উন্নয়ন, পরিবেশ সংকট এবং করোনাভাইরাস

পাভেল পার্থ

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস এখন এক বৈশ্বিক আতঙ্ক। আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু ও দ্রুত সংক্রমণ পরিসংখ্যান বেড়েই চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক সতর্কতা জারি করেছে। এ নিয়ে একদিকে যেমন আতঙ্ক আছে, একইভাবে ছড়িয়েছে নানা গুজব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে অনলাইন গণমাধ্যমে এ সম্পর্কিত খবরের পর অনেকেই নানাভাবে বর্ণবাদী বৈষম্যমূলক মন্তব্যও ছড়িয়েছেন। আতংক নয়, সকলের সম্মিলিত চেষ্টাতেই এই ঝুঁকি সামাল দেয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশ নানাভাবে চেষ্টা করছে, বন্দরগুলোতে থার্মাল স্ক্যানিং, চীনফেরতদের কোয়ারেনটাইন থেকে শুরু করে সচেতনতামূলক প্রচারণা। যদিও এসব প্রচেষ্টা ও মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নানাদিক থেকে নানাকথা ভাসছে চারপাশে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও সাবধানতাকেই আপাতত সংক্রমণ থেকে বাঁচার প্রাথমিক উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখানে তর্ক আছে। বলা হচ্ছে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি, কিন্তু এর ভেতরেই নির্দয় বাজার মাস্কের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে ফেলেছে। আবার শিশুদের মাপে মাস্ক মিলছেও না, এমনকি শিশুরাতো বড়দের মতো মাস্ক পড়েও থাকতে চায় না। বলা হচ্ছে ভালো করে হাত ধোয়াটা জরুরি, হাত ধুতে তো পানি লাগবে। নগরের বস্তি ও গরিব এলাকায় এই পানির এমনিতেই আকাল। বলা হচ্ছে ভালো করে সময় নিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুতে, আবার বেশি পানি ধরলে ঠাণ্ডা লাগবে বলে বাচ্চাদের মানাও করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে অপ্রয়োজনে ঘরের দরজা জানালা না খুলে বন্ধ করে রাখতে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের কারণে ঘরের ভেতর বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে। কেউ বলছে প্রতিষেধক তৈরি হয়ে গেছে, কেউ বলছে ২০২১ সন নাগাদ হবে। মধুর সঙ্গে হুইস্কি মিশিয়ে খাওয়ার প্রচার যেমন হয়েছে, আরেকদিকে কেউ গোবর চিকিৎসাও ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি গণমাধ্যমে এসেছে মৃত ও আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা গোপন করছে চীন, তারা গোপনে মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলছে। সন্দেহ নেই তথ্যভারাক্রান্ত এই সময়ে নানাদিকের নানা কথা আমাদের করোনা নিয়ে উদভ্রান্ত করে তুলছে। বিশেষ করে এই দূষিত ঢাকা নগরে আমরা দারুণ সব বিপজ্জনক সময় সামাল দিয়েই বেঁচে আছি। দূষিত বায়ুর এই নগরে এমনিতেই সারাবছর আমাদের ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বরজারি, শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকছে। করোনাভাইরাস আক্রান্তের প্রাথমিক লক্ষণও এইসব আমাদের নিত্যদিনের জ্বরজারি। চলতি লেখাটি করোনাভাইরাস নিয়ে কোনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যআলাপ গোছের নয়, বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত বিপদের সংকটকে বোঝাই এই আলাপের লক্ষ্য। গত ৫০ বছরে আমরা বিশ্বব্যাপী নানারকমের বিপদজনক রোগসংক্রমণ ও মহামারি ছড়িয়ে যেতে দেখেছি। এই অবস্থা আরও জটিল হচ্ছে নৃশংস নগরায়ণ ও দুনিয়াজুড়ে প্রতিবেশব্যবস্থা চুরমার হয়ে যাওয়ার ফলে।

২.

গ্রীক শব্দ করোনে মানে মুকুট এবং ল্যাটিন শব্দ করোনা মানে মালা থেকেই করোনাভাইরাস পরিবারের নামটি এসেছে। ১৯৬০ সনে খুঁজে পাওয়া এই ভাইরাস পরিবারে দুই শতাধিক সদস্য আছে তবে মানুষের ভেতর সংক্রমণের জন্য আগে ছয়টি ভাইরাস চিহ্নিত হয়েছিল। ২০১৯ সনে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোচিত এই ‘নোবেল করোনাভাইরাস (২০১৯ এনসিওভি)’ হলো মানুষে সংক্রমিত হওয়া করোনার সপ্তম প্রজাতি। কেন বিশ্বে একের পর এক এমনসব জটিল জীবাণু সংক্রমণ ঘটছে? এক সংক্রমণের ধাক্কা সামাল না দিতেই আরেক বিপদ হাজির। সার্স, মার্স, নিপাহ, ইবোলা, হেনিপা, বার্ড ফ্লু ভাইরাসের ভয়াবহতা জারি থাকতেই আবার করোনা। এক চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গু সামাল দিতে না দিতেই আবার করোনা। কেন প্রকৃতি এমন বিমুখ হচ্ছে এই ‘চকমকে ঝলকানো সভ্যতার’ প্রতি? আজ করোনাভাইরাস সামাল দেয়া যেমন জরুরি, একইভাবে কেন প্রকৃতিতে এমনসব মারণমুখী জীবাণুরা জাগছে এই প্রশ্নও খোঁজা জরুরি। দুনিয়াজুড়ে এককভাবে প্রজাতি হিসেবে মানুষের লাগাতার অবিচারই আজ মাতৃদুনিয়াকে এমনস দুর্বিষহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এথনোসেন্ট্রিক উন্নয়নপ্রক্রিয়া দুনিয়ার অপরাপর প্রাণপ্রজাতির বৈচিত্র্য নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, বাস্তুসংস্থান ওলটেপাল্টে দিচ্ছে। ভেঙে পড়ছে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের নানামুখী নির্ভরশীল সম্পর্ক ও খাদ্যশৃঙ্খল। আর এই পরিবেশগত বিপর্যয়ে একের পর এক জাগছে, নতুনভাবে বিকশিত হচ্ছে নানা জীবাণুরা। প্রজাতি হিসেবে মানুষের টিকে থাকার জন্য যা বিপজ্জনক।

৩.

দুনিয়াজুড়েই কমছে প্রাণ-প্রজাতির বৈচিত্র্য। নয়াউদারবাদী করপোরেট বাজারনির্ভর উন্নয়ন প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সহাবস্থানকে বারবার অস্বীকার করছে। ১০ হাজার বছর আগে হাজার উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে মানুষের খাদ্যের জোগান আসতো, আজ মাত্র চারটি শস্যফসল মানুষের খাদ্যবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ঐসময়ে দুনিয়ায় মানুষ ছিল এক ভাগ আর বন্যপ্রাণ ছিল ৯৯ ভাগ। আজ মানুষ হয়েছে ৩২ ভাগ, গবাদি প্রাণিসম্পদ ৬৭ ভাগ আর বন্যপ্রাণ মাত্র এক ভাগ। দুনিয়াজুড়ে নির্দয়ভাবে উধাও হচ্ছে বন্যপ্রাণের জাত ও পরিসংখ্যান। মানুষ আজ মাছ, পাখি, বাদুড়, বাঘ, হাতি কী মৌমাছি সবাইকে উচ্ছেদ করে নিজের বসতি গড়ছে। প্রকৃতিতে এক মানুষ ছাড়া আরসব প্রাণপ্রজাতির বিচরণস্থল ও নিজেদের আপন বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়েছে। প্রতিবেশবিমুখ এই উন্নয়ন বাহাদুরিই একের পর এক নানা অসুখ ও মহামারি ডেকে আনছে। যার প্রভাব জীবনযাপন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি কী বৃহৎ সামাজিক প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। এক একটা বিপদের মুহূর্তে শুধু কিছুটা সময়ের জন্য আমরা ঝুঁকি থেকে বাঁচার জন্য মরিয়া হচ্ছি, কিন্তু বিপদ কিছুটা কমলেই আবার ভুলে যাচ্ছি। নিজেরাই এক একজন প্রবল পরিবেশ-হন্তারক হয়ে ওঠছি। করোনাভাইরাস বা এমনসব মারণমুখী জীবাণুর বিপদ থেকে বাঁচতে আমাদের চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন করতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতির আপন গণিতকে বিকশিত হওয়ার পথগুলো উন্মুক্ত ও সচল রাখতে হবে। প্রকৃতি নিজেই ঝুঁকি তৈরি করে এবং সামাল দিতে জানে। প্রকৃতির উপর খবরদারি নয়, নিজেকে আজ এই প্রকৃতির অংশ হিসেবে ভাবতে হবে আমাদের।

৪.

নানা তর্ক আছে কীভাবে এই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। উহানের বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাজার থেকে কাঁচাবাজার নানাকিছু। বন্যপ্রাণী কেন বাজারে বিক্রি হবে? বৈশ্বিক প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা উদ্যোগগুলো তাহলে কী করে? আবার গণমাধ্যমে এমনও প্রকাশ হয়েছে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে অবস্থিত জীবাণু অস্ত্রের গবেষণাগার থেকেই নাকি এই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ড্যানি শোহামের সূত্র উল্লেখ করে গণমাধ্যমের ভাষ্য ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’ চীনের প্যাথোজেন লেভেল-৪ মানের এক গুরুত্বপূর্ণ জীবাণু প্রযুক্তি গবেষণাগার। জীবাণু ছড়িয়ে না পড়ার ব্যবস্থা থাকতে হয় এখানে। ১৯৮৫ সনে আন্তর্জাতিক জৈব অস্ত্র কনভেনশনে স্বাক্ষরের পর ১৯৯৩ সনে চীন উহানকে দ্বিতীয় জৈব অস্ত্র গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। শোহামের দাবি সার্স ভাইরাসও চীনের জীবাণু-অস্ত্র প্রক্রিয়ার অংশ। করোনার ক্ষেত্রে এমন যদি নাও হয়ে থাকে তবুও বিষয়টি আশঙ্কাজনক যে দুনিয়াজুড়ে এমনসব প্রাণঘাতী গবেষণা চলছে। করোনার সাম্প্রতিক সংক্রমণ থেকে আমাদের এ সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি যে, জীবাণু-অস্ত্রের সব গবেষণা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ করতে হবে। জানা যায়, ১৯১৬ সনে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার যোদ্ধারা ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান আর্মির বিরুদ্ধে ফিনল্যান্ডে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ব্যবহার করে। ১৯৮৪ সনে যুক্তরাষ্ট্রের অরেগনে শ্রী রজনীশের অনুসারীরা সালমোনেলা টাইফিম্যুরিয়াম জীবাণু ছড়িয়ে এলাকার জনসংখ্যাকে নিষ্ক্রিয় করে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। ওই হামলায় ৭১৫ জন খাদ্যবিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলেও কোন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ১৯৯৩ সনের জুনে জাপানে অম শিনরিকিও নামের একটি সংগঠন অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ছড়িয়ে হামলা করেছিল। ভারতে প্রথম প্রমাণিত জৈবসন্ত্রাসের ঘটনাটি ঘটে ১৯৩৩ সনের ২৬ নভেম্বর। ‘পাকুড় হত্যা মামলা’ নামে পরিচিত এ ঘটনায় পাকুড় রাজবাড়ির ছোটকুমার অমরেন্দ্রচন্দ্র পান্ডের ওপর হাওড়া রেলস্টেশনে প্লেগ জীবাণু ছড়িয়ে দেয়া হয়। এতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জৈবসন্ত্রাস বা বায়োটেররিজম ঠেকাতে বাংলাদেশের একটি পাবলিক উদ্যোগের কথা জানা যায়। ২০১৬ সনের আগস্টে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘বায়োসেফটি, বায়োসিকিউরিটি, বায়োটেররিজম ও বায়োডিফেন্স’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। কোথায় আমরা টেনে নিয়ে যাচ্ছি এই মাতৃদুনিয়া? কী হবে আমাদের উন্নয়নের নিয়তি? কেন আমরা বারবার প্রকৃতির ব্যাকরণ চুরমার করে আমাদের বিরুদ্ধেই দাঁড় করাচ্ছি কোনো সংক্রমণ, মহামারি বা এমনকি জলবায়ুজনিত ঝুঁকিকে? জীবাণু-অস্ত্র গবেষণার নামে জিনপ্রযুক্তিতে বিকৃত কোনো জীবাণু যদি প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে তার সামাল কী মানুষ দিতে পারবে? তাহলে এই প্রাণঘাতী গবেষণা কী বাণিজ্য কার বিরুদ্ধে কিংবা কার স্বার্থে? মানুষের এই অবাধ্য দখলবাজ অস্থিরতা থামাতে হবে। তা না হলে আজ করোনাকে সামাল দিলেও, আগামীতে আরেক বিপদ আরো জটিল করে তুলবে আমাদের টিকে থাকা।

৫.

আমরা করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি চাই। আমরা চাই না প্রতিদিন প্রাণঘাতী সব জীবাণুরা জেগে ওঠুক। এমনতিই জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে টলছে পৃথিবী। বাড়ছে দূষণ ও তাপদাহ। গলছে বরফ ও হিমবাহ। নানা গবেষণায় প্রমাণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দুনিয়াজুড়ে জাগছে নানা প্রাণঘাতী জীবাণুরা। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে দুনিয়া তাহলে কী শিক্ষা গ্রহণ করবে? আগামীর জন্য কেমন পৃথিবী কল্পনা করবে? এর উত্তর ঘুমিয়ে আছে আমাদের মনস্তত্ত্ব ও চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পরিবেশ-উদাসিনতার ভেতর। করোনা সংক্রমণ সামাল দেয়ার পাশাপাশি আজ বিশৃঙ্খল প্রকৃতির সংকেতগুলো বিশ্বব্যাপী পাঠ করা জরুরি। কেবল চীনের উহান নয়, দুনিয়ার যে কোনো অঞ্চল থেকেই তা না হলে ছড়িয়ে পড়তে পারে আরেক কোন বিপদবার্তা।

[লেখক : প্রাণ ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক গবেষক] animistbangla@gmail.com

বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২২ মাঘ ১৪২৬, ১০ জমাদিউল সানি ১৪৪১

উন্নয়ন, পরিবেশ সংকট এবং করোনাভাইরাস

পাভেল পার্থ

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস এখন এক বৈশ্বিক আতঙ্ক। আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু ও দ্রুত সংক্রমণ পরিসংখ্যান বেড়েই চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক সতর্কতা জারি করেছে। এ নিয়ে একদিকে যেমন আতঙ্ক আছে, একইভাবে ছড়িয়েছে নানা গুজব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে অনলাইন গণমাধ্যমে এ সম্পর্কিত খবরের পর অনেকেই নানাভাবে বর্ণবাদী বৈষম্যমূলক মন্তব্যও ছড়িয়েছেন। আতংক নয়, সকলের সম্মিলিত চেষ্টাতেই এই ঝুঁকি সামাল দেয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশ নানাভাবে চেষ্টা করছে, বন্দরগুলোতে থার্মাল স্ক্যানিং, চীনফেরতদের কোয়ারেনটাইন থেকে শুরু করে সচেতনতামূলক প্রচারণা। যদিও এসব প্রচেষ্টা ও মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নানাদিক থেকে নানাকথা ভাসছে চারপাশে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও সাবধানতাকেই আপাতত সংক্রমণ থেকে বাঁচার প্রাথমিক উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখানে তর্ক আছে। বলা হচ্ছে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি, কিন্তু এর ভেতরেই নির্দয় বাজার মাস্কের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে ফেলেছে। আবার শিশুদের মাপে মাস্ক মিলছেও না, এমনকি শিশুরাতো বড়দের মতো মাস্ক পড়েও থাকতে চায় না। বলা হচ্ছে ভালো করে হাত ধোয়াটা জরুরি, হাত ধুতে তো পানি লাগবে। নগরের বস্তি ও গরিব এলাকায় এই পানির এমনিতেই আকাল। বলা হচ্ছে ভালো করে সময় নিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুতে, আবার বেশি পানি ধরলে ঠাণ্ডা লাগবে বলে বাচ্চাদের মানাও করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে অপ্রয়োজনে ঘরের দরজা জানালা না খুলে বন্ধ করে রাখতে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের কারণে ঘরের ভেতর বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে। কেউ বলছে প্রতিষেধক তৈরি হয়ে গেছে, কেউ বলছে ২০২১ সন নাগাদ হবে। মধুর সঙ্গে হুইস্কি মিশিয়ে খাওয়ার প্রচার যেমন হয়েছে, আরেকদিকে কেউ গোবর চিকিৎসাও ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি গণমাধ্যমে এসেছে মৃত ও আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা গোপন করছে চীন, তারা গোপনে মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলছে। সন্দেহ নেই তথ্যভারাক্রান্ত এই সময়ে নানাদিকের নানা কথা আমাদের করোনা নিয়ে উদভ্রান্ত করে তুলছে। বিশেষ করে এই দূষিত ঢাকা নগরে আমরা দারুণ সব বিপজ্জনক সময় সামাল দিয়েই বেঁচে আছি। দূষিত বায়ুর এই নগরে এমনিতেই সারাবছর আমাদের ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বরজারি, শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকছে। করোনাভাইরাস আক্রান্তের প্রাথমিক লক্ষণও এইসব আমাদের নিত্যদিনের জ্বরজারি। চলতি লেখাটি করোনাভাইরাস নিয়ে কোনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যআলাপ গোছের নয়, বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত বিপদের সংকটকে বোঝাই এই আলাপের লক্ষ্য। গত ৫০ বছরে আমরা বিশ্বব্যাপী নানারকমের বিপদজনক রোগসংক্রমণ ও মহামারি ছড়িয়ে যেতে দেখেছি। এই অবস্থা আরও জটিল হচ্ছে নৃশংস নগরায়ণ ও দুনিয়াজুড়ে প্রতিবেশব্যবস্থা চুরমার হয়ে যাওয়ার ফলে।

২.

গ্রীক শব্দ করোনে মানে মুকুট এবং ল্যাটিন শব্দ করোনা মানে মালা থেকেই করোনাভাইরাস পরিবারের নামটি এসেছে। ১৯৬০ সনে খুঁজে পাওয়া এই ভাইরাস পরিবারে দুই শতাধিক সদস্য আছে তবে মানুষের ভেতর সংক্রমণের জন্য আগে ছয়টি ভাইরাস চিহ্নিত হয়েছিল। ২০১৯ সনে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোচিত এই ‘নোবেল করোনাভাইরাস (২০১৯ এনসিওভি)’ হলো মানুষে সংক্রমিত হওয়া করোনার সপ্তম প্রজাতি। কেন বিশ্বে একের পর এক এমনসব জটিল জীবাণু সংক্রমণ ঘটছে? এক সংক্রমণের ধাক্কা সামাল না দিতেই আরেক বিপদ হাজির। সার্স, মার্স, নিপাহ, ইবোলা, হেনিপা, বার্ড ফ্লু ভাইরাসের ভয়াবহতা জারি থাকতেই আবার করোনা। এক চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গু সামাল দিতে না দিতেই আবার করোনা। কেন প্রকৃতি এমন বিমুখ হচ্ছে এই ‘চকমকে ঝলকানো সভ্যতার’ প্রতি? আজ করোনাভাইরাস সামাল দেয়া যেমন জরুরি, একইভাবে কেন প্রকৃতিতে এমনসব মারণমুখী জীবাণুরা জাগছে এই প্রশ্নও খোঁজা জরুরি। দুনিয়াজুড়ে এককভাবে প্রজাতি হিসেবে মানুষের লাগাতার অবিচারই আজ মাতৃদুনিয়াকে এমনস দুর্বিষহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এথনোসেন্ট্রিক উন্নয়নপ্রক্রিয়া দুনিয়ার অপরাপর প্রাণপ্রজাতির বৈচিত্র্য নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, বাস্তুসংস্থান ওলটেপাল্টে দিচ্ছে। ভেঙে পড়ছে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের নানামুখী নির্ভরশীল সম্পর্ক ও খাদ্যশৃঙ্খল। আর এই পরিবেশগত বিপর্যয়ে একের পর এক জাগছে, নতুনভাবে বিকশিত হচ্ছে নানা জীবাণুরা। প্রজাতি হিসেবে মানুষের টিকে থাকার জন্য যা বিপজ্জনক।

৩.

দুনিয়াজুড়েই কমছে প্রাণ-প্রজাতির বৈচিত্র্য। নয়াউদারবাদী করপোরেট বাজারনির্ভর উন্নয়ন প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সহাবস্থানকে বারবার অস্বীকার করছে। ১০ হাজার বছর আগে হাজার উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে মানুষের খাদ্যের জোগান আসতো, আজ মাত্র চারটি শস্যফসল মানুষের খাদ্যবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ঐসময়ে দুনিয়ায় মানুষ ছিল এক ভাগ আর বন্যপ্রাণ ছিল ৯৯ ভাগ। আজ মানুষ হয়েছে ৩২ ভাগ, গবাদি প্রাণিসম্পদ ৬৭ ভাগ আর বন্যপ্রাণ মাত্র এক ভাগ। দুনিয়াজুড়ে নির্দয়ভাবে উধাও হচ্ছে বন্যপ্রাণের জাত ও পরিসংখ্যান। মানুষ আজ মাছ, পাখি, বাদুড়, বাঘ, হাতি কী মৌমাছি সবাইকে উচ্ছেদ করে নিজের বসতি গড়ছে। প্রকৃতিতে এক মানুষ ছাড়া আরসব প্রাণপ্রজাতির বিচরণস্থল ও নিজেদের আপন বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়েছে। প্রতিবেশবিমুখ এই উন্নয়ন বাহাদুরিই একের পর এক নানা অসুখ ও মহামারি ডেকে আনছে। যার প্রভাব জীবনযাপন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি কী বৃহৎ সামাজিক প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। এক একটা বিপদের মুহূর্তে শুধু কিছুটা সময়ের জন্য আমরা ঝুঁকি থেকে বাঁচার জন্য মরিয়া হচ্ছি, কিন্তু বিপদ কিছুটা কমলেই আবার ভুলে যাচ্ছি। নিজেরাই এক একজন প্রবল পরিবেশ-হন্তারক হয়ে ওঠছি। করোনাভাইরাস বা এমনসব মারণমুখী জীবাণুর বিপদ থেকে বাঁচতে আমাদের চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন করতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতির আপন গণিতকে বিকশিত হওয়ার পথগুলো উন্মুক্ত ও সচল রাখতে হবে। প্রকৃতি নিজেই ঝুঁকি তৈরি করে এবং সামাল দিতে জানে। প্রকৃতির উপর খবরদারি নয়, নিজেকে আজ এই প্রকৃতির অংশ হিসেবে ভাবতে হবে আমাদের।

৪.

নানা তর্ক আছে কীভাবে এই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। উহানের বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাজার থেকে কাঁচাবাজার নানাকিছু। বন্যপ্রাণী কেন বাজারে বিক্রি হবে? বৈশ্বিক প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা উদ্যোগগুলো তাহলে কী করে? আবার গণমাধ্যমে এমনও প্রকাশ হয়েছে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে অবস্থিত জীবাণু অস্ত্রের গবেষণাগার থেকেই নাকি এই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ড্যানি শোহামের সূত্র উল্লেখ করে গণমাধ্যমের ভাষ্য ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’ চীনের প্যাথোজেন লেভেল-৪ মানের এক গুরুত্বপূর্ণ জীবাণু প্রযুক্তি গবেষণাগার। জীবাণু ছড়িয়ে না পড়ার ব্যবস্থা থাকতে হয় এখানে। ১৯৮৫ সনে আন্তর্জাতিক জৈব অস্ত্র কনভেনশনে স্বাক্ষরের পর ১৯৯৩ সনে চীন উহানকে দ্বিতীয় জৈব অস্ত্র গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। শোহামের দাবি সার্স ভাইরাসও চীনের জীবাণু-অস্ত্র প্রক্রিয়ার অংশ। করোনার ক্ষেত্রে এমন যদি নাও হয়ে থাকে তবুও বিষয়টি আশঙ্কাজনক যে দুনিয়াজুড়ে এমনসব প্রাণঘাতী গবেষণা চলছে। করোনার সাম্প্রতিক সংক্রমণ থেকে আমাদের এ সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি যে, জীবাণু-অস্ত্রের সব গবেষণা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ করতে হবে। জানা যায়, ১৯১৬ সনে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার যোদ্ধারা ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান আর্মির বিরুদ্ধে ফিনল্যান্ডে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ব্যবহার করে। ১৯৮৪ সনে যুক্তরাষ্ট্রের অরেগনে শ্রী রজনীশের অনুসারীরা সালমোনেলা টাইফিম্যুরিয়াম জীবাণু ছড়িয়ে এলাকার জনসংখ্যাকে নিষ্ক্রিয় করে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। ওই হামলায় ৭১৫ জন খাদ্যবিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলেও কোন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ১৯৯৩ সনের জুনে জাপানে অম শিনরিকিও নামের একটি সংগঠন অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ছড়িয়ে হামলা করেছিল। ভারতে প্রথম প্রমাণিত জৈবসন্ত্রাসের ঘটনাটি ঘটে ১৯৩৩ সনের ২৬ নভেম্বর। ‘পাকুড় হত্যা মামলা’ নামে পরিচিত এ ঘটনায় পাকুড় রাজবাড়ির ছোটকুমার অমরেন্দ্রচন্দ্র পান্ডের ওপর হাওড়া রেলস্টেশনে প্লেগ জীবাণু ছড়িয়ে দেয়া হয়। এতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জৈবসন্ত্রাস বা বায়োটেররিজম ঠেকাতে বাংলাদেশের একটি পাবলিক উদ্যোগের কথা জানা যায়। ২০১৬ সনের আগস্টে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘বায়োসেফটি, বায়োসিকিউরিটি, বায়োটেররিজম ও বায়োডিফেন্স’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। কোথায় আমরা টেনে নিয়ে যাচ্ছি এই মাতৃদুনিয়া? কী হবে আমাদের উন্নয়নের নিয়তি? কেন আমরা বারবার প্রকৃতির ব্যাকরণ চুরমার করে আমাদের বিরুদ্ধেই দাঁড় করাচ্ছি কোনো সংক্রমণ, মহামারি বা এমনকি জলবায়ুজনিত ঝুঁকিকে? জীবাণু-অস্ত্র গবেষণার নামে জিনপ্রযুক্তিতে বিকৃত কোনো জীবাণু যদি প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে তার সামাল কী মানুষ দিতে পারবে? তাহলে এই প্রাণঘাতী গবেষণা কী বাণিজ্য কার বিরুদ্ধে কিংবা কার স্বার্থে? মানুষের এই অবাধ্য দখলবাজ অস্থিরতা থামাতে হবে। তা না হলে আজ করোনাকে সামাল দিলেও, আগামীতে আরেক বিপদ আরো জটিল করে তুলবে আমাদের টিকে থাকা।

৫.

আমরা করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি চাই। আমরা চাই না প্রতিদিন প্রাণঘাতী সব জীবাণুরা জেগে ওঠুক। এমনতিই জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে টলছে পৃথিবী। বাড়ছে দূষণ ও তাপদাহ। গলছে বরফ ও হিমবাহ। নানা গবেষণায় প্রমাণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দুনিয়াজুড়ে জাগছে নানা প্রাণঘাতী জীবাণুরা। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে দুনিয়া তাহলে কী শিক্ষা গ্রহণ করবে? আগামীর জন্য কেমন পৃথিবী কল্পনা করবে? এর উত্তর ঘুমিয়ে আছে আমাদের মনস্তত্ত্ব ও চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পরিবেশ-উদাসিনতার ভেতর। করোনা সংক্রমণ সামাল দেয়ার পাশাপাশি আজ বিশৃঙ্খল প্রকৃতির সংকেতগুলো বিশ্বব্যাপী পাঠ করা জরুরি। কেবল চীনের উহান নয়, দুনিয়ার যে কোনো অঞ্চল থেকেই তা না হলে ছড়িয়ে পড়তে পারে আরেক কোন বিপদবার্তা।

[লেখক : প্রাণ ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক গবেষক] animistbangla@gmail.com