আবদুল মান্নান বেঁচে থাকবেন কৃষকের অন্তরে আজীবন

নিতাই চন্দ্র রায়

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা বগুড়া-১ আসনের এমপি আবদুল মান্নান গত ১৮ জানুয়ারি, সকাল সাড়ে আটটায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকায় তার ধানমন্ডির বাসভবনে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে পপুলার হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ল্যাবএইড হাসপাতালে নেয়া হয়। রাতে আরও অবনতি ঘটলে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় এবং শনিবার সকালে ল্যাবএইড হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। এমপি আবদুল মান্নানের মৃত্যুতে দেশ হারাল একজন বরেণ্য রাজনৈতিক নেতাকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হারাল এজন শক্তিশালী সংগঠককে। কৃষক হারাল তাদের আত্মার আত্মীয়কে। তার মৃত্যুর সংবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ১৯ জানুয়ারি, জাতীয় সংসদে এমপি আবদুল মান্নানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আবদুল মান্নান ছাত্র জীবন থেকেই আইয়ুববিরোধী, জিয়াবিরোধী, এরশাদবিরোধী এবং খালেদাবিরোধী আন্দোলন করেছে। প্রতিটি আন্দোলনে ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একটা বৈরী পরিবেশে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এ আন্দোলন সংগ্রামে যেসব ছাত্রনেতারা ভূমিকা রেখেছে, তাদের অনেকেই আমাদের মাঝ থেকে চলে যাচ্ছে- এটা অত্যন্ত কষ্টের ও বেদনার। হাতেগড়া ছাত্র নেতাদের চলে যাওয়ার খবর সত্যই খুব দুঃখজনক। মান্নান এভাবে চলে যাবে ভাবতেই পারিনি। ছাত্র নেতারা নেতৃত্ব দেবে আওয়ামী লীগের, ভবিষ্যতে যখন আমরা থাকব না, এরাই সামনের দিকে আওয়ামী লীগকে নিয়ে যাবে। এদের চলে যাওয়া শুধু দলের নয়, দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর দেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্রলীগের নাম-নিশানা ছিল না। ব্যতিক্রম ছিল শুধু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি ও কৃষকদের ভীষণ ভালোবাসতেন। তিনি জানতেন কৃষির উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় দেশের খাদ্য সমস্যারও সমাধান। তিনি বলতেন, আমার স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কৃষিবিদদের দীর্ঘদিনের দাবি প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড মর্যাদার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। এজন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জাতির জনকের নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতি ছিল খুব অনুরক্ত। সেই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলন টাঙ্গাইলের প্রয়াত এমপি শওকত মোমেন শাহজাহান, বগুড়া-১ আসনের সদ্য প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নান এবং বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত প্রদীপ রঞ্জন কর। মান্নান ভাই থাকতেন শহীদ শামসুল হক হলে। শওকত মোমেন শাহজাহান থাকতেন শাহজালাল হলে আর প্রদীপ রঞ্জন কর থাকতেন শহীদ নাজমুল আহসান হলে। আবদুল মান্নান ছিলেন যেমন সুবক্তা তেমন দক্ষ সংগঠক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল, অনুষদ ও বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। স্মরণশক্তিও ছিল অসাধারণ। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের নাম ধরে ডাকতে পারতেন তিনি। হলের নাম ও মনে রাখতে পারতেন।

১৯৭৯-৮০ সালের বাকসু নির্বাচনে আবদুল মান্নান ভিপি ও প্রদীপ রঞ্জন কর জিএস পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। শুধু ছাত্রলীগ নয়, অন্য সংগঠনের ছাত্রছাত্রীদেরও ভোট পেয়ে ছিলেন এ দুই নন্দিত নেতা। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ১৯৫৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার হিন্দুকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৃত জালাল উদ্দিন সরদার। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। আশির দশকে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতির গুরু দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জয়লাভ করেন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে তৃতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। আবদুল মান্নান কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রকৃচির আন্দোলনে ও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। কৃষক ও কৃষিবিদদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি সক্রীয় ভূমিকা পালন করেন। বহুতল কেআইবি কমপ্লেক্সের জমি ও নির্মাণ কাজে তার অনন্য অবদান ছিল। আবদুল মান্নানের স্ত্রী সাহাদারা মান্নান সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য। তার ছেলে শাখাওয়াত হোসেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক এবং মেয়ে মালিহা মান্নান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আবদুল মান্নানের পরিচয় ছিল। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং ’৭৫ পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসক জিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন আবদুল মান্নান। জিয়া-এরশাদকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেয়নি এ লড়াকু ছাত্রনেতা। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় বিএনপি আমলে তাকে হত্যার জন্য গুণ্ডাবাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয়। সেই হামলায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্রলীগের নেতা শওকত, অলি ও মোহসীন নির্মমভাবে নিহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান বাকসুর ভিপি আবদুল মান্নান। ২০০৬ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠান। সেবার তিনি সুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে আসেন। কৃষকের ঘর থেকে উঠে আসা সন্তান আবদুল মান্নান ছাত্রলীগের অত্যন্ত কঠিন সময়ে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। তখন ছাত্রলীগ ও জাতির জনকের নাম উচ্চারণ করা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তিনি এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। ২০১৬ সালে লালপুরে এক্সিম ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন কালে নর্থ-বেঙ্গল সুগার মিলের অতিথি ভবনে অবস্থান কালে তিনি কৃষিভিত্তিক চিনি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবাইকে আরও নিষ্ঠা, সততা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কথা বলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে আবদুল মান্নান অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক থাকা অবস্থায় প্রতিটি লিফলেট থেকে শুরু করে বিবৃতি শেখ হাসিনা নিজে বসে থেকে তাকে দিয়ে লেখাতেন। প্রতিটি কাজই তিনি দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করতেন। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল আবদুল মান্নান অসম্ভব মেধাবী সাহসী রাজনীতিবিদ ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় তাকে বুদ্ধি দিয়ে, সাহস দিয়ে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করতেন। বগুড়ার মতো বিএনপির ঘাঁটিতে তিনি তিন তিন বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তার ব্যক্তিগত ইমেজ, নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক শক্তির গুণে। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলার রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্টসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখেন। এলাকার সব মানুষের জন্য তার দ্বার ছিল সর্র্বদা উন্মুক্ত। তিনি জনগণকে ভালোবাসতেন এবং সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকতেন।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে ঢাকায় অবস্থান করলেও তিনি প্রাণের ক্যাম্পাস কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা কখনও ভুলতে পারেননি। যে কোন প্রয়োজনেই তিনি ছুটে আসতেন কৃষি বিশ্ববিদ্যলয়ের সবুজ চত্বরে। মনে পড়ে ১৯৮৪ সালে এরশাদ আমলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান বাদশাহ ও ছাত্রনেতা আবদুল গফুর পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হলে তিনি ঢাকা থেকে ট্রেন যোগে ময়মনসিংহে ছুটে আসেন। সেদিন ময়মনসিংহ রেল স্টেশনে অভ্যর্থনা জানানোর সৌভাগ্য হয় আমার। আওয়ামী লীগের নেতা প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে ছাত্র নেতাদের মুক্তির ব্যাপারে তিনি আলোচনা করেন। কথা বলেন আওয়ামী লীগপন্থি অ্যাডভোকেটদের সঙ্গে। জেলখানায় ছাত্র নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তিনি সাহস জোগান। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। সেই সম্মেলনে তার জ্বালাময়ী বক্তব্য এখনও আমাদের আন্দোলিত করে। ২০১৮ সালের ১৩ফেরুয়ারি কৃষিবিদ দিবসে তিনি শেষ বারের মতো আসেন তার প্রিয় ক্যাম্পাসে। প্রয়াত এমপি শওকত মোমেন শাহজাহানের সঙ্গে তিনি এক সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি করতেন কৃষি বিশ্ববদ্যিালয়ে। উভয়েই ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব সৈনিক। কাজকর্ম ও আচার আচরণে অদ্ভুত মিল ছিল দু’জনের মধ্যে। শওকত মোমেন শাহজাহান ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি আর আবদুল মান্নান ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি খুব কাছাকাছি সময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। যতদিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে, ছাত্র রাজনীতি থাকবে, কৃষক ও কৃষি থাকবে, ততদিন উচ্চারিত হবে আবদুল মান্নানের নাম। আবদুল মান্নান বেঁচে থাকবেন কৃষক ও কৃষিবিদদের অন্তরে আজীবন।

[লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লি ]

netairoy18@yahoo.com

বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২০ , ৮ মাঘ ১৪২৬, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

আবদুল মান্নান বেঁচে থাকবেন কৃষকের অন্তরে আজীবন

নিতাই চন্দ্র রায়

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা বগুড়া-১ আসনের এমপি আবদুল মান্নান গত ১৮ জানুয়ারি, সকাল সাড়ে আটটায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকায় তার ধানমন্ডির বাসভবনে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে পপুলার হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ল্যাবএইড হাসপাতালে নেয়া হয়। রাতে আরও অবনতি ঘটলে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় এবং শনিবার সকালে ল্যাবএইড হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। এমপি আবদুল মান্নানের মৃত্যুতে দেশ হারাল একজন বরেণ্য রাজনৈতিক নেতাকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হারাল এজন শক্তিশালী সংগঠককে। কৃষক হারাল তাদের আত্মার আত্মীয়কে। তার মৃত্যুর সংবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ১৯ জানুয়ারি, জাতীয় সংসদে এমপি আবদুল মান্নানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আবদুল মান্নান ছাত্র জীবন থেকেই আইয়ুববিরোধী, জিয়াবিরোধী, এরশাদবিরোধী এবং খালেদাবিরোধী আন্দোলন করেছে। প্রতিটি আন্দোলনে ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একটা বৈরী পরিবেশে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এ আন্দোলন সংগ্রামে যেসব ছাত্রনেতারা ভূমিকা রেখেছে, তাদের অনেকেই আমাদের মাঝ থেকে চলে যাচ্ছে- এটা অত্যন্ত কষ্টের ও বেদনার। হাতেগড়া ছাত্র নেতাদের চলে যাওয়ার খবর সত্যই খুব দুঃখজনক। মান্নান এভাবে চলে যাবে ভাবতেই পারিনি। ছাত্র নেতারা নেতৃত্ব দেবে আওয়ামী লীগের, ভবিষ্যতে যখন আমরা থাকব না, এরাই সামনের দিকে আওয়ামী লীগকে নিয়ে যাবে। এদের চলে যাওয়া শুধু দলের নয়, দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর দেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্রলীগের নাম-নিশানা ছিল না। ব্যতিক্রম ছিল শুধু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি ও কৃষকদের ভীষণ ভালোবাসতেন। তিনি জানতেন কৃষির উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় দেশের খাদ্য সমস্যারও সমাধান। তিনি বলতেন, আমার স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পায়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কৃষিবিদদের দীর্ঘদিনের দাবি প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড মর্যাদার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। এজন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জাতির জনকের নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতি ছিল খুব অনুরক্ত। সেই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলন টাঙ্গাইলের প্রয়াত এমপি শওকত মোমেন শাহজাহান, বগুড়া-১ আসনের সদ্য প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নান এবং বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত প্রদীপ রঞ্জন কর। মান্নান ভাই থাকতেন শহীদ শামসুল হক হলে। শওকত মোমেন শাহজাহান থাকতেন শাহজালাল হলে আর প্রদীপ রঞ্জন কর থাকতেন শহীদ নাজমুল আহসান হলে। আবদুল মান্নান ছিলেন যেমন সুবক্তা তেমন দক্ষ সংগঠক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল, অনুষদ ও বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। স্মরণশক্তিও ছিল অসাধারণ। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের নাম ধরে ডাকতে পারতেন তিনি। হলের নাম ও মনে রাখতে পারতেন।

১৯৭৯-৮০ সালের বাকসু নির্বাচনে আবদুল মান্নান ভিপি ও প্রদীপ রঞ্জন কর জিএস পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। শুধু ছাত্রলীগ নয়, অন্য সংগঠনের ছাত্রছাত্রীদেরও ভোট পেয়ে ছিলেন এ দুই নন্দিত নেতা। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ১৯৫৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার হিন্দুকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৃত জালাল উদ্দিন সরদার। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। আশির দশকে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতির গুরু দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জয়লাভ করেন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে তৃতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। আবদুল মান্নান কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রকৃচির আন্দোলনে ও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। কৃষক ও কৃষিবিদদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি সক্রীয় ভূমিকা পালন করেন। বহুতল কেআইবি কমপ্লেক্সের জমি ও নির্মাণ কাজে তার অনন্য অবদান ছিল। আবদুল মান্নানের স্ত্রী সাহাদারা মান্নান সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য। তার ছেলে শাখাওয়াত হোসেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক এবং মেয়ে মালিহা মান্নান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আবদুল মান্নানের পরিচয় ছিল। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং ’৭৫ পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসক জিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন আবদুল মান্নান। জিয়া-এরশাদকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেয়নি এ লড়াকু ছাত্রনেতা। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় বিএনপি আমলে তাকে হত্যার জন্য গুণ্ডাবাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয়। সেই হামলায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্রলীগের নেতা শওকত, অলি ও মোহসীন নির্মমভাবে নিহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান বাকসুর ভিপি আবদুল মান্নান। ২০০৬ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠান। সেবার তিনি সুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে আসেন। কৃষকের ঘর থেকে উঠে আসা সন্তান আবদুল মান্নান ছাত্রলীগের অত্যন্ত কঠিন সময়ে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। তখন ছাত্রলীগ ও জাতির জনকের নাম উচ্চারণ করা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তিনি এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। ২০১৬ সালে লালপুরে এক্সিম ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন কালে নর্থ-বেঙ্গল সুগার মিলের অতিথি ভবনে অবস্থান কালে তিনি কৃষিভিত্তিক চিনি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবাইকে আরও নিষ্ঠা, সততা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কথা বলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে আবদুল মান্নান অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক থাকা অবস্থায় প্রতিটি লিফলেট থেকে শুরু করে বিবৃতি শেখ হাসিনা নিজে বসে থেকে তাকে দিয়ে লেখাতেন। প্রতিটি কাজই তিনি দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করতেন। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল আবদুল মান্নান অসম্ভব মেধাবী সাহসী রাজনীতিবিদ ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় তাকে বুদ্ধি দিয়ে, সাহস দিয়ে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করতেন। বগুড়ার মতো বিএনপির ঘাঁটিতে তিনি তিন তিন বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তার ব্যক্তিগত ইমেজ, নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক শক্তির গুণে। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলার রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্টসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখেন। এলাকার সব মানুষের জন্য তার দ্বার ছিল সর্র্বদা উন্মুক্ত। তিনি জনগণকে ভালোবাসতেন এবং সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকতেন।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে ঢাকায় অবস্থান করলেও তিনি প্রাণের ক্যাম্পাস কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা কখনও ভুলতে পারেননি। যে কোন প্রয়োজনেই তিনি ছুটে আসতেন কৃষি বিশ্ববিদ্যলয়ের সবুজ চত্বরে। মনে পড়ে ১৯৮৪ সালে এরশাদ আমলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান বাদশাহ ও ছাত্রনেতা আবদুল গফুর পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হলে তিনি ঢাকা থেকে ট্রেন যোগে ময়মনসিংহে ছুটে আসেন। সেদিন ময়মনসিংহ রেল স্টেশনে অভ্যর্থনা জানানোর সৌভাগ্য হয় আমার। আওয়ামী লীগের নেতা প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে ছাত্র নেতাদের মুক্তির ব্যাপারে তিনি আলোচনা করেন। কথা বলেন আওয়ামী লীগপন্থি অ্যাডভোকেটদের সঙ্গে। জেলখানায় ছাত্র নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তিনি সাহস জোগান। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। সেই সম্মেলনে তার জ্বালাময়ী বক্তব্য এখনও আমাদের আন্দোলিত করে। ২০১৮ সালের ১৩ফেরুয়ারি কৃষিবিদ দিবসে তিনি শেষ বারের মতো আসেন তার প্রিয় ক্যাম্পাসে। প্রয়াত এমপি শওকত মোমেন শাহজাহানের সঙ্গে তিনি এক সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি করতেন কৃষি বিশ্ববদ্যিালয়ে। উভয়েই ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব সৈনিক। কাজকর্ম ও আচার আচরণে অদ্ভুত মিল ছিল দু’জনের মধ্যে। শওকত মোমেন শাহজাহান ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি আর আবদুল মান্নান ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি খুব কাছাকাছি সময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। যতদিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে, ছাত্র রাজনীতি থাকবে, কৃষক ও কৃষি থাকবে, ততদিন উচ্চারিত হবে আবদুল মান্নানের নাম। আবদুল মান্নান বেঁচে থাকবেন কৃষক ও কৃষিবিদদের অন্তরে আজীবন।

[লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লি ]

netairoy18@yahoo.com