ভবন ভাঙচুর ও ৫ কোটি টাকার সম্পদ লুট

  • পুলিশের ওসি ও ডিসির গাফিলতি
  • প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত টিম

পুরান ঢাকার নবাবপুরে ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের তিন তলা একটি ভবন। ১৯৭৫ সাল থেকে এই ভবনটি সরকার শহীদ পরিবারকে লিজ দেয়। প্রতি বছর তারা লিজ নবায়ন করে ওই ভবনে ব্যবসা চালিয়ে আসছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে লিজ নবায়ন ও লিজ মানি পরিশোধ করার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জমা দেন। তাদের দখলে থাকা অবস্থায় নতুন করে জাবেদ উদ্দিন শেখ নামে এক ব্যক্তি তা জোর করে দখলে নেয়। তাদের নামে কখনও লিজ ছিল না। লিজ নেয়ার চেষ্টাও করেনি বলে তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে। তবে ওই ব্যক্তি অন্যকে বাদী সাজিয়ে জমির মালিকানা দাবি করছে। এ মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন আছে। এ অবস্থায় গত বছর শহীদ পরিবারের লিজ দেয়া সরকারি এই সম্পত্তি তিনতলা ভবনটি জাবেদ শেখ ৩০ থেকে ৩৫ জন সন্ত্রাসী নিয়ে প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে তান্ডব চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের তদন্তে জানা গেছে, ভূমিদস্যুরা মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত শহীদ জেলা প্রশাসক একেএম শামসুল হক সিএসপির পরিবারের তৃতীয় তলা ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ভবনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা বংশাল থানা পুলিশ রহস্যজনক কারনে ডাকাতির মামলা না নিয়ে চুরির মামলা হিসেবে অভিযোগ নিয়েছে। ভবন দখলদার ভূমিদস্যুদের সঙ্গে স্থানীয় পুলিশের যোগসাজশ ও গাফিলতি রয়েছে। এ নিয়ে ভবন থেকে উচ্ছেদকৃত শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশের আইজি বরাবর লিখিত অভিযোগ করার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অনুসন্ধানী তদন্তদল সরজমিন তদন্ত করে বংশাল থানা ও লালবাগ জোনের পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে। তারা তাদের তদন্ত রিপোর্ট পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে জমা দিয়েছেন। ভবন ভাঙচুর ও সম্পদ লুট নিয়ে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকার কারনে পুলিশ কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তদন্ত কমিটি টানা তদন্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করেছেন।

কুমিল্লা জেলার সাবেক জেলা প্রশাসক মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ একেএম শামসুল হক খান সিএসপির মা মাসুদা খানের নামে ১৯৭৫ সাল থেকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে লিজ প্রাপ্ত হয়ে ভোগ দখল করা অবস্থায় মাতা মাসুদা খানম মৃত্যুর পর আজহারুল হক খান নিজে লিজ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে তারা অগ্রাধিকার হিসেবে তাদের লিজ দেয়া হয়। তারা ১৯৭৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত লিজ মানি পরিশোধ করে। ২০১৮ সালে লিজ নবায়নের জন্য জেলা প্রশাকের কার্যালয়ে আবেদন করে। সম্পত্তি দখলে থাকা অবস্থায় ভূমিদস্যু জাবেদ উদ্দিন শেখ ২০১৮ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ৩০ থেকে ৩৫ জন সন্ত্রাসী নিয়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও হকিস্টিকসহ অন্যান্য অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ২২১ নম্বর হোল্ডিং জোর করে দখল করে। ওই সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকারী সবার মুখে স্কচটেপ আটকিয়ে এবং হাত-পা বেঁধে ২৯ সেপ্টম্বর-২০১৮ ভোর পর্যন্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সব পণ্য লুটপাট করে নিয়ে যায়। যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। বংশাল থানায় এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে পুলিশ ডাকাতির মামলা না নিয়ে চুরির মামলা নেন। আর আসামিদের গ্রেফতার না করে উল্টো সহযোগিতা করছে। হামলার সময় বংশাল থানা পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ কর্তব্যে গাফিলতি করছে বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়।

পরবর্তীতে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলমকে সভাপতি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স) মাহফুজুল আলম রাসেল ও সদস্য উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মুনতাসিরুল ইসলাম ও সদস্য রুবাইয়াত জামান। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রকাশ্যে ও গোপনীয়ভাবে তদন্ত করে তাদের উচ্চ পর্যায়ে রিপোর্ট পেশ করেছেন।

উক্ত তদন্ত প্রতিবেদনের মতামতে তারা বলেছেন, তৃতীয় তলা ভবন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তার স্থলে নতুন ভবন তৈরির ঘটনা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। ঘটনার খবর পেয়েও ঘটনাস্থলের অদূরে বংশাল থানার ওসি ঘটনার সত্যতা জেনেছেন। এরপরও ওসি ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, লুষ্ঠিত মালামাল উদ্ধার, অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়া তাদের কর্তব্য ছিল। কিন্তু তারা তা না করে নানা অজুহাতে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণে পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে। যার কারণে সাধারণ জনমনে পুলিশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উক্ত ঘটনা টানা ৯ ঘণ্টা ধরে চললেও অভিযোগকারীকে সহায়তা না করে গড়িমসি করে দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছে। ঘটনা অবগত থাকিয়া এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ওসি ও তদন্তকারী কর্মকর্তা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পরোক্ষভাবে অপরাধকে সহায়তা করছে বলে তদন্ত কমিটি মনে করেন।

তদন্ত টিমের অনুসন্ধানে (প্রকাশ্যে ও গোপনে) এবং প্রাপ্ত তথ্য ও রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হোল্ডিং নম্বর ২২১-এ অনুপ্রবেশ করে অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অবৈধভাবে লুটকরা মালামাল উদ্ধার হয়েছে বলে তদন্ত কমিটিকে অসত্য তথ্য সরবরাহ করেছে। আর ঘটনার পর অপরাধের বিষয় প্রচলিত আইনের উপযুক্ত ধারায় মামলা রুজু না করা। তিন তলা একটি বিল্ডিং সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা, উক্ত সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল ও পরবর্তীতে নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখা সম্পর্কিত অপরাধে ওসি সাহিদুর রহমান এসআই জাহাঙ্গীর আলম, নবাবপুর পুলিশ ফাঁড়ি বাংশাল থানা, ডিএমপি ঢাকা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তদের পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে মর্মে অত্র কমিটির কাছে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

এদিকে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারও তড়িগড়ি করে দায় এড়ানোর জন্য তদন্ত তদারকি প্রতিবেদন প্রেরণ করেছে। ঘটনার অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটি সরজমিন পরিদর্শন করে ঘটনাস্থলে নির্মাণ কাজ চলছিল বলে প্রতীয়মান হলে তার ওপর তলবকৃত ব্যাখ্যার জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় কমিশনার মনোদয় কর্তৃক অসন্তোষ জ্ঞাপন করেন।

তদন্ত কমিটি লিখিত অভিযোগে আরও বলেন, হোল্ডিং নং ২২১-এ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের বিষয় অসত্য তথ্য সরবরাহ করা, সম্পত্তিতে অনুপ্রবেশ করিয়া অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ককে অবৈধভাবে আটক করে ডাকাতি ও সম্পদ লুট সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে প্রচলিত আইনের উপযুক্ত ধারায় মামলা রুজুর বিষয়ে তদারকি কর্মকর্তা হিসেবে সঠিক নির্দেশনা না দেয়া, তথায় অবস্থিত তিনতলা একটি বিল্ডিং সম্পূর্ণভাবে ভাঙিয়া অবৈধভাবে দখলসহ পরবর্তীতে নতুনভাবে নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে উপ-পুলিশ কমিশনার (লালবাগ) জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারনে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন ও চরম গাফিলতির প্রমাণ তদন্ত কমিটি পেয়েছে।

এ ব্যাপারে তদন্তকমিটির একজন কর্মকর্তা বলেন, টানা ৬ মাস তদন্ত করে তাদের রিপোর্ট সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশানের মাধ্যমে আইজিপি বরাবর জমা দিয়েছেন বলে জানান। রিপোর্টে বংশালের ওই সময়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত ওসি ও লালবাগ জোনের ডিসির কর্তব্যে গাফিলতির প্রমাণ তারা পেয়েছেন বলে জানান। তিনি আরও বলেন, তিনতলা ভবনসহ সম্পত্তি অভিযুক্ত মো. জাবেদ উদ্দিন শেখের লিজ ছিল না এবং নেইও। তবে অন্যজনকে বাদী সাজিয়ে জমির মালিকানা দাবি করছে। এটা আদালতে বিচারাধীন আছে। এ মামলার বাদীর কোন খোঁজ তদন্ত কমিটি পায়নি বলে ওই কর্মকর্তা জানান। আর তদন্ত কমিটি থেকে জানা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে ২২১ হোলিডংয়ের অর্পিত সম্পত্তি সরকার একসনা লিজ দিয়ে দখল বজায় রাখছিল। শহীদ পরিবারকে লিজ দেয়ার পর তারা লিজ মানি পরিশোধ করে আসছে। ২০১৮ সালে নবায়নের জন্য আবেদন করেন।

এ নিয়ে পুলিশের লালবাগ জোনের ডিসির সঙ্গে তার কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ওই সময় কেরানীগঞ্জে গেছেন বলে ফোনে জানিয়েছেন। পরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

এ নিয়ে বংশার থানার ওই সময়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত ওসির সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ঘটনায় তার গাফিলতি ও তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে কিছু জানে না বলে জানান।

আরও খবর
জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশ
জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার স্বাধীনতার প্রতীক
বাংলাদেশে বৈশ্বিক অভিযোজন কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব বান কি মুনের
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আর নেই
ভিকারুননিসার দুই শিক্ষিকার বিচার শুরুর আদেশ
১৩ জুলাই গণঅবস্থান বাম ঐক্যের
প্রবীণ সাংবাদিক অজয় বড়ুয়ার সুস্থতা কামনায় প্রার্থনা
তড়িঘড়ি করে নিয়োগ দেয়ার হিড়িক!
শিশু নির্যাতন বন্ধে স্কুলে অভিযোগ বক্স রাখার নির্দেশ
ধর্ষণ মামলায় একজনের যাবজ্জীবন
ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন : শিক্ষক বরখাস্ত
মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট হাসান রেজা নিখোঁজ

বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০১৯ , ২৭ আষাঢ় ১৪২৫, ৭ জ্বিলকদ ১৪৪০

নবাবপুর শহীদ পরিবারের

ভবন ভাঙচুর ও ৫ কোটি টাকার সম্পদ লুট

বাকী বিল্লাহ

  • পুলিশের ওসি ও ডিসির গাফিলতি
  • প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত টিম

পুরান ঢাকার নবাবপুরে ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের তিন তলা একটি ভবন। ১৯৭৫ সাল থেকে এই ভবনটি সরকার শহীদ পরিবারকে লিজ দেয়। প্রতি বছর তারা লিজ নবায়ন করে ওই ভবনে ব্যবসা চালিয়ে আসছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে লিজ নবায়ন ও লিজ মানি পরিশোধ করার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জমা দেন। তাদের দখলে থাকা অবস্থায় নতুন করে জাবেদ উদ্দিন শেখ নামে এক ব্যক্তি তা জোর করে দখলে নেয়। তাদের নামে কখনও লিজ ছিল না। লিজ নেয়ার চেষ্টাও করেনি বলে তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে। তবে ওই ব্যক্তি অন্যকে বাদী সাজিয়ে জমির মালিকানা দাবি করছে। এ মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন আছে। এ অবস্থায় গত বছর শহীদ পরিবারের লিজ দেয়া সরকারি এই সম্পত্তি তিনতলা ভবনটি জাবেদ শেখ ৩০ থেকে ৩৫ জন সন্ত্রাসী নিয়ে প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে তান্ডব চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের তদন্তে জানা গেছে, ভূমিদস্যুরা মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত শহীদ জেলা প্রশাসক একেএম শামসুল হক সিএসপির পরিবারের তৃতীয় তলা ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ভবনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা বংশাল থানা পুলিশ রহস্যজনক কারনে ডাকাতির মামলা না নিয়ে চুরির মামলা হিসেবে অভিযোগ নিয়েছে। ভবন দখলদার ভূমিদস্যুদের সঙ্গে স্থানীয় পুলিশের যোগসাজশ ও গাফিলতি রয়েছে। এ নিয়ে ভবন থেকে উচ্ছেদকৃত শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশের আইজি বরাবর লিখিত অভিযোগ করার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অনুসন্ধানী তদন্তদল সরজমিন তদন্ত করে বংশাল থানা ও লালবাগ জোনের পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে। তারা তাদের তদন্ত রিপোর্ট পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে জমা দিয়েছেন। ভবন ভাঙচুর ও সম্পদ লুট নিয়ে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকার কারনে পুলিশ কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তদন্ত কমিটি টানা তদন্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করেছেন।

কুমিল্লা জেলার সাবেক জেলা প্রশাসক মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ একেএম শামসুল হক খান সিএসপির মা মাসুদা খানের নামে ১৯৭৫ সাল থেকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে লিজ প্রাপ্ত হয়ে ভোগ দখল করা অবস্থায় মাতা মাসুদা খানম মৃত্যুর পর আজহারুল হক খান নিজে লিজ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে তারা অগ্রাধিকার হিসেবে তাদের লিজ দেয়া হয়। তারা ১৯৭৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত লিজ মানি পরিশোধ করে। ২০১৮ সালে লিজ নবায়নের জন্য জেলা প্রশাকের কার্যালয়ে আবেদন করে। সম্পত্তি দখলে থাকা অবস্থায় ভূমিদস্যু জাবেদ উদ্দিন শেখ ২০১৮ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ৩০ থেকে ৩৫ জন সন্ত্রাসী নিয়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও হকিস্টিকসহ অন্যান্য অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ২২১ নম্বর হোল্ডিং জোর করে দখল করে। ওই সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকারী সবার মুখে স্কচটেপ আটকিয়ে এবং হাত-পা বেঁধে ২৯ সেপ্টম্বর-২০১৮ ভোর পর্যন্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সব পণ্য লুটপাট করে নিয়ে যায়। যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। বংশাল থানায় এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে পুলিশ ডাকাতির মামলা না নিয়ে চুরির মামলা নেন। আর আসামিদের গ্রেফতার না করে উল্টো সহযোগিতা করছে। হামলার সময় বংশাল থানা পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ কর্তব্যে গাফিলতি করছে বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়।

পরবর্তীতে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলমকে সভাপতি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স) মাহফুজুল আলম রাসেল ও সদস্য উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মুনতাসিরুল ইসলাম ও সদস্য রুবাইয়াত জামান। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রকাশ্যে ও গোপনীয়ভাবে তদন্ত করে তাদের উচ্চ পর্যায়ে রিপোর্ট পেশ করেছেন।

উক্ত তদন্ত প্রতিবেদনের মতামতে তারা বলেছেন, তৃতীয় তলা ভবন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তার স্থলে নতুন ভবন তৈরির ঘটনা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। ঘটনার খবর পেয়েও ঘটনাস্থলের অদূরে বংশাল থানার ওসি ঘটনার সত্যতা জেনেছেন। এরপরও ওসি ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, লুষ্ঠিত মালামাল উদ্ধার, অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়া তাদের কর্তব্য ছিল। কিন্তু তারা তা না করে নানা অজুহাতে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণে পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে। যার কারণে সাধারণ জনমনে পুলিশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উক্ত ঘটনা টানা ৯ ঘণ্টা ধরে চললেও অভিযোগকারীকে সহায়তা না করে গড়িমসি করে দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছে। ঘটনা অবগত থাকিয়া এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ওসি ও তদন্তকারী কর্মকর্তা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পরোক্ষভাবে অপরাধকে সহায়তা করছে বলে তদন্ত কমিটি মনে করেন।

তদন্ত টিমের অনুসন্ধানে (প্রকাশ্যে ও গোপনে) এবং প্রাপ্ত তথ্য ও রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হোল্ডিং নম্বর ২২১-এ অনুপ্রবেশ করে অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অবৈধভাবে লুটকরা মালামাল উদ্ধার হয়েছে বলে তদন্ত কমিটিকে অসত্য তথ্য সরবরাহ করেছে। আর ঘটনার পর অপরাধের বিষয় প্রচলিত আইনের উপযুক্ত ধারায় মামলা রুজু না করা। তিন তলা একটি বিল্ডিং সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা, উক্ত সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল ও পরবর্তীতে নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখা সম্পর্কিত অপরাধে ওসি সাহিদুর রহমান এসআই জাহাঙ্গীর আলম, নবাবপুর পুলিশ ফাঁড়ি বাংশাল থানা, ডিএমপি ঢাকা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তদের পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে মর্মে অত্র কমিটির কাছে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

এদিকে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারও তড়িগড়ি করে দায় এড়ানোর জন্য তদন্ত তদারকি প্রতিবেদন প্রেরণ করেছে। ঘটনার অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটি সরজমিন পরিদর্শন করে ঘটনাস্থলে নির্মাণ কাজ চলছিল বলে প্রতীয়মান হলে তার ওপর তলবকৃত ব্যাখ্যার জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় কমিশনার মনোদয় কর্তৃক অসন্তোষ জ্ঞাপন করেন।

তদন্ত কমিটি লিখিত অভিযোগে আরও বলেন, হোল্ডিং নং ২২১-এ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের বিষয় অসত্য তথ্য সরবরাহ করা, সম্পত্তিতে অনুপ্রবেশ করিয়া অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ককে অবৈধভাবে আটক করে ডাকাতি ও সম্পদ লুট সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে প্রচলিত আইনের উপযুক্ত ধারায় মামলা রুজুর বিষয়ে তদারকি কর্মকর্তা হিসেবে সঠিক নির্দেশনা না দেয়া, তথায় অবস্থিত তিনতলা একটি বিল্ডিং সম্পূর্ণভাবে ভাঙিয়া অবৈধভাবে দখলসহ পরবর্তীতে নতুনভাবে নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে উপ-পুলিশ কমিশনার (লালবাগ) জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারনে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন ও চরম গাফিলতির প্রমাণ তদন্ত কমিটি পেয়েছে।

এ ব্যাপারে তদন্তকমিটির একজন কর্মকর্তা বলেন, টানা ৬ মাস তদন্ত করে তাদের রিপোর্ট সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশানের মাধ্যমে আইজিপি বরাবর জমা দিয়েছেন বলে জানান। রিপোর্টে বংশালের ওই সময়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত ওসি ও লালবাগ জোনের ডিসির কর্তব্যে গাফিলতির প্রমাণ তারা পেয়েছেন বলে জানান। তিনি আরও বলেন, তিনতলা ভবনসহ সম্পত্তি অভিযুক্ত মো. জাবেদ উদ্দিন শেখের লিজ ছিল না এবং নেইও। তবে অন্যজনকে বাদী সাজিয়ে জমির মালিকানা দাবি করছে। এটা আদালতে বিচারাধীন আছে। এ মামলার বাদীর কোন খোঁজ তদন্ত কমিটি পায়নি বলে ওই কর্মকর্তা জানান। আর তদন্ত কমিটি থেকে জানা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে ২২১ হোলিডংয়ের অর্পিত সম্পত্তি সরকার একসনা লিজ দিয়ে দখল বজায় রাখছিল। শহীদ পরিবারকে লিজ দেয়ার পর তারা লিজ মানি পরিশোধ করে আসছে। ২০১৮ সালে নবায়নের জন্য আবেদন করেন।

এ নিয়ে পুলিশের লালবাগ জোনের ডিসির সঙ্গে তার কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ওই সময় কেরানীগঞ্জে গেছেন বলে ফোনে জানিয়েছেন। পরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

এ নিয়ে বংশার থানার ওই সময়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত ওসির সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ঘটনায় তার গাফিলতি ও তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে কিছু জানে না বলে জানান।