করোনার প্রভাবে বিপর্যয়ের মুখে দেশের গো-খামার ও দুগ্ধশিল্প

আতিক সিদ্দিকী

করোনা আক্রান্তে মৃতের সংখ্যা যখন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, তখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর করোনার বিরুদ্ধে বিশ্ব আজ এক যুদ্ধে নেমেছে। এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই এখন ভাবছে সবাই। লাশের দীর্ঘ মিছিল দেখে রীতিমতো আতঙ্কে বিশ্ববাসী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এশিয়ায় করোনার মহামারী শেষ হতে সময় লাগবে। সবমিলিয়ে ব্যক্তি, সমাজ এবং অর্থনৈতিক অবস্থা সামাল দিতে কঠিন হয়ে যাবে। দেশের শিল্প খাত বিপর্যয়ে উদ্যোক্তা ও শ্রমজীবী মানুষ দুর্বিষহ জীবনে পতিত হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভাব চরম আকার ধারণ করতে পারে। দেশে অন্যান্য শিল্পের মতো গো-খামারি এবং দুগ্ধশিল্প প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বিশ্বজুড়ে করোনার প্রভাবে দেশের বৃহত্তম সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা দুধ সংগ্রহ ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি থেকে সীমিত পরিমাণ বা কোটা পদ্ধতিতে দুধ সংগ্রহ করছে। এতে দুধ সংগ্রহ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। পরিবহন না থাকার অজুহাতে সুবিধাবাদী গো-খাদ্যের দোকানদার খৈল-ভুষির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অপরদিকে খামারিরা খাবার কমিয়ে দেয়ায় দুধের উৎপাদনও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। কথায় আছে গভীর দুধ ওলানে নয় মুখে, গাভীর দুধ বেশি হয় এমন খাবার মুখে যতো খাবে ততো দুধ বেশি দিবে। কৃষক তাদের বিনিয়োগ নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান জানান, করোনা আতঙ্কে এবং সরকারি নির্দেনায় মানুষ যেহেতু বাজারে কম আসছে কাজেই দুধ এবং মাংসের চাহিদা কমেছে। এ কারণে কৃষক বা খামারিদের ক্ষতির সন্মুখীন হতে হচ্ছে। এই কর্মকর্তা আরও জানান, শাহজাদপুরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ গরু রয়েছে। আর খামার রয়েছে প্রায় ১১ হাজার। এর মধ্যে উন্নতজাতের দুধেল গাভী রয়েছে প্রায় দেড় লাখ। এ কারণে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার দেড় লাখ দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকের উৎপাদিত গরুর দুধ খুচরা বাজারে ২৫ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে। শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সদস্যরা জানিয়েছেন করোনাভাইরাসের প্রভাবে উৎপাদন মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এর ওপর হঠাৎ করেই গো-খাদ্যের দাম বস্তা প্রতি ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করে বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা চরম লোকসানে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলা মিলে প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি ছোট বড় গো-খামার রয়েছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি কৃষকই তাদের বসতবাড়িতে ছোট আকারে গাভী লালন পালন করে। প্রচুর দুধ উৎপাদিত হওয়ায় এ এলাকা থেকে মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ ডেইরি, ফার্মফ্রেস, অ্যামোমিল্ক, আফতাব, রংপুর ডেইরিসহ প্রায় ২০টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান তরল দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে বাজারজাত করে। করোনা পরিস্থিতির কারণে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান দুধ নেয়া কমিয়ে দিয়েছে। কৃষকদের মতে প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ৪৪ টাকা। এ অবস্থায় অধিকাংশ কৃষক ও খামারিকে স্থানীয় বাজারগুলোতে এবং ভ্যানে করে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ২০ থেকে ২৫ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়া অনেক খামারি গ্রাহক না পাওয়ায় ১০ থেকে ১৫ টাকা লিটার দরেও দুধ বিক্রি করেছেন। এসব বিষয়ে নিয়ে বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা কারখানার ডিজিএম ডা. ইদ্রিস আলীর সঙ্গে কথা বলে যা জানা যায়, সেটা হলো করোনার প্রভাবে সরকারি নির্দেশে ফ্যাক্টরি কার্যক্রম আংশিক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকার আবার নির্দেশ দিলে ফ্যাক্টরি চালু করা হবে। তিনি আরো যা বলেন করোনার প্রভাবে বাজারে দুধের চাহিদা কমে গেছে। এদিকে ৯০০ মেট্রিক টন উৎপাদিত গুঁড়োদুধ আমাদের অবিক্রীত অবস্থায় গুদামে মজুদ রয়েছে। এতে কৃষকের সাময়িক অসুবিধা হলেও আমাদের কিছু করার নাই। মিল্কভিটার সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায় তাদের আওতায় ৭১৩টি প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি রয়েছে। এসব সমিতিতে প্রতিদিন আড়াই লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাঘাবাড়ী কারখানায় প্রতিদিন পৌনে ২ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। খামারিরা জানিয়েছেন, মিল্কভিটা থেকে প্রতি লিটার দুধের দাম গড়ে ৩৮ টাকা থেকে ৪০ টাকা পাওয়া যায়। বাকি দুধ লিটার প্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা করে বাইরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সদস্যরা আরও জানিয়েছেন, মিল্কভিটা সকালের দুধ নিচ্ছে না বিকেলের দুধ ক’দিন বন্ধ রাখার পর এখন বিকেলের দুধ নিলেও সীমিত আকারে অর্থাৎ উৎপাদিত পুরোটা দুধ না নিয়ে রেশনিং সিস্টেমে দুধ নিচ্ছে। বিকেলের ফ্যাট বেশি থাকায় ব্যাক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আকিজ, আড়ং, বিক্রমপুর, ইগলু, প্রাণসহ নানা প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় চিলিং পয়েন্ট দুধ সংগ্রহে অনীহা দেখাচ্ছে। কেউ কৌশলে কৃষকদের কম মূল্য দিতে চাইছে।

মিল্কভিটা হলো বিএমপিসিইউএল নামক সংস্থার তৈরি দুগ্ধজাত সামগ্রীর ট্রেড-মার্কের নাম। মিল্কভিটা নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দুধ সংগ্রহ করে শহরবাসীর দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রীর চাহিদা পূরণে সচেষ্ট রয়েছে। বর্তমানে বিএমপিসিইউএল দেশের ছয়টি দুধ উৎপাদন এলাকা টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, টেকেরহাট, বাঘাবাড়িঘাট, রংপুর ও শ্রীনগরে কাজ করে আসছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক সমবায় সমিতির মাধ্যমে দুধ সংগৃহীত হয়। মিল্কভিটার মোট প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন এবং এগুলোর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। এসব সদস্যরা দিনে দু’বার সমিতিকে দুধের জোগান দেয়, দুধে বিদ্যমান ফ্যাট ও অন্যান্য উপাদানের অনুপাতেই দুধের দাম সাধারণত নির্ধারিত হয়। সমিতিতে সংগৃহীত দুধ প্রাথমিক প্রসেসিংয়ের জন্য নিকটতম কারখানায় পৌঁছানো হয়। টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, টেকেরহাট ও শ্রীনগর অঞ্চলের দুধ ঢাকায় আসে এবং তা থেকে তরল দুধ, ক্রিম, আইসক্রিম ও দই প্রস্তুত করা হয়। রংপুর ও বাঘাবাড়ি ঘাটের দুধ থেকে বাঘাবাড়ি ঘাটের ডেইরি কারখানা গুঁড়োদুধ, মাখন ও ঘি উৎপাদন করে। দই একটি গাঁজনকৃত দুগ্ধপণ্য; যা স্বাভাবিক দুধ বা দুধের সর থেকে তৈরি করা হয় দই। বিশুদ্ধভাবে উৎপাদিত যে কোনো গাঁজানোর উপযোগী অণুজীব সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করে দই তৈরি করা হয়। সামান্য পরিমাণ দই বেছন হিসেবে দুধে মিশিয়েও দই তৈরি করা যায়। বগুড়ার দই বিশেষভাবে জনপ্রিয়। ঘন দুধ থেকে পনির করা হয়। জলীয় অংশ দুধের ঘন অংশ থেকে আলাদা করার জন্য ছোট ছোট টুকরা করে নেয়া হয়। দুধের টুকরো শুকানো হয় এবং পরিমাণমতো লবণ মিশানো হয়। এরপর চাপ প্রয়োগে সুস্বাদু পনির তৈরি করা হয়। ফুটন্ত দুধে টক বা ছানার পানি মিশিয়ে তৈরি হয় জমানো ছানা। ছানাকে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে বানানো হয় নানা ধরনের মিষ্টি, যেমন রসগোল্লা, সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা, চমচম, মণ্ডা, রসমালাই, ছানার বানানো হরেক রকমের মিষ্টি। নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের চমচম ও কুমিল্লার রসমালাই, মুক্তাগাছার মণ্ডা, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ছানামুখী দেশের ছানায় বানানো নামকরা মিষ্টির মধ্যে অন্যতম। দুধের ক্রিম মন্থন করে তৈরি হয় মাখন। একটি গড়মাত্রার মাখনে স্নেহপদার্থ, আমিষ, পানি, লবণ এবং খাদ্যপ্রাণ ভিটামিনএ ও ডি। ঘি’য়ে প্রায় ৯৯.৭ ভাগ স্নেহপদার্থ থাকতে পারে এবং গরু ও মহিষ উভয়ের দুধ থেকেই ঘি তৈরি করা যায়। আমাদের দেশে পোলাও, বিরিয়ানি, রোস্ট, কোরমা ও এ ধরনের অন্যান্য সুস্বাদু খাদ্য তৈরিতে ঘি ব্যবহার হয়।

দেশে দু’ধরনের খামার রয়েছে, সরকারি মালিকানাধীন খামার এবং বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত খামার। বড় খামারের অধিকাংশই সরকারের মালিকানাধীন। মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৬টি এবং ৩টি রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণায়ের। তবে রাজশাহী দুগ্ধখামার ব্যতীত, অধিকাংশ খামারে শঙ্কর ও বিশুদ্ধ বিদেশি জাতের গবাদিপশু রয়েছে। পাস্তরিত মোড়কজাত দুধ সরকারি হাসপাতাল, আর্মি কোয়ার্টারস এবং কিছু পরিমাণে খোলাবাজারে বিক্রয় করা হয়। দেশে বেশ বড় আকারের ডেইরি খামার। এসব খামারে রয়েছে তাদের নিজস্ব শীতলকরণ, পাস্তরিতকরণ, মোড়কজাতকরণ ও পরিবহন ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে পাস্তুরিত তরল দুধ পলিব্যাগে করে শহরাঞ্চলে বিক্রয় করা হয়। এসব খামারের অধিকাংশ গাভী শঙ্করজাত, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশুদ্ধজাত অর্থাৎ ফ্রিজিয়ান জাত দেখা যায়। শিশুর বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের জন্য দুধ অপরিহার্য। দুধ পুষ্টিকর খাদ্যসমূহের মধ্যে অন্যতম। পুষ্টিগুণের বিবেচনায় এটি আদর্শ ও সুষম খাদ্য।

আজকাল দুধ সংরক্ষণের নানা পদ্ধতিতে সাধারণ প্যাকেটেই দুধকে অনেক দিন রেখে দেয়া যায় ঘরের স্বাভাবিক উষ্ণতাতেই। বায়ুশূন্য পাত্রে ৬০ সে. উত্তাপে উত্তপ্ত করে প্রায় ৬০ শতাংশ জলীয় ভাগ শুকিয়ে ফেললে এভাপোরেটেড দুধ তৈরি হয় যা বদ্ধ টিনে অনেক দিন ভালো থাকে। এর সঙ্গে চিনি মিশিয়ে রাখলে তাকে কনডেন্সড মিল্ক বলা হয়। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া ইউনিয়নের বড়াল নদীর তীরে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী কো-অপারেটিভ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। মিল্কভিটা দেশের অন্যতম বৃহৎ সমবায় ভিত্তিক দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান। সরকার সিরাজগঞ্জ জেলার ১২৯৬.২৫ একর এবং পাবনা জেলার ১১২.৮২ একর অর্থাৎ মোট ১৪০৯.০৭ একর সরকারি খাসজমিকে গো-চারণ ভূমি ঘোষণা করা হয়। এই বিশাল গো-চারণ ভূমি বিভিন্ন সমিতিকে বছর ভিত্তিক ইজারা প্রদানের মাধ্যমে গো-সম্পদ প্রতিপালন ও মিল্কভিটা কারখানায় দুগ্ধ সরবরাহ করা হয়। গোখামার সাধারণত দুগ্ধবতী গাভী পালনের জন্য গবাদিপশুর খামার এ এলাকায় গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ করে দুগ্ধ উন্নয়ন খাতে পশু সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। গবাদিপশুই আমাদের দেশে দুধ, মাংস, চামড়া প্রভৃতি উৎপাদনের একমাত্র উৎস। উন্নত স্বাস্থ্যবান গরু দেখা যায় শহর এলাকার আশপাশে এবং সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ঘাট এলাকার বড়াল নদী তীরে বাথানে। যেখানে শীতকালীন গোচারণ ভূমি পাওয়া যায়। এসব গোচারণ ভূমিতে বানের পানি সরে যাবার পর খেসারি ও মাষকলাই ছিটিয়ে আবাদ করা হয়। বর্ষার পানিতে মাঠ তলিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত বাথানে গরুকে লালন পালন করে থাকেন খামারিরা। বাথানে হরিয়ানা, শাহীওয়াল ও সিন্ধি জাতের সঙ্গে স্থানীয় গরুকে শঙ্করায়ণ করা হয়ে থাকে। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে বেশিরভাগ উন্নত জাতের দুধেল গাভীর বিচরণ মন জুড়িয়ে দেয়।

১৯৮৭ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে চেরনোবিল দুর্র্ঘটনার পর সরকার ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে গুঁড়োদুধ এবং দুগ্ধজাতপণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল। সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারে দুধের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে নতুনভাবে দুগ্ধশিল্পের ওপর সচেতনতা সৃষ্টি হয়। এই শিল্পে বিনিয়োগে উদ্যোগী হয় অনেক শিল্প উদ্যোক্তা। বিদ্যমান বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি এই শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এতে কোন সন্দেহ নেই। দুগ্ধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত দেশের কোটি মানুষের আর্থিক পরিণতি এখন ঘাতক সংক্রামক করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, দেশে করোনার সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব এবং তা থেকে উত্তরণে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

স্বাধীনতার মহান স্থপতি দেশ ও জাতির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন, উৎপাদিত দুধের ন্যায্য মূল্য এবং ভোক্তা শ্রেণীর নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত দুধের চাহিদা পূরণে দুগ্ধশিল্প গড়ে তোলার জন্য নির্দেশ দেন। তারই ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) ও ডেনমার্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ড্যানিডা’র সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার তৎকালীন পাবনা জেলার শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ি এলাকায় সমবায় দুগ্ধ প্রকল্প নামে ১৯৭৩ সালে একটি দুগ্ধ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প স্থাপন করে।

[লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক]

atiquesiddiquee@gmail.com

শনিবার, ০৪ এপ্রিল ২০২০ , ২১ চৈত্র ১৪২৬, ৯ শাবান ১৪৪১

করোনার প্রভাবে বিপর্যয়ের মুখে দেশের গো-খামার ও দুগ্ধশিল্প

আতিক সিদ্দিকী

করোনা আক্রান্তে মৃতের সংখ্যা যখন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, তখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর করোনার বিরুদ্ধে বিশ্ব আজ এক যুদ্ধে নেমেছে। এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই এখন ভাবছে সবাই। লাশের দীর্ঘ মিছিল দেখে রীতিমতো আতঙ্কে বিশ্ববাসী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এশিয়ায় করোনার মহামারী শেষ হতে সময় লাগবে। সবমিলিয়ে ব্যক্তি, সমাজ এবং অর্থনৈতিক অবস্থা সামাল দিতে কঠিন হয়ে যাবে। দেশের শিল্প খাত বিপর্যয়ে উদ্যোক্তা ও শ্রমজীবী মানুষ দুর্বিষহ জীবনে পতিত হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভাব চরম আকার ধারণ করতে পারে। দেশে অন্যান্য শিল্পের মতো গো-খামারি এবং দুগ্ধশিল্প প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বিশ্বজুড়ে করোনার প্রভাবে দেশের বৃহত্তম সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা দুধ সংগ্রহ ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি থেকে সীমিত পরিমাণ বা কোটা পদ্ধতিতে দুধ সংগ্রহ করছে। এতে দুধ সংগ্রহ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। পরিবহন না থাকার অজুহাতে সুবিধাবাদী গো-খাদ্যের দোকানদার খৈল-ভুষির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অপরদিকে খামারিরা খাবার কমিয়ে দেয়ায় দুধের উৎপাদনও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। কথায় আছে গভীর দুধ ওলানে নয় মুখে, গাভীর দুধ বেশি হয় এমন খাবার মুখে যতো খাবে ততো দুধ বেশি দিবে। কৃষক তাদের বিনিয়োগ নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান জানান, করোনা আতঙ্কে এবং সরকারি নির্দেনায় মানুষ যেহেতু বাজারে কম আসছে কাজেই দুধ এবং মাংসের চাহিদা কমেছে। এ কারণে কৃষক বা খামারিদের ক্ষতির সন্মুখীন হতে হচ্ছে। এই কর্মকর্তা আরও জানান, শাহজাদপুরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ গরু রয়েছে। আর খামার রয়েছে প্রায় ১১ হাজার। এর মধ্যে উন্নতজাতের দুধেল গাভী রয়েছে প্রায় দেড় লাখ। এ কারণে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার দেড় লাখ দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকের উৎপাদিত গরুর দুধ খুচরা বাজারে ২৫ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে। শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সদস্যরা জানিয়েছেন করোনাভাইরাসের প্রভাবে উৎপাদন মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এর ওপর হঠাৎ করেই গো-খাদ্যের দাম বস্তা প্রতি ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করে বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা চরম লোকসানে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলা মিলে প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি ছোট বড় গো-খামার রয়েছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি কৃষকই তাদের বসতবাড়িতে ছোট আকারে গাভী লালন পালন করে। প্রচুর দুধ উৎপাদিত হওয়ায় এ এলাকা থেকে মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ ডেইরি, ফার্মফ্রেস, অ্যামোমিল্ক, আফতাব, রংপুর ডেইরিসহ প্রায় ২০টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান তরল দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে বাজারজাত করে। করোনা পরিস্থিতির কারণে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান দুধ নেয়া কমিয়ে দিয়েছে। কৃষকদের মতে প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ৪৪ টাকা। এ অবস্থায় অধিকাংশ কৃষক ও খামারিকে স্থানীয় বাজারগুলোতে এবং ভ্যানে করে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ২০ থেকে ২৫ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়া অনেক খামারি গ্রাহক না পাওয়ায় ১০ থেকে ১৫ টাকা লিটার দরেও দুধ বিক্রি করেছেন। এসব বিষয়ে নিয়ে বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা কারখানার ডিজিএম ডা. ইদ্রিস আলীর সঙ্গে কথা বলে যা জানা যায়, সেটা হলো করোনার প্রভাবে সরকারি নির্দেশে ফ্যাক্টরি কার্যক্রম আংশিক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকার আবার নির্দেশ দিলে ফ্যাক্টরি চালু করা হবে। তিনি আরো যা বলেন করোনার প্রভাবে বাজারে দুধের চাহিদা কমে গেছে। এদিকে ৯০০ মেট্রিক টন উৎপাদিত গুঁড়োদুধ আমাদের অবিক্রীত অবস্থায় গুদামে মজুদ রয়েছে। এতে কৃষকের সাময়িক অসুবিধা হলেও আমাদের কিছু করার নাই। মিল্কভিটার সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায় তাদের আওতায় ৭১৩টি প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি রয়েছে। এসব সমিতিতে প্রতিদিন আড়াই লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাঘাবাড়ী কারখানায় প্রতিদিন পৌনে ২ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। খামারিরা জানিয়েছেন, মিল্কভিটা থেকে প্রতি লিটার দুধের দাম গড়ে ৩৮ টাকা থেকে ৪০ টাকা পাওয়া যায়। বাকি দুধ লিটার প্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা করে বাইরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সদস্যরা আরও জানিয়েছেন, মিল্কভিটা সকালের দুধ নিচ্ছে না বিকেলের দুধ ক’দিন বন্ধ রাখার পর এখন বিকেলের দুধ নিলেও সীমিত আকারে অর্থাৎ উৎপাদিত পুরোটা দুধ না নিয়ে রেশনিং সিস্টেমে দুধ নিচ্ছে। বিকেলের ফ্যাট বেশি থাকায় ব্যাক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আকিজ, আড়ং, বিক্রমপুর, ইগলু, প্রাণসহ নানা প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় চিলিং পয়েন্ট দুধ সংগ্রহে অনীহা দেখাচ্ছে। কেউ কৌশলে কৃষকদের কম মূল্য দিতে চাইছে।

মিল্কভিটা হলো বিএমপিসিইউএল নামক সংস্থার তৈরি দুগ্ধজাত সামগ্রীর ট্রেড-মার্কের নাম। মিল্কভিটা নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দুধ সংগ্রহ করে শহরবাসীর দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রীর চাহিদা পূরণে সচেষ্ট রয়েছে। বর্তমানে বিএমপিসিইউএল দেশের ছয়টি দুধ উৎপাদন এলাকা টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, টেকেরহাট, বাঘাবাড়িঘাট, রংপুর ও শ্রীনগরে কাজ করে আসছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক সমবায় সমিতির মাধ্যমে দুধ সংগৃহীত হয়। মিল্কভিটার মোট প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন এবং এগুলোর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। এসব সদস্যরা দিনে দু’বার সমিতিকে দুধের জোগান দেয়, দুধে বিদ্যমান ফ্যাট ও অন্যান্য উপাদানের অনুপাতেই দুধের দাম সাধারণত নির্ধারিত হয়। সমিতিতে সংগৃহীত দুধ প্রাথমিক প্রসেসিংয়ের জন্য নিকটতম কারখানায় পৌঁছানো হয়। টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, টেকেরহাট ও শ্রীনগর অঞ্চলের দুধ ঢাকায় আসে এবং তা থেকে তরল দুধ, ক্রিম, আইসক্রিম ও দই প্রস্তুত করা হয়। রংপুর ও বাঘাবাড়ি ঘাটের দুধ থেকে বাঘাবাড়ি ঘাটের ডেইরি কারখানা গুঁড়োদুধ, মাখন ও ঘি উৎপাদন করে। দই একটি গাঁজনকৃত দুগ্ধপণ্য; যা স্বাভাবিক দুধ বা দুধের সর থেকে তৈরি করা হয় দই। বিশুদ্ধভাবে উৎপাদিত যে কোনো গাঁজানোর উপযোগী অণুজীব সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করে দই তৈরি করা হয়। সামান্য পরিমাণ দই বেছন হিসেবে দুধে মিশিয়েও দই তৈরি করা যায়। বগুড়ার দই বিশেষভাবে জনপ্রিয়। ঘন দুধ থেকে পনির করা হয়। জলীয় অংশ দুধের ঘন অংশ থেকে আলাদা করার জন্য ছোট ছোট টুকরা করে নেয়া হয়। দুধের টুকরো শুকানো হয় এবং পরিমাণমতো লবণ মিশানো হয়। এরপর চাপ প্রয়োগে সুস্বাদু পনির তৈরি করা হয়। ফুটন্ত দুধে টক বা ছানার পানি মিশিয়ে তৈরি হয় জমানো ছানা। ছানাকে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে বানানো হয় নানা ধরনের মিষ্টি, যেমন রসগোল্লা, সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা, চমচম, মণ্ডা, রসমালাই, ছানার বানানো হরেক রকমের মিষ্টি। নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের চমচম ও কুমিল্লার রসমালাই, মুক্তাগাছার মণ্ডা, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ছানামুখী দেশের ছানায় বানানো নামকরা মিষ্টির মধ্যে অন্যতম। দুধের ক্রিম মন্থন করে তৈরি হয় মাখন। একটি গড়মাত্রার মাখনে স্নেহপদার্থ, আমিষ, পানি, লবণ এবং খাদ্যপ্রাণ ভিটামিনএ ও ডি। ঘি’য়ে প্রায় ৯৯.৭ ভাগ স্নেহপদার্থ থাকতে পারে এবং গরু ও মহিষ উভয়ের দুধ থেকেই ঘি তৈরি করা যায়। আমাদের দেশে পোলাও, বিরিয়ানি, রোস্ট, কোরমা ও এ ধরনের অন্যান্য সুস্বাদু খাদ্য তৈরিতে ঘি ব্যবহার হয়।

দেশে দু’ধরনের খামার রয়েছে, সরকারি মালিকানাধীন খামার এবং বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত খামার। বড় খামারের অধিকাংশই সরকারের মালিকানাধীন। মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৬টি এবং ৩টি রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণায়ের। তবে রাজশাহী দুগ্ধখামার ব্যতীত, অধিকাংশ খামারে শঙ্কর ও বিশুদ্ধ বিদেশি জাতের গবাদিপশু রয়েছে। পাস্তরিত মোড়কজাত দুধ সরকারি হাসপাতাল, আর্মি কোয়ার্টারস এবং কিছু পরিমাণে খোলাবাজারে বিক্রয় করা হয়। দেশে বেশ বড় আকারের ডেইরি খামার। এসব খামারে রয়েছে তাদের নিজস্ব শীতলকরণ, পাস্তরিতকরণ, মোড়কজাতকরণ ও পরিবহন ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে পাস্তুরিত তরল দুধ পলিব্যাগে করে শহরাঞ্চলে বিক্রয় করা হয়। এসব খামারের অধিকাংশ গাভী শঙ্করজাত, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশুদ্ধজাত অর্থাৎ ফ্রিজিয়ান জাত দেখা যায়। শিশুর বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের জন্য দুধ অপরিহার্য। দুধ পুষ্টিকর খাদ্যসমূহের মধ্যে অন্যতম। পুষ্টিগুণের বিবেচনায় এটি আদর্শ ও সুষম খাদ্য।

আজকাল দুধ সংরক্ষণের নানা পদ্ধতিতে সাধারণ প্যাকেটেই দুধকে অনেক দিন রেখে দেয়া যায় ঘরের স্বাভাবিক উষ্ণতাতেই। বায়ুশূন্য পাত্রে ৬০ সে. উত্তাপে উত্তপ্ত করে প্রায় ৬০ শতাংশ জলীয় ভাগ শুকিয়ে ফেললে এভাপোরেটেড দুধ তৈরি হয় যা বদ্ধ টিনে অনেক দিন ভালো থাকে। এর সঙ্গে চিনি মিশিয়ে রাখলে তাকে কনডেন্সড মিল্ক বলা হয়। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া ইউনিয়নের বড়াল নদীর তীরে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী কো-অপারেটিভ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। মিল্কভিটা দেশের অন্যতম বৃহৎ সমবায় ভিত্তিক দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান। সরকার সিরাজগঞ্জ জেলার ১২৯৬.২৫ একর এবং পাবনা জেলার ১১২.৮২ একর অর্থাৎ মোট ১৪০৯.০৭ একর সরকারি খাসজমিকে গো-চারণ ভূমি ঘোষণা করা হয়। এই বিশাল গো-চারণ ভূমি বিভিন্ন সমিতিকে বছর ভিত্তিক ইজারা প্রদানের মাধ্যমে গো-সম্পদ প্রতিপালন ও মিল্কভিটা কারখানায় দুগ্ধ সরবরাহ করা হয়। গোখামার সাধারণত দুগ্ধবতী গাভী পালনের জন্য গবাদিপশুর খামার এ এলাকায় গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ করে দুগ্ধ উন্নয়ন খাতে পশু সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। গবাদিপশুই আমাদের দেশে দুধ, মাংস, চামড়া প্রভৃতি উৎপাদনের একমাত্র উৎস। উন্নত স্বাস্থ্যবান গরু দেখা যায় শহর এলাকার আশপাশে এবং সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ঘাট এলাকার বড়াল নদী তীরে বাথানে। যেখানে শীতকালীন গোচারণ ভূমি পাওয়া যায়। এসব গোচারণ ভূমিতে বানের পানি সরে যাবার পর খেসারি ও মাষকলাই ছিটিয়ে আবাদ করা হয়। বর্ষার পানিতে মাঠ তলিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত বাথানে গরুকে লালন পালন করে থাকেন খামারিরা। বাথানে হরিয়ানা, শাহীওয়াল ও সিন্ধি জাতের সঙ্গে স্থানীয় গরুকে শঙ্করায়ণ করা হয়ে থাকে। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে বেশিরভাগ উন্নত জাতের দুধেল গাভীর বিচরণ মন জুড়িয়ে দেয়।

১৯৮৭ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে চেরনোবিল দুর্র্ঘটনার পর সরকার ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে গুঁড়োদুধ এবং দুগ্ধজাতপণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল। সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারে দুধের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে নতুনভাবে দুগ্ধশিল্পের ওপর সচেতনতা সৃষ্টি হয়। এই শিল্পে বিনিয়োগে উদ্যোগী হয় অনেক শিল্প উদ্যোক্তা। বিদ্যমান বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি এই শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এতে কোন সন্দেহ নেই। দুগ্ধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত দেশের কোটি মানুষের আর্থিক পরিণতি এখন ঘাতক সংক্রামক করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, দেশে করোনার সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব এবং তা থেকে উত্তরণে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

স্বাধীনতার মহান স্থপতি দেশ ও জাতির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন, উৎপাদিত দুধের ন্যায্য মূল্য এবং ভোক্তা শ্রেণীর নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত দুধের চাহিদা পূরণে দুগ্ধশিল্প গড়ে তোলার জন্য নির্দেশ দেন। তারই ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) ও ডেনমার্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ড্যানিডা’র সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার তৎকালীন পাবনা জেলার শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ি এলাকায় সমবায় দুগ্ধ প্রকল্প নামে ১৯৭৩ সালে একটি দুগ্ধ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প স্থাপন করে।

[লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক]

atiquesiddiquee@gmail.com