বাছির ও মিজানুরের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে

৪০ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেনে ফেঁসেছেন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট পুলিশের ডিআইজি (বরখাস্ত) মিজানুর রহমান ও অভিযোগ অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক পরিচালক (বরখাস্ত) খন্দকার এনামুল বাছির। এ নিয়ে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে সংশ্লিষ্ট দফতর। ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানের জন্য নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মঞ্জুর মোরদেশকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ঘুষ লেনদেনে তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে ঘুষ দেয়া ডিআইজি মিজান ও ঘুষ নেয়া দুদক পরিচালক (বরখাস্ত) খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ডিআইজি মিজান নিশ্চয়ই অপরাধ ঢাকতে ঘুষ দিয়েছেন। তার আগের অপরাধের বিচার চলছে। নতুন করে যদি ঘুষ দেয়ার মতো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি কেন ঘুষ দিয়েছেন? নিশ্চয়ই তার কোন দুর্বলতা আছে। তা না হলে তিনি কেন ঘুষ দেবেন? দুর্বলতা ঢাকতে তিনি ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ। তার বিরুদ্ধে আগের অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার এখনও প্রক্রিয়াধীন।

পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র জানায়, দুদক কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়া এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে কথা বলার ঘটনায় ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। একজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মিজানুর রহমান যেহেতু একজন ডিআইজি, এ জন্য তার চেয়ে সিনিয়র অর্থাৎ অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বিষয়টি তদন্ত করবেন। তিনি তদন্ত করে সুপারিশসহকারে প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেবেন।

পুলিশের সাবেক আইজি একেএম শহিদুল হক বলেন, ডিআইজি মিজান ঘুষ দিয়ে থাকলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। মিজানুর রহমান একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। আইন তার জানার কথা। যদি তিনি করে থাকেন, তাহলে কাজটি ঠিক করেননি।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, তার (ডিআইজি মিজান) ব্যক্তিগত কোন কাজের দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক নারীকে অস্ত্রের মুখে বিয়ে করা এবং ওই বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে। কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী মরিয়ম আক্তার প্রভা বিয়ের কথা প্রকাশ করায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে গ্রেফতার ও নির্যাতন, এক সংবাদ পাঠিকা ও এক নারী রিপোর্টারকে যৌন হয়রানির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রথমে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীকে দায়িত্ব দেয় দুদক। এরপর ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীকে সরিয়ে নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা দেয়া হয় খন্দকার এনামুল বাছিরকে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে খন্দকার এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেন। ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগÑ তিনি পুলিশের নিয়োগ, বদলিতেও এক সময় ভূমিকা রাখতেন। গ্রেফতার ও মামলা দিয়ে হয়রানি করে টাকা আদায় করতেন। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন ডিআইজি মিজান। সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনারও ছিলেন তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ছিলেন। ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হলে তিনি দ্বিতীয় অনুসন্ধান কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাছিরকে ঘুষের ট্রাফে ফেলেন। নিজেকে বাঁচাতে দুদক পরিচালককে ২ দফায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেন। ঘুষের লেনদেনের তথ্য তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলেন এবং তা রেকর্ড করে রাখেন। প্রশ্ন হলো, যে ৪০ লাখ টাকা তিনি ঘুষ দিয়েছেন, ওই টাকার উৎস কি? বরখাস্ত থাকা অবস্থায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা ৪০ লাখ টাকা কোথায় পেলেন, আইনের লোক হয়েও ঘুষ দেয়া অপরাধ জেনেও তিনি কেন আরেকজন কর্মকর্তাকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেনÑ এসব বিষয় তদন্ত করা হবে।

ডিআইজি মিজানকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া এবং কমিশনের তথ্য পাচারের অভিযোগে বরখাস্তÍ হওয়া দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এর আগেও একবার ৪০ মাস সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। তখন ৩৫০ কোটি টাকা উদ্ধার সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তদন্তে অসততার অভিযোগ উঠলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। তবে পরে পরিস্থিতি সামলে উঠে চাকরিতে পুনর্বহাল হন তিনি, পান পদোন্নতি। তার নামে রাজধানীর মেরাদিয়ায় ৬ শতাংশ জমির ওপর স্থাপিত একটি স্কুল এবং তার স্ত্রী নামে উত্তরায় একটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। স্ত্রী রুমানা শাহীন শেফা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এনামুল রাছিরের দাবি, তার ও স্ত্রী শেফার সার্ভিস অ্যাকাউন্টের বাইরে কোন ব্যাংক হিসাব নেই। তবে অনুসন্ধানে রুমানা শাহীন শেফার নামে সার্ভিস অ্যাকাউন্টের বাইরে সোনালী ব্যাংক ও বাছিরের নামে এক্সিম ব্যাংকে দুটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। বাছিরের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো, তিনি ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে স্ত্রী শেফাকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বানাতে চেয়েছিলেন। শেফাকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদের চার সদস্য নিয়ে একটি নিয়োগ কমিটিও গঠিত হয়। তবে নিয়োগ নিয়ে ৩০ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠলে গত ২৯ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগ নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। বিষয়টি এখন তদন্তাধীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন তৎকালীন পিজি থেকে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) শরীরবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন খন্দকার এনামুল বাছির। তার পড়াশোনা শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। ১৯৯১ সালে তিনি দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে যোগ দেন। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরোর নাম হয় দুর্নীতি দমন কমিশন। পরিচালক হওয়ার আগে দুদকের আইন বিভাগের উপ-পরিচালকও ছিলেন তিনি। ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের দায়িত্ব যখন পান, তখন তিনি বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত অনুবিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ৬ মাস আগে তিনি বদলি হয়ে অবৈধ সম্পদ উদ্ধার ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পান।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই তাকে গ্রেফতারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না দুদক। ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে খন্দকার এনামুল বাছিরকে বরখাস্ত করা হয়নি। তথ্য পাচারের অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। যে কারও বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসতে পারে। এটিই স্বাভাবিক। এর মানে এই নয় যে, তিনি অপরাধী। কে অপরাধী, সেটি প্রমাণ হবে আদালতে। বাছিরের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে দুদক। অনুসন্ধানে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে। তিনি বলেন, দুদকের অনুসন্ধানে যাতে কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে, এ জন্য খন্দকার এনামুল বাছিরকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান জানান, পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে কমিশন। দুদক পরিচালক মঞ্জুর মোরশেদকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে যে প্রতিবেদন দুদকে জমা দিয়েছে, তা আমলে নেয়নি দুদক। নতুন করে ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করেন নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির জানান, তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে ভুল, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। এতে তিনি ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছেন। সংবাদ প্রকাশে তারা যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন মনে করছেন না।

গত ২৩ মে ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন ঘুষ লেনদেন ও তথ্য পাচারের অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুর বাছির। ওই প্রতিবেদনে তিনি ডিআইজি মিজানের ৪ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে এবং এর মধ্যে ২ কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। ওই প্রতিবেদনের জমা দেয়ার পর ৩০ মে পুলিশ প্লাজায় অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক পরিচালক এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের স্ত্রীর মালিকানাধীন দোকানে যান। ওইদিন সেখানে ডিআইজি মিজানের সঙ্গে তার কথা হয়। সেখানে ডিআইজি মিজান তার বিরুদ্ধে চলা সম্পদের অনুসন্ধানে রিপোর্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে এনামুল বাছির প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে বলে জানান। এরপর ডিআইজি মিজান অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে ঘুষ লেনদেনের অডিও ফাঁস করেন। ওই অডিও বক্তব্য অনুযায়ী ডিআইজি মিজানের সঙ্গে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের সঙ্গে ঘুষের টাকা চাওয়া, গাড়ি চাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে শোনা গেছে। গণমাধ্যমে এ বক্তব্য প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে দুর্নীতি দমন কমিশন। ডিআইজি মিজান দাবি করেন, তাকে বাধ্য করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাছির দু’দফায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। আরও ১০ লাখ টাকা ঘুষের জন্য তিনি বার বার চাপ দিয়েছেন। এছাড়া তার কাছে একটি গাড়িও দাবি করেছেন বাছির। অনুসসন্ধান চলাকালে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে না এমন বক্তব্য দিয়ে ঘুষের টাকার বিষয়ে এবং গাড়ি চেয়ে বাছিরের কথোপকথন রেকর্ড করেছেন তিনি। দুদক চাইলে তিনি ওইসব রেকর্ড দিতে পারবেন। অন্যদিকে বরখাস্ত হওয়া দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের দাবি- প্রযুক্তি সহযোগিতায় এমন অডিও রেকর্ড তৈরি করে প্রকাশ করেছে ডিআইজি মিজান। ঘুষের টাকার জন্য তিনি ডিআইজি মিজানের সঙ্গে কোন কথা বলেননি। এমনকি গাড়িও চাননি। কেবল অনুসন্ধান বিষয়ে দুটি বিষয়ে তিনি জানতে ডিআইজি মিজানকে ফোন করেছিলেন।

বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন ২০১৯ , ৩০ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ৯ শাওয়াল ১৪৪০

ঘুষ লেনদেন

বাছির ও মিজানুরের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

৪০ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেনে ফেঁসেছেন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট পুলিশের ডিআইজি (বরখাস্ত) মিজানুর রহমান ও অভিযোগ অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক পরিচালক (বরখাস্ত) খন্দকার এনামুল বাছির। এ নিয়ে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে সংশ্লিষ্ট দফতর। ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানের জন্য নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মঞ্জুর মোরদেশকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ঘুষ লেনদেনে তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে ঘুষ দেয়া ডিআইজি মিজান ও ঘুষ নেয়া দুদক পরিচালক (বরখাস্ত) খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ডিআইজি মিজান নিশ্চয়ই অপরাধ ঢাকতে ঘুষ দিয়েছেন। তার আগের অপরাধের বিচার চলছে। নতুন করে যদি ঘুষ দেয়ার মতো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি কেন ঘুষ দিয়েছেন? নিশ্চয়ই তার কোন দুর্বলতা আছে। তা না হলে তিনি কেন ঘুষ দেবেন? দুর্বলতা ঢাকতে তিনি ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ। তার বিরুদ্ধে আগের অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার এখনও প্রক্রিয়াধীন।

পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র জানায়, দুদক কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়া এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে কথা বলার ঘটনায় ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। একজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মিজানুর রহমান যেহেতু একজন ডিআইজি, এ জন্য তার চেয়ে সিনিয়র অর্থাৎ অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বিষয়টি তদন্ত করবেন। তিনি তদন্ত করে সুপারিশসহকারে প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেবেন।

পুলিশের সাবেক আইজি একেএম শহিদুল হক বলেন, ডিআইজি মিজান ঘুষ দিয়ে থাকলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। মিজানুর রহমান একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। আইন তার জানার কথা। যদি তিনি করে থাকেন, তাহলে কাজটি ঠিক করেননি।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, তার (ডিআইজি মিজান) ব্যক্তিগত কোন কাজের দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক নারীকে অস্ত্রের মুখে বিয়ে করা এবং ওই বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে। কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী মরিয়ম আক্তার প্রভা বিয়ের কথা প্রকাশ করায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে গ্রেফতার ও নির্যাতন, এক সংবাদ পাঠিকা ও এক নারী রিপোর্টারকে যৌন হয়রানির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রথমে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীকে দায়িত্ব দেয় দুদক। এরপর ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীকে সরিয়ে নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা দেয়া হয় খন্দকার এনামুল বাছিরকে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে খন্দকার এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেন। ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগÑ তিনি পুলিশের নিয়োগ, বদলিতেও এক সময় ভূমিকা রাখতেন। গ্রেফতার ও মামলা দিয়ে হয়রানি করে টাকা আদায় করতেন। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন ডিআইজি মিজান। সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনারও ছিলেন তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ছিলেন। ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হলে তিনি দ্বিতীয় অনুসন্ধান কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাছিরকে ঘুষের ট্রাফে ফেলেন। নিজেকে বাঁচাতে দুদক পরিচালককে ২ দফায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেন। ঘুষের লেনদেনের তথ্য তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলেন এবং তা রেকর্ড করে রাখেন। প্রশ্ন হলো, যে ৪০ লাখ টাকা তিনি ঘুষ দিয়েছেন, ওই টাকার উৎস কি? বরখাস্ত থাকা অবস্থায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা ৪০ লাখ টাকা কোথায় পেলেন, আইনের লোক হয়েও ঘুষ দেয়া অপরাধ জেনেও তিনি কেন আরেকজন কর্মকর্তাকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেনÑ এসব বিষয় তদন্ত করা হবে।

ডিআইজি মিজানকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া এবং কমিশনের তথ্য পাচারের অভিযোগে বরখাস্তÍ হওয়া দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এর আগেও একবার ৪০ মাস সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। তখন ৩৫০ কোটি টাকা উদ্ধার সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তদন্তে অসততার অভিযোগ উঠলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। তবে পরে পরিস্থিতি সামলে উঠে চাকরিতে পুনর্বহাল হন তিনি, পান পদোন্নতি। তার নামে রাজধানীর মেরাদিয়ায় ৬ শতাংশ জমির ওপর স্থাপিত একটি স্কুল এবং তার স্ত্রী নামে উত্তরায় একটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। স্ত্রী রুমানা শাহীন শেফা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এনামুল রাছিরের দাবি, তার ও স্ত্রী শেফার সার্ভিস অ্যাকাউন্টের বাইরে কোন ব্যাংক হিসাব নেই। তবে অনুসন্ধানে রুমানা শাহীন শেফার নামে সার্ভিস অ্যাকাউন্টের বাইরে সোনালী ব্যাংক ও বাছিরের নামে এক্সিম ব্যাংকে দুটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। বাছিরের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো, তিনি ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে স্ত্রী শেফাকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বানাতে চেয়েছিলেন। শেফাকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদের চার সদস্য নিয়ে একটি নিয়োগ কমিটিও গঠিত হয়। তবে নিয়োগ নিয়ে ৩০ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠলে গত ২৯ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগ নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। বিষয়টি এখন তদন্তাধীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন তৎকালীন পিজি থেকে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) শরীরবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন খন্দকার এনামুল বাছির। তার পড়াশোনা শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। ১৯৯১ সালে তিনি দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে যোগ দেন। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরোর নাম হয় দুর্নীতি দমন কমিশন। পরিচালক হওয়ার আগে দুদকের আইন বিভাগের উপ-পরিচালকও ছিলেন তিনি। ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের দায়িত্ব যখন পান, তখন তিনি বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত অনুবিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ৬ মাস আগে তিনি বদলি হয়ে অবৈধ সম্পদ উদ্ধার ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পান।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই তাকে গ্রেফতারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না দুদক। ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে খন্দকার এনামুল বাছিরকে বরখাস্ত করা হয়নি। তথ্য পাচারের অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। যে কারও বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসতে পারে। এটিই স্বাভাবিক। এর মানে এই নয় যে, তিনি অপরাধী। কে অপরাধী, সেটি প্রমাণ হবে আদালতে। বাছিরের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে দুদক। অনুসন্ধানে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে। তিনি বলেন, দুদকের অনুসন্ধানে যাতে কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে, এ জন্য খন্দকার এনামুল বাছিরকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান জানান, পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে কমিশন। দুদক পরিচালক মঞ্জুর মোরশেদকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে যে প্রতিবেদন দুদকে জমা দিয়েছে, তা আমলে নেয়নি দুদক। নতুন করে ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করেন নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির জানান, তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে ভুল, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। এতে তিনি ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছেন। সংবাদ প্রকাশে তারা যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন মনে করছেন না।

গত ২৩ মে ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন ঘুষ লেনদেন ও তথ্য পাচারের অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুর বাছির। ওই প্রতিবেদনে তিনি ডিআইজি মিজানের ৪ কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে এবং এর মধ্যে ২ কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। ওই প্রতিবেদনের জমা দেয়ার পর ৩০ মে পুলিশ প্লাজায় অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক পরিচালক এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের স্ত্রীর মালিকানাধীন দোকানে যান। ওইদিন সেখানে ডিআইজি মিজানের সঙ্গে তার কথা হয়। সেখানে ডিআইজি মিজান তার বিরুদ্ধে চলা সম্পদের অনুসন্ধানে রিপোর্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে এনামুল বাছির প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে বলে জানান। এরপর ডিআইজি মিজান অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে ঘুষ লেনদেনের অডিও ফাঁস করেন। ওই অডিও বক্তব্য অনুযায়ী ডিআইজি মিজানের সঙ্গে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের সঙ্গে ঘুষের টাকা চাওয়া, গাড়ি চাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে শোনা গেছে। গণমাধ্যমে এ বক্তব্য প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে দুর্নীতি দমন কমিশন। ডিআইজি মিজান দাবি করেন, তাকে বাধ্য করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাছির দু’দফায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। আরও ১০ লাখ টাকা ঘুষের জন্য তিনি বার বার চাপ দিয়েছেন। এছাড়া তার কাছে একটি গাড়িও দাবি করেছেন বাছির। অনুসসন্ধান চলাকালে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে না এমন বক্তব্য দিয়ে ঘুষের টাকার বিষয়ে এবং গাড়ি চেয়ে বাছিরের কথোপকথন রেকর্ড করেছেন তিনি। দুদক চাইলে তিনি ওইসব রেকর্ড দিতে পারবেন। অন্যদিকে বরখাস্ত হওয়া দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের দাবি- প্রযুক্তি সহযোগিতায় এমন অডিও রেকর্ড তৈরি করে প্রকাশ করেছে ডিআইজি মিজান। ঘুষের টাকার জন্য তিনি ডিআইজি মিজানের সঙ্গে কোন কথা বলেননি। এমনকি গাড়িও চাননি। কেবল অনুসন্ধান বিষয়ে দুটি বিষয়ে তিনি জানতে ডিআইজি মিজানকে ফোন করেছিলেন।