সাহিত্য সংগ্রামের আহসান হাবীব

রহিমা আক্তার মৌ

বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশের প্রসঙ্গ অনুষঙ্গকে যিনি কবিতায় তুলে আনতে পেরেছেন চমৎকার কুশলতায়। সব রকম শোষণ-জুলুম, দুঃশাসন নির্যাতন যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। দেখেছেন মানবিক ঔদার্য্য দিয়ে, অন্তরঙ্গ আলোকের নিভৃত ভূগোলে যিনি সময়ে ও অসময়ে মানুষকে জর্জরিত হতে দেখে ব্যথিত হয়েছেন, তা দিয়ে দুঃখের পঙ্ক্তিমালা সাজিয়েছেন, যাকে চল্লিশ দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি হিসেবেই চেনেন সবাই, তিনি হলেন কবি আহসান হাবীব। ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুর জেলার শঙ্করপাশা গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কবি আহসান হাবীব। বাবা হামিজ উদ্দিন হাওলাদার এবং মা জমিলা খাতুনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পারিবার ছিল তাদের। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে দায়িত্বও ছিল অনেক। আহসান হাবীব সাহিত্য সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন, শৈশবেই তার ভেতরে কবিতার বীজ, শেকড় গড়ে উঠে। ১২/১৩ বছর বয়সেই লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ছাত্রাবস্থায় কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হলে নিজের সম্পর্কে আস্থা বেড়ে যায়। ১৯৩৪ সালে তার প্রথম কবিতা মায়ের কবর পাড়ে কিশোর পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তুকে কবিতায় উপস্থাপিত করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

তিনি পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৩৫ সালে। পাস করার পর ভর্তি হন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। বাবার সাথে মনোমালিন্য পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতা আর কবি হওয়ায় বাসনায় কলেজে পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই ১৯৩৬ সালের শেষের দিকে পাড়ি জমান কলকাতায়। কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন এবং আজীবন ওই পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। কলকাতায় শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। ফজলুল হক শেলবর্ষী সম্পাদিত ‘দৈনিক তদবির’ পত্রিকায় মাসিক ১৭ টাকায় শুরু করেন কর্মজীবনের প্রথম চাকরি। তারপর তিনি বিভিন্ন সময় দৈনিক, মাসিক, পাক্ষিক পত্রিকাসহ শিশু শওগত, দৈনিক কৃষক ইত্যাদি কাগজে ও কাজ করেন।

‘যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার’ জীবনের যুদ্ধ তার যৌবনের যুদ্ধকে ছুতে পারেনি, সেই যৌবনে কলকাতায় মেসবাড়ির দুর্বিষহ জীবনের মধ্যে তিনি সময় বের করে নিভৃতে কাব্যচর্চা চালিয়ে যেতেন। জীবনের ওই চরম মুহূর্তের মধ্যেও তিনি ফলিয়েছেন কবিতার সোনার ফসল। বাংলা কবিতার ভুবনে যুক্ত করেছেন এক হিরন্ময় অধ্যায়। আমাদের এই বাংলায় উত্তরাধুনিক যুগ আর পথ নির্মাণে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন আহসান হাবীব। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার বুলবুল পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক সওগাত পত্রিকায় কাজ করেন। এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন এবং একই সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাকের সাাহিত্য সম্পাদক হন তিনি।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি বিভিন্ন সময়ে আজাদ, মোহাম্মদী, কৃষক, ইত্তেহাদ প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কমরেড পাবলিশার্স থেকে ১৯৪৭ সালে আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই ‘রাত্রি শেষ’ প্রকাশিত হয়। জীবনের গভীর দুঃখ-কষ্টের সময়ে লেখা কবিতাগুলো স্থান পায় তার এই গ্রন্থে। কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে মানুষ, সমাজ, সমকাল, বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রাম, স্বপ্ন, প্রাপ্তি, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ও শ্রেণী বৈষম্য। তার সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বিষয়ও।

আহসান হাবীব ১৯৪৭ সালের ২১ জুন বিয়ে করেন বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া নিবাসী মহসীন আলী মিয়ার কন্যা সুফিয়া খাতুনকে। দাম্পত্য জীবনে দুই কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের বাবা-মা তারা। সন্তানরা হলেনÑ কেয়া চৌধুরী, জোহরা নাসরীন, মঈনুল আহসান সাবের ও মনজুরুল আহসান জাবের। পুত্র মঈনুল আহসান সাবের একজন স্বনামখ্যাত বাংলা ঔপন্যাসিক। ১৯৫০ সালে পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি ‘কথাবিতান’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে তোলেন। সেই প্রকাশনা থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অবশেষ ১৯৬৪ সালে যোগ দেন তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫৭-৬৪ পর্যন্ত তিনি ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনসের প্রডাকশন অ্যাডভাইজার ছিলেন। পরে তিনি কিছুদিন দৈনিক পাকিস্তানে কাজ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দৈনিক বাংলার সাহিত্য-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

আহসান হাবীবের কবি জীবন রোমান্টিকতার অনুসারী। তবে তা সমাজ ও সমাজের ভাবনার বিষয় বস্তুর বাহিরের ছিল না। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল প্রায় প্রবাদতুল্য। এ দেশের বহু লেখক ও কবির জীবনের প্রথম রচনা তার হাত দিয়েই প্রকাশিত হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে তার প্রচেষ্টা ছিল অগ্রগণ্য। বাংলা সাহিত্যে অনিবার্য একটি নাম আহসান হাবীব, প্রচন্ড জীবন সংগ্রামের মধ্যে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সাহিত্য সাধনায়। মৃদুভাষী, আত্মমগ্ন ও ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। নিসর্গের প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ। বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশের প্রসঙ্গ অনুষঙ্গকে আহসানে হাবীব নিজের কবিতায় তুলে আনতে পেরেছেন চমৎকারভাবে। কারণ এসব তিনি প্রত্যক্ষভাবেই দেখেছে, উপলব্ধি করেছেন।

মানুষের জীবন এক বিচিত্র অবস্থান, চারদিকে ছড়িয়ে থাকে নানা বৈচিত্র্য, সুখ-দুঃখ, আনন্দ আর বেদনা। কবিগণ এ আনন্দময় বিচিত্র জীবন থেকে বেঁচে থাকার সুখ ও সার্থকতা তুলে ধরেন তার কবিতায়। কবি আহসান হাবীবের বেলায়ও হয়েছে তাই। নিজের আত্মচরিত্রকে উন্মুক্ত করে আহসান হাবীব চৈতন্য নতুন পথ সঞ্চারের নির্দেশে শিকড়স্পর্শী চেতনায় জানান দিয়েছেন নিজেই নিজের কবিতার লাইনে। কবিতা যে একজন কবির জীবনের সম্ভাবনার একটা ইতিবাচক প্রান্তর তা তিনি রচনা করে গেছেন। কবিতার শাখার শাখায় আধুনিকতার জটিল মাত্রা খুঁজে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন তিনি। রাজনীতিতে কবিতার সচেতন মানসভূমির উচ্চারণ হিসেবেই এনেছেন তিনি, সেখানেও শিল্পের দায়-দাবি পূরণে তিনি ছিলেন নিখুঁত যত্নশীল। কোনো ধরনের বাহুল্য, পক্ষপাতিত্ব, কূপমন্ডুকতা সেখানে জায়গা পায়নি। প্রত্যক্ষ করেছেন কাল ও সংকটের আবর্তে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়মান মানুষের জীবনযাত্রা। আবহমান কালের অস্থিরতা নৈরাজ্য প্রতিনিয়ত তাকে বিচলিত করেছে। তাইতো সব সংকটের তীব্রতায় দু’চোখে দেখে তিনি অক্লান্ত আকাঙ্ক্ষা ও অস্থির চিত্তে উচ্চারণ করেছেন কবিতার শব্দ।

মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা তার কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন যুগযন্ত্রণা তার কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফূটিত হয়েছে। কবিতার ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ খুঁজে পায় তার ভক্ত ও কবিতাপ্রেমীরা। খ্যাতিমান বাংলাদেশি কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে আহসান হাবীব দীর্ঘদিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনেও অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন। তিনি দেশ বিভাগের আগেই সমকালীন কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা তার কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন যুগ যন্ত্রণা তার কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফূটিত হয়েছে।

সমকালীন জীবন ও সমাজের বাস্তবরূপ তার কবিতায় সহজ-সরল ভাষায় উঠে এসেছে। গভীর জীবন বোধ ও আশাবাদ তার কবিতাকে বিশিষ্ট ব্যঞ্জনা দান করেছে। তার কবিতার স্নিগ্ধতা পাঠকচিত্তে এক মধুর আবেশ সৃষ্টি করে। তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং আর্ত-মানবতার পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের কীর্তিমান কবি ও লেখক আহসান হাবীব ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই ইন্তেকাল করেন। কবি বললেও সাহিত্যের অনেক গন্ডিতে রয়েছে আহসান হাবীবের রচিত সাহিত্যকর্ম। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৮টি। অন্যান্য লেখাসহ সব মিলিয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যা ২৫। এর মধ্যে রয়েছে কাব্যগ্রন্থ- ‘রাত্রি শেষ’, ‘ছায়া হরিণ’, ‘সারা দুপুর’, ‘আশায় বসতি’, ‘দুই হাতে দুই আদিম পাথর’, ‘প্রেমের কবিতা’ ও ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’। কাব্যনুবাদ হলো ‘খসড়া’। উপন্যাস ‘অরণ্য নীলিমা’। শিশুসাহিত্য- ‘জোছনা রাতের গল্প’, ‘রাণী খালের সাঁকো, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ‘ছুটির দিন দুপুরে’। অনুবাদ- ‘প্রবাল দ্বীপে তিন বন্ধু’ ‘অভিযাত্রী কলম্বাস’, ‘রত্নদ্বীপ’, ‘রাজা বাদশা হাজার মানুষ’, ‘এসো পথ চিনে নিই’ ‘ইন্দোনেশিয়া’, ‘ছোটদের পাকিস্তান’ ও ‘বোকা বোকাই’। সম্পাদিত গ্রন্থ- ‘বিদেশের সেরা গল্প’ ও ‘কাব্যলোক’। কবি আহসান হাবীব বরাবরই ছিলেন নির্লিপ্ত অন্তর্মুখী এক মানুষ। বাংলা কবিতায় তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একাধিক সাহিত্য পুরস্কার। তার মধ্যে ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, একুশে পদক, আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পদক, আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি। পঞ্চাশের কাব্য আন্দোলনের উত্তর সাধক হিসেবে আধুনিক কবিতার উত্তরাধিকারের পথকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন আহসান হাবীব।

[লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক]

rbabygolpo710@gmail.com

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

সাহিত্য সংগ্রামের আহসান হাবীব

রহিমা আক্তার মৌ

বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশের প্রসঙ্গ অনুষঙ্গকে যিনি কবিতায় তুলে আনতে পেরেছেন চমৎকার কুশলতায়। সব রকম শোষণ-জুলুম, দুঃশাসন নির্যাতন যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। দেখেছেন মানবিক ঔদার্য্য দিয়ে, অন্তরঙ্গ আলোকের নিভৃত ভূগোলে যিনি সময়ে ও অসময়ে মানুষকে জর্জরিত হতে দেখে ব্যথিত হয়েছেন, তা দিয়ে দুঃখের পঙ্ক্তিমালা সাজিয়েছেন, যাকে চল্লিশ দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি হিসেবেই চেনেন সবাই, তিনি হলেন কবি আহসান হাবীব। ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুর জেলার শঙ্করপাশা গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কবি আহসান হাবীব। বাবা হামিজ উদ্দিন হাওলাদার এবং মা জমিলা খাতুনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পারিবার ছিল তাদের। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে দায়িত্বও ছিল অনেক। আহসান হাবীব সাহিত্য সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন, শৈশবেই তার ভেতরে কবিতার বীজ, শেকড় গড়ে উঠে। ১২/১৩ বছর বয়সেই লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ছাত্রাবস্থায় কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হলে নিজের সম্পর্কে আস্থা বেড়ে যায়। ১৯৩৪ সালে তার প্রথম কবিতা মায়ের কবর পাড়ে কিশোর পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তুকে কবিতায় উপস্থাপিত করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

তিনি পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৩৫ সালে। পাস করার পর ভর্তি হন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। বাবার সাথে মনোমালিন্য পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতা আর কবি হওয়ায় বাসনায় কলেজে পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই ১৯৩৬ সালের শেষের দিকে পাড়ি জমান কলকাতায়। কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন এবং আজীবন ওই পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। কলকাতায় শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। ফজলুল হক শেলবর্ষী সম্পাদিত ‘দৈনিক তদবির’ পত্রিকায় মাসিক ১৭ টাকায় শুরু করেন কর্মজীবনের প্রথম চাকরি। তারপর তিনি বিভিন্ন সময় দৈনিক, মাসিক, পাক্ষিক পত্রিকাসহ শিশু শওগত, দৈনিক কৃষক ইত্যাদি কাগজে ও কাজ করেন।

‘যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার’ জীবনের যুদ্ধ তার যৌবনের যুদ্ধকে ছুতে পারেনি, সেই যৌবনে কলকাতায় মেসবাড়ির দুর্বিষহ জীবনের মধ্যে তিনি সময় বের করে নিভৃতে কাব্যচর্চা চালিয়ে যেতেন। জীবনের ওই চরম মুহূর্তের মধ্যেও তিনি ফলিয়েছেন কবিতার সোনার ফসল। বাংলা কবিতার ভুবনে যুক্ত করেছেন এক হিরন্ময় অধ্যায়। আমাদের এই বাংলায় উত্তরাধুনিক যুগ আর পথ নির্মাণে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন আহসান হাবীব। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার বুলবুল পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক সওগাত পত্রিকায় কাজ করেন। এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন এবং একই সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাকের সাাহিত্য সম্পাদক হন তিনি।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি বিভিন্ন সময়ে আজাদ, মোহাম্মদী, কৃষক, ইত্তেহাদ প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কমরেড পাবলিশার্স থেকে ১৯৪৭ সালে আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই ‘রাত্রি শেষ’ প্রকাশিত হয়। জীবনের গভীর দুঃখ-কষ্টের সময়ে লেখা কবিতাগুলো স্থান পায় তার এই গ্রন্থে। কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে মানুষ, সমাজ, সমকাল, বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রাম, স্বপ্ন, প্রাপ্তি, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ও শ্রেণী বৈষম্য। তার সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বিষয়ও।

আহসান হাবীব ১৯৪৭ সালের ২১ জুন বিয়ে করেন বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া নিবাসী মহসীন আলী মিয়ার কন্যা সুফিয়া খাতুনকে। দাম্পত্য জীবনে দুই কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের বাবা-মা তারা। সন্তানরা হলেনÑ কেয়া চৌধুরী, জোহরা নাসরীন, মঈনুল আহসান সাবের ও মনজুরুল আহসান জাবের। পুত্র মঈনুল আহসান সাবের একজন স্বনামখ্যাত বাংলা ঔপন্যাসিক। ১৯৫০ সালে পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি ‘কথাবিতান’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে তোলেন। সেই প্রকাশনা থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অবশেষ ১৯৬৪ সালে যোগ দেন তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫৭-৬৪ পর্যন্ত তিনি ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনসের প্রডাকশন অ্যাডভাইজার ছিলেন। পরে তিনি কিছুদিন দৈনিক পাকিস্তানে কাজ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দৈনিক বাংলার সাহিত্য-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

আহসান হাবীবের কবি জীবন রোমান্টিকতার অনুসারী। তবে তা সমাজ ও সমাজের ভাবনার বিষয় বস্তুর বাহিরের ছিল না। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল প্রায় প্রবাদতুল্য। এ দেশের বহু লেখক ও কবির জীবনের প্রথম রচনা তার হাত দিয়েই প্রকাশিত হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে তার প্রচেষ্টা ছিল অগ্রগণ্য। বাংলা সাহিত্যে অনিবার্য একটি নাম আহসান হাবীব, প্রচন্ড জীবন সংগ্রামের মধ্যে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সাহিত্য সাধনায়। মৃদুভাষী, আত্মমগ্ন ও ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। নিসর্গের প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ। বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশের প্রসঙ্গ অনুষঙ্গকে আহসানে হাবীব নিজের কবিতায় তুলে আনতে পেরেছেন চমৎকারভাবে। কারণ এসব তিনি প্রত্যক্ষভাবেই দেখেছে, উপলব্ধি করেছেন।

মানুষের জীবন এক বিচিত্র অবস্থান, চারদিকে ছড়িয়ে থাকে নানা বৈচিত্র্য, সুখ-দুঃখ, আনন্দ আর বেদনা। কবিগণ এ আনন্দময় বিচিত্র জীবন থেকে বেঁচে থাকার সুখ ও সার্থকতা তুলে ধরেন তার কবিতায়। কবি আহসান হাবীবের বেলায়ও হয়েছে তাই। নিজের আত্মচরিত্রকে উন্মুক্ত করে আহসান হাবীব চৈতন্য নতুন পথ সঞ্চারের নির্দেশে শিকড়স্পর্শী চেতনায় জানান দিয়েছেন নিজেই নিজের কবিতার লাইনে। কবিতা যে একজন কবির জীবনের সম্ভাবনার একটা ইতিবাচক প্রান্তর তা তিনি রচনা করে গেছেন। কবিতার শাখার শাখায় আধুনিকতার জটিল মাত্রা খুঁজে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন তিনি। রাজনীতিতে কবিতার সচেতন মানসভূমির উচ্চারণ হিসেবেই এনেছেন তিনি, সেখানেও শিল্পের দায়-দাবি পূরণে তিনি ছিলেন নিখুঁত যত্নশীল। কোনো ধরনের বাহুল্য, পক্ষপাতিত্ব, কূপমন্ডুকতা সেখানে জায়গা পায়নি। প্রত্যক্ষ করেছেন কাল ও সংকটের আবর্তে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়মান মানুষের জীবনযাত্রা। আবহমান কালের অস্থিরতা নৈরাজ্য প্রতিনিয়ত তাকে বিচলিত করেছে। তাইতো সব সংকটের তীব্রতায় দু’চোখে দেখে তিনি অক্লান্ত আকাঙ্ক্ষা ও অস্থির চিত্তে উচ্চারণ করেছেন কবিতার শব্দ।

মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা তার কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন যুগযন্ত্রণা তার কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফূটিত হয়েছে। কবিতার ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ খুঁজে পায় তার ভক্ত ও কবিতাপ্রেমীরা। খ্যাতিমান বাংলাদেশি কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে আহসান হাবীব দীর্ঘদিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনেও অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন। তিনি দেশ বিভাগের আগেই সমকালীন কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা তার কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন যুগ যন্ত্রণা তার কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফূটিত হয়েছে।

সমকালীন জীবন ও সমাজের বাস্তবরূপ তার কবিতায় সহজ-সরল ভাষায় উঠে এসেছে। গভীর জীবন বোধ ও আশাবাদ তার কবিতাকে বিশিষ্ট ব্যঞ্জনা দান করেছে। তার কবিতার স্নিগ্ধতা পাঠকচিত্তে এক মধুর আবেশ সৃষ্টি করে। তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং আর্ত-মানবতার পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের কীর্তিমান কবি ও লেখক আহসান হাবীব ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই ইন্তেকাল করেন। কবি বললেও সাহিত্যের অনেক গন্ডিতে রয়েছে আহসান হাবীবের রচিত সাহিত্যকর্ম। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৮টি। অন্যান্য লেখাসহ সব মিলিয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যা ২৫। এর মধ্যে রয়েছে কাব্যগ্রন্থ- ‘রাত্রি শেষ’, ‘ছায়া হরিণ’, ‘সারা দুপুর’, ‘আশায় বসতি’, ‘দুই হাতে দুই আদিম পাথর’, ‘প্রেমের কবিতা’ ও ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’। কাব্যনুবাদ হলো ‘খসড়া’। উপন্যাস ‘অরণ্য নীলিমা’। শিশুসাহিত্য- ‘জোছনা রাতের গল্প’, ‘রাণী খালের সাঁকো, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ‘ছুটির দিন দুপুরে’। অনুবাদ- ‘প্রবাল দ্বীপে তিন বন্ধু’ ‘অভিযাত্রী কলম্বাস’, ‘রত্নদ্বীপ’, ‘রাজা বাদশা হাজার মানুষ’, ‘এসো পথ চিনে নিই’ ‘ইন্দোনেশিয়া’, ‘ছোটদের পাকিস্তান’ ও ‘বোকা বোকাই’। সম্পাদিত গ্রন্থ- ‘বিদেশের সেরা গল্প’ ও ‘কাব্যলোক’। কবি আহসান হাবীব বরাবরই ছিলেন নির্লিপ্ত অন্তর্মুখী এক মানুষ। বাংলা কবিতায় তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একাধিক সাহিত্য পুরস্কার। তার মধ্যে ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, একুশে পদক, আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পদক, আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি। পঞ্চাশের কাব্য আন্দোলনের উত্তর সাধক হিসেবে আধুনিক কবিতার উত্তরাধিকারের পথকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন আহসান হাবীব।

[লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক]

rbabygolpo710@gmail.com