মাস্ক কিনতে না পারায় কান ধরে উঠবস করালেন

সিরাজ প্রামাণিক

মাস্ক কিনতে না পারায় তিন বৃদ্ধকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন যশোরের মনিরামপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাইয়েমা হাসানের ভ্রাম্যমাণ আদালত। শুক্রবার বিকেলে তিন সিনিয়র সিটিজেনের সাজা দেয়ার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজে ওই চিত্র তার মোবাইলে ধারণ করেন। রাতেই এ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনাকালে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চিনাটোলা বাজারে এক বৃদ্ধ রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন এবং এক বৃদ্ধ ভ্যানচালক ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু তাদের মুখে মাস্ক ছিল না। শুধু কান ধরে ওঠবস নয়, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকারও সাজা দেয়া হয় তাদের। ভ্রাম্যমাণ আদালতের এমন দ- প্রদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে সুধীজনরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। চলছে আলোচনা সমালোচনা। চলাটাই স্বাভাবিক।

ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সঙ্গে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোন একটির কোনরকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। বহু বছর আগে মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং লিখেছিলেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসি দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স লিখেছিলেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দুরবস্থায় উপরোক্ত দুটি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো আইন মানবতা বিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।

যারা দিন আনে দিন খায়, মাস্ক কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের কে দেখবে? কীভাবে তাদের দিন যাবে? কান ধরে ওঠবস করানো বৃদ্ধটি তো ভ্যানচালক। পেটের দায়ে ভ্যান চালিয়ে সংসারের চাল-ডাল কিনতে এসেছিলেন যশোরের মণিরামপুরের চিনেটোলা বাজারে। এসি ল্যান্ড দেশের সামান্য একজন কর্মচারী। অতিরঞ্জিত তো কোন কিছুই ভালো না। মেনে নিলাম করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তবে কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে তার জন্য রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। কিন্তু কান ধরে ওঠবস করানো অতঃপর নিজ মোবাইলে ছবি তোলা শাস্তির কথা তো আইনে কোথায় বলা হয়নি। যদিও এসি ল্যান্ডরা নিজেদের ম্যাজিস্ট্রেট বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট শব্দের বাংলা অর্থ তো ফৌজদারি বিচারক ও শাসনকর্তা। তাকে তো ফৌজদারি আইন জেনে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হবে। কয়েক দিন আগে আমি একটি কলাম লিখেছিলাম। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা কলামটি ঘটা করে প্রকাশ করেছে। আমার লেখার শুরুতেই ছিল ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ শিরোনামে শামসুর রাহমানের একটি কবিতা। দেশের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মায়াকান্না করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষমতা নিয়ে এক ধরনের উদ্ভট এক উটের পিঠে চড়ে জনগণের ওপর যা খুশি তাই করছে। পাঠক নিশ্চয়ই কয়েক দিন আগে কুড়িগ্রামের ডিসির অপকর্মের কথা মনে আছে। সঙ্গে দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকেও লেলিয়ে দিয়েছিল সাংবাদিক আরিফকে হত্যার জন্য। যদিও মহামান্য হাইকোর্ট ওই ডিসি এবং দিনমজুর সন্তান ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পরায়ন নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম- এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।

ব্রিটিশ তো আইন তৈরি করেছিল শাসন শোষণের জন্য, দরিদ্র কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের জন্য কিংবা প্রজাকে কাছারিতে ধরে নিয়ে মারধর, হাত-পা বেঁধে আঁধার কুঠুরিতে ফেলে রাখা, প্রজার স্ত্রী-কন্যাকে বন্ধক হিসেবে আটক রাখা, বিষয়-সম্পত্তি ক্রোক করা এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য। বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা এখনও কি তার উত্তরাধিকার বহন করছে? যদি উত্তর পজেটিভ হয় তাহলে যুগে যুগে এসিল্যান্ডদের বিজয় হোক!

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনজন বয়স্ক ব্যক্তিকে কান ধরিয়ে ‘বেআইনি ও অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ’ করায় যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

[লেখক : আইনজীবী]

seraj.pramanik@gmail.com

রবিবার, ২৯ মার্চ ২০২০ , ১৫ চৈত্র ১৪২৬, ২৯ রজব সানি ১৪৪১

এবার এসিল্যান্ডের রোষানলে তিন বৃদ্ধ দিনমজুর!

মাস্ক কিনতে না পারায় কান ধরে উঠবস করালেন

সিরাজ প্রামাণিক

মাস্ক কিনতে না পারায় তিন বৃদ্ধকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন যশোরের মনিরামপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাইয়েমা হাসানের ভ্রাম্যমাণ আদালত। শুক্রবার বিকেলে তিন সিনিয়র সিটিজেনের সাজা দেয়ার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজে ওই চিত্র তার মোবাইলে ধারণ করেন। রাতেই এ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনাকালে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চিনাটোলা বাজারে এক বৃদ্ধ রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন এবং এক বৃদ্ধ ভ্যানচালক ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু তাদের মুখে মাস্ক ছিল না। শুধু কান ধরে ওঠবস নয়, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকারও সাজা দেয়া হয় তাদের। ভ্রাম্যমাণ আদালতের এমন দ- প্রদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে সুধীজনরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। চলছে আলোচনা সমালোচনা। চলাটাই স্বাভাবিক।

ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সঙ্গে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোন একটির কোনরকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। বহু বছর আগে মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং লিখেছিলেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসি দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স লিখেছিলেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দুরবস্থায় উপরোক্ত দুটি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো আইন মানবতা বিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।

যারা দিন আনে দিন খায়, মাস্ক কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের কে দেখবে? কীভাবে তাদের দিন যাবে? কান ধরে ওঠবস করানো বৃদ্ধটি তো ভ্যানচালক। পেটের দায়ে ভ্যান চালিয়ে সংসারের চাল-ডাল কিনতে এসেছিলেন যশোরের মণিরামপুরের চিনেটোলা বাজারে। এসি ল্যান্ড দেশের সামান্য একজন কর্মচারী। অতিরঞ্জিত তো কোন কিছুই ভালো না। মেনে নিলাম করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তবে কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে তার জন্য রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। কিন্তু কান ধরে ওঠবস করানো অতঃপর নিজ মোবাইলে ছবি তোলা শাস্তির কথা তো আইনে কোথায় বলা হয়নি। যদিও এসি ল্যান্ডরা নিজেদের ম্যাজিস্ট্রেট বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট শব্দের বাংলা অর্থ তো ফৌজদারি বিচারক ও শাসনকর্তা। তাকে তো ফৌজদারি আইন জেনে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হবে। কয়েক দিন আগে আমি একটি কলাম লিখেছিলাম। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা কলামটি ঘটা করে প্রকাশ করেছে। আমার লেখার শুরুতেই ছিল ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ শিরোনামে শামসুর রাহমানের একটি কবিতা। দেশের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মায়াকান্না করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষমতা নিয়ে এক ধরনের উদ্ভট এক উটের পিঠে চড়ে জনগণের ওপর যা খুশি তাই করছে। পাঠক নিশ্চয়ই কয়েক দিন আগে কুড়িগ্রামের ডিসির অপকর্মের কথা মনে আছে। সঙ্গে দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকেও লেলিয়ে দিয়েছিল সাংবাদিক আরিফকে হত্যার জন্য। যদিও মহামান্য হাইকোর্ট ওই ডিসি এবং দিনমজুর সন্তান ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পরায়ন নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম- এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।

ব্রিটিশ তো আইন তৈরি করেছিল শাসন শোষণের জন্য, দরিদ্র কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের জন্য কিংবা প্রজাকে কাছারিতে ধরে নিয়ে মারধর, হাত-পা বেঁধে আঁধার কুঠুরিতে ফেলে রাখা, প্রজার স্ত্রী-কন্যাকে বন্ধক হিসেবে আটক রাখা, বিষয়-সম্পত্তি ক্রোক করা এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য। বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা এখনও কি তার উত্তরাধিকার বহন করছে? যদি উত্তর পজেটিভ হয় তাহলে যুগে যুগে এসিল্যান্ডদের বিজয় হোক!

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনজন বয়স্ক ব্যক্তিকে কান ধরিয়ে ‘বেআইনি ও অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ’ করায় যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

[লেখক : আইনজীবী]

seraj.pramanik@gmail.com