ছয় দফা : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা

মোস্তাফা জব্বার

ছয়

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণায় পাকিস্তান সরকার কেবল উদ্বিগ্ন হয়নি, এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা ছয় দফা দাবিকে দেশদ্রোহী, এ দাবির সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দল নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে অভিহিত করে প্রচার কার্য পরিচালনা করতে থাকে। জাতীয় পরিষদে ১৪ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এসএম জাফর বলেন,

... they are the Enemies of the country, we shall hunt them, we shall unmask them and we shall put them on the national record as enemies, sir, this is a country of Patriots and they ( the Enemies) have wrongly chosen this country. they shall be diminished, washed and finished. (আবদুল হক, লেখকের রোজনামচায় চার দশকের রাজনীতি-পরিক্রমা ১৯৫৩-৯৩, (ঢাকা : ইউপি এল, ১৯৯৬) পৃ. ১১৭)

তার এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে দেশের পত্র পত্রিকায় বিবৃতি প্রকাশিত হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, এনডিএফ, নেজামে ইসলামসহ অনেক রাজনীতিক দল, ছাত্র সংগঠন, আইনজীবী সমিতি, হাইকোর্টের বার সমিতির বিবৃতির মাধ্যমে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তখন মাওলানা ভাসানী কোন প্রতিবাদ করেননি। দেশে এই নিয়ে বিরোধী দলসমূহ এতই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যে, ১৯৬৭ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে প্রায় সব বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে সেমিনার অনুষ্ঠান করে। আইয়ূব খানও ১৭ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও এ এক অনুষ্ঠানে স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরুদ্ধে দম্ভ ভরে বলেন, “যে সব শক্তি দেশের উভয় অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বিরোধ, বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে এবং তাহার দ্বারা দেশের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করিতেছে তাহাদের সে চেষ্টা বানচাল করিবার জন্য” বলেন, “যতদিন আমি জীবিত থাকিব এবং যতদিন আমি রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে থাকিব, ততদিন আমি তাহাদের জঘন্য কারসাজিকে সফল হইতে দিব না।”

১৯৬৭ সালে সরকারের পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগের ভাঙন ধরানো এবং ছয় দফার আন্দোলনকে দুর্বল করা। রাজনীতিতেও তখন নেতৃত্বের শূন্যতা, দোদুল্যমানতা সিদ্ধান্তহীনতা ইত্যাদি নতুনভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে সে ধরনের লক্ষ্মণ প্রতীয়মান হতে থাকে। আওয়ামী লীগ প্রদেশব্যাপী ১৯৬৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি দিবসের কর্মসূচি পালন করে। এ উপলক্ষে বেশ কয়েকটি স্থানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের সদ্য কারামুক্ত নেতা এমএ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরীসহ অনেকে জনসভায় বক্তব্য রাখেন। ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ পল্টন ময়দানে আপত্তিকর ভাষণ দানের জন্য ১৯৬৭ সালের ২৮ এপ্রিল রায় ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।

এ রায় প্রদানের আগে ১৯৬৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট এমএ খানের কোর্টে ১৯৬৪ সালে ২৯ মার্চ পল্টন ময়দানে প্রদত্ত শেখ মুজিবের ভাষণকে আপত্তিকর হিসেবে অভিহিত করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার বিচার শুরু করা হয়। ছাত্রলীগ ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ৬ দফা গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় (১৯ ও ২০ মার্চ, ১৯৬৭) আব্দুল সালাম খানের উত্থাপিত পিডিএমের তিন দফা সম্পর্কে রিপোর্ট প্রদান করলে বৈঠকে উপস্থিত জেলা ও মহকুমা থেকে আগত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তা প্রত্যাখ্যান করেন। সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার আন্দোলন অব্যাহত রাখার পক্ষে দৃঢ় মত ব্যক্ত করা হয়। তবে মধ্যপন্থি একটি অংশ ছয় দফার পাশাপাশি পিডিএমের তিন দফার সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্যও চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আওয়ামী লীগের জন্য এটি ছিল একটি জটিল পরিস্থিতি। সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ সংকটজনক ছিল।

তবে ওই সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা ছয় দফা আন্দোলনকে বেগবান করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করে। সরকারও বসে ছিল না। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান আরও জোরেশোরে ৬ দফার বিরুদ্ধে নেমে পড়েন। খুলনার জনসভায় ১৯৬৭ সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখে ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান স্বায়ত্তশাসন দাবির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। পাকিস্তানের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য তিনি ছয় দফা দাবিকে দায়ী করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আরও বেশি পাকিস্তানি হওয়ার জন্য উপদেশ প্রদান করেন।

এদিকে এপ্রিল মাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মুক্তি, আওয়ামী লীগ নেত্রী আমেনা বেগমের সাংগঠনিক সফর এবং মানিক মিয়া, মমতাজ দৌলতানা, এনডিএফ, নেজামে ইসলাম, জামাতসহ বিভিন্ন দলের উদ্যোগে ঐক্যজোট গঠনের উদ্যোগ। আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নীতিগত প্রশ্নে এ ধরনের জোট গঠনের বিরোধিতা করেন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবসময় আদর্শগত ঐক্য ছাড়া জোট গঠনে অনীহা প্রকাশ করতেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার প্রশ্নে কোন দলের সঙ্গে আপোষ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। আওয়ামী লীগের কাছে জোট গঠনের উদ্যোগটি সঠিক বলে বিবেচিত হয়নি বরং দলের মধ্যে এবং ৬ দফা আন্দোলনের মধ্যে ফাটল ধরানোর হীন সরকারি ষড়যন্ত্র রূপেই বিবেচিত ছিল। আফতাব আহমদ নামক জনৈক পাকিস্তানি আমলা ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ছয় দফা ত্যাগ করার পরামর্শ দেয়ায় সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এটি সরকারেরই কোন নীলনকশা বাস্তবায়নের উদ্যোগ। ফলে কয়েকটি বিরোধী দল ৮ দফার কর্মসূচির ভিক্তিতে ‘পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ নামে একটি ঐক্যজোট গঠন করে। ঐক্যজোট গঠিত হলেও মূল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। ন্যাপও এর সঙ্গে যায়নি।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই পাকিস্তান গনতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐক্যজোটের চুক্তিতে সাক্ষর করেন। পিডিএমের ৮ দফাকে আওয়ামী লীগ ৬ দফা নস্যাতের ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে। কিছু কিছু নেতা পিডিএমের পক্ষে। আওয়ামী লীগের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নুরুল ইসলাম আট দফাকে আওয়ামী লীগের ‘মানস পূত্র’ বলে বিবৃতি দিয়েছে। যেন ছয় দফার চেয়ে আট দফা দাবিই ভালো। মূলত ছয় দফা থেকে পূর্ব বাংলার লোকদের আট দফার দিকে মোড় ঘোরানোর জন্য তাদের এ অপচেষ্টা। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলে বঙ্গবন্ধু তাদের বলে দেন, ‘ছয় দফার জন্য জেলে এসেছি জেল থেকে বের হয়ে ছয় দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি সনদ ছয় দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না।’

ইতোমধ্যে দেশে ১৯৬৭ সালের আগস্টে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ১৯৬৬ সালের ৮ মে তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আটকাদেশকে ৯ আগস্ট বৈধ বলে ঘোষণা দেয়। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি আবারও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের মধ্যে ছয় দফাও আট দফার বিরোধ বিভ্রান্তি তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৪ জন পিডিএমপন্থি নেতা পিডিএমের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৪ আগস্ট ওয়ার্কিং কমিটির একটি রিকুইজিশন সভা আহ্বান করেন। এ ধরনের উদ্যোগ দলের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের পরিপন্থি ছিল কারণ ওই সিদ্ধান্তে কথা ছিল বিষয়টি দলের কাউন্সিল অধিবেশনে উপস্থাপিত হবে। সেই সিদ্ধান্ত দলের পিডিএমপন্থিদের দ্বারা লঙ্ঘিত হওয়ায় দলের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

অপরদিকে ছয় দফা পন্থিরা দলে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এর প্রতিফলন ঘটে ১৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে। ঢাকার ইডেন হোটেলে ১৯৬৭ সালের ১৯ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৯৫০ জন কাউন্সিলের মধ্যে ৮৮৬ জন উপস্থিত হন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনকে অবৈধ হিসেবে অভিহিত করে ২৩ আগস্ট তারিখে দলের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করেন। সভায় পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ভেঙে দেয়া হয় এবং ২৪ সদস্যের একটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়। এর পাল্টা ২৭ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এক ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকা হয়। সভায় কামরুজ্জামানকে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির নতুন কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়।

এই সিদ্ধান্তের পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য করাচি সিন্ধু হায়দারাবাদসহ বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষে ঢাকায় ফিরে ১৯৬৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আয়োজিত এক সম্মেলনে কামরুজ্জামান ৪৮ সদস্যবিশিষ্ট নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটি কমিটির নাম ঘোষণা করেন। এতে পাকিস্তানের ২৪ জন এবং পূর্ব পাকিস্তানের ২৪ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। নতুন কমিটি ছয় দফার প্রতি অনুগত ছিল। নবগঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির ১৯৬৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় প্রথম সভায় মিলিত হয়। পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগের এডহক কমিটির এক বৈঠক ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৬৭ সালের ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় উক্ত দলের কাউন্সিল অধিবেশন।

তবে দেশে যথাযথভাবে আন্দোলন দাঁড় করতে না পারার কারণে পিডিএমপন্থিদের মধ্যে হতাশা ও আত্মরক্ষার সুরই ধ্বনিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের পিডিএম একটা পাল্টা শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম হলেও পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভব হয়নি। এর কারণ মূলত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বে পরিচালিত কোন আন্দোলন বা সংগঠনের প্রতি ততটা আস্থাশীল হতে পারেনি, যতটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ওপর হয়েছিল। কারণ ছয় দফার আবেদন বাঙালির কাছে দ্রুত পৌঁছে যায়, কিন্তু আট দফার প্রতি মানুষের ধারণা অস্পষ্ট প্রথম থেকেই ছিল। তাছাড়া মূল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ বহুসংখ্যক নেতাকে কারারুদ্ধ করে রাখার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী তথা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণা অব্যাহত থাকে। একইভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার জাতিসত্তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বাড়তে থাকে।

ঢাকা : প্রথম লেখা : ১৬ অক্টোবর, ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

মঙ্গলবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৬ মাঘ ১৪২৭, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ছয় দফা : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা

মোস্তাফা জব্বার

ছয়

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণায় পাকিস্তান সরকার কেবল উদ্বিগ্ন হয়নি, এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা ছয় দফা দাবিকে দেশদ্রোহী, এ দাবির সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দল নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে অভিহিত করে প্রচার কার্য পরিচালনা করতে থাকে। জাতীয় পরিষদে ১৪ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এসএম জাফর বলেন,

... they are the Enemies of the country, we shall hunt them, we shall unmask them and we shall put them on the national record as enemies, sir, this is a country of Patriots and they ( the Enemies) have wrongly chosen this country. they shall be diminished, washed and finished. (আবদুল হক, লেখকের রোজনামচায় চার দশকের রাজনীতি-পরিক্রমা ১৯৫৩-৯৩, (ঢাকা : ইউপি এল, ১৯৯৬) পৃ. ১১৭)

তার এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে দেশের পত্র পত্রিকায় বিবৃতি প্রকাশিত হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, এনডিএফ, নেজামে ইসলামসহ অনেক রাজনীতিক দল, ছাত্র সংগঠন, আইনজীবী সমিতি, হাইকোর্টের বার সমিতির বিবৃতির মাধ্যমে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তখন মাওলানা ভাসানী কোন প্রতিবাদ করেননি। দেশে এই নিয়ে বিরোধী দলসমূহ এতই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যে, ১৯৬৭ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে প্রায় সব বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে সেমিনার অনুষ্ঠান করে। আইয়ূব খানও ১৭ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও এ এক অনুষ্ঠানে স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরুদ্ধে দম্ভ ভরে বলেন, “যে সব শক্তি দেশের উভয় অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বিরোধ, বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে এবং তাহার দ্বারা দেশের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করিতেছে তাহাদের সে চেষ্টা বানচাল করিবার জন্য” বলেন, “যতদিন আমি জীবিত থাকিব এবং যতদিন আমি রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে থাকিব, ততদিন আমি তাহাদের জঘন্য কারসাজিকে সফল হইতে দিব না।”

১৯৬৭ সালে সরকারের পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগের ভাঙন ধরানো এবং ছয় দফার আন্দোলনকে দুর্বল করা। রাজনীতিতেও তখন নেতৃত্বের শূন্যতা, দোদুল্যমানতা সিদ্ধান্তহীনতা ইত্যাদি নতুনভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে সে ধরনের লক্ষ্মণ প্রতীয়মান হতে থাকে। আওয়ামী লীগ প্রদেশব্যাপী ১৯৬৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি দিবসের কর্মসূচি পালন করে। এ উপলক্ষে বেশ কয়েকটি স্থানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের সদ্য কারামুক্ত নেতা এমএ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরীসহ অনেকে জনসভায় বক্তব্য রাখেন। ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ পল্টন ময়দানে আপত্তিকর ভাষণ দানের জন্য ১৯৬৭ সালের ২৮ এপ্রিল রায় ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।

এ রায় প্রদানের আগে ১৯৬৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট এমএ খানের কোর্টে ১৯৬৪ সালে ২৯ মার্চ পল্টন ময়দানে প্রদত্ত শেখ মুজিবের ভাষণকে আপত্তিকর হিসেবে অভিহিত করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার বিচার শুরু করা হয়। ছাত্রলীগ ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ৬ দফা গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় (১৯ ও ২০ মার্চ, ১৯৬৭) আব্দুল সালাম খানের উত্থাপিত পিডিএমের তিন দফা সম্পর্কে রিপোর্ট প্রদান করলে বৈঠকে উপস্থিত জেলা ও মহকুমা থেকে আগত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তা প্রত্যাখ্যান করেন। সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার আন্দোলন অব্যাহত রাখার পক্ষে দৃঢ় মত ব্যক্ত করা হয়। তবে মধ্যপন্থি একটি অংশ ছয় দফার পাশাপাশি পিডিএমের তিন দফার সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্যও চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আওয়ামী লীগের জন্য এটি ছিল একটি জটিল পরিস্থিতি। সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ সংকটজনক ছিল।

তবে ওই সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা ছয় দফা আন্দোলনকে বেগবান করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করে। সরকারও বসে ছিল না। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান আরও জোরেশোরে ৬ দফার বিরুদ্ধে নেমে পড়েন। খুলনার জনসভায় ১৯৬৭ সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখে ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান স্বায়ত্তশাসন দাবির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। পাকিস্তানের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য তিনি ছয় দফা দাবিকে দায়ী করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আরও বেশি পাকিস্তানি হওয়ার জন্য উপদেশ প্রদান করেন।

এদিকে এপ্রিল মাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মুক্তি, আওয়ামী লীগ নেত্রী আমেনা বেগমের সাংগঠনিক সফর এবং মানিক মিয়া, মমতাজ দৌলতানা, এনডিএফ, নেজামে ইসলাম, জামাতসহ বিভিন্ন দলের উদ্যোগে ঐক্যজোট গঠনের উদ্যোগ। আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নীতিগত প্রশ্নে এ ধরনের জোট গঠনের বিরোধিতা করেন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবসময় আদর্শগত ঐক্য ছাড়া জোট গঠনে অনীহা প্রকাশ করতেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার প্রশ্নে কোন দলের সঙ্গে আপোষ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। আওয়ামী লীগের কাছে জোট গঠনের উদ্যোগটি সঠিক বলে বিবেচিত হয়নি বরং দলের মধ্যে এবং ৬ দফা আন্দোলনের মধ্যে ফাটল ধরানোর হীন সরকারি ষড়যন্ত্র রূপেই বিবেচিত ছিল। আফতাব আহমদ নামক জনৈক পাকিস্তানি আমলা ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ছয় দফা ত্যাগ করার পরামর্শ দেয়ায় সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এটি সরকারেরই কোন নীলনকশা বাস্তবায়নের উদ্যোগ। ফলে কয়েকটি বিরোধী দল ৮ দফার কর্মসূচির ভিক্তিতে ‘পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ নামে একটি ঐক্যজোট গঠন করে। ঐক্যজোট গঠিত হলেও মূল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। ন্যাপও এর সঙ্গে যায়নি।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই পাকিস্তান গনতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐক্যজোটের চুক্তিতে সাক্ষর করেন। পিডিএমের ৮ দফাকে আওয়ামী লীগ ৬ দফা নস্যাতের ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে। কিছু কিছু নেতা পিডিএমের পক্ষে। আওয়ামী লীগের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নুরুল ইসলাম আট দফাকে আওয়ামী লীগের ‘মানস পূত্র’ বলে বিবৃতি দিয়েছে। যেন ছয় দফার চেয়ে আট দফা দাবিই ভালো। মূলত ছয় দফা থেকে পূর্ব বাংলার লোকদের আট দফার দিকে মোড় ঘোরানোর জন্য তাদের এ অপচেষ্টা। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলে বঙ্গবন্ধু তাদের বলে দেন, ‘ছয় দফার জন্য জেলে এসেছি জেল থেকে বের হয়ে ছয় দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি সনদ ছয় দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না।’

ইতোমধ্যে দেশে ১৯৬৭ সালের আগস্টে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ১৯৬৬ সালের ৮ মে তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আটকাদেশকে ৯ আগস্ট বৈধ বলে ঘোষণা দেয়। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি আবারও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের মধ্যে ছয় দফাও আট দফার বিরোধ বিভ্রান্তি তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৪ জন পিডিএমপন্থি নেতা পিডিএমের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৪ আগস্ট ওয়ার্কিং কমিটির একটি রিকুইজিশন সভা আহ্বান করেন। এ ধরনের উদ্যোগ দলের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের পরিপন্থি ছিল কারণ ওই সিদ্ধান্তে কথা ছিল বিষয়টি দলের কাউন্সিল অধিবেশনে উপস্থাপিত হবে। সেই সিদ্ধান্ত দলের পিডিএমপন্থিদের দ্বারা লঙ্ঘিত হওয়ায় দলের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

অপরদিকে ছয় দফা পন্থিরা দলে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এর প্রতিফলন ঘটে ১৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে। ঢাকার ইডেন হোটেলে ১৯৬৭ সালের ১৯ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৯৫০ জন কাউন্সিলের মধ্যে ৮৮৬ জন উপস্থিত হন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনকে অবৈধ হিসেবে অভিহিত করে ২৩ আগস্ট তারিখে দলের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করেন। সভায় পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ভেঙে দেয়া হয় এবং ২৪ সদস্যের একটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়। এর পাল্টা ২৭ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এক ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকা হয়। সভায় কামরুজ্জামানকে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির নতুন কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়।

এই সিদ্ধান্তের পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য করাচি সিন্ধু হায়দারাবাদসহ বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষে ঢাকায় ফিরে ১৯৬৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আয়োজিত এক সম্মেলনে কামরুজ্জামান ৪৮ সদস্যবিশিষ্ট নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটি কমিটির নাম ঘোষণা করেন। এতে পাকিস্তানের ২৪ জন এবং পূর্ব পাকিস্তানের ২৪ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। নতুন কমিটি ছয় দফার প্রতি অনুগত ছিল। নবগঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির ১৯৬৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় প্রথম সভায় মিলিত হয়। পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগের এডহক কমিটির এক বৈঠক ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৬৭ সালের ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় উক্ত দলের কাউন্সিল অধিবেশন।

তবে দেশে যথাযথভাবে আন্দোলন দাঁড় করতে না পারার কারণে পিডিএমপন্থিদের মধ্যে হতাশা ও আত্মরক্ষার সুরই ধ্বনিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের পিডিএম একটা পাল্টা শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম হলেও পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভব হয়নি। এর কারণ মূলত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বে পরিচালিত কোন আন্দোলন বা সংগঠনের প্রতি ততটা আস্থাশীল হতে পারেনি, যতটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ওপর হয়েছিল। কারণ ছয় দফার আবেদন বাঙালির কাছে দ্রুত পৌঁছে যায়, কিন্তু আট দফার প্রতি মানুষের ধারণা অস্পষ্ট প্রথম থেকেই ছিল। তাছাড়া মূল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ বহুসংখ্যক নেতাকে কারারুদ্ধ করে রাখার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী তথা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণা অব্যাহত থাকে। একইভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার জাতিসত্তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বাড়তে থাকে।

ঢাকা : প্রথম লেখা : ১৬ অক্টোবর, ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com