সারাদেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার গাড়ির ফিটনেস নেই

রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়। গত রোববার রাত ১০টা। বাসের অপেক্ষা দাঁড়িয়ে আছে জসিম। যাত্রাবাড়ী যাবেন তিনি। ১৫ মিনিট পরে ২২ নম্বর (সাবেক-৮) বাসে উঠেন তিনি। সিটে বসার সঙ্গে সঙ্গে তার হাঁটুর কাছে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখেন তার প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে। সিটের পাশের জানালার গ্লাসও ভাঙা। দৈনিক বাংলা থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত আশার পর হঠাৎ বাসটির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। আধঘণ্টা অপেক্ষার পরও বাসটি চালু করতে পারেনি চালক। তাই সেখানেই নামিয়ে দেয়া হয় সব যাত্রীদের। অন্য বাসে ১১টার পর বাসায় যান তিনি। এই হলো ঢাকার একটি ফিটনেসবিহীন বাসের অবস্থা। রাজধানীতে প্রতিনিয়ত এ রকম ফিটনেসবিহীন, লক্কর-ঝক্কর, ছেঁরা-ফাঁটা নোরাং সিটের বাসে যাতায়াত করতে হয় বলে জানান যাত্রীরা।

গতকাল জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই হিসাব। মালিকদের এসএমএসের মাধ্যমে ফিটনেস করার তাগাদা, সার্কেল অফিস থেকে নবায়নের ব্যবস্থার পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদ-, কারাদ-, ডাম্পিংসহ নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী মোড়ে মিরপুরগামী শিকড় পরিবহন যাত্রী উঠানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। যার নাম্বার ঢাকা মোট্রো-১১২১৫৮। পিছন থেকে দেখা গেল গাড়িটির পিছনে কোন নির্দেশনামূলক লাইট নেই। জানালার গ্লাসগুলো ভাঙা। উপরে উঠে ড্রাইভার ও হেলপারকে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেন সব ঠিক আছে। ফিটনেসের সার্টিফিকেট নেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব ঠিক না থাকার পড়ও ফিটনেস সার্টিফিকেট কিভাবে নেয়া হলো? এর জাবাবে বিকল্প সুপার গাড়ির ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম সংবাদে বলেন, ফিটনেসের জন্য গাড়ি দেখাতে হয় না। ট্রাফিক পুলিশের একটি প্রতিবেদনের সঙ্গে কিছু টাকা পয়সা দিলেই বিআরটিএ’র সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। তবে ট্রাফিক পুলিশকেও টাকা দিয়ে এই প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয় বলে তিনি জানান।

জানা গেছে, সারাদেশের যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। প্রতিবছর পর ১০০০-১৫০০ টাকা ফি দিয়ে ফিটনেস সনদ নিতে হয়। কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি যানবাহন ফিটনেস সনদ নেয়নি। এ পর্যন্ত ৪৫ লাখ ৬৮ হাজার ৮৭৮টি গাড়ি নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৬৬০টি গাড়ির নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মহানগরীতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এরমধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার বাস-মিনিবাসের মধ্যে ৩০ শতাংশ বাসই ফিটনেসবিহীন। অর্ধেকের বেশি বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর পেরিয়ে গেছে। রাজধানীতে চলাচলরত প্রায় ৫০ শতাংশ যানবাহনের লাইটিং ব্যবস্থা ঠিক নেই। একটি ফিটনেস গাড়ির সামনে-পিছনে সাতটি নির্দেশনামূলক লাইট থাকে। এরমধ্যে পিছনে চারটি, সামনে তিনটি। এগুলো হলো ব্যাক লাইট, এন্ডিকাটার লাইট, পার্কিং লাইট, লো লাইট, সামনে থাকে হেড লাইট, এন্ডিকাটার লাইট ও ফোক লাইট। কিন্তু রাজধানীতে প্রায় ৬০ শতাংশ গাড়িতে পিছনের লাইটগুলো নেই। এ পর্যন্ত ১৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৬টি গাড়ির নিবন্ধন দেয়া হয়েছে বলে বিআরটিএ’র সূত্র জানায়।

বিআরটিএর তথ্যমতে, রাজধানীতে চলাচলকারী বাসের প্রায় ৯৫ শতাংশই মিনিবাস। বাকি ৫ শতাংশ বড় বাস। মিনিবাসগুলোর মধ্যে আবার প্রায় দুই হাজার বা ৫৭ শতাংশ ২০ বছরের বেশি পুরনো। বাকিগুলোর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল থাকলেও অবস্থা খুবই নাজুক। চলমান বাস-মিনিবাসের প্রায় ৬৮ শতাংশের দরজা-জানালা ভাঙা। বসার সিট ছেঁড়া ও ভাঙা ৫২ শতাংশের ও বাইরের কাঠামো ভাঙা-চোরা ৬০ শতাংশের। দুই স্তরের কাঠামো (স্টিল ও ফোম/কাপড়) নেই ৮০ শতাংশ বাস-মিনিবাসের। যেসব বাসে স্টিলের কাঠামের ভেতর ফোম বা কাপড়ের স্তর আছে সেগুলোরও অধিকাংশ ছেঁড়া। এছাড়া ৮০ শতাংশ বাস-মিনিবাসেই পাখা নেই। এছাড়া অধিকাংশ বাসেরই দরজা-জানালা ভাঙা। একই অবস্থা আসনগুলোরও। তাই এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও ভুয়া চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে সংস্থাটির সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার সংবাদকে বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ঢাকা ও চট্টগ্রামে মহানগরীতে ১৩টি মোবাইল কোর্ট দিয়ে অভিযান পরিচালনা হয়। এছাড়া জরিমানাবিহীন লাইসেন্স নবায়নে সময় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে অনেকেই ইচ্ছে করে গাড়ি ফিটনেস নবায়ন করে না। তাই দেশের প্রতিটি বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।

বুধবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২১ , ১৩ মাঘ ১৪২৭, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪২

সারাদেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার গাড়ির ফিটনেস নেই

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

রাজধানীর সড়কে ফিটনেসবিহীন বাস -সংবাদ

রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়। গত রোববার রাত ১০টা। বাসের অপেক্ষা দাঁড়িয়ে আছে জসিম। যাত্রাবাড়ী যাবেন তিনি। ১৫ মিনিট পরে ২২ নম্বর (সাবেক-৮) বাসে উঠেন তিনি। সিটে বসার সঙ্গে সঙ্গে তার হাঁটুর কাছে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখেন তার প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে। সিটের পাশের জানালার গ্লাসও ভাঙা। দৈনিক বাংলা থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত আশার পর হঠাৎ বাসটির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। আধঘণ্টা অপেক্ষার পরও বাসটি চালু করতে পারেনি চালক। তাই সেখানেই নামিয়ে দেয়া হয় সব যাত্রীদের। অন্য বাসে ১১টার পর বাসায় যান তিনি। এই হলো ঢাকার একটি ফিটনেসবিহীন বাসের অবস্থা। রাজধানীতে প্রতিনিয়ত এ রকম ফিটনেসবিহীন, লক্কর-ঝক্কর, ছেঁরা-ফাঁটা নোরাং সিটের বাসে যাতায়াত করতে হয় বলে জানান যাত্রীরা।

গতকাল জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই হিসাব। মালিকদের এসএমএসের মাধ্যমে ফিটনেস করার তাগাদা, সার্কেল অফিস থেকে নবায়নের ব্যবস্থার পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদ-, কারাদ-, ডাম্পিংসহ নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী মোড়ে মিরপুরগামী শিকড় পরিবহন যাত্রী উঠানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। যার নাম্বার ঢাকা মোট্রো-১১২১৫৮। পিছন থেকে দেখা গেল গাড়িটির পিছনে কোন নির্দেশনামূলক লাইট নেই। জানালার গ্লাসগুলো ভাঙা। উপরে উঠে ড্রাইভার ও হেলপারকে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেন সব ঠিক আছে। ফিটনেসের সার্টিফিকেট নেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব ঠিক না থাকার পড়ও ফিটনেস সার্টিফিকেট কিভাবে নেয়া হলো? এর জাবাবে বিকল্প সুপার গাড়ির ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম সংবাদে বলেন, ফিটনেসের জন্য গাড়ি দেখাতে হয় না। ট্রাফিক পুলিশের একটি প্রতিবেদনের সঙ্গে কিছু টাকা পয়সা দিলেই বিআরটিএ’র সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। তবে ট্রাফিক পুলিশকেও টাকা দিয়ে এই প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয় বলে তিনি জানান।

জানা গেছে, সারাদেশের যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। প্রতিবছর পর ১০০০-১৫০০ টাকা ফি দিয়ে ফিটনেস সনদ নিতে হয়। কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি যানবাহন ফিটনেস সনদ নেয়নি। এ পর্যন্ত ৪৫ লাখ ৬৮ হাজার ৮৭৮টি গাড়ি নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৬৬০টি গাড়ির নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মহানগরীতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এরমধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার বাস-মিনিবাসের মধ্যে ৩০ শতাংশ বাসই ফিটনেসবিহীন। অর্ধেকের বেশি বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর পেরিয়ে গেছে। রাজধানীতে চলাচলরত প্রায় ৫০ শতাংশ যানবাহনের লাইটিং ব্যবস্থা ঠিক নেই। একটি ফিটনেস গাড়ির সামনে-পিছনে সাতটি নির্দেশনামূলক লাইট থাকে। এরমধ্যে পিছনে চারটি, সামনে তিনটি। এগুলো হলো ব্যাক লাইট, এন্ডিকাটার লাইট, পার্কিং লাইট, লো লাইট, সামনে থাকে হেড লাইট, এন্ডিকাটার লাইট ও ফোক লাইট। কিন্তু রাজধানীতে প্রায় ৬০ শতাংশ গাড়িতে পিছনের লাইটগুলো নেই। এ পর্যন্ত ১৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৬টি গাড়ির নিবন্ধন দেয়া হয়েছে বলে বিআরটিএ’র সূত্র জানায়।

বিআরটিএর তথ্যমতে, রাজধানীতে চলাচলকারী বাসের প্রায় ৯৫ শতাংশই মিনিবাস। বাকি ৫ শতাংশ বড় বাস। মিনিবাসগুলোর মধ্যে আবার প্রায় দুই হাজার বা ৫৭ শতাংশ ২০ বছরের বেশি পুরনো। বাকিগুলোর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল থাকলেও অবস্থা খুবই নাজুক। চলমান বাস-মিনিবাসের প্রায় ৬৮ শতাংশের দরজা-জানালা ভাঙা। বসার সিট ছেঁড়া ও ভাঙা ৫২ শতাংশের ও বাইরের কাঠামো ভাঙা-চোরা ৬০ শতাংশের। দুই স্তরের কাঠামো (স্টিল ও ফোম/কাপড়) নেই ৮০ শতাংশ বাস-মিনিবাসের। যেসব বাসে স্টিলের কাঠামের ভেতর ফোম বা কাপড়ের স্তর আছে সেগুলোরও অধিকাংশ ছেঁড়া। এছাড়া ৮০ শতাংশ বাস-মিনিবাসেই পাখা নেই। এছাড়া অধিকাংশ বাসেরই দরজা-জানালা ভাঙা। একই অবস্থা আসনগুলোরও। তাই এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও ভুয়া চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে সংস্থাটির সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার সংবাদকে বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ঢাকা ও চট্টগ্রামে মহানগরীতে ১৩টি মোবাইল কোর্ট দিয়ে অভিযান পরিচালনা হয়। এছাড়া জরিমানাবিহীন লাইসেন্স নবায়নে সময় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে অনেকেই ইচ্ছে করে গাড়ি ফিটনেস নবায়ন করে না। তাই দেশের প্রতিটি বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।