মৌসুমি ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

খাদ্য হিসেবে ফলের বিকল্প নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার সুস্থ-সবল জীবনের জন্য দৈনিক কিছু ফল গ্রহণ অপরিহার্য। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কিছু না কিছু ফল রাখতেই হয়। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে সারা বছরই কিছু না কিছু ফল পাওয়া যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ফলের গাছ লাগানোর ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গ্রামগঞ্জে আজকাল ব্যাপক হারে নানা ধরনের ফলের আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের চিরপরিচিত আম, জাম, লটকন, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, আনারসের বাইরেও ট্রবেরি, মাল্টা, আঙ্গুর, ড্রাগনের মতো ফলগাছ লাগিয়ে সফল হয়েছেন। ইতোপূর্বে এসব ফল সাধারণত বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। সেই ধারা অব্যাহত থাকলেও দেশে উৎপাদিত এসব বিদেশজাত ফল যোগ হওয়ায় ফলের দামও ক্রয়সীমার মধ্যে নেমে এসেছে। বাজারে নানা জাতের ফলের বিপুল সমারোহ চোখে পড়ে। অথচ আমাদের ছেলেবেলায় আঙ্গুর, আপেলের মতো ফল ছিল রোগীর পথ্য। অথচ আজকাল সববেশি সবাই এসব ফলের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন। ফলগাছ লাগানোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ার বিশেষ কিছু কারণও রয়েছে।

শহরের বাড়ির আঙিনায় এমনকি ছাদে ফলের বাগান করে সেখানে উৎপাদিত ফল খেতে শুরু করেছে। গ্রামের পতিত জায়গা ছেয়ে গেছে ফলবাগানে। অনেক শিক্ষিত মানুষও বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফল বাগান করে সাফল্য পেয়েছেন। বরিশালের স্বরূপকাঠিসহ কিছু এলাকায় ফলগাছের নার্সারির জমজমাট ব্যবসা গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর বর্ষাকালে বৃক্ষমেলায় এখান থেকে উন্নত প্রজাতির ফল গাছের চারা ও কলম নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। সেসব গাছে উৎপাদিত ফলে আজকাল সয়লাব রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি এলাকা।

মিষ্টি আমের রাজধানী বলে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আড়াইশ’ জাতের আমের চাষ হয়। এসব আমের মধ্যে রয়েছে ল্যাংড়া, বোম্বাই, হিমসাগর, আম্রপালি, গোপালভোগ। ঝড়বৃষ্টির কারণে কিছু আম ঝরে পড়লেও ফলন একেবারে কম নয়।

পৃথিবীর সব দেশে উৎপাদিত মৌসুমি ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা থাকে। সরকারি অথবা বেসরকারি পর্যায়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়। ইরাকে প্রচুর উন্নতমানের খেজুর উৎপন্ন হয়। ওদের নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর পরিমাণ খেজুর বিদেশে রফতানি করে। এরপরও খেজুর প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘকাল রেখে খাওয়ার জন্য বহু শিল্পকারখানা স্থাপন করা হয়েছে। গাছ নয়, পাকা খেজুর থেকে রস বের করে জ্যামের মতো কৌটাজাত করা হয়; যা দেখতে জ্যামের মতো এবং খেতে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। একইভাবে উৎপাদিত তরমুজও প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা রয়েছে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে। নাইজেরিয়ায় প্রচুর আম জন্মে। ওখানকার স্থানীয় লোকজন আম ততটা পছন্দ করে না। তাই আমের রসকে প্রক্রিয়াজাত করে কৌটায় ভরে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হয়। এমনকি টমেটোর জুসকেও কৌটাজাত করা হয় নাইজেরিয়ায়। পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ সিয়েরালিয়নে উৎপন্ন প্রচুর আমকে প্রক্রিয়াজাত করতে রাজধানী ফ্রিটাউনে আনার জন্য গ্রামে অনেক ফিডার রোড তৈরি করা হয়েছে। এসব রাস্তা নির্মাণে সহযোগিতা দিয়েছে ইউএনডিপি। একইভাবে মালয়েশিয়ায় রামবুটান, ডুরিয়ানকে প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্যামসন কোম্পানির কৌটাজাত আনারস তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে হরদম উচ্চমূল্যে বিক্রি হতে দেখেছি পাকিস্তান আমলে। অথচ সেই আনারসই আজকাল কত কম মূল্যে আমাদের দেশে বিক্রি হচ্ছে।

ফলের রাজা আম ছাড়াও তরমুজ, কাঁঠাল, পেয়ারার মতো পুষ্টিকর ফল বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয় আমাদের দেশে। দামও তুলনামূলকভাবে কম। অথচ মৌসুমের অল্পদিন পরই এসব ফল ফুরিয়ে যায়। কদাচিৎ পাওয়া গেলেও বিক্রি হয় চড়া দামে, থাকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মৌসুমে উৎপাদিত যেকোনো ফলের দাম অতিরিক্ত কমে যাওয়া বা ফল পচে নষ্ট হওয়া ঠেকাতে ফল প্রক্রিজাতকরণের জন্য শিল্পকারখানা গড়ে তোলা একটি স্বাভাবিক নিয়ম।

দেশে আম প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প অতিনগন্য। বাংলাদেশে উৎপাদিত নানা জাতের বিপুল পরিমাণ মৌসুমি ফল বিশেষ করে- আম, কাঁঠাল, আনারস সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা প্রয়োজন। স্বরূপকাঠির আটঘর, কুড়িআনায় উৎপাদিত প্রচুর পরিমাণে পেয়ারা দিয়ে কারখানায় তৈরি করা যেতে পারে উন্নতমানের জ্যাম। এসব শিল্পকারখানা স্থাপিত হলে সেখানে বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে। দেশের বেকার জনগোষ্ঠী কর্মমুখী হলে হ্রাস পাবে দারিদ্র্য। এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। ফল চাষিরা আর্থিক ক্ষতির বদলে লাভের মুখ দেখবেন। তারা ফল চাষে বেশি আগ্রহী হবেন। বাংলাদেশের মানুষের ফলের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে প্রক্রিয়াজাত ফল বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।

[লেখক : সাবেক প্রকৌশলী ও শিক্ষক]

সোমবার, ২৮ জুন ২০২১ , ১৪ আষাঢ় ১৪২৮ ১৬ জিলক্বদ ১৪৪২

মৌসুমি ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

খাদ্য হিসেবে ফলের বিকল্প নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার সুস্থ-সবল জীবনের জন্য দৈনিক কিছু ফল গ্রহণ অপরিহার্য। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কিছু না কিছু ফল রাখতেই হয়। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে সারা বছরই কিছু না কিছু ফল পাওয়া যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ফলের গাছ লাগানোর ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গ্রামগঞ্জে আজকাল ব্যাপক হারে নানা ধরনের ফলের আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের চিরপরিচিত আম, জাম, লটকন, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, আনারসের বাইরেও ট্রবেরি, মাল্টা, আঙ্গুর, ড্রাগনের মতো ফলগাছ লাগিয়ে সফল হয়েছেন। ইতোপূর্বে এসব ফল সাধারণত বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। সেই ধারা অব্যাহত থাকলেও দেশে উৎপাদিত এসব বিদেশজাত ফল যোগ হওয়ায় ফলের দামও ক্রয়সীমার মধ্যে নেমে এসেছে। বাজারে নানা জাতের ফলের বিপুল সমারোহ চোখে পড়ে। অথচ আমাদের ছেলেবেলায় আঙ্গুর, আপেলের মতো ফল ছিল রোগীর পথ্য। অথচ আজকাল সববেশি সবাই এসব ফলের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন। ফলগাছ লাগানোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ার বিশেষ কিছু কারণও রয়েছে।

শহরের বাড়ির আঙিনায় এমনকি ছাদে ফলের বাগান করে সেখানে উৎপাদিত ফল খেতে শুরু করেছে। গ্রামের পতিত জায়গা ছেয়ে গেছে ফলবাগানে। অনেক শিক্ষিত মানুষও বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফল বাগান করে সাফল্য পেয়েছেন। বরিশালের স্বরূপকাঠিসহ কিছু এলাকায় ফলগাছের নার্সারির জমজমাট ব্যবসা গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর বর্ষাকালে বৃক্ষমেলায় এখান থেকে উন্নত প্রজাতির ফল গাছের চারা ও কলম নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। সেসব গাছে উৎপাদিত ফলে আজকাল সয়লাব রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি এলাকা।

মিষ্টি আমের রাজধানী বলে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আড়াইশ’ জাতের আমের চাষ হয়। এসব আমের মধ্যে রয়েছে ল্যাংড়া, বোম্বাই, হিমসাগর, আম্রপালি, গোপালভোগ। ঝড়বৃষ্টির কারণে কিছু আম ঝরে পড়লেও ফলন একেবারে কম নয়।

পৃথিবীর সব দেশে উৎপাদিত মৌসুমি ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা থাকে। সরকারি অথবা বেসরকারি পর্যায়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়। ইরাকে প্রচুর উন্নতমানের খেজুর উৎপন্ন হয়। ওদের নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর পরিমাণ খেজুর বিদেশে রফতানি করে। এরপরও খেজুর প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘকাল রেখে খাওয়ার জন্য বহু শিল্পকারখানা স্থাপন করা হয়েছে। গাছ নয়, পাকা খেজুর থেকে রস বের করে জ্যামের মতো কৌটাজাত করা হয়; যা দেখতে জ্যামের মতো এবং খেতে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। একইভাবে উৎপাদিত তরমুজও প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা রয়েছে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে। নাইজেরিয়ায় প্রচুর আম জন্মে। ওখানকার স্থানীয় লোকজন আম ততটা পছন্দ করে না। তাই আমের রসকে প্রক্রিয়াজাত করে কৌটায় ভরে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হয়। এমনকি টমেটোর জুসকেও কৌটাজাত করা হয় নাইজেরিয়ায়। পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ সিয়েরালিয়নে উৎপন্ন প্রচুর আমকে প্রক্রিয়াজাত করতে রাজধানী ফ্রিটাউনে আনার জন্য গ্রামে অনেক ফিডার রোড তৈরি করা হয়েছে। এসব রাস্তা নির্মাণে সহযোগিতা দিয়েছে ইউএনডিপি। একইভাবে মালয়েশিয়ায় রামবুটান, ডুরিয়ানকে প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্যামসন কোম্পানির কৌটাজাত আনারস তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে হরদম উচ্চমূল্যে বিক্রি হতে দেখেছি পাকিস্তান আমলে। অথচ সেই আনারসই আজকাল কত কম মূল্যে আমাদের দেশে বিক্রি হচ্ছে।

ফলের রাজা আম ছাড়াও তরমুজ, কাঁঠাল, পেয়ারার মতো পুষ্টিকর ফল বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয় আমাদের দেশে। দামও তুলনামূলকভাবে কম। অথচ মৌসুমের অল্পদিন পরই এসব ফল ফুরিয়ে যায়। কদাচিৎ পাওয়া গেলেও বিক্রি হয় চড়া দামে, থাকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মৌসুমে উৎপাদিত যেকোনো ফলের দাম অতিরিক্ত কমে যাওয়া বা ফল পচে নষ্ট হওয়া ঠেকাতে ফল প্রক্রিজাতকরণের জন্য শিল্পকারখানা গড়ে তোলা একটি স্বাভাবিক নিয়ম।

দেশে আম প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প অতিনগন্য। বাংলাদেশে উৎপাদিত নানা জাতের বিপুল পরিমাণ মৌসুমি ফল বিশেষ করে- আম, কাঁঠাল, আনারস সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা প্রয়োজন। স্বরূপকাঠির আটঘর, কুড়িআনায় উৎপাদিত প্রচুর পরিমাণে পেয়ারা দিয়ে কারখানায় তৈরি করা যেতে পারে উন্নতমানের জ্যাম। এসব শিল্পকারখানা স্থাপিত হলে সেখানে বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে। দেশের বেকার জনগোষ্ঠী কর্মমুখী হলে হ্রাস পাবে দারিদ্র্য। এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। ফল চাষিরা আর্থিক ক্ষতির বদলে লাভের মুখ দেখবেন। তারা ফল চাষে বেশি আগ্রহী হবেন। বাংলাদেশের মানুষের ফলের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে প্রক্রিয়াজাত ফল বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।

[লেখক : সাবেক প্রকৌশলী ও শিক্ষক]