দর্শনীয় হাজারদুয়ারী

মো. হামিদুল হক টিপু

২০১৫ সালের মার্চ মাসে গিয়েছিলাম ভারত সফরে। ভিসার সময়টা ছিল খুবই কম। তাই যাত্রাও ছিল খুব স্বল্প সময়ের জন্য। অবশ্য উদ্দেশ্যটা ছিল আমার পিতা এবং মাতার বাবা-মা’র বাড়ি খোঁজা। সে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পালিয়ে গিয়েছিলাম ভারতে। তখন আমি খুব ছোট। তারপর আর কখনো যাওয়া হয়নি। সহসা দাদা-নানার বাড়ি যে খুঁজে পাওয়া যাবে তাও কখনও ভাবিনি। তাই ভিসার স্বল্প সময়ের মধ্যে খুঁজতে বের হয়েছিলাম দাদা-নানার বাড়ি। আমার এক খালার মোবাইল নম্বর ছিল আমার কাছে। ওই নম্বরে ফোন করতেই খালা রিসিভ করলেন। বললেন তুমি আনু বু’র ছেলে? তা’ কোথায় আছ? উত্তরে আমি বললাম-আমি ভারতের মালদাহতে। অমনি খালা বললেন তুমি কোথায় যাবে? বললাম-দাদা-নানার বাড়ির খোঁজেই বের হয়েছি। তখন খালা বললেন-তাহলে তুমি ফারাক্কা ব্রিজ পার হয়ে যে স্ট্যান্ডে স্টেট বাস থামবে সেখানে নেমে যাবে। আমার ছেলে ফরহাদ তোমার খালাতো ভাই যাবে তোমাকে আনতে।

অনেক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে স্টেট বাসে চেপে যেতে শুরু করলাম গন্তব্য স্থলে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে নামতেই ফোন করলাম খালার নম্বরে। আর তখনি আমার পাশ থেকে খালাতো ভাই বললো- আপনি টিপু ভাই? ঠিক আছে বসুন। চলুন বাড়ি যাই।

১৫ মিনিটের মাথায় গিয়ে পৌঁছে গেলাম খালার কাছে। সেকি আদর। কিভাবে, কোথায় যে আমাকে রাখবে তা ভেবে পাচ্ছে না খালা। খালা জিজ্ঞাস করলো- তোমার মা কেমন আছে? বললাম-মা পরলোকে গিয়েছে, বাবাও তাই। আমরা ৭ ভাই এখন বেঁচে আছি। খালা কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদার তালে তালে সেই ছোট বেলাকার স্মৃতি বলতে বলতে কাঁদছে আর আমাকে আদর করছে।

রাত হয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর ওই বাড়িতে একজন কোট-টাই পড়া ভদ্রলোকের প্রবেশ হলো। খালা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো-এটা তোমার মামাতো ভাই। নাম মো. রবিউল ইসলাম বাবু। একজন নামকরা অ্যাডভোকেট। বয়সে আমার ছোট। তাই তুমি করে সম্বন্ধ করে বললাম অ্যাডভোকেটি পেশা কেমন চলছে। জবাবে আমার মামাতো ভাই বললো-ভালো।

তারপর রাতের খাবার শেষে মামাতো ভাই বললো-ভাই বাড়ি চলো। মনে মনে প্রশ্ন করলাম তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিলাম। এরপর আরেক বাড়িতে আসতেই মামাতো ভাই গাড়ি ব্রেক করে বললো নামুন। মামাতো ভাই বললো এটা আপনার আসল নানার বাড়ি। ওটা ছিল খালার বাড়ি। এরপর হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে যাওয়ার আগেই মামা এসে হাজির। নানা ধরনের কথা শুনতে শুরু করলেন মামা। রাত অনেক হওয়াতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে নানা বাড়ির বিভিন্ন দিক ঘুরে দেখালো মামা। তারপর দুপুরের খাওয়া শেষে মামাতো ভাইয়ের চেম্বার ফারাক্কায় গেলাম। ফারাক্কা মানে ফারাক্কা নদী। সেখানে যেতেই অনেক সিকিউরিটি পেরিয়ে ফারাক্কায় মামাতো ভাইয়ের চেম্বারে গেলাম। বলে রাখা ভালো যে মামাতো ভাই কিন্তু একজন অ্যাভোকেট। মুর্শিদাবাদ জেলার জেলা জজ কোর্ট কিন্তু জঙ্গিপুর সাব ডিভিশনে। যদিও মুর্শিদাবাদের জেলা শহর বহরমপুর। কিন্তু জেলা জজ কোট জঙ্গিপুরে অবস্থিত।

ফারাক্কায় মামাতো ভইয়ের চেম্বারে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ফারাক্কায় ব্যারেজ এবং এনটিপিসি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অবশ্য নিজস্ব গাড়ি ছিল বলেই দেখা সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় হেঁটে হেঁটে দেখা সম্ভব হতো না। বেশ রাত হওয়ার পর মামাতো ভাই চেম্বার বন্ধ করে বাড়ী ফিরে এলেন। সাথে আমিও। নানা বাড়ি অবশ্য বলে রাখা ভালো যে, আমার নানার বাড়ি হাজারপুর গ্রামে।

রাত শেষে পরদিন মামা নিয়ে গেলেন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হাজার দুয়ারি প্রাসাদে। এটা মুর্শিবাদাদেই অবস্থিত। প্রাসাদটির নামকরণের কারণ এর অদ্ভুত গঠনশৈলী। প্রাসাদটিতে দরজা এবং জানালার সংখ্যা হাজারের বেশি। ১৮২৯ সালের ২৯ আগস্ট নবাব নাজিম হুমায়ুন জা। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উলিয়াম ক্যাভিন্ডিস বেন্টিঞ্চ ও বহু গণ্যমান্য নানা নাগরিকের উপস্থিতিতে ইটালিয়ন স্থাপত্যে গঠিত প্রাসাদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সের কর্নেল ডানকান-ম্যাকলিয়ড প্রসাদটি গঠনের পরিকল্পনা করেন।

হাজার দুয়ারির চত্বরে ঢুকতে গেলে প্রথমেই টিকিট করে নিতে হয়। মাত্র ১০ টাকায় টিকিট করে সেই ঐতিহাসিক হাজার দুয়ারি প্রাসাদে প্রবেশ করি।

প্রাসাদটির ভিতরের কারুকার্য অত্যন্ত সুন্দর। এক তলায় রয়েছে অস্ত্রাগার, কেরর্ড ঘর ও আফিস ঘর। সিরাজের তরবারি, আলিবর্দীর তরবারি, নাদির শাহের বর্ম ও শিরত্রান, মীর কাশিমের ছোরা, মীর কাশিমের মুঙ্গেরের কারখানার বন্দুক এবং আরও বিভিন্ন ধরনের বন্দুক, ছোরা, বল্লম, খঞ্জর আছে এই অস্ত্রাগারে। এছাড়া পলাশীর যুদ্ধের সময় যে কামান ফেটে গিয়ে মীরমর্দন নিহত হয়েছিলেন সেটি এবং অকৃতজ্ঞ মহম্মদী বেগ যে ছোরা দিয়ে সিরাজকে হত্যা করেছিল সেই ছোরা টিও সযত্নে রক্ষিত আছে অস্ত্রাগারে।

প্রাসাদটির দোতালায় ও তিনতলায় রয়েছে বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি এবং দর্শনীয় বস্তু। দর্শনীয় বস্তুগুলোর মধ্যে মুর্শিদ কুলিখাঁর মার্বেল পাথরের সিংহাসন, সিরাজের রুপার সিংহাসন, পানপাত্র, চিনামাটির বিভিন্ন রকমের ফুলদানী, হাতির দাঁতের সোফাসেট ও পালকী, রুপার পালকী, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ব্যবহৃত বিলিয়ার্ড বোর্ড, ম্যাজিক আয়না, কিছু মুর্তি, মমি করা প্রচুর দুষ্প্রাপ্য পাখি উল্লেখ্যযোগ্য।

দোতলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় সুদৃশ্য দরবার কক্ষটি। কক্ষটি এমনভাবে তৈরি যে একমাত্র অমাবস্যার রাত ছাড়া সমস্ত কক্ষটি আলোকিত থাকে। দরবার কক্ষের মাঝখানে আছে সম্রাজ্ঞী ভিকটোরিয়ার উপহার দেওয়া ১০১ বাতির সুদৃশ্য ঝাড়লণ্ঠন। কক্ষটির ছাদের দেওয়ালে চুনসুরকির তৈরি আঙ্গুর লতার কাজ দর্শনীয়।

দোতলায় লাইব্রেরিতে আছে উর্দু, ইংরেজি, ফার্সি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় লিখিত প্রায় ১২ হাজার দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য বই। কিন্তু লাইব্রেরি পরিদর্শন করতে গেলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়।

এগুলো ছাড়া প্রাসাদে রয়েছে প্রচুর বহুমূল্যবান ছবি। ছবিগুলো ভ্যানডিউক, র‌্যাফেল মার্শাল, জজ টিসিয়ান এবং আরো অনেক অজ্ঞাতনামা চিত্রকরের আঁকা।

এছাড়া বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুন অর রশিদের হস্তলিখিত ১০ ইঞ্চি ৬ ইঞ্চি লম্বা চাওড়া আকৃতি একটি একত্রিশ পাতা বিশিষ্ট পবিত্র কোরআন শরিফ ও আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী’র পাণ্ডুলিপি রয়েছে।

প্রাসাদটির উচ্চতা ৮০ ফুট। তৈরি করতে খরচ পড়েছিল ১৬ লাখ টাকা। লক্ষণীয় যে তখন নাকি ৫ পয়সায় মজদুর অর্থাৎ লেবার এবং ২ আনাতে রাজমিস্ত্রি পাওয়া যেত।

প্রাসাদটির গাঁথনিতে প্রচুর খয়ের জল, মৌরী জল, ডিমের কুসুম ব্যবহার করায় এর গঠন খুব শক্তিশালী ও মজবুত। প্রাসাদের ভিত্তি ভূমির প্রতিপ্রান্তে একটি করে সোনার ইট পোতা হয়েছে। প্রসাদটির নির্মাণকাজ শেষে হয়েছে ১৮৩৭ সালে।

হাজার দুয়ারির এ প্রাসাদটি প্রতিদিন খোলা থাকে না। যাত্রার পূর্বে দেখে নিবেন বারটি কি? কেননা প্রতি শুক্রবার প্রাসাদটির দর্শন বন্ধ থাকে। হাজার দুয়ারিতে প্রবেশ করতে ১৫ বছর পর্যন্ত কোন টিকিট লাগে না।

হাজার দুয়ারীর পুরো ক্যাম্পাসটির আয়তন ৪১ একর। হাজার দুয়ারী প্রাসাদের সম্মুখ ভাগের দু’পাশে মনোরম বাগান রয়েছে। একতলা প্রাসাদের সম্মুখভাগে বিশাল সিড়ি “দরবার কক্ষ” পর্যন্ত উঠেছে। সম্মুখে লম্বা গোলাকার স্তম্ভরাজি যাতে সুন্দর নকশার কাজ রয়েছে ও সিড়ির দু’পাশের সম্মুখভাগে অবস্থিত দুটি সিংহমূর্তি এর সৌন্দর্যকে আরও অপরুপ করেছে।

[লেখক : সাংবাদিক]

রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৩ ফল্গুন ১৪২৬, ২১ জমাদিউল সানি ১৪৪১

দর্শনীয় হাজারদুয়ারী

মো. হামিদুল হক টিপু

image

২০১৫ সালের মার্চ মাসে গিয়েছিলাম ভারত সফরে। ভিসার সময়টা ছিল খুবই কম। তাই যাত্রাও ছিল খুব স্বল্প সময়ের জন্য। অবশ্য উদ্দেশ্যটা ছিল আমার পিতা এবং মাতার বাবা-মা’র বাড়ি খোঁজা। সে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পালিয়ে গিয়েছিলাম ভারতে। তখন আমি খুব ছোট। তারপর আর কখনো যাওয়া হয়নি। সহসা দাদা-নানার বাড়ি যে খুঁজে পাওয়া যাবে তাও কখনও ভাবিনি। তাই ভিসার স্বল্প সময়ের মধ্যে খুঁজতে বের হয়েছিলাম দাদা-নানার বাড়ি। আমার এক খালার মোবাইল নম্বর ছিল আমার কাছে। ওই নম্বরে ফোন করতেই খালা রিসিভ করলেন। বললেন তুমি আনু বু’র ছেলে? তা’ কোথায় আছ? উত্তরে আমি বললাম-আমি ভারতের মালদাহতে। অমনি খালা বললেন তুমি কোথায় যাবে? বললাম-দাদা-নানার বাড়ির খোঁজেই বের হয়েছি। তখন খালা বললেন-তাহলে তুমি ফারাক্কা ব্রিজ পার হয়ে যে স্ট্যান্ডে স্টেট বাস থামবে সেখানে নেমে যাবে। আমার ছেলে ফরহাদ তোমার খালাতো ভাই যাবে তোমাকে আনতে।

অনেক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে স্টেট বাসে চেপে যেতে শুরু করলাম গন্তব্য স্থলে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে নামতেই ফোন করলাম খালার নম্বরে। আর তখনি আমার পাশ থেকে খালাতো ভাই বললো- আপনি টিপু ভাই? ঠিক আছে বসুন। চলুন বাড়ি যাই।

১৫ মিনিটের মাথায় গিয়ে পৌঁছে গেলাম খালার কাছে। সেকি আদর। কিভাবে, কোথায় যে আমাকে রাখবে তা ভেবে পাচ্ছে না খালা। খালা জিজ্ঞাস করলো- তোমার মা কেমন আছে? বললাম-মা পরলোকে গিয়েছে, বাবাও তাই। আমরা ৭ ভাই এখন বেঁচে আছি। খালা কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদার তালে তালে সেই ছোট বেলাকার স্মৃতি বলতে বলতে কাঁদছে আর আমাকে আদর করছে।

রাত হয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর ওই বাড়িতে একজন কোট-টাই পড়া ভদ্রলোকের প্রবেশ হলো। খালা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো-এটা তোমার মামাতো ভাই। নাম মো. রবিউল ইসলাম বাবু। একজন নামকরা অ্যাডভোকেট। বয়সে আমার ছোট। তাই তুমি করে সম্বন্ধ করে বললাম অ্যাডভোকেটি পেশা কেমন চলছে। জবাবে আমার মামাতো ভাই বললো-ভালো।

তারপর রাতের খাবার শেষে মামাতো ভাই বললো-ভাই বাড়ি চলো। মনে মনে প্রশ্ন করলাম তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিলাম। এরপর আরেক বাড়িতে আসতেই মামাতো ভাই গাড়ি ব্রেক করে বললো নামুন। মামাতো ভাই বললো এটা আপনার আসল নানার বাড়ি। ওটা ছিল খালার বাড়ি। এরপর হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে যাওয়ার আগেই মামা এসে হাজির। নানা ধরনের কথা শুনতে শুরু করলেন মামা। রাত অনেক হওয়াতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে নানা বাড়ির বিভিন্ন দিক ঘুরে দেখালো মামা। তারপর দুপুরের খাওয়া শেষে মামাতো ভাইয়ের চেম্বার ফারাক্কায় গেলাম। ফারাক্কা মানে ফারাক্কা নদী। সেখানে যেতেই অনেক সিকিউরিটি পেরিয়ে ফারাক্কায় মামাতো ভাইয়ের চেম্বারে গেলাম। বলে রাখা ভালো যে মামাতো ভাই কিন্তু একজন অ্যাভোকেট। মুর্শিদাবাদ জেলার জেলা জজ কোর্ট কিন্তু জঙ্গিপুর সাব ডিভিশনে। যদিও মুর্শিদাবাদের জেলা শহর বহরমপুর। কিন্তু জেলা জজ কোট জঙ্গিপুরে অবস্থিত।

ফারাক্কায় মামাতো ভইয়ের চেম্বারে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ফারাক্কায় ব্যারেজ এবং এনটিপিসি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অবশ্য নিজস্ব গাড়ি ছিল বলেই দেখা সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় হেঁটে হেঁটে দেখা সম্ভব হতো না। বেশ রাত হওয়ার পর মামাতো ভাই চেম্বার বন্ধ করে বাড়ী ফিরে এলেন। সাথে আমিও। নানা বাড়ি অবশ্য বলে রাখা ভালো যে, আমার নানার বাড়ি হাজারপুর গ্রামে।

রাত শেষে পরদিন মামা নিয়ে গেলেন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হাজার দুয়ারি প্রাসাদে। এটা মুর্শিবাদাদেই অবস্থিত। প্রাসাদটির নামকরণের কারণ এর অদ্ভুত গঠনশৈলী। প্রাসাদটিতে দরজা এবং জানালার সংখ্যা হাজারের বেশি। ১৮২৯ সালের ২৯ আগস্ট নবাব নাজিম হুমায়ুন জা। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উলিয়াম ক্যাভিন্ডিস বেন্টিঞ্চ ও বহু গণ্যমান্য নানা নাগরিকের উপস্থিতিতে ইটালিয়ন স্থাপত্যে গঠিত প্রাসাদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সের কর্নেল ডানকান-ম্যাকলিয়ড প্রসাদটি গঠনের পরিকল্পনা করেন।

হাজার দুয়ারির চত্বরে ঢুকতে গেলে প্রথমেই টিকিট করে নিতে হয়। মাত্র ১০ টাকায় টিকিট করে সেই ঐতিহাসিক হাজার দুয়ারি প্রাসাদে প্রবেশ করি।

প্রাসাদটির ভিতরের কারুকার্য অত্যন্ত সুন্দর। এক তলায় রয়েছে অস্ত্রাগার, কেরর্ড ঘর ও আফিস ঘর। সিরাজের তরবারি, আলিবর্দীর তরবারি, নাদির শাহের বর্ম ও শিরত্রান, মীর কাশিমের ছোরা, মীর কাশিমের মুঙ্গেরের কারখানার বন্দুক এবং আরও বিভিন্ন ধরনের বন্দুক, ছোরা, বল্লম, খঞ্জর আছে এই অস্ত্রাগারে। এছাড়া পলাশীর যুদ্ধের সময় যে কামান ফেটে গিয়ে মীরমর্দন নিহত হয়েছিলেন সেটি এবং অকৃতজ্ঞ মহম্মদী বেগ যে ছোরা দিয়ে সিরাজকে হত্যা করেছিল সেই ছোরা টিও সযত্নে রক্ষিত আছে অস্ত্রাগারে।

প্রাসাদটির দোতালায় ও তিনতলায় রয়েছে বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি এবং দর্শনীয় বস্তু। দর্শনীয় বস্তুগুলোর মধ্যে মুর্শিদ কুলিখাঁর মার্বেল পাথরের সিংহাসন, সিরাজের রুপার সিংহাসন, পানপাত্র, চিনামাটির বিভিন্ন রকমের ফুলদানী, হাতির দাঁতের সোফাসেট ও পালকী, রুপার পালকী, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ব্যবহৃত বিলিয়ার্ড বোর্ড, ম্যাজিক আয়না, কিছু মুর্তি, মমি করা প্রচুর দুষ্প্রাপ্য পাখি উল্লেখ্যযোগ্য।

দোতলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় সুদৃশ্য দরবার কক্ষটি। কক্ষটি এমনভাবে তৈরি যে একমাত্র অমাবস্যার রাত ছাড়া সমস্ত কক্ষটি আলোকিত থাকে। দরবার কক্ষের মাঝখানে আছে সম্রাজ্ঞী ভিকটোরিয়ার উপহার দেওয়া ১০১ বাতির সুদৃশ্য ঝাড়লণ্ঠন। কক্ষটির ছাদের দেওয়ালে চুনসুরকির তৈরি আঙ্গুর লতার কাজ দর্শনীয়।

দোতলায় লাইব্রেরিতে আছে উর্দু, ইংরেজি, ফার্সি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় লিখিত প্রায় ১২ হাজার দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য বই। কিন্তু লাইব্রেরি পরিদর্শন করতে গেলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়।

এগুলো ছাড়া প্রাসাদে রয়েছে প্রচুর বহুমূল্যবান ছবি। ছবিগুলো ভ্যানডিউক, র‌্যাফেল মার্শাল, জজ টিসিয়ান এবং আরো অনেক অজ্ঞাতনামা চিত্রকরের আঁকা।

এছাড়া বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুন অর রশিদের হস্তলিখিত ১০ ইঞ্চি ৬ ইঞ্চি লম্বা চাওড়া আকৃতি একটি একত্রিশ পাতা বিশিষ্ট পবিত্র কোরআন শরিফ ও আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী’র পাণ্ডুলিপি রয়েছে।

প্রাসাদটির উচ্চতা ৮০ ফুট। তৈরি করতে খরচ পড়েছিল ১৬ লাখ টাকা। লক্ষণীয় যে তখন নাকি ৫ পয়সায় মজদুর অর্থাৎ লেবার এবং ২ আনাতে রাজমিস্ত্রি পাওয়া যেত।

প্রাসাদটির গাঁথনিতে প্রচুর খয়ের জল, মৌরী জল, ডিমের কুসুম ব্যবহার করায় এর গঠন খুব শক্তিশালী ও মজবুত। প্রাসাদের ভিত্তি ভূমির প্রতিপ্রান্তে একটি করে সোনার ইট পোতা হয়েছে। প্রসাদটির নির্মাণকাজ শেষে হয়েছে ১৮৩৭ সালে।

হাজার দুয়ারির এ প্রাসাদটি প্রতিদিন খোলা থাকে না। যাত্রার পূর্বে দেখে নিবেন বারটি কি? কেননা প্রতি শুক্রবার প্রাসাদটির দর্শন বন্ধ থাকে। হাজার দুয়ারিতে প্রবেশ করতে ১৫ বছর পর্যন্ত কোন টিকিট লাগে না।

হাজার দুয়ারীর পুরো ক্যাম্পাসটির আয়তন ৪১ একর। হাজার দুয়ারী প্রাসাদের সম্মুখ ভাগের দু’পাশে মনোরম বাগান রয়েছে। একতলা প্রাসাদের সম্মুখভাগে বিশাল সিড়ি “দরবার কক্ষ” পর্যন্ত উঠেছে। সম্মুখে লম্বা গোলাকার স্তম্ভরাজি যাতে সুন্দর নকশার কাজ রয়েছে ও সিড়ির দু’পাশের সম্মুখভাগে অবস্থিত দুটি সিংহমূর্তি এর সৌন্দর্যকে আরও অপরুপ করেছে।

[লেখক : সাংবাদিক]