মন চাইছে তাই বলছি

ডা. হারিসুল হক

পৃথিবী অনেকদূর এগিয়েছে। মানুষ চন্দ্রাভিযানকে নস্যি করেছে, আজকাল মঙ্গলের প্রতিই মানুষের তুমুল আকর্ষণ। কিন্তু কী আশ্চর্য একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আরএনএ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না! এবং এটাই বাস্তবতা।

এ রকমটি পৃথিবীর পোর্টফোলিওতে প্রথম নয়। শত বছর আগেও এমনটা ঘটেছে, এর আগের শতকেও এটি ঘটেছে। এককথায় প্রতি শতাব্দীতেই পৃথিবী এসে জানান দিয়ে যায় প্রকৃতির কাছে আমরা কখনো কখনো কত অসহায়। একসময় এ অঞ্চলে ‘ওলা ওঠায়’ মানে কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত, অনেকে ভাব তো দেশের কেউ-ই বুঝি বাঁচবে না; কিন্তু না দেশও সাবাড় হয়নি মানুষও কমেনি বরং জনসংখ্যা সীমিত রাখতে জম্ননিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে।

প্রকৃতির লীলাসহচর এ পৃথিবী। কাজে কাজেই রোগ বালাই এখানে আসবেই। একসময় গুটি বসন্তে মানুষের প্রাণ যেত, আক্রান্তদের অনেকেরই চোখ যেত, তারা অন্ধ হয়ে বেঁচে ছিলেন।

আমি মফস্বলে বেড়ে ওঠা মানুষ। ফি বছরই আমার বেহেশতবাসিনী মা একটা কাণ্ড ঘটাতেন। বছরের এ সময়টায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই দেখতাম খাবার পাতে তেলে ভাজা কুড়কুড়ে কচি নিম পাতা আর সজনে ডাটা-ডাল। চারপাশে জল বসন্ত, হাম এড়াতে নাকি এগুলো অব্যর্থ। এ বিষয়টার অবতারণা করলাম শুধু এটাই মনে করিয়ে দিতে যে আণুবীক্ষণিক জীবের সঙ্গে মানুষের লড়াইটা নতুন কিছু নয়, যুগ যুগ ধরে এটি চলে আসছে। এখনকার পরিস্থিতিটা বৈশ্বিক ফলে এর বৈশিষ্ট্যও জটিল।

তবে তখনকার পরিস্থিতি থেকে এখন আমরা অনেক এগিয়ে কী তথ্য প্রবাহের দিক থেকে কী চিকিৎসা বিধানের দিক থেকে।

রেপিড টেস্ট কিট বাজার জাত হচ্ছে ফলে করোনা শনাক্ত করতে খুব বেগ পেতে হবে না আমাদের। করোনার স্বভাবও আমাদের কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। ঔষধও পাওয়া গেছে। ফলে অহেতুক দুর্ভাবনা করে আরেক রোগ বাধিয়ে বসবেন না। ভেবে দেখুন আগের শতকগুলোতে মহামারীতে একেকটা আঞ্চলিক ভূখণ্ডেই মারা পড়তেন লাখ লাখ লোক।

আর একটু সচেতনতা আমাদের রক্ষা করতে পারে অনেকাংশে।

তাই বলছি ভেঙে পড়বেন না। ভুলে যান কেন এদেশের স্বাধীনতার জন্য ঝরেছে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ।

এদিন থাকবে না। আবারও মুখর হবে বটতলা, কফি কর্নার আর মোড়ের দোকান। তবে এ প্রলয় আামাদের যে শিক্ষা দিয়ে গেল তা যেন ভুলে না যাই। যেমন প্রকৃতি ধনী নির্ধন বিচার করে না- সবাইকে সে একই পাল্লায় মাপে। সে প্রজাকে যেমন দংশায় রাজাকেও ছেড়ে কথা কয় না; আপনার আহরিত অর্থ আপনার জীবনের গ্যারান্টি দিতে ব্যর্থ। তাই মানুষকে ভালবাসুন। আর দশজনের জন্য মমত্ববোধের ক্ষেত্রটাকে প্রশস্ত করুন।

পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ, প্রকৃতির প্রতিটা সৃষ্টি ভালো থাকুক। পৃথিবীর প্রতিটা সৃষ্টি মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। তাই সাগরের প্রতি, অরণ্যের প্রতি, পাহাড়ের প্রতি, বুনোহাঁসের প্রতি আর কখনোই আমাদের রুঢ় হওয়া চলবে না।

এবং এ জাতীয় ভালোবাসা এক ধরনের শক্তি দেয়। এ শক্তি বিমূর্ত কিন্তু তীব্র। এ শক্তি অনুভব করা যায় কিন্তু বলে বোঝানো দুরূহ।

[লেখক : কার্ডিওলজিস্ট, অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ]

রবিবার, ২৯ মার্চ ২০২০ , ১৫ চৈত্র ১৪২৬, ২৯ রজব সানি ১৪৪১

মন চাইছে তাই বলছি

ডা. হারিসুল হক

পৃথিবী অনেকদূর এগিয়েছে। মানুষ চন্দ্রাভিযানকে নস্যি করেছে, আজকাল মঙ্গলের প্রতিই মানুষের তুমুল আকর্ষণ। কিন্তু কী আশ্চর্য একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আরএনএ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না! এবং এটাই বাস্তবতা।

এ রকমটি পৃথিবীর পোর্টফোলিওতে প্রথম নয়। শত বছর আগেও এমনটা ঘটেছে, এর আগের শতকেও এটি ঘটেছে। এককথায় প্রতি শতাব্দীতেই পৃথিবী এসে জানান দিয়ে যায় প্রকৃতির কাছে আমরা কখনো কখনো কত অসহায়। একসময় এ অঞ্চলে ‘ওলা ওঠায়’ মানে কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত, অনেকে ভাব তো দেশের কেউ-ই বুঝি বাঁচবে না; কিন্তু না দেশও সাবাড় হয়নি মানুষও কমেনি বরং জনসংখ্যা সীমিত রাখতে জম্ননিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে।

প্রকৃতির লীলাসহচর এ পৃথিবী। কাজে কাজেই রোগ বালাই এখানে আসবেই। একসময় গুটি বসন্তে মানুষের প্রাণ যেত, আক্রান্তদের অনেকেরই চোখ যেত, তারা অন্ধ হয়ে বেঁচে ছিলেন।

আমি মফস্বলে বেড়ে ওঠা মানুষ। ফি বছরই আমার বেহেশতবাসিনী মা একটা কাণ্ড ঘটাতেন। বছরের এ সময়টায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই দেখতাম খাবার পাতে তেলে ভাজা কুড়কুড়ে কচি নিম পাতা আর সজনে ডাটা-ডাল। চারপাশে জল বসন্ত, হাম এড়াতে নাকি এগুলো অব্যর্থ। এ বিষয়টার অবতারণা করলাম শুধু এটাই মনে করিয়ে দিতে যে আণুবীক্ষণিক জীবের সঙ্গে মানুষের লড়াইটা নতুন কিছু নয়, যুগ যুগ ধরে এটি চলে আসছে। এখনকার পরিস্থিতিটা বৈশ্বিক ফলে এর বৈশিষ্ট্যও জটিল।

তবে তখনকার পরিস্থিতি থেকে এখন আমরা অনেক এগিয়ে কী তথ্য প্রবাহের দিক থেকে কী চিকিৎসা বিধানের দিক থেকে।

রেপিড টেস্ট কিট বাজার জাত হচ্ছে ফলে করোনা শনাক্ত করতে খুব বেগ পেতে হবে না আমাদের। করোনার স্বভাবও আমাদের কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। ঔষধও পাওয়া গেছে। ফলে অহেতুক দুর্ভাবনা করে আরেক রোগ বাধিয়ে বসবেন না। ভেবে দেখুন আগের শতকগুলোতে মহামারীতে একেকটা আঞ্চলিক ভূখণ্ডেই মারা পড়তেন লাখ লাখ লোক।

আর একটু সচেতনতা আমাদের রক্ষা করতে পারে অনেকাংশে।

তাই বলছি ভেঙে পড়বেন না। ভুলে যান কেন এদেশের স্বাধীনতার জন্য ঝরেছে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ।

এদিন থাকবে না। আবারও মুখর হবে বটতলা, কফি কর্নার আর মোড়ের দোকান। তবে এ প্রলয় আামাদের যে শিক্ষা দিয়ে গেল তা যেন ভুলে না যাই। যেমন প্রকৃতি ধনী নির্ধন বিচার করে না- সবাইকে সে একই পাল্লায় মাপে। সে প্রজাকে যেমন দংশায় রাজাকেও ছেড়ে কথা কয় না; আপনার আহরিত অর্থ আপনার জীবনের গ্যারান্টি দিতে ব্যর্থ। তাই মানুষকে ভালবাসুন। আর দশজনের জন্য মমত্ববোধের ক্ষেত্রটাকে প্রশস্ত করুন।

পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ, প্রকৃতির প্রতিটা সৃষ্টি ভালো থাকুক। পৃথিবীর প্রতিটা সৃষ্টি মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। তাই সাগরের প্রতি, অরণ্যের প্রতি, পাহাড়ের প্রতি, বুনোহাঁসের প্রতি আর কখনোই আমাদের রুঢ় হওয়া চলবে না।

এবং এ জাতীয় ভালোবাসা এক ধরনের শক্তি দেয়। এ শক্তি বিমূর্ত কিন্তু তীব্র। এ শক্তি অনুভব করা যায় কিন্তু বলে বোঝানো দুরূহ।

[লেখক : কার্ডিওলজিস্ট, অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ]