ইংরেজি নববর্ষ ও আমাদের জীবন

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

বর্ষ আসে, বর্ষ যায়। জীবনের মালা থেকে আয়ুর এক একটি খণ্ড খসে পড়ে। তাই বলে মানুষ হা-হুতাশ করে না। মানুষ চায় অনুভূতির ভেতর দিয়ে বাঁচতে। সে জানে নতুন অনুভবের জন্য চাই, নতুন মুহূর্ত, নবীন দিন, নববর্ষ। নতুনের বীজ থাকে ভবিষ্যতের গর্ভে। তাই ভবিষ্যৎ কখন বর্তমান হবে, সে প্রতীক্ষায় থাকে মানুষ। এরই নাম আশা। একেই বলি কামনা কিংবা বাসনা। মানুষ বাঁচে এ আশা-বাসনা নিয়েই। বাসনা পূরণের জন্য চাই প্রয়াস। এরই নাম জীবন। ভবিষ্যতের ভরসাতেই বাঁচে মানুষ। নববর্ষে সেই আকাক্সক্ষা ভবিষ্যতের বর্তমানে রূপ নেবার পালা হয় শুরু। তাই তো নববর্ষকে করা যায় না উপেক্ষা। থাকা চলে না উদাসীন। বছরের প্রথম দিনে, আশা-দীপ্ত হৃদয়ে, উন্মুখ আগ্রহে বরণ করে মানুষ নববর্ষের নবীন প্রভাতকে। মৃত বছরের শেষ রাত্রির অবসানে যখন ঘুম ছুটে যায়, যখন চোখ মেলি, তখনই অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ দেহ-মন-আত্মায় গুঞ্জারিত হয়ে ওঠে আজ নব প্রভাত, নতুন দিন, নতুন জীবন। এক একটি বছর যেন আমাদের জীবন বর্ষের এক-একটি পাতা। ধীরে ধীরে সে পাতাগুলো একের পর এক পার হয়ে যাচ্ছে- আর আমরাও শৈশব থেকে কৈশর, যৌবন ইত্যাদি জীবনের বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছি। আমাদের জীবনে এক একটি বছর অতীতের গর্ভে মিলিয়ে যায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আর অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর সামনে রেখে। এ অভিজ্ঞতার ওপর কুড়িয়েই আমরা জীবনের বেলাভূমিতে এসে উপনীতি হই। আমাদের জীবন পথে ফেলে আসা অতীত থেকে আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে। আর সামনে আগত নতুন দিন সে চলার পথে নবনব অনুপ্রেরণার ফুল ছড়িয়ে স্বাগত জানায়। তাই আমরা নবীন আশায় উন্মুখ হয়ে নতুনকে বরণ করে নেই।

একদিকে বলা যায়, ধ্বংসের মাঝেই নতুনের সৃষ্টি। পুরাতনের বিদায়েই নবীনের আবির্ভাব। পুরাতন বিদায় বার্তা ঘোষণা করে নতুনকে আহ্বান জানায়। জীবনানুভূতির অবলম্বনই হচ্ছে নতুন। নববর্ষ এই নতুনের প্রতীক, নবীনের বাহন। তাই নববর্ষের নতুন দিন আমাদের প্রাণে জাগায় সাড়া। যা বিগত, তাই পুরোনো; যা আকৃষ্ট করেনা, তা-ই অতীত। সামনে চলার নামই এগুনো। বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্থিতি সামনেই। পেছনে থাকে ফেলে-আসা দিন, কর্ম আর বেদন ও ব্যার্থতা সবই অতীতের। অতীত তো অবসানের, ধ্বংসের প্রতীক। অতীত কে ছাড়তে হয়, নইলে বরণ করা যায়না বর্তমানকে। তরুলতার জীবনে আমরা দেখি-বৃদ্ধির জন্যে তাকে পুরোনো পাতার মায়া ছাড়তে হয়। পুরোনো ধূসর পাতা খসে পড়ে, ভরে ওঠে নতুন কিশলয়ে। নতুনেই জীবনের রস ও রূপ নিহিত। নতুন কখনো অকল্যাণকর হয় না। তাই নতুনেই আমরা উল্লাস বোধ করি।

যে পুরোনোকে ধরে রাখতে চায় পুরোনোর স্মৃতি দিয়েই চিত্তলোক ভরে তুলতে চায়, সে জীবনের পরম প্রসাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিতই রাখে। জীবন এক ঘেয়ে হয় কখন যখন ঘটে বৈচিত্র্যের অভাব। বৈচিত্র্য তো নতুনেই আসে। অতএব নতুনেই জীবন। নবচেতনার উন্মেষ ও বিকাশ শুধু এভাবেই সম্ভব। নতুনের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে, নতুনভাবে পাই নিজেকে-নিজের আত্মাকে। সুতরাং নতুনের প্রতি আকর্ষণই আমাদের প্রাণ রস-আমাদের জীবনের ভিত্তি। নতুন আমাদের কর্ম ও চেতনার বার্তাবাহী।

আবার নতুন মাত্রই সাধারণভাবে সুন্দর। মানুষের জীবনে সুন্দরের সাধনাই হচ্ছে ব্রত। এক কথায় সুন্দর মনের লাবণ্য ও সুরচির প্রলেপ মানুষ তার চিন্তা, কর্ম ও আচরণ স্নিগ্ধ ও শোভন করে তুলতে সদা সচেষ্ট। পুরোনো এ পৃথিবীকে বহুবর্ষের পুরোনো এ জীবনকে নতুন করে অনুভব করার জন্য চাই নতুন দিন, নতুন মন, নব উদ্যম, নবীণ প্রাণ, সতেজ চিত্ত ও সুদৃঢ় সংকল্প। নববর্ষ নতুন জীবনের উৎস, নবশক্তির আধার। তাই আমাদের জীবনে নববর্ষের, নবীন প্রভাতের নবারুন এত চমকপ্রদ। প্রাণে জাগায় আত্ম বিকাশের নব সম্ভাবনা, খুলে দেয় নব দিগন্তের দ্বার। ১ জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন। এ দিনেই আমাদের মন-বিহঙ্গ পাখা মেলে নতুন উদ্যমে মেতে ওঠে নবযাত্রার আয়োজনে। চিত্ত লোকে পড়ে যায় নব জীবনের সাড়া। আমাদের জীবন নতুন প্রাচুর্যে ভরে ওঠে। হৃদয়ের সব অনুভূতি দিয়ে যেন আমরা ভালোবাসতে পারি এই সোনার বাংলাদেশের মাটি, তার ভাষা আর তার বুকের কোটি কোটি মানুষকে। নববর্ষে এই হোক আমাদের শুভ কামনা, প্রত্যাশা। কবির ভাষায়-

‘ছন্দে ছন্দে পদে পদে অঞ্চলের আবর্ত আঘাতে পুড়ে হোক ক্ষয়,

ধুলি সম তৃণ সম পুরাতন বৎসরে যত নিষ্ফল সঞ্চয়।’

[লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা]

jewelwriter53@gmail.com

বুধবার, ০১ জানুয়ারী ২০২০ , ১৮ পৌষ ১৪২৬, ৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ইংরেজি নববর্ষ ও আমাদের জীবন

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

image

বর্ষ আসে, বর্ষ যায়। জীবনের মালা থেকে আয়ুর এক একটি খণ্ড খসে পড়ে। তাই বলে মানুষ হা-হুতাশ করে না। মানুষ চায় অনুভূতির ভেতর দিয়ে বাঁচতে। সে জানে নতুন অনুভবের জন্য চাই, নতুন মুহূর্ত, নবীন দিন, নববর্ষ। নতুনের বীজ থাকে ভবিষ্যতের গর্ভে। তাই ভবিষ্যৎ কখন বর্তমান হবে, সে প্রতীক্ষায় থাকে মানুষ। এরই নাম আশা। একেই বলি কামনা কিংবা বাসনা। মানুষ বাঁচে এ আশা-বাসনা নিয়েই। বাসনা পূরণের জন্য চাই প্রয়াস। এরই নাম জীবন। ভবিষ্যতের ভরসাতেই বাঁচে মানুষ। নববর্ষে সেই আকাক্সক্ষা ভবিষ্যতের বর্তমানে রূপ নেবার পালা হয় শুরু। তাই তো নববর্ষকে করা যায় না উপেক্ষা। থাকা চলে না উদাসীন। বছরের প্রথম দিনে, আশা-দীপ্ত হৃদয়ে, উন্মুখ আগ্রহে বরণ করে মানুষ নববর্ষের নবীন প্রভাতকে। মৃত বছরের শেষ রাত্রির অবসানে যখন ঘুম ছুটে যায়, যখন চোখ মেলি, তখনই অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ দেহ-মন-আত্মায় গুঞ্জারিত হয়ে ওঠে আজ নব প্রভাত, নতুন দিন, নতুন জীবন। এক একটি বছর যেন আমাদের জীবন বর্ষের এক-একটি পাতা। ধীরে ধীরে সে পাতাগুলো একের পর এক পার হয়ে যাচ্ছে- আর আমরাও শৈশব থেকে কৈশর, যৌবন ইত্যাদি জীবনের বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছি। আমাদের জীবনে এক একটি বছর অতীতের গর্ভে মিলিয়ে যায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আর অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর সামনে রেখে। এ অভিজ্ঞতার ওপর কুড়িয়েই আমরা জীবনের বেলাভূমিতে এসে উপনীতি হই। আমাদের জীবন পথে ফেলে আসা অতীত থেকে আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে। আর সামনে আগত নতুন দিন সে চলার পথে নবনব অনুপ্রেরণার ফুল ছড়িয়ে স্বাগত জানায়। তাই আমরা নবীন আশায় উন্মুখ হয়ে নতুনকে বরণ করে নেই।

একদিকে বলা যায়, ধ্বংসের মাঝেই নতুনের সৃষ্টি। পুরাতনের বিদায়েই নবীনের আবির্ভাব। পুরাতন বিদায় বার্তা ঘোষণা করে নতুনকে আহ্বান জানায়। জীবনানুভূতির অবলম্বনই হচ্ছে নতুন। নববর্ষ এই নতুনের প্রতীক, নবীনের বাহন। তাই নববর্ষের নতুন দিন আমাদের প্রাণে জাগায় সাড়া। যা বিগত, তাই পুরোনো; যা আকৃষ্ট করেনা, তা-ই অতীত। সামনে চলার নামই এগুনো। বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্থিতি সামনেই। পেছনে থাকে ফেলে-আসা দিন, কর্ম আর বেদন ও ব্যার্থতা সবই অতীতের। অতীত তো অবসানের, ধ্বংসের প্রতীক। অতীত কে ছাড়তে হয়, নইলে বরণ করা যায়না বর্তমানকে। তরুলতার জীবনে আমরা দেখি-বৃদ্ধির জন্যে তাকে পুরোনো পাতার মায়া ছাড়তে হয়। পুরোনো ধূসর পাতা খসে পড়ে, ভরে ওঠে নতুন কিশলয়ে। নতুনেই জীবনের রস ও রূপ নিহিত। নতুন কখনো অকল্যাণকর হয় না। তাই নতুনেই আমরা উল্লাস বোধ করি।

যে পুরোনোকে ধরে রাখতে চায় পুরোনোর স্মৃতি দিয়েই চিত্তলোক ভরে তুলতে চায়, সে জীবনের পরম প্রসাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিতই রাখে। জীবন এক ঘেয়ে হয় কখন যখন ঘটে বৈচিত্র্যের অভাব। বৈচিত্র্য তো নতুনেই আসে। অতএব নতুনেই জীবন। নবচেতনার উন্মেষ ও বিকাশ শুধু এভাবেই সম্ভব। নতুনের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে, নতুনভাবে পাই নিজেকে-নিজের আত্মাকে। সুতরাং নতুনের প্রতি আকর্ষণই আমাদের প্রাণ রস-আমাদের জীবনের ভিত্তি। নতুন আমাদের কর্ম ও চেতনার বার্তাবাহী।

আবার নতুন মাত্রই সাধারণভাবে সুন্দর। মানুষের জীবনে সুন্দরের সাধনাই হচ্ছে ব্রত। এক কথায় সুন্দর মনের লাবণ্য ও সুরচির প্রলেপ মানুষ তার চিন্তা, কর্ম ও আচরণ স্নিগ্ধ ও শোভন করে তুলতে সদা সচেষ্ট। পুরোনো এ পৃথিবীকে বহুবর্ষের পুরোনো এ জীবনকে নতুন করে অনুভব করার জন্য চাই নতুন দিন, নতুন মন, নব উদ্যম, নবীণ প্রাণ, সতেজ চিত্ত ও সুদৃঢ় সংকল্প। নববর্ষ নতুন জীবনের উৎস, নবশক্তির আধার। তাই আমাদের জীবনে নববর্ষের, নবীন প্রভাতের নবারুন এত চমকপ্রদ। প্রাণে জাগায় আত্ম বিকাশের নব সম্ভাবনা, খুলে দেয় নব দিগন্তের দ্বার। ১ জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন। এ দিনেই আমাদের মন-বিহঙ্গ পাখা মেলে নতুন উদ্যমে মেতে ওঠে নবযাত্রার আয়োজনে। চিত্ত লোকে পড়ে যায় নব জীবনের সাড়া। আমাদের জীবন নতুন প্রাচুর্যে ভরে ওঠে। হৃদয়ের সব অনুভূতি দিয়ে যেন আমরা ভালোবাসতে পারি এই সোনার বাংলাদেশের মাটি, তার ভাষা আর তার বুকের কোটি কোটি মানুষকে। নববর্ষে এই হোক আমাদের শুভ কামনা, প্রত্যাশা। কবির ভাষায়-

‘ছন্দে ছন্দে পদে পদে অঞ্চলের আবর্ত আঘাতে পুড়ে হোক ক্ষয়,

ধুলি সম তৃণ সম পুরাতন বৎসরে যত নিষ্ফল সঞ্চয়।’

[লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা]

jewelwriter53@gmail.com