সুস্থ দেহের জন্য প্রয়োজন ভেজালমুক্ত খাদ্যের

ইয়াসমীন রীমা

যে খাদ্য খেয়ে মানুষ জীবন ধারণ করে সেই খাদ্যেই রয়েছে বিষ। আসলে আমরা কী খাচ্ছি? ভোগ্যপণ্যের বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষায় ভেজালের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। মিষ্টি এবং মিষ্টিজাতীয় পণ্যে ভেজালের পরিমাণ সবেচেয়ে বেশি। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তাই ভেজাল খাবারে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের আক্রান্ত হবার আশংকা থাকে বেশি।

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে খাদ্য। অতি মুনাফালোভী এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি, কীটনাশক, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড মিশিয়ে ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পণ্য উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রত্যেকটি স্তরেই ক্যামিকেল মেশানো হচ্ছে। যথাযথ নজরদারির পরও এসব ঘটনা ঘটেই চলেছে, যাতে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে।

এখন কিছুই যেন নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে খেতে পারছি না। তাই মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবন রক্ষায় নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। খাদ্যই যদি নিরাপদ না হয়ে বিষযুক্ত হয়, তাহলে মানুষের সুস্থভাবে বাঁচার নিশ্চয়তা কী? কৃষিতে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এবং মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহার দেশের জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। কৃষিপণ্যকে কীটনাশক থেকে রক্ষা করা গেলে মানুষ অনেকটা স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে।

নানা ধরনের বিষাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুতকৃত নিম্নমানের খাদ্য গ্রহণ করে আগামী প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর অসুখের ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। গর্ভবতী নারীরা জন্ম দিতে পারে বিকলাঙ্গ শিশু এবং গর্ভস্থ শিশুপ্রতিবন্ধী হওয়ার আশংকাও থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এসব খাবার খাওয়ার ফলে বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিছু খাবার এমনই বিষাক্ত যে, তা ডিএনএকে পর্যন্ত বদলে দিতে পারে।

কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৬ ভাগ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের ফলে। ক্যানসার, কিডনি ও লিভার রোগীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। দীর্ঘদিন বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে গর্ভবতী মা ও তার ভ্রুণের ক্ষতি হয়, সন্তানও ক্যান্সার, কিডনিসহ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হচ্ছে। খাদ্যের সঙ্গে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ গ্রহণের ফলে দেহে দীর্ঘদিন জমা থাকে। ফলে এ বিষক্রিয়া বংশ থেকে বংশে স্থানান্তর হয়।

জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে ৮২টি খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করা হয়। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি। এসব রাসায়নিক বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি রয়েছে। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়া সম্পন্ন আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদ গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় ছিল সীসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সীসা পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে পাওয়া গেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব। হলুদ ও লবণে সীসাসহ আরও কিছু ধাতব উপাদান প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলো চকচকে ও ভারী করা হয়।

কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ শতাংশই জমিসংলগ্ন জলাশয়ের পানিতে মেশে। এ ছাড়া ওই কীটনাশক প্রয়োগের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বা উপকরণ পরিষ্কার করতে গিয়ে আরও কিছু কীটনাশক পুকুর বা নালার পানিতে চলে যায়। এতে একদিকে যেমন সরাসরি মাছ ও মাছের ডিমের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, অন্যদিকে পানিতে থাকা মাছের খাদ্য উদ্ভিদকতা ও প্রাণিকতা তাৎক্ষণিক মরে যায়। ফলে জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাছের খাদ্য নষ্ট হয়, পানি নষ্ট হয়। আবার মাছ থেকে তা মানবদেহে চলে যায়।

মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে বিএসটিআই লবণ, হলুদ, গুঁড়া মরিচ, কারি পাউডার, সরিষার তেল, বোতলজাত খাবার পানি, মাখন, আটা, ময়দা, নুডলস, বিস্কুটের ৪০৬টি নমুনা পরীক্ষা করে এ বছর মে ও জুন মাসে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪৬টি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ৭৪টি পণ্য নিম্নমানের। আদালত এসব পণ্য বাজার থেকে অপসারণ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। আদালত সরকারকে মাদকের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক যুদ্ধের মতো ‘খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ করার অনুরোধ জানান।

শিশু খাদ্যে ভেজালের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে গড়ে ওঠেছে ভেজাল খাদ্যসমগ্রীর দোকান। দোকানের সামনে বিভিন্ন ধরনের চিপস, চকলেট, আইসক্রীম, চাটনি, প্যাকেটজাত জুস এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয় যাতে সহজেই শিশুদের নজর কাড়ে। এসব বেশিরভাগ খাদ্য পণ্য বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিত নয়। বিশ্বের অনেক দেশে শিশুদের স্কুলের সামনে চটকদার খাবার বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের বিধি-নিষেধ না থাকায় এসব খাদ্য-পণ্য দেদারসে বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকার আশপাশে প্রচুর টেক্সটাইল ও ডাইং ইন্ডাস্ট্রি আছে। এসব টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিভিন্ন ধরনের ঢাকার পার্শ্ববতী নদীতে চলে যায়। নদীর বিষাক্ত পানি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়। ফলে শাকসবজি ও ধান এবং মাছে ভারী ধাতু যেমন লেড, আর্সেনিক, কেডমিয়াম ও মারকারির মিশ্রন ঘটে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেজাল ও নিম্নমানের খাবার গ্রহণের ফলে অপুষ্টি, খাদ্যজনিত বিষক্রিয়া এবং ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়ে। দেশে কিডনি ও লিভার ক্যানসারের সাম্প্রতিক বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে ভেজাল খাবার। দূষিত খাবার গ্রহণকারী মায়েদের শিশুরা অপুষ্টি, ক্যান্সার এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। ভোক্তা, ব্যবসায়ী, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকেরই সচেতন হতে হবে। আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে কেবল আমাদের বর্তমান নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা থাকলেও কৃষককে সচেতন করে তোলার মতো তেমন কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায় না। কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ অনেক রাসায়নিক পদার্থের বিক্রি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক কীটনাশক লেবেল ছাড়া ভুয়া লেবেল দিয়ে কৃষকদের কোনো সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা বা নির্দেশাবলী ছাড়া বিক্রি করা হচ্ছে। কৃষকদের মধ্যে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং বিষমুক্ত খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহ দেয়া।

দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ ভেজাল ও নিম্নমানের খাবারের ঝুঁকি সম্পর্কে অজ্ঞ। ভেজাল ও নিম্নমানের খাবারের সমস্যা একটি সামাজিক ও আচরণগত সমস্যা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দেশে ১৫টি আইন রয়েছে। এসব আইনে খাদ্য দূষণকে দ-নীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহতা বিবেচনায় বর্তমান সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫, নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। বিএসটিআই, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের কর্মকর্তার নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করছে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের জেলা জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।

সুস্থ জাতি গঠনের জন্য পুষ্টিকর ও ভেজালমুক্ত খাবারের বিকল্প নেই। আমরা সবাই বুঝে না বুঝে বিষাক্ত খাবার গ্রহণ করছি। ভোজাল খাদ্য প্রতিরোধে ভোক্তা, উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী সবারই সচেতনতা দরকার। শুধু শাস্তি দিয়ে নয় নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে খাধ্যে ভেজাল দেয়া বন্ধ করতে হবে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

বুধবার, ০১ জানুয়ারী ২০২০ , ১৮ পৌষ ১৪২৬, ৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

সুস্থ দেহের জন্য প্রয়োজন ভেজালমুক্ত খাদ্যের

ইয়াসমীন রীমা

যে খাদ্য খেয়ে মানুষ জীবন ধারণ করে সেই খাদ্যেই রয়েছে বিষ। আসলে আমরা কী খাচ্ছি? ভোগ্যপণ্যের বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষায় ভেজালের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। মিষ্টি এবং মিষ্টিজাতীয় পণ্যে ভেজালের পরিমাণ সবেচেয়ে বেশি। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তাই ভেজাল খাবারে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের আক্রান্ত হবার আশংকা থাকে বেশি।

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে খাদ্য। অতি মুনাফালোভী এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি, কীটনাশক, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড মিশিয়ে ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পণ্য উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রত্যেকটি স্তরেই ক্যামিকেল মেশানো হচ্ছে। যথাযথ নজরদারির পরও এসব ঘটনা ঘটেই চলেছে, যাতে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে।

এখন কিছুই যেন নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে খেতে পারছি না। তাই মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবন রক্ষায় নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। খাদ্যই যদি নিরাপদ না হয়ে বিষযুক্ত হয়, তাহলে মানুষের সুস্থভাবে বাঁচার নিশ্চয়তা কী? কৃষিতে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এবং মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহার দেশের জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। কৃষিপণ্যকে কীটনাশক থেকে রক্ষা করা গেলে মানুষ অনেকটা স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে।

নানা ধরনের বিষাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুতকৃত নিম্নমানের খাদ্য গ্রহণ করে আগামী প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর অসুখের ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। গর্ভবতী নারীরা জন্ম দিতে পারে বিকলাঙ্গ শিশু এবং গর্ভস্থ শিশুপ্রতিবন্ধী হওয়ার আশংকাও থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এসব খাবার খাওয়ার ফলে বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিছু খাবার এমনই বিষাক্ত যে, তা ডিএনএকে পর্যন্ত বদলে দিতে পারে।

কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৬ ভাগ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের ফলে। ক্যানসার, কিডনি ও লিভার রোগীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। দীর্ঘদিন বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে গর্ভবতী মা ও তার ভ্রুণের ক্ষতি হয়, সন্তানও ক্যান্সার, কিডনিসহ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হচ্ছে। খাদ্যের সঙ্গে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ গ্রহণের ফলে দেহে দীর্ঘদিন জমা থাকে। ফলে এ বিষক্রিয়া বংশ থেকে বংশে স্থানান্তর হয়।

জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে ৮২টি খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করা হয়। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি। এসব রাসায়নিক বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি রয়েছে। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়া সম্পন্ন আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদ গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় ছিল সীসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সীসা পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে পাওয়া গেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব। হলুদ ও লবণে সীসাসহ আরও কিছু ধাতব উপাদান প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলো চকচকে ও ভারী করা হয়।

কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ শতাংশই জমিসংলগ্ন জলাশয়ের পানিতে মেশে। এ ছাড়া ওই কীটনাশক প্রয়োগের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বা উপকরণ পরিষ্কার করতে গিয়ে আরও কিছু কীটনাশক পুকুর বা নালার পানিতে চলে যায়। এতে একদিকে যেমন সরাসরি মাছ ও মাছের ডিমের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, অন্যদিকে পানিতে থাকা মাছের খাদ্য উদ্ভিদকতা ও প্রাণিকতা তাৎক্ষণিক মরে যায়। ফলে জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাছের খাদ্য নষ্ট হয়, পানি নষ্ট হয়। আবার মাছ থেকে তা মানবদেহে চলে যায়।

মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে বিএসটিআই লবণ, হলুদ, গুঁড়া মরিচ, কারি পাউডার, সরিষার তেল, বোতলজাত খাবার পানি, মাখন, আটা, ময়দা, নুডলস, বিস্কুটের ৪০৬টি নমুনা পরীক্ষা করে এ বছর মে ও জুন মাসে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪৬টি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ৭৪টি পণ্য নিম্নমানের। আদালত এসব পণ্য বাজার থেকে অপসারণ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। আদালত সরকারকে মাদকের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক যুদ্ধের মতো ‘খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ করার অনুরোধ জানান।

শিশু খাদ্যে ভেজালের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে গড়ে ওঠেছে ভেজাল খাদ্যসমগ্রীর দোকান। দোকানের সামনে বিভিন্ন ধরনের চিপস, চকলেট, আইসক্রীম, চাটনি, প্যাকেটজাত জুস এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয় যাতে সহজেই শিশুদের নজর কাড়ে। এসব বেশিরভাগ খাদ্য পণ্য বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিত নয়। বিশ্বের অনেক দেশে শিশুদের স্কুলের সামনে চটকদার খাবার বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের বিধি-নিষেধ না থাকায় এসব খাদ্য-পণ্য দেদারসে বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকার আশপাশে প্রচুর টেক্সটাইল ও ডাইং ইন্ডাস্ট্রি আছে। এসব টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিভিন্ন ধরনের ঢাকার পার্শ্ববতী নদীতে চলে যায়। নদীর বিষাক্ত পানি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়। ফলে শাকসবজি ও ধান এবং মাছে ভারী ধাতু যেমন লেড, আর্সেনিক, কেডমিয়াম ও মারকারির মিশ্রন ঘটে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেজাল ও নিম্নমানের খাবার গ্রহণের ফলে অপুষ্টি, খাদ্যজনিত বিষক্রিয়া এবং ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়ে। দেশে কিডনি ও লিভার ক্যানসারের সাম্প্রতিক বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে ভেজাল খাবার। দূষিত খাবার গ্রহণকারী মায়েদের শিশুরা অপুষ্টি, ক্যান্সার এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। ভোক্তা, ব্যবসায়ী, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকেরই সচেতন হতে হবে। আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে কেবল আমাদের বর্তমান নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা থাকলেও কৃষককে সচেতন করে তোলার মতো তেমন কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায় না। কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ অনেক রাসায়নিক পদার্থের বিক্রি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক কীটনাশক লেবেল ছাড়া ভুয়া লেবেল দিয়ে কৃষকদের কোনো সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা বা নির্দেশাবলী ছাড়া বিক্রি করা হচ্ছে। কৃষকদের মধ্যে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং বিষমুক্ত খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহ দেয়া।

দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ ভেজাল ও নিম্নমানের খাবারের ঝুঁকি সম্পর্কে অজ্ঞ। ভেজাল ও নিম্নমানের খাবারের সমস্যা একটি সামাজিক ও আচরণগত সমস্যা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দেশে ১৫টি আইন রয়েছে। এসব আইনে খাদ্য দূষণকে দ-নীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহতা বিবেচনায় বর্তমান সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫, নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। বিএসটিআই, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের কর্মকর্তার নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করছে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের জেলা জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।

সুস্থ জাতি গঠনের জন্য পুষ্টিকর ও ভেজালমুক্ত খাবারের বিকল্প নেই। আমরা সবাই বুঝে না বুঝে বিষাক্ত খাবার গ্রহণ করছি। ভোজাল খাদ্য প্রতিরোধে ভোক্তা, উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী সবারই সচেতনতা দরকার। শুধু শাস্তি দিয়ে নয় নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে খাধ্যে ভেজাল দেয়া বন্ধ করতে হবে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)