যা কিছু অর্জন সেটা শুধু নারীর জন্য নয় রাষ্ট্র ও সমাজেরও জন্য

মুনীরুজ্জামান

লড়াই সংগ্রাম আন্দোলন সংগঠন গড়ে তোলার অর্ধ শতাব্দীর পথ অতিক্রম করল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সময়টা ছিল উত্তাল। সময়টা ছিল আন্দোলনের, লড়াইয়ের। সময়টা ছিল জাগরণের। সময়টা ছিল বাংলার নারী সমাজের নিজেদের শক্তিকে উপলব্ধি কবার। ১৯৭০ সাল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সদ্য শেষ হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচার কথিত ‘লৌহমানব’ আইয়ুব খানের পতন হয়েছে গণমানুষের আন্দোলনে। যে আন্দোলনে বাংলার নারী সমাজ-ছাত্রী-নারী শ্রমিক-পেশাজীবীরা ছিলেন উজ্জীবিত অংশীদার। রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণে। বলা যায় আন্দোলন পরিপূর্ণতা লাভ করে নারী সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণে।

গণমানুষের সৃষ্ট এ সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতাই একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক মহিলা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে। অপরিহার্য করে তোলে এমন একটি নারী সংগঠনের যে সংগঠন নারীকে একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে সংগঠিত করবে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নারীকে ঐক্যবদ্ধ করবে। নারীর ব্যক্তি, পরিবার এবং সামাজিক পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে সচেতন করবে, নারী বিরোধী সামাজিক-পারিবারিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে, সব অন্ধত্বের বিরুদ্ধে সচেতন লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করবে। জাগরণ ঘটাবে বাংলার নারী সমাজের। এ লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭০ সালে ৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। নেতৃত্বে ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল সভানেত্রী, মালেকা বেগম সাধারণ সম্পাদক।

সেই যাত্রা অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আজও থামেনি। লড়াই করে করে বাংলাদেশের নারী সমাজকে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ চলার পথটা মোটেই মসৃণ ছিল না, এখনও মসৃণ নয়। নিঃসন্দেহে প্রথম কাজটি ছিল সংগঠন গড়ে তোলা, সংগঠনের ব্যাপ্তি বাড়ানো। নারীদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে নারী সমাজকে যুক্ত করে তার মধ্যে থেকে সংগঠনের শক্তি বাড়ানো ছিল প্রাথমিক কঠিন কাজটি। পরিবারে ও সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, পারিবারিক-সামাজিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং ধর্মকে ব্যবহার করে পরিবারে এবং সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মহিলা পরিষদ নেতৃত্বকে সূচনার লড়াইগুলো চালিয়ে যেতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই সংগঠিত হয় নারী সমাজ, নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। সচেতন হয়েছে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে। এরই মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারী সমাজ এবং মহিলা পরিষদ অভিন্ন পথের সঙ্গী হয়েছে ৫০ বছর ধরে।

মহিলা পরিষদের জন্ম সম্পর্কে সংগঠনটির ওয়েবসাইটে, ‘মহিলা পরিষদকে জানুন’ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে- নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক দেশ ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে একসূত্রে গ্রথিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি লগ্নে ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

দেশ প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ছাত্রী-তরুণীদের এক অংশ এবং দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সচেতন নারী সমাজের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমের অঙ্গীকার নিয়ে কবি সুফিয়া কামলের নেতৃত্বে অধিকার ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গঠিত হয় আন্দোলনমুখী জাতীয়ভিত্তিক, অরাজনৈতিক এ স্বেচ্ছাসেবী গণ নারী সংগঠন। অসাম্প্রদায়িক, গণতন্ত্র ও নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে মহিলা পরিষদ। নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বিভিন্নমুখী পরিবেশ ও পরিস্থিতি মোকাবিলা করে গড়ে উঠেছে মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক ভিত্তির গ্রহণযোগ্যতা।

নারীর অধিকার মানবাধিকার এ স্লোগান নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ পরিচালনায় নারীর সমঅংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা, নারীর ব্যক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সামগ্রিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে চার দশকের অধিক সময় ধরে নারী সমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করে আন্দোলন পরিচালনা করছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। নারীর অধিকার বিষয়ে মহিলা পরিষদের রয়েছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর অধিকার বিষয়ে মহিলা পরিষদের রয়েছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ১২টি পৃথক উপ-পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সংগঠনের বহুমুখী কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠালগ্নে যে অঙ্গীকার নিয়ে মহিলা পরিষদ যাত্র শুরু করেছিল, আজ বিগত অর্ধশত বছরের লড়াই সংগ্রাম নারী-পুরুষের সমতা ভিত্তিক মানবিক সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে মহিলা পরিষদকে প্রতিনিয়তই সমাজ, পরিবার, ব্যক্তির প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগোতে হয়েছে। কখনও কখনও রাষ্ট্রও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে দু’দুটি সামরিক অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারী সরকারের শাসন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকার মহিলা পরিষদের চলার পথকে আরও কঠিন করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান এবং সামরিক-স্বৈরাচারী সরকার উভয়েই মহিলা পরিষদের চলার পথকে কঠিন করেছে।

বলাবাহুল্য এ লড়াইয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে মহিলা পরিষদ। দেশব্যাপী এ সংগঠন এখন একই সঙ্গে নারী নির্যাতনবিরোধী কণ্ঠ যেমন সোচ্চার রেখেছে, তেমনি নারীর পক্ষে বিশেষ নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং রাষ্ট্রীয় অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মৌলিক এবং আইনি নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে ফতোয়াবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফতোয়ার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের বাস্তবতা তৈরিতে সাফল্য। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্ষণবিরোধী কার্যকর চেতনা বৃদ্ধি। অবশ্য তাতেও ধর্ষণের প্রকোপ বাংলাদেশে কমেছে বলা যাবে না। নারীর প্রতি পুরুষ ও ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা সম্ভব না হলে এ সামাজিক অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, কতগুলো সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে মহিলা পরিষদের নিরন্তর সংগ্রামের কথা, গণচেতনা বৃদ্ধির চেষ্টার কথা।

এ প্রসঙ্গে মহিলা পরিষদ যে দুটি স্লোগান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সে দুটি স্লোগান হলো- ধর্ষণ হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এবং, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মানবতার বিরুদ্ধে সহিংসতা। নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এ সংগ্রামে এখনও সর্বাত্মক বিজয় অর্জিত হয়নি, কারণ পরিবার এবং ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বহুলাংশে নারীবিরোধী। আরকেটি বড় কারণ হচ্ছে, মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি এ প্রশ্ন রাষ্ট্রকে যে মাত্রায় প্রভাবিত করছে বা করতে পারছে নারী আন্দোলন এখনও সেই মাত্রায় পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু পৌঁছতে হবে এবং এর কোন বিকল্প নেই। নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন প্রতিরোধের সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লড়াইটা এখনও সমাপ্ত হয়নি। বলা যায় চলমান রয়েছে।

তবে সুদীর্ঘ এ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মহিলা পরিষদ তথা বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে- বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, এই আইনটিতে পরবর্তী সময় মৌলবাদীদের চাপে সরকার বিয়ের বয়স কমিয়ে দিয়েছে। এটা প্রতিরোধ করা যায়নি। অন্যান্য নারী সংগঠনকে নিয়ে মহিলা পরিষদকে এ আইনটির প্রতিক্রিয়াশীল সংশোধন বাতিল করাতে হবে রাষ্ট্রকে দিয়ে। এই লক্ষ্যে জনসমর্থন দাবির পক্ষে সমবেত করতে হবে নিঃসন্দেহে।

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০২০ প্রণীত হলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন হয়েছে বলা যাবে না। মহিলা পরিষদকে এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যেটা নিয়ে মহিলা পরিষদ বহু বছর ধরে কাজ করছে সেটা হলো- নারীর প্রতি সব প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ-সিডও। এ সনদটি বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করলেও এর দুটি ধারা অনুমোদন করেনি। এর একটি হচ্ছে-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার। এ অধিকারটি আদায় করা বাংলাদেশের বাস্তবতায় খুবই কঠিন। এ দেশে ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রের প্রভাব এতই শক্তিশালী যে এ দাবিটি আদায় করতে হলে শুধু নারী সংগঠনগুলোর জাতীয় ঐক্যই (সংগ্রাম-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মহিলা পরিষদ বহুদিন ধরেই এ ঐক্য অর্জন করেছে) যথেষ্ট নয় গোটা সমাজকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, ধর্ম বিশ্বাস নির্বিশেষে ব্যাপক ঐক্যের চাপই রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারে আইন প্রণয়নে। মহিলা পরিষদ এ লক্ষ্যে কাজ করছে বটে সমাজ ও রাষ্ট্র এখনও অনেক পিছিয়ে আছে।

মহিলা পরিষদের আরেকটি বড় অর্জন হচ্ছে- আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ করার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা। নারী স্বাস্থ্য অধিকার ও জাতীয় বাজেট নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন, বাংলাদেশে দলিত নারীর অবস্থা ও চ্যালেঞ্জ, নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, বিচার ব্যবস্থাকে জেন্ডার সেনসিটিভ করে নারীর মানবাধিকার গভীরতর করা, স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালীকরণ এর মতো নীতি ও কর্মকা- মহিলা পরিষদকে সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখার অবস্থানে উত্তরণ ঘটিয়েছে।

দীর্ঘ চলার পথে মহিলা পরিষদ যা কিছু অর্জন করেছে এবং ভবিষ্যতে যা কিছু অর্জন করবে তার সবটাই সংকীর্ণভাবে শুধু নারী সমাজের জন্য নয়, শুধু ব্যক্তি নারীর জন্য নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজেরও জন্য। কারণ, নারীর উন্নয়নই রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়ন।

শনিবার, ০৪ এপ্রিল ২০২০ , ২১ চৈত্র ১৪২৬, ৯ শাবান ১৪৪১

যা কিছু অর্জন সেটা শুধু নারীর জন্য নয় রাষ্ট্র ও সমাজেরও জন্য

মুনীরুজ্জামান

লড়াই সংগ্রাম আন্দোলন সংগঠন গড়ে তোলার অর্ধ শতাব্দীর পথ অতিক্রম করল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সময়টা ছিল উত্তাল। সময়টা ছিল আন্দোলনের, লড়াইয়ের। সময়টা ছিল জাগরণের। সময়টা ছিল বাংলার নারী সমাজের নিজেদের শক্তিকে উপলব্ধি কবার। ১৯৭০ সাল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সদ্য শেষ হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচার কথিত ‘লৌহমানব’ আইয়ুব খানের পতন হয়েছে গণমানুষের আন্দোলনে। যে আন্দোলনে বাংলার নারী সমাজ-ছাত্রী-নারী শ্রমিক-পেশাজীবীরা ছিলেন উজ্জীবিত অংশীদার। রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণে। বলা যায় আন্দোলন পরিপূর্ণতা লাভ করে নারী সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণে।

গণমানুষের সৃষ্ট এ সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতাই একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক মহিলা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে। অপরিহার্য করে তোলে এমন একটি নারী সংগঠনের যে সংগঠন নারীকে একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে সংগঠিত করবে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নারীকে ঐক্যবদ্ধ করবে। নারীর ব্যক্তি, পরিবার এবং সামাজিক পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে সচেতন করবে, নারী বিরোধী সামাজিক-পারিবারিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে, সব অন্ধত্বের বিরুদ্ধে সচেতন লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করবে। জাগরণ ঘটাবে বাংলার নারী সমাজের। এ লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭০ সালে ৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। নেতৃত্বে ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল সভানেত্রী, মালেকা বেগম সাধারণ সম্পাদক।

সেই যাত্রা অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আজও থামেনি। লড়াই করে করে বাংলাদেশের নারী সমাজকে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ চলার পথটা মোটেই মসৃণ ছিল না, এখনও মসৃণ নয়। নিঃসন্দেহে প্রথম কাজটি ছিল সংগঠন গড়ে তোলা, সংগঠনের ব্যাপ্তি বাড়ানো। নারীদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে নারী সমাজকে যুক্ত করে তার মধ্যে থেকে সংগঠনের শক্তি বাড়ানো ছিল প্রাথমিক কঠিন কাজটি। পরিবারে ও সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, পারিবারিক-সামাজিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং ধর্মকে ব্যবহার করে পরিবারে এবং সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মহিলা পরিষদ নেতৃত্বকে সূচনার লড়াইগুলো চালিয়ে যেতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই সংগঠিত হয় নারী সমাজ, নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। সচেতন হয়েছে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে। এরই মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারী সমাজ এবং মহিলা পরিষদ অভিন্ন পথের সঙ্গী হয়েছে ৫০ বছর ধরে।

মহিলা পরিষদের জন্ম সম্পর্কে সংগঠনটির ওয়েবসাইটে, ‘মহিলা পরিষদকে জানুন’ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে- নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক দেশ ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে একসূত্রে গ্রথিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি লগ্নে ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

দেশ প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ছাত্রী-তরুণীদের এক অংশ এবং দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সচেতন নারী সমাজের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমের অঙ্গীকার নিয়ে কবি সুফিয়া কামলের নেতৃত্বে অধিকার ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গঠিত হয় আন্দোলনমুখী জাতীয়ভিত্তিক, অরাজনৈতিক এ স্বেচ্ছাসেবী গণ নারী সংগঠন। অসাম্প্রদায়িক, গণতন্ত্র ও নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে মহিলা পরিষদ। নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বিভিন্নমুখী পরিবেশ ও পরিস্থিতি মোকাবিলা করে গড়ে উঠেছে মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক ভিত্তির গ্রহণযোগ্যতা।

নারীর অধিকার মানবাধিকার এ স্লোগান নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ পরিচালনায় নারীর সমঅংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা, নারীর ব্যক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সামগ্রিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে চার দশকের অধিক সময় ধরে নারী সমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করে আন্দোলন পরিচালনা করছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। নারীর অধিকার বিষয়ে মহিলা পরিষদের রয়েছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর অধিকার বিষয়ে মহিলা পরিষদের রয়েছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ১২টি পৃথক উপ-পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সংগঠনের বহুমুখী কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠালগ্নে যে অঙ্গীকার নিয়ে মহিলা পরিষদ যাত্র শুরু করেছিল, আজ বিগত অর্ধশত বছরের লড়াই সংগ্রাম নারী-পুরুষের সমতা ভিত্তিক মানবিক সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে মহিলা পরিষদকে প্রতিনিয়তই সমাজ, পরিবার, ব্যক্তির প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগোতে হয়েছে। কখনও কখনও রাষ্ট্রও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে দু’দুটি সামরিক অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারী সরকারের শাসন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকার মহিলা পরিষদের চলার পথকে আরও কঠিন করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান এবং সামরিক-স্বৈরাচারী সরকার উভয়েই মহিলা পরিষদের চলার পথকে কঠিন করেছে।

বলাবাহুল্য এ লড়াইয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে মহিলা পরিষদ। দেশব্যাপী এ সংগঠন এখন একই সঙ্গে নারী নির্যাতনবিরোধী কণ্ঠ যেমন সোচ্চার রেখেছে, তেমনি নারীর পক্ষে বিশেষ নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং রাষ্ট্রীয় অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মৌলিক এবং আইনি নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে ফতোয়াবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফতোয়ার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের বাস্তবতা তৈরিতে সাফল্য। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্ষণবিরোধী কার্যকর চেতনা বৃদ্ধি। অবশ্য তাতেও ধর্ষণের প্রকোপ বাংলাদেশে কমেছে বলা যাবে না। নারীর প্রতি পুরুষ ও ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা সম্ভব না হলে এ সামাজিক অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, কতগুলো সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে মহিলা পরিষদের নিরন্তর সংগ্রামের কথা, গণচেতনা বৃদ্ধির চেষ্টার কথা।

এ প্রসঙ্গে মহিলা পরিষদ যে দুটি স্লোগান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সে দুটি স্লোগান হলো- ধর্ষণ হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এবং, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মানবতার বিরুদ্ধে সহিংসতা। নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এ সংগ্রামে এখনও সর্বাত্মক বিজয় অর্জিত হয়নি, কারণ পরিবার এবং ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বহুলাংশে নারীবিরোধী। আরকেটি বড় কারণ হচ্ছে, মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি এ প্রশ্ন রাষ্ট্রকে যে মাত্রায় প্রভাবিত করছে বা করতে পারছে নারী আন্দোলন এখনও সেই মাত্রায় পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু পৌঁছতে হবে এবং এর কোন বিকল্প নেই। নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন প্রতিরোধের সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লড়াইটা এখনও সমাপ্ত হয়নি। বলা যায় চলমান রয়েছে।

তবে সুদীর্ঘ এ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মহিলা পরিষদ তথা বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে- বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, এই আইনটিতে পরবর্তী সময় মৌলবাদীদের চাপে সরকার বিয়ের বয়স কমিয়ে দিয়েছে। এটা প্রতিরোধ করা যায়নি। অন্যান্য নারী সংগঠনকে নিয়ে মহিলা পরিষদকে এ আইনটির প্রতিক্রিয়াশীল সংশোধন বাতিল করাতে হবে রাষ্ট্রকে দিয়ে। এই লক্ষ্যে জনসমর্থন দাবির পক্ষে সমবেত করতে হবে নিঃসন্দেহে।

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০২০ প্রণীত হলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন হয়েছে বলা যাবে না। মহিলা পরিষদকে এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যেটা নিয়ে মহিলা পরিষদ বহু বছর ধরে কাজ করছে সেটা হলো- নারীর প্রতি সব প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ-সিডও। এ সনদটি বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করলেও এর দুটি ধারা অনুমোদন করেনি। এর একটি হচ্ছে-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার। এ অধিকারটি আদায় করা বাংলাদেশের বাস্তবতায় খুবই কঠিন। এ দেশে ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রের প্রভাব এতই শক্তিশালী যে এ দাবিটি আদায় করতে হলে শুধু নারী সংগঠনগুলোর জাতীয় ঐক্যই (সংগ্রাম-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মহিলা পরিষদ বহুদিন ধরেই এ ঐক্য অর্জন করেছে) যথেষ্ট নয় গোটা সমাজকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, ধর্ম বিশ্বাস নির্বিশেষে ব্যাপক ঐক্যের চাপই রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারে আইন প্রণয়নে। মহিলা পরিষদ এ লক্ষ্যে কাজ করছে বটে সমাজ ও রাষ্ট্র এখনও অনেক পিছিয়ে আছে।

মহিলা পরিষদের আরেকটি বড় অর্জন হচ্ছে- আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ করার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা। নারী স্বাস্থ্য অধিকার ও জাতীয় বাজেট নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন, বাংলাদেশে দলিত নারীর অবস্থা ও চ্যালেঞ্জ, নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, বিচার ব্যবস্থাকে জেন্ডার সেনসিটিভ করে নারীর মানবাধিকার গভীরতর করা, স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালীকরণ এর মতো নীতি ও কর্মকা- মহিলা পরিষদকে সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখার অবস্থানে উত্তরণ ঘটিয়েছে।

দীর্ঘ চলার পথে মহিলা পরিষদ যা কিছু অর্জন করেছে এবং ভবিষ্যতে যা কিছু অর্জন করবে তার সবটাই সংকীর্ণভাবে শুধু নারী সমাজের জন্য নয়, শুধু ব্যক্তি নারীর জন্য নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজেরও জন্য। কারণ, নারীর উন্নয়নই রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়ন।