ফেসবুকে সম্পর্ক, শতাধিক নারীর সঙ্গে প্রতারণা যুবক গ্রেপ্তার

চাকরিজীবী অথবা ধনাঢ্য পরিবারের মধ্যবয়সী গৃহবধূ থেকে শুরু করে নানা বয়সী নারীদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বন্ধু হন। এরপর নানা প্রলোভনে ফেলে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ঘনিষ্ট হওয়ার মুহূর্তগুলোর ছবি বা ভিডিও ধারণ করে রেখে পরে তার মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করেন। ধূর্ত এ প্রতারকের নাম বেলাল হোসেন। আর কোন পেশা বা কর্ম না থাকলেও ফেসবুককেন্দ্রিক সম্পর্কে নারীদের ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করা তার প্রধান পেশা। এ প্রতারকের ফাঁদে পড়ে আর্থিক এবং মানসিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছেন শতাধিক নারী। সংসার বিচ্ছিন্ন হয়েছে অনেকের।

ডিবির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার রফিকুল ইসলাম সংবাদকে জানান, গত মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী থানায় এক গৃহবধূর করা মামলায় বেলাল হোসেনকে যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির ডিবির মতিঝিল জোনাল টিমের সদস্যরা। অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন টিম বেলালকে গ্রেপ্তার করে মোবাইল জব্দ করে। পরে তার মোবাইল, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন একাউন্ট ঘেটে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে ঘনিষ্টতার ছবি ও ভিডিও খুঁজে পান। বেলালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড হেফাজতে আনার অনুমতি চেয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। বর্তমানে ডিবি হেফাজতে বেলালকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এডিসি রফিকুল জানান, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ৪৫ বছর বয়সী এক গৃহবধূর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে ৩ মাস আগে পরিচয় হয় বেলালের। বরিশালের হিজলা থানার গোয়াবাড়িয়া এলাকার আবদুল আজিজের ছেলে বেলাল হোসেন নিজেকে নগর ভবনের কম্পিউটার অপারেরট পরিচয় দিয়ে ওই গৃহবধূর সঙ্গে নিয়মিত ম্যাসেঞ্জারে আলাপ করতে থাকেন। ৩ মাসেই ওই গৃহবধূকে পটিয়ে ফেলেন বেলাল। গৃহবধূকে বিয়ে করারও আশ্বাস দেন। অথচ ওই গৃহবধূর ছেলে এবং ছেলে বউ রয়েছে। স্বামীর সঙ্গে যাত্রাবাড়ী এলাকায় নিজ বাড়িতে থাকেন। আর্থিক ও সামাজিক দিক বিবেচনায় গৃহবধূ স্বাবলম্বী। মূলত এ কারণে ওই গৃহবধূকে ফাঁদে ফেলেছেন। ওই গৃহবধূও বেলালের টোপে পা দিয়েছেন।

ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, ওই গৃহবধূর সঙ্গে একাধিকবার ঘনিষ্ট সময় কাটিয়ে ছবি ও ভিডিও করে রেখেছেন। যা গৃহবধূ বুঝতে পারেননি। এক পর্যায়ে তিনি (গৃহবধূ) ভুল করছেন বুঝতে পেরে নিজেকে সুধরে আনেন। আর তখনই বেলাল তার আসল রূপ প্রকাশ করে। গৃহবধূর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ঘনিষ্টতার ছবি পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন গৃহবধূর কাছে। এরপর নিজের সংসার ও সম্মান রক্ষায় ওই গৃহবধূ টাকা দিতে সম্মত হন। টাকা দিতে দেরি হওয়ায় এক পর্যায়ে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে বেলাল। তখন ওই গৃহবধূ চিন্তা করেন টাকা দিলে তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বেলাল যদি এসব ছবি ভাইরাল করে বা তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে গৃহবধূ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। দুশ্চিন্তায় খাওয়া ছেড়ে দেন। এমন পরিস্থিতিতে গৃহবধূর ছেলের বউয়ের নজরে শাশুড়ির আস্বাভাবিকতা পড়ে। ছেলের বউ বুঝতে পেরে শাশুড়ির ফেসবুকে নিজেকে যুুক্ত করলে মূল কাহিনী জানতে পারেন। এরপর ওই গৃহবূধকে নজরে রাখলে তিনি পরিবারের কাছে নিজের ভুলের কথা স্বীকার করেন। পরে তারা থানায় মামলা করলে বেলালকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার আতিকুর রহমান জানান, ‘বেলাল হোসেন একজন ধূর্ত প্রতারক। তার মূল টার্গেট ব্ল্যাকমেইলিং বা প্রতরণা করা। গত কয়েক বছর ধরে সে এ কাজ করে আসছে। এ পর্যন্ত শতাধিক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়েছে। ঘনিষ্টতার সময় নিজের মোবাইলে ছবি ও ভিডিও করে রেখেছে। এসব ছবি ও ভিডিও ওইসব নারীদের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে টাকা দাবি করত। অনেক নারীর সংসার ভেঙেছে বেলালের কারণে। তার মোবাইলে শত শত ছবি ভিডিও মিলেছে। এসব নিয়ে তদন্ত চলছে।’

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এসি আতিকুর রহমান জানান, বেলাল হোসেন ধলপুর এলাকায় থাকে। প্রতারণাই তার মূল পেশা। প্রতারণার জন্য সে চাকরিজীবী নারী, বাড়ির মালিক মধ্যবয়সী নারীদের টার্গেট করেন। তার প্রতারণার ধরন দুইভাবে হয়। প্রথমত নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে সম্পর্ক গড়েন। ঘনিষ্ট হওয়ার সময় গোপনে ছবি বা ভিডিও করেন। এসব ছবি বা ভিডিও নারীদের কাছে পাঠিয়ে অর্থ দাবি করতে থাকেন। আরেকটি ফেসবুক একাউন্ট খুলে নারী পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়ে বিষয়টি সমাধান করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েও টাকা নিতেন। গত ৮ বছর ধরে এ এমনভাবে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ফাঁদে ফেলা নারীদের কাছ থেকে। গত রোববার বেলালকে ১ দিনের রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞসাবাদের অনুমতি দেয় আদালত। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাকে জেলে পাঠিয়েছে। আদালতের অনমুতি নিয়ে বেলালের মোবাইল ফরেনসিকের জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছে। বেলালের নিজের শ্যালিকাকেও টোপে ফেলে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে প্রতরণা করেছে। যেসব নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তাদের নাম পরিচয় পাওয়া গেলেও ওইসব নারীদের সম্মানের কথা বিবেচনা করে তাদের ডাকা হয়নি। ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এ মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। অভিযোগ প্রমাণে ফরেনসিক প্রতিবেদন যথেষ্ট বলে আমরা মনে করছি।

বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৭ মাঘ ১৪২৭, ২৭ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ফেসবুকে সম্পর্ক, শতাধিক নারীর সঙ্গে প্রতারণা যুবক গ্রেপ্তার

সাইফ বাবলু

চাকরিজীবী অথবা ধনাঢ্য পরিবারের মধ্যবয়সী গৃহবধূ থেকে শুরু করে নানা বয়সী নারীদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বন্ধু হন। এরপর নানা প্রলোভনে ফেলে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ঘনিষ্ট হওয়ার মুহূর্তগুলোর ছবি বা ভিডিও ধারণ করে রেখে পরে তার মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করেন। ধূর্ত এ প্রতারকের নাম বেলাল হোসেন। আর কোন পেশা বা কর্ম না থাকলেও ফেসবুককেন্দ্রিক সম্পর্কে নারীদের ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করা তার প্রধান পেশা। এ প্রতারকের ফাঁদে পড়ে আর্থিক এবং মানসিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছেন শতাধিক নারী। সংসার বিচ্ছিন্ন হয়েছে অনেকের।

ডিবির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার রফিকুল ইসলাম সংবাদকে জানান, গত মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী থানায় এক গৃহবধূর করা মামলায় বেলাল হোসেনকে যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির ডিবির মতিঝিল জোনাল টিমের সদস্যরা। অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন টিম বেলালকে গ্রেপ্তার করে মোবাইল জব্দ করে। পরে তার মোবাইল, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন একাউন্ট ঘেটে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে ঘনিষ্টতার ছবি ও ভিডিও খুঁজে পান। বেলালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড হেফাজতে আনার অনুমতি চেয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। বর্তমানে ডিবি হেফাজতে বেলালকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এডিসি রফিকুল জানান, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ৪৫ বছর বয়সী এক গৃহবধূর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে ৩ মাস আগে পরিচয় হয় বেলালের। বরিশালের হিজলা থানার গোয়াবাড়িয়া এলাকার আবদুল আজিজের ছেলে বেলাল হোসেন নিজেকে নগর ভবনের কম্পিউটার অপারেরট পরিচয় দিয়ে ওই গৃহবধূর সঙ্গে নিয়মিত ম্যাসেঞ্জারে আলাপ করতে থাকেন। ৩ মাসেই ওই গৃহবধূকে পটিয়ে ফেলেন বেলাল। গৃহবধূকে বিয়ে করারও আশ্বাস দেন। অথচ ওই গৃহবধূর ছেলে এবং ছেলে বউ রয়েছে। স্বামীর সঙ্গে যাত্রাবাড়ী এলাকায় নিজ বাড়িতে থাকেন। আর্থিক ও সামাজিক দিক বিবেচনায় গৃহবধূ স্বাবলম্বী। মূলত এ কারণে ওই গৃহবধূকে ফাঁদে ফেলেছেন। ওই গৃহবধূও বেলালের টোপে পা দিয়েছেন।

ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, ওই গৃহবধূর সঙ্গে একাধিকবার ঘনিষ্ট সময় কাটিয়ে ছবি ও ভিডিও করে রেখেছেন। যা গৃহবধূ বুঝতে পারেননি। এক পর্যায়ে তিনি (গৃহবধূ) ভুল করছেন বুঝতে পেরে নিজেকে সুধরে আনেন। আর তখনই বেলাল তার আসল রূপ প্রকাশ করে। গৃহবধূর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ঘনিষ্টতার ছবি পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন গৃহবধূর কাছে। এরপর নিজের সংসার ও সম্মান রক্ষায় ওই গৃহবধূ টাকা দিতে সম্মত হন। টাকা দিতে দেরি হওয়ায় এক পর্যায়ে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে বেলাল। তখন ওই গৃহবধূ চিন্তা করেন টাকা দিলে তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বেলাল যদি এসব ছবি ভাইরাল করে বা তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে গৃহবধূ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। দুশ্চিন্তায় খাওয়া ছেড়ে দেন। এমন পরিস্থিতিতে গৃহবধূর ছেলের বউয়ের নজরে শাশুড়ির আস্বাভাবিকতা পড়ে। ছেলের বউ বুঝতে পেরে শাশুড়ির ফেসবুকে নিজেকে যুুক্ত করলে মূল কাহিনী জানতে পারেন। এরপর ওই গৃহবূধকে নজরে রাখলে তিনি পরিবারের কাছে নিজের ভুলের কথা স্বীকার করেন। পরে তারা থানায় মামলা করলে বেলালকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার আতিকুর রহমান জানান, ‘বেলাল হোসেন একজন ধূর্ত প্রতারক। তার মূল টার্গেট ব্ল্যাকমেইলিং বা প্রতরণা করা। গত কয়েক বছর ধরে সে এ কাজ করে আসছে। এ পর্যন্ত শতাধিক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়েছে। ঘনিষ্টতার সময় নিজের মোবাইলে ছবি ও ভিডিও করে রেখেছে। এসব ছবি ও ভিডিও ওইসব নারীদের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে টাকা দাবি করত। অনেক নারীর সংসার ভেঙেছে বেলালের কারণে। তার মোবাইলে শত শত ছবি ভিডিও মিলেছে। এসব নিয়ে তদন্ত চলছে।’

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এসি আতিকুর রহমান জানান, বেলাল হোসেন ধলপুর এলাকায় থাকে। প্রতারণাই তার মূল পেশা। প্রতারণার জন্য সে চাকরিজীবী নারী, বাড়ির মালিক মধ্যবয়সী নারীদের টার্গেট করেন। তার প্রতারণার ধরন দুইভাবে হয়। প্রথমত নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে সম্পর্ক গড়েন। ঘনিষ্ট হওয়ার সময় গোপনে ছবি বা ভিডিও করেন। এসব ছবি বা ভিডিও নারীদের কাছে পাঠিয়ে অর্থ দাবি করতে থাকেন। আরেকটি ফেসবুক একাউন্ট খুলে নারী পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়ে বিষয়টি সমাধান করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েও টাকা নিতেন। গত ৮ বছর ধরে এ এমনভাবে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ফাঁদে ফেলা নারীদের কাছ থেকে। গত রোববার বেলালকে ১ দিনের রিমান্ড হেফাজতে জিজ্ঞসাবাদের অনুমতি দেয় আদালত। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাকে জেলে পাঠিয়েছে। আদালতের অনমুতি নিয়ে বেলালের মোবাইল ফরেনসিকের জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছে। বেলালের নিজের শ্যালিকাকেও টোপে ফেলে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে প্রতরণা করেছে। যেসব নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তাদের নাম পরিচয় পাওয়া গেলেও ওইসব নারীদের সম্মানের কথা বিবেচনা করে তাদের ডাকা হয়নি। ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এ মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। অভিযোগ প্রমাণে ফরেনসিক প্রতিবেদন যথেষ্ট বলে আমরা মনে করছি।