জাতীয় মসজিদে বোমা হামলার হুমকির নেপথ্য কাহিনী

তদন্ত কমিটির ৮ দফা সুপারিশ

রাজধানীর ফুলবাড়িয়া স্বর্ণালী আবাসিক হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ না করলে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বোমা হামলা চালানো হবে। মসজিদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এমন হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি পাঠানোর পর মসজিদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরু করা হয়। তদন্তে নানা কাহিনি বেরিয়ে আসছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্তে পুলিশের লালবাগ জোন ও বংশাল থানার সাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হয়েছে। তাদের অদক্ষতা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালনে ইচ্ছাকৃত অনীহা ছিল বলে তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কথিত হোটেল থেকে নিয়মিত টাকা নেয়া ও হোটেলের সুসজ্জিত ভিআইপি রুমে মাস্তিমারার (আরাম করার) প্রমাণ পাওয়া যায়নি। লালবাগ জোনের সাবেক ডিসি ও বংশাল থানার সাবেক ওসি তদন্ত টিমের কাছে তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সব মিথ্যা বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করছেন। এরপরও তদন্ত টিম তাদের রিপোর্টের আলোকে ৮ দফা সুপারিশ করেছেন। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, বংশাল থানার ওসি, নবাবপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও ৩ নং বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইনচার্জকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণস্থানে অতিদ্রুত পদায়ন করার সুপারিশ করেছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্ত টিমে ছিলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম, উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মুনতাসিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মহিদুল ইসলাম ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রুবাইয়াত জামান। তারা ঘটনার দীর্ঘ অনুসন্ধান করে পুলিশ কমিশনার বরাবর রিপোর্ট পেশ করেছেন।

অভিযোগে বলা হয়, পুরান ঢাকার বংশাল থানাধীন ফুলবাড়িয়ার ১০ কাজি আবদুল হামিদ লেনস্থ হোটেল স্বর্ণালীতে ৩ থেকে ৫ তলা পর্যন্ত রুমগুলোতে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবৈধ কার্যকলাপসহ নানা অপকর্ম চলে। পুলিশের লালবাগ জোনের সাবেক একজন ডিসি ও বংশাল থানার সাবেক একজন ওসি ওই হোটেলে গিয়ে নিয়মিত আরাম করত। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে তাকালে ওই হোটেলটি দেখা যায়। অভিযোগকারী চিঠিতে হুমকি দেয় যে, হোটেলে ব্যাভিচার সহ্য করবে না। যদি হোটেলের অপকর্ম বন্ধ না হয় তাহলে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে বোমা বা টাইম বোমা চার্জ করা হবে। অবিলম্বে এ কাজ বন্ধ না করলে বায়তুর মোকাররম ইসলামি ফাউন্ডেশনের মধ্যেও বোমা মারা হবে। এমন হুমকির পর পুরো বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও আশপাশ এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। পরে বিষয়টি নিয়ে ইসলামী ফাউন্ডেশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্ত দল মাঠে নামে। অনুসন্ধানের সময় পুলিশের লালবাগ বিভাগের সাবেক ডিসি, বংশাল থানার সাবেক ওসিসহ ১২ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও হোটেল মালিক, ম্যানেজারের জবানবন্দি গ্রহণ করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে লালবাগ বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান তদন্ত টিমকে বলেন, গোপনে এসি রুমে অবস্থান করাসহ আনিত অভিযোগ সব মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর হোটেল থেকে অর্থ নেয়ার অভিযোগও মিথ্যা। তিনি তদন্ত টিমকে বলেন, বংশাল থানাধীন হোটেলগুলোতে অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ ছিল।

বংশাল থানার সাবেক ওসি সাহিদুর রহমান তদন্ত টিমের কাছে তার জবানবন্দিতে বলেন, বংশাল থানা এলাকার আবাসিক হোটেলগুলোতে অসামাজিক কার্যকলাপ যাতে না হয় তার জন্য অভিযান চালানো হতো। অভিযানের কারণে দুইটি হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। হোটেলগুলোতে পুলিশ কর্তৃক বেআইনি অপকর্ম করার কথিত অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে ওসি উল্লেখ করেন।

তদন্ত টিম বলেছেন, হোটেল স্বর্ণালীতে দেহ ব্যবসাসহ নানা অপকর্ম চলমান ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ নিয়ে বংশাল থানা একটি মামলা হয়েছে। এ সব বিষয় নিয়ে বংশার থানার ওসি ও জোনের ডিসি কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালনে তাদের ইচ্ছাকৃত অনীহা ছিল। ওসি অভিযান চালানোর কথা জানালেও তার পক্ষে থানায় জিডি বা গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

তদন্ত টিমের সুপারিশে বলা হয়েছে, আবাসিক হোটেলগুলোতে সিসিটিভি ব্যবহার হচ্ছে কিনা, হয়ে থাকলে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। হোটেলে বর্ডারদের রুম বুকিং দেয়ার সময় তার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে হোটেলে উঠছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। আগত বর্ডার বা তার কার্যক্রম ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন সন্দেহ হলে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে। হোটেল বর্ডার ফর্ম থানায় প্রেরণ করতে হবে এবং যাচাই-বাছাই করতে হবে। হোটেলের কার্যক্রম সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হলে অভিযানের ব্যবস্থা নিতে হবে। আর হোটেলগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে বলে তদন্ত টিম সুপারিশ করেছেন।

সোমবার, ২৯ জুলাই ২০১৯ , ১৪ শ্রাবন ১৪২৫, ২৫ জিলকদ ১৪৪০

জাতীয় মসজিদে বোমা হামলার হুমকির নেপথ্য কাহিনী

তদন্ত কমিটির ৮ দফা সুপারিশ

বাকী বিল্লাহ

রাজধানীর ফুলবাড়িয়া স্বর্ণালী আবাসিক হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ না করলে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বোমা হামলা চালানো হবে। মসজিদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এমন হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি পাঠানোর পর মসজিদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরু করা হয়। তদন্তে নানা কাহিনি বেরিয়ে আসছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্তে পুলিশের লালবাগ জোন ও বংশাল থানার সাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হয়েছে। তাদের অদক্ষতা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালনে ইচ্ছাকৃত অনীহা ছিল বলে তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কথিত হোটেল থেকে নিয়মিত টাকা নেয়া ও হোটেলের সুসজ্জিত ভিআইপি রুমে মাস্তিমারার (আরাম করার) প্রমাণ পাওয়া যায়নি। লালবাগ জোনের সাবেক ডিসি ও বংশাল থানার সাবেক ওসি তদন্ত টিমের কাছে তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সব মিথ্যা বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করছেন। এরপরও তদন্ত টিম তাদের রিপোর্টের আলোকে ৮ দফা সুপারিশ করেছেন। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, বংশাল থানার ওসি, নবাবপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও ৩ নং বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইনচার্জকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণস্থানে অতিদ্রুত পদায়ন করার সুপারিশ করেছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্ত টিমে ছিলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম, উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মুনতাসিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মহিদুল ইসলাম ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রুবাইয়াত জামান। তারা ঘটনার দীর্ঘ অনুসন্ধান করে পুলিশ কমিশনার বরাবর রিপোর্ট পেশ করেছেন।

অভিযোগে বলা হয়, পুরান ঢাকার বংশাল থানাধীন ফুলবাড়িয়ার ১০ কাজি আবদুল হামিদ লেনস্থ হোটেল স্বর্ণালীতে ৩ থেকে ৫ তলা পর্যন্ত রুমগুলোতে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবৈধ কার্যকলাপসহ নানা অপকর্ম চলে। পুলিশের লালবাগ জোনের সাবেক একজন ডিসি ও বংশাল থানার সাবেক একজন ওসি ওই হোটেলে গিয়ে নিয়মিত আরাম করত। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে তাকালে ওই হোটেলটি দেখা যায়। অভিযোগকারী চিঠিতে হুমকি দেয় যে, হোটেলে ব্যাভিচার সহ্য করবে না। যদি হোটেলের অপকর্ম বন্ধ না হয় তাহলে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে বোমা বা টাইম বোমা চার্জ করা হবে। অবিলম্বে এ কাজ বন্ধ না করলে বায়তুর মোকাররম ইসলামি ফাউন্ডেশনের মধ্যেও বোমা মারা হবে। এমন হুমকির পর পুরো বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও আশপাশ এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। পরে বিষয়টি নিয়ে ইসলামী ফাউন্ডেশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্ত দল মাঠে নামে। অনুসন্ধানের সময় পুলিশের লালবাগ বিভাগের সাবেক ডিসি, বংশাল থানার সাবেক ওসিসহ ১২ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও হোটেল মালিক, ম্যানেজারের জবানবন্দি গ্রহণ করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে লালবাগ বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান তদন্ত টিমকে বলেন, গোপনে এসি রুমে অবস্থান করাসহ আনিত অভিযোগ সব মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর হোটেল থেকে অর্থ নেয়ার অভিযোগও মিথ্যা। তিনি তদন্ত টিমকে বলেন, বংশাল থানাধীন হোটেলগুলোতে অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ ছিল।

বংশাল থানার সাবেক ওসি সাহিদুর রহমান তদন্ত টিমের কাছে তার জবানবন্দিতে বলেন, বংশাল থানা এলাকার আবাসিক হোটেলগুলোতে অসামাজিক কার্যকলাপ যাতে না হয় তার জন্য অভিযান চালানো হতো। অভিযানের কারণে দুইটি হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। হোটেলগুলোতে পুলিশ কর্তৃক বেআইনি অপকর্ম করার কথিত অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে ওসি উল্লেখ করেন।

তদন্ত টিম বলেছেন, হোটেল স্বর্ণালীতে দেহ ব্যবসাসহ নানা অপকর্ম চলমান ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ নিয়ে বংশাল থানা একটি মামলা হয়েছে। এ সব বিষয় নিয়ে বংশার থানার ওসি ও জোনের ডিসি কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালনে তাদের ইচ্ছাকৃত অনীহা ছিল। ওসি অভিযান চালানোর কথা জানালেও তার পক্ষে থানায় জিডি বা গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

তদন্ত টিমের সুপারিশে বলা হয়েছে, আবাসিক হোটেলগুলোতে সিসিটিভি ব্যবহার হচ্ছে কিনা, হয়ে থাকলে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। হোটেলে বর্ডারদের রুম বুকিং দেয়ার সময় তার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে হোটেলে উঠছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। আগত বর্ডার বা তার কার্যক্রম ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন সন্দেহ হলে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে। হোটেল বর্ডার ফর্ম থানায় প্রেরণ করতে হবে এবং যাচাই-বাছাই করতে হবে। হোটেলের কার্যক্রম সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হলে অভিযানের ব্যবস্থা নিতে হবে। আর হোটেলগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে বলে তদন্ত টিম সুপারিশ করেছেন।