ভিকটিম ব্লেইমিং ও আমজনতার বিচার সংস্কৃতি

আসিফ উল হক

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একে-অপরের প্রতি সত্যিকার দরদ এবং ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত হোক- এটা মনে-প্রাণে সবাই চায়। এমনকি এ ব্যাপারে কারো কোন প্রকার দ্বিধা বা সন্দেহের অবকাশও নেই। তবে প্রশ্ন থেকে যায়Ñ এই দরদ বা মমতা দেখাতে গিয়ে আমরা অন্যায়ভাবে কাউকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি কিনা, যিনি যেই কাজটি করেননি বরং অহেতুক ক্ষতির শিকার হয়েছেন তাকে আমরা সেই কাজটির জন্য দোষারোপ করছি কিনা। যদি উত্তর হ্যাঁ হয় তাহলে বুঝতে হবে আমরা কাজটি সঠিক করছি না। কেননা ভুক্তভোগীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা মানেই পরোক্ষভাবে অপরাধীকে বাচানোর কূটকৌশল; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়, মারাত্মক অপরাধও বটে। তাই কোনো অপরাধের জন্য কাউকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করার আগে সেদিকে আমাদের যতœশীল হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।

আমরা সাধারণ মানুষ নিজেদের অতিরিক্ত বুদ্ধিমান মনে করি এবং সেই সাথে হরহামেশাই আমরা নিজেদের অভিব্যক্তি দিয়ে অন্যের অনুভূতিতে অযাচিত স্পর্শ করতে চাই। বর্তমান সময়ে আমাদের মতপ্রকাশের বিষয়টা খুবই চিন্তার খোরাক জন্ম দিচ্ছে। বিচার্য বিষয়ে সাধারণত যে মনোভাব প্রকাশিত হচ্ছে এতে করে বিচারহীনতা বা ন্যায্য দাবি যাই বলি না কেন তা কোনোভাবেই আমাদের জন্য সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ব্যতীত মঙ্গলজনক কোন পন্থা হয়ে উঠছে না। আমরা সমালোচনা করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে অন্যকে জেনে বা না জেনে, বুঝে বা না বুঝে মানহানিকর পরিস্থিতিতে উপনীত করছি। এতে ভুক্তভোগীর সামাজকি মর্যাদা মানসম্মান সবকিছুই আমাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভিকটিম ব্লেইমিং কোন বালিশ বদল বা চেয়ার সিটিং খেলা নয়, তবুও অমরা ভিকটিমকেই অনেক সময় দায়ী বা দোষারোপ করছি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের জন্য। ন্যায়সঙ্গত বিচারের আগেই অভিযুক্তের পাশাপাশি ভুক্তভোগীও বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে আমজনতার, পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের। এতে আমরা পরোক্ষভাবে অন্যায়টাকে প্রধান্য না দিয়ে প্রধান্য দিচ্ছি ঘটনায় ভিকটিমের কী দোষ তার ওপর। ভুক্তভোগী কেন গেল? কেন করল? এসব প্রশ্নবাণেই জর্জরিত আমাদের চিন্তাগুলো।

ভিকটিম ব্লেইমিং শব্দটি পৃথিবী ব্যাপি বহুল প্রচলিত। ভিক্টিম ব্লেইমিং একটি ইংরেজি শব্দ যার আবিধানিক অর্থ ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করা। অর্থাৎ কোন অন্যায় সংঘটিত হলে যে ব্যক্তি ভুক্তভোগী তাকেই পরোক্ষভাবে দোষারোপ করা। বিশেষ করে ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের সংস্কৃতিটা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোটামুটি ভালোভাবেই চর্চা করে থাকি আমরা যা মোটেও কাম্য নয়। আমাদের চিন্তার জায়গা থেকে যেখানে আমাদের গঠনমূলক সমালোচনাটা জরুরি সেখানে অতিরঞ্জিত বক্তব্য প্রদান বা বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে মস্তিষ্ক নিসৃত চিন্তাগুলো তুলে ধরছি; যার বেশির ভাগই ব্লেইমিং করা হচ্ছে ভুক্তভোগীকে কেন্দ্র করে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশকিছু ঘটনার সম্পর্কে আমরা জানি যেখানে অপরাধীর চেয়ে ভিকটিমকেই বেশি দোষারোপ করা হয়েছে, করা হচ্ছে। সিলেটের এমসি কলেজে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থী ধর্ষণের কথা বলতে পারি। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুক্তভোগীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দোষারোপ করা হয়েছে। তারা সেখানে কেন গিয়েছিল? কেন এমন পোশাক পরেছিল? কেন একটা মেয়ে হয়ে ছেলেদের সাথে আড্ডা দিয়েছিল- এমন অনেক অর্থহীন প্রশ্ন। কথা বলার হাবভাব এমন যেন সংঘটিত অপরাধটির জন্য ভুক্তভোগীও সমানভাবে দায়ী, অপরাধীর সাথে তারও বিচার হওয়া উচিত। প্রতিনিয়ত আমরা এভাবেই ভিকটিমকে দোষারোপ করছি। আমজনতার এমন ব্যবহারে ভুক্তভোগীদের মধ্যে যিনি মারা যাচ্ছে তিনি এক বুক আর্তনাদ নিয়ে চলে যাচ্ছেন, আর যিনি বেঁচে থাকেন তিনি বয়ে বেড়ান এক বৃহৎ যন্ত্রণা যা বুঝবার সাধ্য আমাদের কারো নেই। আমরা কি নোয়াখালীর যৌন নিপীড়ন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির কথা ভুলে গেছি? এ ঘটনায়ও ভিকটিমকেই দায়ী করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল ভুক্তভোগী কেন থানায় অভিযোগ করেনি? কী অবান্তর প্রশ্ন! শুধু উপরোল্লিখিত ৩টি ঘটনাই নয়, প্রায় প্রতিটি ঘটনায় এভাবেই ভুক্তভোগীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সমাজ ও আমাদের ভূমিকাটা কী হওয়া উচিত, কখনো কি তা ভেবে দেখেছি? হয়ত না। যদি ভাবতাম তাহলে এভাবে ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করতাম না। যদিও ভিকটিম ব্লেইমিং রুখতে আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে এটাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এমনকি দণ্ডবিধিতেও কোন ধারায় দণ্ডের কথা বলা হয়নি। আইনের মারপ্যাঁচে অপরাধ না হলেও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ কাজটি একটি চরম অন্যায় এবং ভুক্তভোগীর জন্য চূড়ান্ত অপমান ও মানহানিকর।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ধারা ১৪-তে বলা হয়েছে, এ আইনের বর্ণিত অপরাধের শিকার হয়েছেন এরূপ নারী ও শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদপত্রে বা অন্য কোন সংবাদমাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা উপস্থাপন করা যাবে না; যাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ পায়। যদি উক্ত বিধান কেউ লঙ্ঘন করে তবে ওই কাজের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা তবে ভিকটিমের পরিচয়কে বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপন না করার জন্য বিশেষ বাধানিষেধ রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকে দুই বৎসরের কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অথচ আমরা হরহামেশাই বিভিন্ন অভিপ্রেত কথাবার্তা বা বিভিন্ন ডিজিটাল প্লাটফর্মে লেখনির মাধ্যমে ভুক্তভোগীর নিন্দাবাদ প্রকাশ করছি; যা ভুক্তভোগীসহ অভিযুক্তের ক্ষেত্রেও অধিকাংশ সময় মানহানি করছে। আমাদের একটা বিষয়ে সুষ্ঠুষ্ঠরূপে ধারণা রাখতে হবে কোন অপরাধে কাউকে অভিযুক্ত করা মানে এই নয় যে, তিনি প্রকৃত অপরাধী। আইনে বলা হয়েছেÑ প্রাথমিক দৃষ্টিতে প্রত্যেক অপরাধীই নিষ্পাপ। একবার চিন্তা করুন। যেখানে অপরাধ প্রামাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত অপরাধীকেও অপরাধী বলতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে আপনি কীভাবে ভুক্তভোগীকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন!

ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিমকে বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে যারা বিভিন্ন যৌন নিপীড়ন বা শ্লীলতাহানির শিকার তাদের আমাদের কর্ম, কথা বা লেখনীর মাধ্যমে অপমান অপদস্ত করে থাকি; যা প্রকৃত অর্থে দণ্ডনীয় অপরাধ। দণ্ডবিধি ৪৯৯ ধারা এবং কিছু ক্ষেত্রে ধারা ৫০৯ এর অধীনে কৃত কাজটি অপরাধ। এর জন্য দোষী ব্যক্তি দণ্ডবিধির ৫০০ ধারা মোতাবেক দুই বৎসর মেয়াদের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। যদি অপরাধটি সংঘটিত করা হয় কেবল নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে তবে সেক্ষেত্রে অপরাধী এক বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের উচিত চিন্তা বা কর্মে সৃজনশীলতা ধরে রাখা। না জেনে কোন বিষয়ে অহেতুক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা। একটা অপরাধের বিচার চাইতে গিয়ে যেন কোনভাবেই ভিকটিম সমাজের চোখে অপরাধী না হয়ে উঠে- এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

[লেখক : আইনের শিক্ষক, বিইউবিটি]

মঙ্গলবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৬ মাঘ ১৪২৭, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ভিকটিম ব্লেইমিং ও আমজনতার বিচার সংস্কৃতি

আসিফ উল হক

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একে-অপরের প্রতি সত্যিকার দরদ এবং ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত হোক- এটা মনে-প্রাণে সবাই চায়। এমনকি এ ব্যাপারে কারো কোন প্রকার দ্বিধা বা সন্দেহের অবকাশও নেই। তবে প্রশ্ন থেকে যায়Ñ এই দরদ বা মমতা দেখাতে গিয়ে আমরা অন্যায়ভাবে কাউকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি কিনা, যিনি যেই কাজটি করেননি বরং অহেতুক ক্ষতির শিকার হয়েছেন তাকে আমরা সেই কাজটির জন্য দোষারোপ করছি কিনা। যদি উত্তর হ্যাঁ হয় তাহলে বুঝতে হবে আমরা কাজটি সঠিক করছি না। কেননা ভুক্তভোগীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা মানেই পরোক্ষভাবে অপরাধীকে বাচানোর কূটকৌশল; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়, মারাত্মক অপরাধও বটে। তাই কোনো অপরাধের জন্য কাউকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করার আগে সেদিকে আমাদের যতœশীল হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।

আমরা সাধারণ মানুষ নিজেদের অতিরিক্ত বুদ্ধিমান মনে করি এবং সেই সাথে হরহামেশাই আমরা নিজেদের অভিব্যক্তি দিয়ে অন্যের অনুভূতিতে অযাচিত স্পর্শ করতে চাই। বর্তমান সময়ে আমাদের মতপ্রকাশের বিষয়টা খুবই চিন্তার খোরাক জন্ম দিচ্ছে। বিচার্য বিষয়ে সাধারণত যে মনোভাব প্রকাশিত হচ্ছে এতে করে বিচারহীনতা বা ন্যায্য দাবি যাই বলি না কেন তা কোনোভাবেই আমাদের জন্য সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ব্যতীত মঙ্গলজনক কোন পন্থা হয়ে উঠছে না। আমরা সমালোচনা করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে অন্যকে জেনে বা না জেনে, বুঝে বা না বুঝে মানহানিকর পরিস্থিতিতে উপনীত করছি। এতে ভুক্তভোগীর সামাজকি মর্যাদা মানসম্মান সবকিছুই আমাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভিকটিম ব্লেইমিং কোন বালিশ বদল বা চেয়ার সিটিং খেলা নয়, তবুও অমরা ভিকটিমকেই অনেক সময় দায়ী বা দোষারোপ করছি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের জন্য। ন্যায়সঙ্গত বিচারের আগেই অভিযুক্তের পাশাপাশি ভুক্তভোগীও বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে আমজনতার, পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের। এতে আমরা পরোক্ষভাবে অন্যায়টাকে প্রধান্য না দিয়ে প্রধান্য দিচ্ছি ঘটনায় ভিকটিমের কী দোষ তার ওপর। ভুক্তভোগী কেন গেল? কেন করল? এসব প্রশ্নবাণেই জর্জরিত আমাদের চিন্তাগুলো।

ভিকটিম ব্লেইমিং শব্দটি পৃথিবী ব্যাপি বহুল প্রচলিত। ভিক্টিম ব্লেইমিং একটি ইংরেজি শব্দ যার আবিধানিক অর্থ ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করা। অর্থাৎ কোন অন্যায় সংঘটিত হলে যে ব্যক্তি ভুক্তভোগী তাকেই পরোক্ষভাবে দোষারোপ করা। বিশেষ করে ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের সংস্কৃতিটা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোটামুটি ভালোভাবেই চর্চা করে থাকি আমরা যা মোটেও কাম্য নয়। আমাদের চিন্তার জায়গা থেকে যেখানে আমাদের গঠনমূলক সমালোচনাটা জরুরি সেখানে অতিরঞ্জিত বক্তব্য প্রদান বা বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে মস্তিষ্ক নিসৃত চিন্তাগুলো তুলে ধরছি; যার বেশির ভাগই ব্লেইমিং করা হচ্ছে ভুক্তভোগীকে কেন্দ্র করে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশকিছু ঘটনার সম্পর্কে আমরা জানি যেখানে অপরাধীর চেয়ে ভিকটিমকেই বেশি দোষারোপ করা হয়েছে, করা হচ্ছে। সিলেটের এমসি কলেজে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থী ধর্ষণের কথা বলতে পারি। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুক্তভোগীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দোষারোপ করা হয়েছে। তারা সেখানে কেন গিয়েছিল? কেন এমন পোশাক পরেছিল? কেন একটা মেয়ে হয়ে ছেলেদের সাথে আড্ডা দিয়েছিল- এমন অনেক অর্থহীন প্রশ্ন। কথা বলার হাবভাব এমন যেন সংঘটিত অপরাধটির জন্য ভুক্তভোগীও সমানভাবে দায়ী, অপরাধীর সাথে তারও বিচার হওয়া উচিত। প্রতিনিয়ত আমরা এভাবেই ভিকটিমকে দোষারোপ করছি। আমজনতার এমন ব্যবহারে ভুক্তভোগীদের মধ্যে যিনি মারা যাচ্ছে তিনি এক বুক আর্তনাদ নিয়ে চলে যাচ্ছেন, আর যিনি বেঁচে থাকেন তিনি বয়ে বেড়ান এক বৃহৎ যন্ত্রণা যা বুঝবার সাধ্য আমাদের কারো নেই। আমরা কি নোয়াখালীর যৌন নিপীড়ন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটির কথা ভুলে গেছি? এ ঘটনায়ও ভিকটিমকেই দায়ী করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল ভুক্তভোগী কেন থানায় অভিযোগ করেনি? কী অবান্তর প্রশ্ন! শুধু উপরোল্লিখিত ৩টি ঘটনাই নয়, প্রায় প্রতিটি ঘটনায় এভাবেই ভুক্তভোগীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সমাজ ও আমাদের ভূমিকাটা কী হওয়া উচিত, কখনো কি তা ভেবে দেখেছি? হয়ত না। যদি ভাবতাম তাহলে এভাবে ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করতাম না। যদিও ভিকটিম ব্লেইমিং রুখতে আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে এটাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এমনকি দণ্ডবিধিতেও কোন ধারায় দণ্ডের কথা বলা হয়নি। আইনের মারপ্যাঁচে অপরাধ না হলেও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ কাজটি একটি চরম অন্যায় এবং ভুক্তভোগীর জন্য চূড়ান্ত অপমান ও মানহানিকর।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ধারা ১৪-তে বলা হয়েছে, এ আইনের বর্ণিত অপরাধের শিকার হয়েছেন এরূপ নারী ও শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদপত্রে বা অন্য কোন সংবাদমাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা উপস্থাপন করা যাবে না; যাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ পায়। যদি উক্ত বিধান কেউ লঙ্ঘন করে তবে ওই কাজের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা তবে ভিকটিমের পরিচয়কে বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপন না করার জন্য বিশেষ বাধানিষেধ রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকে দুই বৎসরের কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অথচ আমরা হরহামেশাই বিভিন্ন অভিপ্রেত কথাবার্তা বা বিভিন্ন ডিজিটাল প্লাটফর্মে লেখনির মাধ্যমে ভুক্তভোগীর নিন্দাবাদ প্রকাশ করছি; যা ভুক্তভোগীসহ অভিযুক্তের ক্ষেত্রেও অধিকাংশ সময় মানহানি করছে। আমাদের একটা বিষয়ে সুষ্ঠুষ্ঠরূপে ধারণা রাখতে হবে কোন অপরাধে কাউকে অভিযুক্ত করা মানে এই নয় যে, তিনি প্রকৃত অপরাধী। আইনে বলা হয়েছেÑ প্রাথমিক দৃষ্টিতে প্রত্যেক অপরাধীই নিষ্পাপ। একবার চিন্তা করুন। যেখানে অপরাধ প্রামাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত অপরাধীকেও অপরাধী বলতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে আপনি কীভাবে ভুক্তভোগীকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন!

ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিমকে বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে যারা বিভিন্ন যৌন নিপীড়ন বা শ্লীলতাহানির শিকার তাদের আমাদের কর্ম, কথা বা লেখনীর মাধ্যমে অপমান অপদস্ত করে থাকি; যা প্রকৃত অর্থে দণ্ডনীয় অপরাধ। দণ্ডবিধি ৪৯৯ ধারা এবং কিছু ক্ষেত্রে ধারা ৫০৯ এর অধীনে কৃত কাজটি অপরাধ। এর জন্য দোষী ব্যক্তি দণ্ডবিধির ৫০০ ধারা মোতাবেক দুই বৎসর মেয়াদের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। যদি অপরাধটি সংঘটিত করা হয় কেবল নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে তবে সেক্ষেত্রে অপরাধী এক বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের উচিত চিন্তা বা কর্মে সৃজনশীলতা ধরে রাখা। না জেনে কোন বিষয়ে অহেতুক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা। একটা অপরাধের বিচার চাইতে গিয়ে যেন কোনভাবেই ভিকটিম সমাজের চোখে অপরাধী না হয়ে উঠে- এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

[লেখক : আইনের শিক্ষক, বিইউবিটি]