সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হলে

সামসুল ইসলাম টুকু

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোনেম বলেছেন এ বছর সীমান্ত হত্যা অনেকে বেড়ে গেছে। সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাবার বিষয়টি ভারতের কাছে তুলে ধরার ব্যাপারে সরকার সজাগ রয়েছে। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে তখনই ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে বিষয়টি অবহিত করা হয় এবং কেন এই হত্যাকাণ্ড হচ্ছে সে ব্যাপারে জবাবদিহিতা চাওয়া হয়। প্রেক্ষিতে ভারত সরকার বারবারই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সীমান্তে একজনেরও প্রাণহানি হবে না। তবুও হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে সীমান্তে কোন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার। তথাপি হচ্ছে। এ নিয়ে ভারত সরকার তথা বিএসএফ নানা প্রকারের ব্যাখ্যা দেয়। যেমন সীমান্তে কোন হত্যাকাণ্ড হয়না। তাদের দেশের অনেক বেশি অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বলেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিষয়টি মোটেও সত্য নয়। সত্য হলে লাশ তারাই পেত। কিন্তু অধিকাংশ লাশই বিজিবি উদ্ধার করে। এবং এ থেকে বোঝা যায় সীমান্তের কমবেশী ৫০ গজের মধ্যে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায়। শুধু তাই নয় কোন কোন সময় বিএসএফ গুলি চালায় এবং তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ে থাকা লাশও ভারতে নিয়ে যায়। প্রমাণ করতে চায় মৃতরা সবাই ভারতে অনুপ্রবেশকারী। এছাড়া ক্ষেতে কর্মরত কৃষককে হত্যা করার ঘটনাও আছে।

গত ৪ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে সীমান্তে সর্বোচ্চ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল যার সংখ্যা ছিল ৩৮ জন। আর চলতি বছরের ৪৫ দিনেই ১৫ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। শুধু তাই নয় রাজশাহী পদ্মা নদীতে বাংলাদেশের জলসীমানার ১ মাইল ভেতরে ঢুকে বিএসএফ গত ৩১ জানুয়ারি ৫ জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে এবং অতি দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগ সাজিয়ে ভারতীয় পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। পতাকা বৈঠকের সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। এ ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ইতিপূর্বেও ঘটেছে। রাজশাহীর ঘটনার প্রেক্ষিতে বিজিবি পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানালেও ইতোমধ্যে ১৫ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত বিএসএফ সাড়া দেয়নি। এসব হত্যাকাণ্ড ও কীর্তিকলাপকে যেভাবে চিহ্নিত করা হোকনা কেন অথবা যাকেই দায়ী করা হোক না কেন মূল বিষয় হচ্ছে চোরাচালান। আর সেটা হচ্ছে মূলত গরু চোরাচালান। এ চোরাচালানের সঙ্গে দুদেশের গরু ব্যবসায়ী ও রাখাল জড়িত থাকলেও দৃশ্যমান হয় ও হত্যার শিকার হয় বাংলাদেশের গরু ব্যবসায়ী বা রাখালরা। কারণ তারাই সীমান্ত অতিক্রম করে। হাতেগোনা কিছু গরু ব্যবসায়ী আছে যারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গরু ব্যবসায়। ভারতীয় গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে টাকার লেনদেন হয় বিভিন্ন কৌশলে। আর বাংলাদেশের রাখালরা গরু প্রতি মাত্র দুহাজার টাকার বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্তের ওপারে যায় এবং গরু নিয়ে পদ্মা সাঁতরিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে। এই সময়েই বিএসএফের গুলির শিকার হয় তারা। আর দুদেশের গরু ব্যবসায়ীরা নেপথ্যে থেকে যায়। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, সব রাখালই গুলির শিকার হয়না। যারা গরু প্রতি ধার্যকৃত টাকা ওপারের দালালকে দিয়ে আসে তারা গুলির শিকার হয় না। অন্যদিকে ভারতীয় রাখালরা কখনই সীমান্তের কাছাকাছি যায় না।

এ পর্যন্ত যা বলা হলো তা চোরাপথে বা অবৈধপথে গরু ব্যবসার কুফল। এবার বলব তথা কথিত বৈধ পথে গরু ব্যবসার কথা। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ আমলের কথা। গরুর মাংস কম মূল্যে পাবার জন্য কিছু লোকের কর্মসংস্থানের জন্য ও কিছু সরকারি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে গরু আনার জন্য করিডোর খোলা হয়। ভারত থেকে নিয়ে আসা প্রতিটি গরুর জন্য কাস্টমসকে ৫০০ টাকা দিলে তার বিনিময়ে করিডোরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গরুর পিঠে একটি নাম্বার বসিয়ে দেয়। অন্যদিকে দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের নির্দিষ্ট হারে সেলামি দিতে হয়। এভাবেই গরুটি সারা দেশের জন্য বৈধ হয়ে যায়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ ব্যবসা ভালো চলেছে। সরকারের রাজস্ব আদায়ও কম হয়নি। কিন্তু ক্রমশ এ ব্যবসার দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। তখন করিডোর ছিল সীমান্ত থেকে অন্তত ৫ কিমি. ভেতরে। বর্তমানে ব্যবসাটা নিয়ে গেল একেবারে সীমান্তের কাছে পদ্মা নদীর কয়েকটি ঘাটে। নাম রাখা হলো বিট/খাটাল। যেখানে সীমান্ত পার হয়ে গরু আসবে বিশ্রাম নেবে ও গোখাদ্য খাবে। তারপরে পয়সা-কড়ি দিয়ে দেশের ভেতরে ঢুকবে। এই বিট/খাটাল বা ঘাটের খাস কালেকশান করে জেলা প্রশাসন। বছরে সেটাও ৩০/৪০ লাখ টাকা মূল্যে ইজারা দেয়া হয়। গরু প্রতি ১৫০/২০০ টাকা আদায় করার কথা থাকলেও আদায়কারী ইজারাদাররা আদায় করে ৫ হাজার টাকা। কারণ সীমান্ত পথে গরু আনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি নেবার জন্য মোটা অঙ্কের সেলামি দিতে হয়। যারা বিট/খাটাল বসানোর অনুমতি নেয় তারা গরু প্রতি ৫ হাজার টাকা নিলেও এর ভাগ দিতে হয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। এ ভাগ-বাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে ও বিট/খাটাল অনুমতি ও ইজারাকে কেন্দ্র করে মামলা মোকদ্দমা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিট/খাটাল সংলগ্ন ঘাটগুলোর খাস কালেকশানকে কেন্দ্র করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ডিসি ও টিএনও’র বিরোধ পর্যন্ত পত্র-পত্রিকায় খবর হয়েছে। বিট/খাটালের দুর্নীতির চিত্র বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও লাইভ দেখানো হয়েছে। এই বিট/খাটাল বেশকিছু সুবিধাভোগী মানুষের অবৈধ আয়ের উৎস হয়েছে। কিন্তু কাস্টমসের আদায় গরু প্রতি ৫০০ টাকায় থেকে গেছে। কমবেশি একই চিত্র ভারত সীমান্তের। আর এই দু’দেশের সীমান্তে ঘুষ বাণিজ্যের ফলে গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বি-গুণেরও বেশি। তারপরেও গরু আসা বন্ধ হয় না। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এবং গরু আসা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়ার ফলে গত প্রায় ৩ বছর যাবৎ বিট/খাটালের ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। বিট/খাটালের এখন আর দাম নাই। ফলে এখন চোরাপথে গরু আসছে এবং সীমান্ত হত্যা বাড়ছে। আজকে এ লেখাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে এ গরু ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব কতটা পড়েছে এবং এর প্রতিকারইবা কী। এরশাদের আমলে করিডোর খোলার পর এবং বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসার ফলে এবং দেশি গরুর চেয়ে দাম কম হওয়ায় তখন থেকেই দেশীয় খামারিরা গরু পালন বন্ধ করতে বাধ্য হয়। একমাত্র দুধের গরু পালন ছাড়া। ফলে যারা গরু পালন ও উৎপাদনের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের রুটি রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে বেকার হয়ে পড়ে। গোটা দেশ ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। যে দেশে সবুজে শ্যামলে ভরা, গো-খাদ্যের অভাব নেই সেদেশেই গরু পালন ও উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো দুর্ভাগ্য হতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই গরু উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দেশের পশু সম্পদ খাতে সংকট সৃষ্টি হয়। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকার ভাবছে না তা নয়। মোদি সরকার গরু আসা বন্ধ করে দিয়ে সরকার দেশীয় খামারিদের গরু পালনে উৎসাহিত করাসহ ঋণ দেবার ঘোষণা দেয়। কিন্তু করিডোর বিট/খাটালের তৎপরতা বন্ধ করেনি। এটা চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে। শুধু তাহলেই দেশীয় উদ্যোক্তা খামারিরা গরু পালনে উৎসাহ পাবে। বেকার সমস্যা অনেকটা দূর হবে। দেশের আর্থিক ভিত্তি মজবুত হবে। দেশ গো-সম্পদে আত্মনির্ভরশীল হবে। চোরাপথে গরু আসা বন্ধ হবে। চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত গরুর রাখালদের গরু পালনসহ বিকল্প কাজে নিয়োজিত করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে। বাংলাদেশের লোকেরা চোরাচালানি এমন দুর্নাম মুছে দিতে হবে। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার জন্য ভারত সরকারের কাছে অনুগ্রহ চাইতে হবে না। পশু সম্পদ বিভাগ দাবি করে তারা মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে দেশকে। সরকার উদ্যোগী হলে দেশ গো-সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

[লেখক : সাংবাদিক]

রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৩ ফল্গুন ১৪২৬, ২১ জমাদিউল সানি ১৪৪১

সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হলে

সামসুল ইসলাম টুকু

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোনেম বলেছেন এ বছর সীমান্ত হত্যা অনেকে বেড়ে গেছে। সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাবার বিষয়টি ভারতের কাছে তুলে ধরার ব্যাপারে সরকার সজাগ রয়েছে। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে তখনই ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে বিষয়টি অবহিত করা হয় এবং কেন এই হত্যাকাণ্ড হচ্ছে সে ব্যাপারে জবাবদিহিতা চাওয়া হয়। প্রেক্ষিতে ভারত সরকার বারবারই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সীমান্তে একজনেরও প্রাণহানি হবে না। তবুও হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে সীমান্তে কোন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার। তথাপি হচ্ছে। এ নিয়ে ভারত সরকার তথা বিএসএফ নানা প্রকারের ব্যাখ্যা দেয়। যেমন সীমান্তে কোন হত্যাকাণ্ড হয়না। তাদের দেশের অনেক বেশি অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বলেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিষয়টি মোটেও সত্য নয়। সত্য হলে লাশ তারাই পেত। কিন্তু অধিকাংশ লাশই বিজিবি উদ্ধার করে। এবং এ থেকে বোঝা যায় সীমান্তের কমবেশী ৫০ গজের মধ্যে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায়। শুধু তাই নয় কোন কোন সময় বিএসএফ গুলি চালায় এবং তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ে থাকা লাশও ভারতে নিয়ে যায়। প্রমাণ করতে চায় মৃতরা সবাই ভারতে অনুপ্রবেশকারী। এছাড়া ক্ষেতে কর্মরত কৃষককে হত্যা করার ঘটনাও আছে।

গত ৪ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে সীমান্তে সর্বোচ্চ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল যার সংখ্যা ছিল ৩৮ জন। আর চলতি বছরের ৪৫ দিনেই ১৫ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। শুধু তাই নয় রাজশাহী পদ্মা নদীতে বাংলাদেশের জলসীমানার ১ মাইল ভেতরে ঢুকে বিএসএফ গত ৩১ জানুয়ারি ৫ জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে এবং অতি দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগ সাজিয়ে ভারতীয় পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। পতাকা বৈঠকের সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। এ ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ইতিপূর্বেও ঘটেছে। রাজশাহীর ঘটনার প্রেক্ষিতে বিজিবি পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানালেও ইতোমধ্যে ১৫ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত বিএসএফ সাড়া দেয়নি। এসব হত্যাকাণ্ড ও কীর্তিকলাপকে যেভাবে চিহ্নিত করা হোকনা কেন অথবা যাকেই দায়ী করা হোক না কেন মূল বিষয় হচ্ছে চোরাচালান। আর সেটা হচ্ছে মূলত গরু চোরাচালান। এ চোরাচালানের সঙ্গে দুদেশের গরু ব্যবসায়ী ও রাখাল জড়িত থাকলেও দৃশ্যমান হয় ও হত্যার শিকার হয় বাংলাদেশের গরু ব্যবসায়ী বা রাখালরা। কারণ তারাই সীমান্ত অতিক্রম করে। হাতেগোনা কিছু গরু ব্যবসায়ী আছে যারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গরু ব্যবসায়। ভারতীয় গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে টাকার লেনদেন হয় বিভিন্ন কৌশলে। আর বাংলাদেশের রাখালরা গরু প্রতি মাত্র দুহাজার টাকার বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্তের ওপারে যায় এবং গরু নিয়ে পদ্মা সাঁতরিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে। এই সময়েই বিএসএফের গুলির শিকার হয় তারা। আর দুদেশের গরু ব্যবসায়ীরা নেপথ্যে থেকে যায়। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, সব রাখালই গুলির শিকার হয়না। যারা গরু প্রতি ধার্যকৃত টাকা ওপারের দালালকে দিয়ে আসে তারা গুলির শিকার হয় না। অন্যদিকে ভারতীয় রাখালরা কখনই সীমান্তের কাছাকাছি যায় না।

এ পর্যন্ত যা বলা হলো তা চোরাপথে বা অবৈধপথে গরু ব্যবসার কুফল। এবার বলব তথা কথিত বৈধ পথে গরু ব্যবসার কথা। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ আমলের কথা। গরুর মাংস কম মূল্যে পাবার জন্য কিছু লোকের কর্মসংস্থানের জন্য ও কিছু সরকারি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে গরু আনার জন্য করিডোর খোলা হয়। ভারত থেকে নিয়ে আসা প্রতিটি গরুর জন্য কাস্টমসকে ৫০০ টাকা দিলে তার বিনিময়ে করিডোরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গরুর পিঠে একটি নাম্বার বসিয়ে দেয়। অন্যদিকে দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের নির্দিষ্ট হারে সেলামি দিতে হয়। এভাবেই গরুটি সারা দেশের জন্য বৈধ হয়ে যায়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ ব্যবসা ভালো চলেছে। সরকারের রাজস্ব আদায়ও কম হয়নি। কিন্তু ক্রমশ এ ব্যবসার দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। তখন করিডোর ছিল সীমান্ত থেকে অন্তত ৫ কিমি. ভেতরে। বর্তমানে ব্যবসাটা নিয়ে গেল একেবারে সীমান্তের কাছে পদ্মা নদীর কয়েকটি ঘাটে। নাম রাখা হলো বিট/খাটাল। যেখানে সীমান্ত পার হয়ে গরু আসবে বিশ্রাম নেবে ও গোখাদ্য খাবে। তারপরে পয়সা-কড়ি দিয়ে দেশের ভেতরে ঢুকবে। এই বিট/খাটাল বা ঘাটের খাস কালেকশান করে জেলা প্রশাসন। বছরে সেটাও ৩০/৪০ লাখ টাকা মূল্যে ইজারা দেয়া হয়। গরু প্রতি ১৫০/২০০ টাকা আদায় করার কথা থাকলেও আদায়কারী ইজারাদাররা আদায় করে ৫ হাজার টাকা। কারণ সীমান্ত পথে গরু আনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি নেবার জন্য মোটা অঙ্কের সেলামি দিতে হয়। যারা বিট/খাটাল বসানোর অনুমতি নেয় তারা গরু প্রতি ৫ হাজার টাকা নিলেও এর ভাগ দিতে হয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। এ ভাগ-বাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে ও বিট/খাটাল অনুমতি ও ইজারাকে কেন্দ্র করে মামলা মোকদ্দমা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিট/খাটাল সংলগ্ন ঘাটগুলোর খাস কালেকশানকে কেন্দ্র করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ডিসি ও টিএনও’র বিরোধ পর্যন্ত পত্র-পত্রিকায় খবর হয়েছে। বিট/খাটালের দুর্নীতির চিত্র বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও লাইভ দেখানো হয়েছে। এই বিট/খাটাল বেশকিছু সুবিধাভোগী মানুষের অবৈধ আয়ের উৎস হয়েছে। কিন্তু কাস্টমসের আদায় গরু প্রতি ৫০০ টাকায় থেকে গেছে। কমবেশি একই চিত্র ভারত সীমান্তের। আর এই দু’দেশের সীমান্তে ঘুষ বাণিজ্যের ফলে গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বি-গুণেরও বেশি। তারপরেও গরু আসা বন্ধ হয় না। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এবং গরু আসা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়ার ফলে গত প্রায় ৩ বছর যাবৎ বিট/খাটালের ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। বিট/খাটালের এখন আর দাম নাই। ফলে এখন চোরাপথে গরু আসছে এবং সীমান্ত হত্যা বাড়ছে। আজকে এ লেখাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে এ গরু ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব কতটা পড়েছে এবং এর প্রতিকারইবা কী। এরশাদের আমলে করিডোর খোলার পর এবং বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসার ফলে এবং দেশি গরুর চেয়ে দাম কম হওয়ায় তখন থেকেই দেশীয় খামারিরা গরু পালন বন্ধ করতে বাধ্য হয়। একমাত্র দুধের গরু পালন ছাড়া। ফলে যারা গরু পালন ও উৎপাদনের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের রুটি রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে বেকার হয়ে পড়ে। গোটা দেশ ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। যে দেশে সবুজে শ্যামলে ভরা, গো-খাদ্যের অভাব নেই সেদেশেই গরু পালন ও উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো দুর্ভাগ্য হতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই গরু উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দেশের পশু সম্পদ খাতে সংকট সৃষ্টি হয়। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকার ভাবছে না তা নয়। মোদি সরকার গরু আসা বন্ধ করে দিয়ে সরকার দেশীয় খামারিদের গরু পালনে উৎসাহিত করাসহ ঋণ দেবার ঘোষণা দেয়। কিন্তু করিডোর বিট/খাটালের তৎপরতা বন্ধ করেনি। এটা চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে। শুধু তাহলেই দেশীয় উদ্যোক্তা খামারিরা গরু পালনে উৎসাহ পাবে। বেকার সমস্যা অনেকটা দূর হবে। দেশের আর্থিক ভিত্তি মজবুত হবে। দেশ গো-সম্পদে আত্মনির্ভরশীল হবে। চোরাপথে গরু আসা বন্ধ হবে। চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত গরুর রাখালদের গরু পালনসহ বিকল্প কাজে নিয়োজিত করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে। বাংলাদেশের লোকেরা চোরাচালানি এমন দুর্নাম মুছে দিতে হবে। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার জন্য ভারত সরকারের কাছে অনুগ্রহ চাইতে হবে না। পশু সম্পদ বিভাগ দাবি করে তারা মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে দেশকে। সরকার উদ্যোগী হলে দেশ গো-সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

[লেখক : সাংবাদিক]