদের জন্য মর্যাদাবান হিসেবে কর্মকর্তা উপাধী নির্ধারণ করে নিয়েছেন। এ ক্ষমতাধরদের সালাম দিয়ে স্যার বলা না হলে তারা আন্দোলন করে তা আদায় করে নেন। চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় বিশ্বকে এরা একভাবে দেখেন আর চেয়ার থেকে নেমে সবকিছু অন্যভাবে দেখে থাকেন। এরা সরল বিশ্বাসে কোন কাজ করলে দেশের কোন আইনে অন্যায় বা দুর্নীতি হয় না। তাই দেশের বোকা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত একজন নাগরিকের জন্য সরল বিশ্বাসে একশ কোটি টাকা ঋণ দেশের যে কোনো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ হেলাশ্রেদ্ধা করে দিয়ে নিজেদের অসীম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন। বোকা নাগরিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে কৃতজ্ঞ হব, বাধিত হব।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)]

মঙ্গলবার, ০৮ জুন ২০২১ , ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৬ শাওয়াল ১৪৪২

ব্যাংক ঋণ চাই

এমআর খায়রুল উমাম

বাংলাদেশের যে কোন ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে চাই। এমন কোন ব্যাংক কি দেশে আছে যারা এই সামান্য টাকাটা ঋণ দেবে? ব্যাংকে গেলে ঋণের কথা শুনলে যেসব নিয়মকানুন, বিধিবিধান, সীমাবদ্ধতার কথা শুনতে হয় তাতে আগামী ১০০ বছরের প্রচেষ্টায় সফল হওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। পত্রিকায় দেখি ব্যাংক ব্যক্তিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে, লক্ষ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পড়ে আছে, শত শত কোটি টাকা সুদ মওকুফ করছে, খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের আবার ঋণ দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোর এই বিশাল ঋণ কার্যক্রমের মধ্যে ১০০ কোটি টাকা খুব বেশি টাকা কি? এই অঙ্কের টাকা চাওয়া কি খুব অন্যায় হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ বিবেচনায় অনেকের কাছে অন্যায় আবদার মনে হলেও বিশ্বাস করি ব্যাংকের কাছে এটি অন্যায় আবদার নয়। দেশের সরল বিশ্বাসে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায় করলে তা অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হয় না। ব্যাংকের প্রচলিত আইনের পরিপন্থি হলেও সরল বিশ্বাসে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দিতে পারে, অবশ্যই পারে।

সত্যিকার অর্থে টাকাটা খুব দরকার। একসময় দেশের প্রকৌশলীদের মিস্টার টেন পারসেন্ট বলা হতো। পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারি এখন কেউ আর টেন পারসেন্টে আর আটকে নেই। ৩১ কোটি টাকার হাসপাতাল ধুমধাম করে ফিতে কাটার পর এখন যেভাবে ফাঁকা মাঠ হয়ে গিয়েছে তাতে বিশ্বাস করতেই পারি বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। তাই ভরসা করতেই পারি ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া সম্ভব। তবে কথা দিতে পারি ঋণের টাকা হাতে পাওয়ার আগে সব রকমের চাহিদা মিটিয়ে তারপর বাকি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরব। সবার চাহিদা পূরণের পর নিজের প্রয়োজন মেটাবো। ব্যাংক থেকে মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা নিচ্ছে। পিকে হালদার মহাশয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে এখন কানাডায় বাতাস খাচ্ছে। শস্য শ্যামলা সোনার বাংলা ছেড়ে কোথাও যেতে মন চায় না, সে কারণেই শত শত কোটি টাকা, সহস্র কোটি টাকার প্রয়োজন আমার নেই।

দেশের যে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য যেসব গুণাবলির প্রয়োজন তার কিছুই আমার নেই। পৈত্রিক সম্পত্তি নেই, বিবাহসূত্রে সম্পদ প্রাপ্তির কোন সুযোগ নেই, রাজনৈতিক কোন পরিচয় নেই, প্রভাবশালী কোন ব্যক্তি নই, প্রভাবশালী কোন ব্যক্তির সুপারিশ পাওয়ার যোগ্যতা নেই, দখল করার সাহস নেই, দখল করে দেয়ার কোন লোক নেই, ব্যাংকে ন্যূনতম যোগাযোগ নেই, ব্যাংকের কোন কর্মচারীর সঙ্গে হৃদ্যতা নেই। ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির একমাত্র যোগ্যতা আমি এ দেশের একজন নাগরিক। এই নাগরিকত্বের মধ্যে কৃত্রিমতার লেশমাত্র নেই। কোনো সেকেন্ড হোম নেই, বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার কোন বাসনাও নেই। জীবনের শেষদিনগুলো দেশের মাটিতে কাটাতে চাই। তাই ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিলে তা পাচারের সম্ভাবনা নেই বা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছাও নেই। ঋণটা খুব প্রয়োজন এবং দেশের চলমান পরিবেশ পরিস্থিতি ঋণ চাইতে সাহসী করে।

দেশের ব্যাংকগুলোতে ঋণ প্রদানের অবস্থা দেখে ছোটবেলায় পড়া একটা গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। শিয়াল প-িত আর কুমিরের গল্প। এক সকালে কুমির তার সাত বাচ্চা নিয়ে শিয়ালের বাড়িতে হাজির। লেখাপড়া না শিখলে তার বাচ্চারা কি করে খাবে সে ভাবনায় অস্থির কুমির তাই ভাবে শিয়াল প-িত যদি কুমির ছানাদের একটু শিক্ষা দিয়ে দেয়। এদিকে খাবার বাড়ি এসে হাজির হওয়ার আনন্দে শিয়াল তৎক্ষণাৎ কুমিরের কথায় রাজি হয়ে গেল। কুমির ছানাগুলোকে পেয়ে শিয়ালের বাড়িতে ভোজ শুরু হয়ে গেল। প্রতিদিন একটা করে কুমির ছানা খায়। এদিকে প্রতিদিন সকালে কুমির আসে ছানাদের দেখতে আর শিয়াল তার গর্তের ভেতর থেকে একটা একটা করে ছানা এনে দেখায়। প্রথমদিন পাঁচটা ছানাকে একবার এবং শেষের ছানাকে দুবার দেখায়। তারপরের দিন শেষের ছানাকে তিনবার দেখায়। কুমিরও তার ছানারা ভালো আছে দেখে ফেরত চলে যায়। দেশের ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বোধকরি একই ছানা বারবার দেখে। জীবকুলে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান হওয়ার কারণে কার ছানা দেখছে তা ভাবার সময় পায় না। কুমির নিজের সন্তানদের চেনে কিন্তু আমাদের ব্যাংক তাও জানে না।

জাতীয় দৈনিক বণিক বার্তা ৬ এপিল ২০২১ মঙ্গলবার লিড নিউজ করেছিল এক জনপ্রতিনিধির ব্যাংক ঋণ নিয়ে। নির্বাচন কমিশনে দেয়া তথ্যমতে ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে আমিন বাজার এলাকায় তার সাড়ে তিন বিঘা জমি ছিল। ২০১৩ সালের নির্বাচনের হলফনামায় তিনি জমির পরিমাণ ১৪১ একরের বেশি দেখান। অপরদিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে অভিযোগ তোলা হয়েছে শুধু বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ পাড়েরই জমি দখল হয়েছে ৫৪ একরের বেশি। বিদ্যুৎকেন্দ্র, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার নামে এ দখল কাজ করা হয়েছে। ব্যাংক এসব জমির ওপর ঋণ প্রদান করেছে। শুধু তাই নয় বিশেষজ্ঞদের মতে যেখানে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ৩৫০-৪০০ কোটি টাকার প্রয়োজন পড়ে সেখানে তার চারগুণ অর্থঋণ প্রদান করা হয়েছে। একে জনগণের জমি তার ওপর প্রয়োজনের চারগুণ অর্থ। এ প্রকল্প থেকে ঋণ আদায় সম্ভব নয় বলেই অনেকে মনে করেন এবং সেটাই হয়েছে। ঋণ ইতোমধ্যে খেলাপি হয়েছে এখন সুদ মওকুফ করে ও আসলটা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অথচ ব্যাংক শিয়াল প-িতের মতো কুমির ছানা দেখছে আর ঋণ দিয়ে চলেছে।

গ্রাম বাংলার একটা কথা আছে ‘আশায় মরে চাষা’। ব্যাংক দখলকৃত জমির বিপরীতে ঋণ দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্ধার অভিযান চলার পরও মামলা চলছে বলে ঋণ পরিশোধের আশায় ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল করে চলেছে। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাকারীদের কত অসীম ক্ষমতা। এই ক্ষমতার জন্যই অনেকে বাংলাদেশকে সব সম্ভবের দেশ ভাবতে পারে। সে সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই ১০০ কোটি টাকা ঋণ চাই। প্রজাতন্ত্রের মালিকের অংশ হিসেবে একজন সাধারণ নাগরিক নিশ্চয়ই নিজে সম্পদহীন হয়েও ব্যাংক ঋণ পাওয়া যেতে পারে, যেখানে ব্যাংকের রয়েছে অসীম ক্ষমতা। সেখানে সামান্য অনুগ্রহ করলেই ঋণ প্রাপ্তি ঘটতে পারে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের শুধু ইচ্ছার প্রয়োজন। তারা একজন সাধারণ নাগরিকের প্রতি ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটালেই হয়। কুমিরের ছানা দেখে ঋণ দেয়া আর সম্পদহীন, যোগ্যতাহীন জেনে ঋণ দেয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দেশের ব্যাংকগুলোতে সারা বছর সুদ মওকুফের যে খেলা চলে তার থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেখালে ব্যাংকের আপাতদৃষ্টিতে কোন ক্ষতি হবে না। দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন এক লক্ষ হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ রয়েছে। প্রতি বছর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কলাকৌশল করে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ উদ্ধার করে তার থেকে বেশি পরিমাণ খেলাপি হয়ে যায়। সে কারণে প্রতি বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ক্রমাগত বেড়ে চলা খেলাপি ঋণের সঙ্গে ১০০ কোটি টাকা যোগ হলে ব্যাংকের কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে? তাই পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় ১০০ কোটি টাকার ঋণ চাওয়া যেতেই পারে এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দ্বিধাহীন চিত্তে এই টাকা দিয়েও দিতে পারে।

বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষরা রাজার রাজা। সাংবিধানিকভাবে এরা কর্মচারী বলে আখ্যায়িত হলেও নিজেদের জন্য মর্যাদাবান হিসেবে কর্মকর্তা উপাধী নির্ধারণ করে নিয়েছেন। এ ক্ষমতাধরদের সালাম দিয়ে স্যার বলা না হলে তারা আন্দোলন করে তা আদায় করে নেন। চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় বিশ্বকে এরা একভাবে দেখেন আর চেয়ার থেকে নেমে সবকিছু অন্যভাবে দেখে থাকেন। এরা সরল বিশ্বাসে কোন কাজ করলে দেশের কোন আইনে অন্যায় বা দুর্নীতি হয় না। তাই দেশের বোকা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত একজন নাগরিকের জন্য সরল বিশ্বাসে একশ কোটি টাকা ঋণ দেশের যে কোনো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ হেলাশ্রেদ্ধা করে দিয়ে নিজেদের অসীম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন। বোকা নাগরিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে কৃতজ্ঞ হব, বাধিত হব।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)]