আরও অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক আবজাল দম্পতির

স্বাস্থ্য সেক্টরের দুর্নীতির হোতা অধিদফতরের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী আবজাল-রুবিনা খানম দম্পতির আরও অনেক অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। নামে-বেনামে এসব সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে। মামলায় আবজাল দম্পতির যে পরিমাণ অবৈধ সম্পদ থাকার তথ্য রয়েছে দুদক তার বাইরে নতুন সম্পদের যে তথ্য পেয়েছে, তাতে রীতিমতো বিস্মিত দুদক কর্মকর্তারাও।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আবজাল আহমেদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের উপ-পরিচালক তৌফিক এলাহীর নেতৃত্বে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গত ৩ দিনের রিমান্ড হেফাজতে নিত্যনতুন তথ্য দিচ্ছে আবজাল। এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় গ্রেফতার হয়ে স্বাস্থ্য সেক্টরে লুটপাটের মাফিয়া ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী আবজাল আহমেদ রিমান্ডে দুদকের হেফাজতে থাকলে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে তার স্ত্রী রুবিনা খানম। মামলার এক বছর পর আদালতে হাজির হয়ে আবজাল কারাগারে থাকলেও রুবিনা খানমের হদিস মিলছে না। আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমকে গ্রেফতারে সহয়তায় চেয়ে আদালত কর্তৃক জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা দেশের বিভিন্ন থানায় পাঠনো হয়েছে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রচার চালিয়ে আবজালের মতো তার স্ত্রী রুবিনা খানম দেশেই আত্মগোপনে আছেন বলে ধারণা করছে দুদকের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, ‘দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে আবজালের আরও সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এসব সম্পদের বিষয়ে দুদক খোঁজ নিচ্ছে। আবজাল ওইসব সম্পদ সেসব সম্পদ জব্দ করা হবে। একই মামলায় আসামি তার পলাতক স্ত্রীর সন্ধানে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা বিভিন্ন থানায় পাঠানো হয়েছে। পুলিশের সহয়তায় আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

দুদক সূত্র জানায়, গত ৩ দিনের রিমান্ড হেফাজতে আবদাল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে করা মামলায় তার যেসব সম্পদের কথা বলা হয়েছে সেইসব সম্পদের বাইরেও নতুন করে সম্পদের তথ্য মিলেছে। ওইসব সম্পদ নামে-বেনামে গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যভাবেও আবজালের সম্পদ এবং বিদেশে কি পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে তা জানার চেষ্টা করছে দুদক। স্বাস্থ্য সেক্টরে আবজাল কিভাবে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করত, তার এসব কাজে স্বাস্থ্য সেক্টরে কাদের সহযোগিতা ছিল এসব বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছে। স্বাস্থ্য সেক্টরে অবৈধভাবে টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ, অপ্রয়োজনীয় মালামাল কেনা, কমমূল্যের মালামাল বেশি দামে দেখিয়ে সরকারের অর্থ লুটে কারা কারা জড়িত, তারা কত পরিমাণ সম্পদ গড়েছে সেসব বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, অনুসন্ধানে আবজাল আহমেদের অবৈধ সম্পদ যা পাওয়া গেছে এর বাইরে আরও বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ রয়েছে। রিমান্ড হেফাজতে এসব সম্পদের তথ্য পাচ্ছে দুদক। এতে মনে হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ দেশ-বিদেশে গড়েছে আবজাল আহমেদ ও রুবিনা খানম দম্পতি।

দুদক সূত্র জানায়, অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় আবজাল আহমেদকে ১৪ দিনের রিমান্ড হেফাজতে এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। গত ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আবজাল হোসেনের বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলায় সাত দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ডে মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে আবজাল হোসেনকে তৃতীয় দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম। দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তাকে প্রায় ৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দুদক। এর আগে গত ২৬ আগস্ট সকালে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশের আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন আবজাল হোসেন। শুনানি শেষে বিচারক তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। ওই সময় দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবজাল আহমেদকে রিমান্ড হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত দুদকের আইনজীবীর যুক্তিতর্ক শুনে রিমান্ড হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।

২০১৯ সালের ২৭ জুন প্রায় ২৮৫ কোটি টাকা পাচার এবং ৩৪ কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার এজাহারে বিভিন্ন মেডিকে?ল কলেজ ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও মালামাল সরবরাহের নামে ২৮৪ কোটি ৫১ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫৫ টাকা পাচার ও হস্তান্তরের অভিযোগ আনা হয়েছে। অপর মামলায় রুবিনা খানমের বিরুদ্ধে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি গোপনসহ মোট ৩১ কোটি ৫১ লাখ ২৩ হাজার টাকা এবং আবজালের বিরুদ্ধে মোট ৪ কোটি ৭৯ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই বছরের ২৬ এপ্রিল কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে সরকারের সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ওই দম্পতিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এরই মধ্যে ২৫টি বাড়ি-প্লট ও জমি আদালতের আদেশে ক্রোক করেছে দুদক। জব্দ করা সম্পদের মধ্যে আছে ঢাকার মিরপুরে আড়াই কাঠা জমির ওপর টিনশেড বাড়ি, পল্লবীতে ছয় কাঠা জমি, উত্তরার ১৫/সি নম্বর সেক্টরে তিন কাঠার দুটি প্লট, খিলক্ষেতে তিন কাঠা জমি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় চার কাঠার প্লট ও ঢাকার বাইরে ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও খুলনায় প্রায় ৩৫০ শতাংশ জমি। অন্যদিকে, আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানমের নামে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে ছয়তলা দুটি বাড়ি, ঢাকার মিরপুরে একটি টিনশেড বাড়ি, পল্লবীতে আড়াই কাঠা জমি, বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পে তিন কাঠার দুটি প্লট, কেরানীগঞ্জের দোকান ও সাভারে ১৫ শতাংশ জমি এবং ঢাকা বাইরে ফরিদপুরে কয়েকটি প্লট মোট ২৫ শতাংশ জমিও জব্দ করা হয়।

দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আবজাল হোসেন ১৯৯২ সালে তৃতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করে প্রথমে গ্রামে ধান সুপারির ব্যবসা শুরু করে। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারে পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে অফিস সহকারী পদে যোগদান করেন। ২০০০ সালে প্রকল্পটি জাতীয় রাজস্বখাতে স্থানান্তরিত হলে আবজাল ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে অফিস সহকারী পদে বদলি হয়। এরপর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ক্যাশিয়ার পদেও চাকরি করে। এরমধ্যে তাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি করা হলেও মোটা অঙ্কের ঘুষ ও তদবীর করে দুই মাসের মাথায় সে ওই বদলি ঠেকায়। আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানম স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পের স্টেনো গ্রাফার পদে ১৯৯৮ সালে যোগ দান করেন। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে সে স্বেচ্ছায় অবসর নেয়। আবজাল ও তার স্ত্রী রুবিনা খানম রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে স্বাস্থ্য অধিফতরের যাবতীয় টেন্ডার বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দীর্ঘদিন পর্যন্ত টেন্ডারবাণিজ্য, কেনাকাটায় দুর্নীতি, নিয়োগ, বদলি-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। এ সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসেবে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল ভূমিকা পালন করেছে। তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করত স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, অধ্যাপক ডা. আবদুর রশিদ, বাজেট শাখার সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান। টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে নিম্মমানের স্বাস্থ্যসামগ্রী কেনাকাটা করা হতো আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কখনও কখনও দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ না করেই ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে এ চক্রের বিরুদ্ধে। অবৈধভাবে সরকারের কোটি কোটি টাকা অত্মসাত করে এসব অর্থ দেশ বিদেশে পাচার করেছে চক্রটি। নামে-বেনামে একেকজন গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। চক্রটি বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানির কর্তক অথরাইজেশন লেটার জালিয়াতি করে দরপত্রে উচ্চ মূল্যে মালামাল দেখিয়ে নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ করত। এছাড়া কখনও কখনও কোন মামলা না দিয়েই পুরো টাকা তুলে নিত। এসব অভিযোগে মূলত ২০১৮ সাল থেকে অনুসন্ধানে নামে দুদকের একটি টিম। এ টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সামছুল আলম।

আরও খবর
ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অভিযোজন তহবিল বৃদ্ধিতে জোরালো বৈশ্বিক সমর্থন কামনা প্রধানমন্ত্রীর
ওজোন ক্ষয়কারী দ্রব্য উৎপাদন ও ব্যবহার রোধে জীববৈচিত্র্যকে ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা সম্ভব প্রধানমন্ত্রী
মাছ এবং শামুক সংরক্ষণ ও উন্নয়নসহ ৪ প্রকল্প অনুমোদন
চিকিৎসকদের আবাসন ও আইসোলেশন ব্যবস্থা করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
জয় বাংলা টেলিমেডিসিন অ্যাপ উদ্বোধন কাদেরের
ভরাট হয়ে গেছে লৌহজং চ্যানেল ‘বিকল্প চ্যানেল খনন করা হচ্ছে’
চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথ ফের চালু করতে ভারতকে অনুরোধ
ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধী-বিধবা ও ভিজিডির চাল আত্মসাতের অভিযোগ
অবৈধ বিল বোর্ড ও সাইনবোর্ড উচ্ছেদ চলছে
লালমনিরহাটের ১৪ কারারক্ষী স্ট্যান্ড রিলিজ
সাহেদ করিমের অস্ত্র মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ
বিটিসিএলকে সেবামুখী করতে ঢেলে সাজানো হচ্ছে
এসপির বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা

বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ২৬ মহররম ১৪৪২, ২৮ ভাদ্র ১৪২৭

স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্নীতি

আরও অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক আবজাল দম্পতির

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

স্বাস্থ্য সেক্টরের দুর্নীতির হোতা অধিদফতরের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী আবজাল-রুবিনা খানম দম্পতির আরও অনেক অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। নামে-বেনামে এসব সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে। মামলায় আবজাল দম্পতির যে পরিমাণ অবৈধ সম্পদ থাকার তথ্য রয়েছে দুদক তার বাইরে নতুন সম্পদের যে তথ্য পেয়েছে, তাতে রীতিমতো বিস্মিত দুদক কর্মকর্তারাও।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আবজাল আহমেদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের উপ-পরিচালক তৌফিক এলাহীর নেতৃত্বে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গত ৩ দিনের রিমান্ড হেফাজতে নিত্যনতুন তথ্য দিচ্ছে আবজাল। এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় গ্রেফতার হয়ে স্বাস্থ্য সেক্টরে লুটপাটের মাফিয়া ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী আবজাল আহমেদ রিমান্ডে দুদকের হেফাজতে থাকলে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে তার স্ত্রী রুবিনা খানম। মামলার এক বছর পর আদালতে হাজির হয়ে আবজাল কারাগারে থাকলেও রুবিনা খানমের হদিস মিলছে না। আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমকে গ্রেফতারে সহয়তায় চেয়ে আদালত কর্তৃক জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা দেশের বিভিন্ন থানায় পাঠনো হয়েছে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রচার চালিয়ে আবজালের মতো তার স্ত্রী রুবিনা খানম দেশেই আত্মগোপনে আছেন বলে ধারণা করছে দুদকের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, ‘দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে আবজালের আরও সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এসব সম্পদের বিষয়ে দুদক খোঁজ নিচ্ছে। আবজাল ওইসব সম্পদ সেসব সম্পদ জব্দ করা হবে। একই মামলায় আসামি তার পলাতক স্ত্রীর সন্ধানে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা বিভিন্ন থানায় পাঠানো হয়েছে। পুলিশের সহয়তায় আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

দুদক সূত্র জানায়, গত ৩ দিনের রিমান্ড হেফাজতে আবদাল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে করা মামলায় তার যেসব সম্পদের কথা বলা হয়েছে সেইসব সম্পদের বাইরেও নতুন করে সম্পদের তথ্য মিলেছে। ওইসব সম্পদ নামে-বেনামে গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যভাবেও আবজালের সম্পদ এবং বিদেশে কি পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে তা জানার চেষ্টা করছে দুদক। স্বাস্থ্য সেক্টরে আবজাল কিভাবে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করত, তার এসব কাজে স্বাস্থ্য সেক্টরে কাদের সহযোগিতা ছিল এসব বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছে। স্বাস্থ্য সেক্টরে অবৈধভাবে টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ, অপ্রয়োজনীয় মালামাল কেনা, কমমূল্যের মালামাল বেশি দামে দেখিয়ে সরকারের অর্থ লুটে কারা কারা জড়িত, তারা কত পরিমাণ সম্পদ গড়েছে সেসব বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, অনুসন্ধানে আবজাল আহমেদের অবৈধ সম্পদ যা পাওয়া গেছে এর বাইরে আরও বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ রয়েছে। রিমান্ড হেফাজতে এসব সম্পদের তথ্য পাচ্ছে দুদক। এতে মনে হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ দেশ-বিদেশে গড়েছে আবজাল আহমেদ ও রুবিনা খানম দম্পতি।

দুদক সূত্র জানায়, অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় আবজাল আহমেদকে ১৪ দিনের রিমান্ড হেফাজতে এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। গত ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আবজাল হোসেনের বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলায় সাত দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ডে মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে আবজাল হোসেনকে তৃতীয় দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম। দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তাকে প্রায় ৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দুদক। এর আগে গত ২৬ আগস্ট সকালে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশের আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন আবজাল হোসেন। শুনানি শেষে বিচারক তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। ওই সময় দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবজাল আহমেদকে রিমান্ড হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত দুদকের আইনজীবীর যুক্তিতর্ক শুনে রিমান্ড হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।

২০১৯ সালের ২৭ জুন প্রায় ২৮৫ কোটি টাকা পাচার এবং ৩৪ কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার এজাহারে বিভিন্ন মেডিকে?ল কলেজ ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও মালামাল সরবরাহের নামে ২৮৪ কোটি ৫১ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫৫ টাকা পাচার ও হস্তান্তরের অভিযোগ আনা হয়েছে। অপর মামলায় রুবিনা খানমের বিরুদ্ধে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি গোপনসহ মোট ৩১ কোটি ৫১ লাখ ২৩ হাজার টাকা এবং আবজালের বিরুদ্ধে মোট ৪ কোটি ৭৯ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই বছরের ২৬ এপ্রিল কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে সরকারের সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ওই দম্পতিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এরই মধ্যে ২৫টি বাড়ি-প্লট ও জমি আদালতের আদেশে ক্রোক করেছে দুদক। জব্দ করা সম্পদের মধ্যে আছে ঢাকার মিরপুরে আড়াই কাঠা জমির ওপর টিনশেড বাড়ি, পল্লবীতে ছয় কাঠা জমি, উত্তরার ১৫/সি নম্বর সেক্টরে তিন কাঠার দুটি প্লট, খিলক্ষেতে তিন কাঠা জমি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় চার কাঠার প্লট ও ঢাকার বাইরে ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও খুলনায় প্রায় ৩৫০ শতাংশ জমি। অন্যদিকে, আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানমের নামে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে ছয়তলা দুটি বাড়ি, ঢাকার মিরপুরে একটি টিনশেড বাড়ি, পল্লবীতে আড়াই কাঠা জমি, বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পে তিন কাঠার দুটি প্লট, কেরানীগঞ্জের দোকান ও সাভারে ১৫ শতাংশ জমি এবং ঢাকা বাইরে ফরিদপুরে কয়েকটি প্লট মোট ২৫ শতাংশ জমিও জব্দ করা হয়।

দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আবজাল হোসেন ১৯৯২ সালে তৃতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করে প্রথমে গ্রামে ধান সুপারির ব্যবসা শুরু করে। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারে পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে অফিস সহকারী পদে যোগদান করেন। ২০০০ সালে প্রকল্পটি জাতীয় রাজস্বখাতে স্থানান্তরিত হলে আবজাল ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে অফিস সহকারী পদে বদলি হয়। এরপর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ক্যাশিয়ার পদেও চাকরি করে। এরমধ্যে তাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি করা হলেও মোটা অঙ্কের ঘুষ ও তদবীর করে দুই মাসের মাথায় সে ওই বদলি ঠেকায়। আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানম স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পের স্টেনো গ্রাফার পদে ১৯৯৮ সালে যোগ দান করেন। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে সে স্বেচ্ছায় অবসর নেয়। আবজাল ও তার স্ত্রী রুবিনা খানম রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে স্বাস্থ্য অধিফতরের যাবতীয় টেন্ডার বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দীর্ঘদিন পর্যন্ত টেন্ডারবাণিজ্য, কেনাকাটায় দুর্নীতি, নিয়োগ, বদলি-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। এ সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসেবে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল ভূমিকা পালন করেছে। তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করত স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, অধ্যাপক ডা. আবদুর রশিদ, বাজেট শাখার সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান। টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে নিম্মমানের স্বাস্থ্যসামগ্রী কেনাকাটা করা হতো আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কখনও কখনও দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ না করেই ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে এ চক্রের বিরুদ্ধে। অবৈধভাবে সরকারের কোটি কোটি টাকা অত্মসাত করে এসব অর্থ দেশ বিদেশে পাচার করেছে চক্রটি। নামে-বেনামে একেকজন গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। চক্রটি বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কোম্পানির কর্তক অথরাইজেশন লেটার জালিয়াতি করে দরপত্রে উচ্চ মূল্যে মালামাল দেখিয়ে নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ করত। এছাড়া কখনও কখনও কোন মামলা না দিয়েই পুরো টাকা তুলে নিত। এসব অভিযোগে মূলত ২০১৮ সাল থেকে অনুসন্ধানে নামে দুদকের একটি টিম। এ টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সামছুল আলম।