ভ্রমণ

অভিমুখ পাহাড়ী মানুষের দেশ

ইশতিয়াক আলম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ম্যাপ এবং গাইড বই পড়ে আগেই জেনেছি শহরের দেখার কী আছে, কোথায় এবং কোনদিকে তার অবস্থান। উত্তরে সবচেয়ে উঁচু হচ্ছে হ্যালি টিলা, তা ছাড়িয়ে চাঁদমারির শিরে ডার্টল্যান্ড হিল্স, দক্ষিণে খাটলা বাজার। পুবে নিচে বেথেলহেমে জুয়োলজিক্যাল গার্ডেন এবং চিড়িয়াখানা। শহরের দক্ষিণে বেশিরভাগ দর্শনীয় স্পট।

ঘণ্টা হিসাবে মিটিয়ে অমরা একটা উঠি টাটা সুমোতে। যে রাস্তাটা সামনে যেয়ে পাহাড়ে উঠেছে সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর যেতেই পাহাড়ের মাথায় সমতলে থামে। পৌঁছে গেলাম ম্যাকডোনাল্ড হিল্ শীর্ষে। ওপরটায় সমতল মাঠ। সেখানে ফুটবল খেলছে একদল স্কুল ছাত্র।

এখানেই মাঠের ডানে মিজোরাম স্টেট মিউজিয়াম, নতুন। ১৯৭৭ সালে যাত্রা শুরু করলেও ছ’তলা এ নতুন ভবনে এসেছে ১৯৮১-তে। চার তলা নিয়ে মিউজিয়াম। গ্যালারি সংখ্যা পাঁচ। মিউজিয়ামটিতে প্রতœতত্ত্ব এবং নৃতাত্বিক অনেক উপকরণ রয়েছে এক্সিবিট হিসাবে। রয়েছে প্রস্তর নির্মিত গৃহস্থালী দ্রব্যাদি, শিলালিপি, ফসিল, বিভিন্ন সময়ে আদিবাসীদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, দৈনন্দিন ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, প্রাচীন পদ্ধতিতে হাতে বোনা বস্ত্র, দলপতিদের পোশাক এবং বিচিত্র অলঙ্কার। রেপ্লিকার সাহায্যে দেখানো হয়েছে আদিম জীবনযাপন পদ্ধতি।

ঢোকার মুখে ধাতুর ঢালের উপর লেখা মিউজিয়ামের নাম ও উদ্বোধনের তথ্য। পাশে কাঠের ফ্রেমে ঝোলানো বিরাট ঢাক, যা বাজিয়ে তারা কখনো পাঠাতো সংবাদ, কখনো ব্যবহৃত হতো রণসঙ্গীত কিংবা সামাজিক নৃত্য উৎসবে সহযোগী যন্ত্র হিসাবে। তার পাশে এক শিলাপাথরের স্তম্ভ, আদিম কোনো গোত্রের বীরযোদ্ধার স্মরণে যা স্থাপিত হয়েছিল পাহাড়ে। ঢুকেই বাম দিকের ঘরে আদিবাসীদের ঘরের একাধিক মডেল। দলপতির বাড়ি এবং তরুণদের একত্রে বসবাসের জন্য ডর্মিটরি বা ‘জওলাবুক’। ‘জওল’ অর্থ চওড়া, বুক অর্থ অস্থায়ী বিশ্রামাগার। বার্মা থেকে যখন আদিবাসীরা দেশান্তরী হয়ে এদেশে আগমন করে তখন থেকে এর শুরু। মিজোদের সমাজজীবনে এই জওলাবুক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিজো বালকদের শৈশব কাটে এখানে। শরীরচর্চা, শিকার ও যুদ্ধের কৌশল শিক্ষা, সামাজিক রীতি-নীতি, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, শৃঙ্খলা সব কিছুরই শিক্ষা গ্রহণের জন্য অবস্থান করতে হয় এখানে। এমনকি বিয়ের পর প্রথম বছর কিংবা প্রথম সন্তান জন্ম গ্রহণ পর্যন্ত মিজো যুবকদের কাটে এই জওলাবুকে। প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণের পরে মিজো যুবক পৃথক ঘর করে স্বাবলম্বীভাবে বাস করা শুরু করে, কিন্তু সে যদি কনিষ্ঠ সন্তান হয়, তবে তাকে থাকতে হবে পিতামাতার সঙ্গে তাদের দেখাশোনা করবার জন্য এবং সে সন্তানই হবে পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার। পূর্বপুরুষের বাসগৃহটিও পাবে সে। যদি সে মারা যায় তবে উত্তরাধিকার বর্তাবে তার পরের বড় ভাইয়ের উপর।

মিউজিয়ামের সামনের মাঠের ওপারে সরকারি হাই স্কুল এবং বড় একটা গির্জা। কাছেই একজন মিশনারীর সমাধি। ব্যবসা করতে আসা ইংরেজরা এদেশে শুধু রাজত্বের প্রসারই করেনি, করেছে ধর্ম প্রচার এবং প্রসারও। ১৮৯৪ সালের এক উত্তপ্ত গ্রীষ্মে স্যাভিজ এবং লরেইল নামের দু’জন মিশনারীর আগমনের মধ্য দিয়ে এই রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের যে যাত্রা শুরু হয়, মাত্র অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে তা পুরোপুরি সম্পূর্ণতায় পৌঁছায়। মিজোরমে এখন একক ধর্মের দেশ এবং সেই ধর্মটি হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্ম। একাশি সালের জনসংখ্যা অনুসারে মোট জনসংখ্যার শতকরা চুরাশি জন খ্রিস্টান। শতকরা ৮ জন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ৭ জন হিন্দু। মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা একেরও কম।

এখানে ছবি তোলার সময় রাস্তা অতিক্রমকারী দুই মিজো তরুণীকে অনুরোধ করতে তারা সাহাস্যে এসে দাঁড়াল ক্যামেরার সামনে। দেশে যেয়ে তাদের ছবি পাঠিয়ে দেব বলায় এক টুকরো কাগজে ঠিকানা লিখে দিল। এরপর নিচের রাস্তা দেখিয়ে সেদিকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে যা বলল তা আর বুঝতে পারিনে। একজনের সাহায্য নিয়ে জানতে পারলাম, নিচে তাদের দোকান আছে। সেখানে গেলে ছবি তোলার চার্জ দিয়ে দেবে। জানালাম, খরচ লাগবে না। এমনিতেই ছবি পাঠাব। ছবি ওঠাতে দেওয়ার জন্য বরং ধন্যবাদ। তরুণী দু’টি অবাক হলো। খুশিও।

না নেমে গাড়িতে বসেই দেখে নিলাম সার্কিট হাউস, রাজ্যভবন, এসেমব্লি হাউস ও ভিউ পয়েন্ট।

ফেরার পথে রাস্তার পাশে পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী আগ্রাসন প্রতিহত করতে যেয়ে নিহত মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের কবর। এরা সব ভারতীয়। পরিচ্ছন্নতা দেখে মনে হয় যত্ন নেয়া হয় প্রতিদিন।

পথে পড়ল বড়াবাজার। ওপর-নিচে দু’তিন ধাপে রাস্তার পাশে বাজার। দোকানে ভারতের বাজারে প্রাপ্য দ্রব্যসামগ্রী। রাস্তার ঢালে এক পাশে আয়তাকায় অনেকটা জায়গা নিয়ে কাঁচাবাজার। বেলা এগারোটা, কিন্তু বাজার প্রায় শেষ। লেবু, পেয়ারা, বরবটি, কচু ও কয়েক রকম শাক। বিক্রেতা শত ভাগ মহিলা। ক্রেতার হারও শতের কাছাকাছি। ছবি তোলার অনুমতি চাইতে সহাস্যে অনুমতি দেয়। স্কার্টের উপর টপ্্্স, প্যান্টের সঙ্গে হাফহাতা শার্ট কিংবা স্যান্ডো গেঞ্জি যেমন রয়েছে, তেমনি মহিলাদের পরনে রয়েছে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক স্কার্ট ধরনের কোমর জড়ানো ‘সিয়াপসুপ’। ঊর্ধ্বাংশে বড় হাতার ব্লাউজ, গেঞ্জি বা হাফশার্ট।

হোটেলে ফেরার পথে সঞ্চিত হলো এক বিরল অভিজ্ঞতা। শহর থেকে যে রাস্তাটি বেরিয়ে গেছে শিলচরের দিকে, সেই রাস্তায় দিন-দুপুরে ঘটল এক প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা। আকস্মিক কোনো কারণে পাহাড়ের উপরের দিক থেকে একাংশ ধসে পড়ছে। দূর থেকেও তার শব্দ শোনা যেতে থাকল। পাথর-মাটি ভেঙ্গে পড়েছে প্রথমে রাস্তা ও বাড়িঘরের উপর, এরপরে ধ্বসে পড়া অংশ ক্রমান্বয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকল নিচে। কিছুক্ষণ চলল ধ্বংসপ্রক্রিয়া। রাস্তার দু’দিকের চলমান গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল সার বেঁধে। বেশ দূরে, তাই তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতির পরিসংখ্যান জানতে পারলাম না। তবে চাক্ষুষভাবে দেখতে ও জানতে পারলাম পাহাড়ি শহরে বসবাসের ভীতিকর দুর্ঘটনার সম্ভাবনার দিকটি।

মিনিবাসে পুরো শহর চক্কর দেওয়ার জন্য ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মাঝ শহর জারকট থেকে উঠে ট্রেজারি স্কোয়ারের ঢালে মিনি বদলে ঘুরে ঘুরে একদম নিচে রেথেনভেনে নেমে চোখের সামনে পুরো শহরকে দেখলাম। কথাটা বোধ হয় সঠিক হলো না। পাহাড়ী শহর; পাহাড় চূড়া থেকে একদম নিচে পর্যন্ত নেমেছি আমরা। শহরতলীর বাড়িঘর এবং সামনের পাহাড়ের ওপিঠে আড়াল করা সূর্যের আভায় আইজল শহরের অন্যরূপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আইজল শহরের গড় উচ্চতা চার হাজার ফুট। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি সেখান থেকে শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় চূড়ার উচ্চতা প্রায় হাজার ফুট। কাছেই যুয়োলজিক্যাল গার্ডেন এবং চিড়িয়াখানা, কিস্তু এখন এই সন্ধ্যায় কে আর যায় সেদিকে।

আসার সময় বাসে পেয়েছি এক বাঙালি মুসলমান ভদ্রলোককে। বাসে নিজের পরিচয় দেননি। বাসযাত্রীরা নেমে কাছ এসে পরিচিত হন। তিনি বাংলাদেশের, চট্টগ্রামে বাড়ি। এখানে আছেন অনেক দিন। কাপড়ের দোকান আছে। তার কাছেই জানলাম আইজল থেকেও বাস যায় মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ইম্ফল। তাই তাকে সঙ্গে নিয়ে চললাম ইম্ফলগামী বাসের সন্ধানে। বেশি দূরে না তবে যা খবর পেলাম তা কোনো কাজে লাগলো না। হাটবারে বাস আসে। যেদিন আসে তার পরদিন ফিরে যায়। যেতে সময় নেয় পুরো দেড় দিন। পথ ভালো নয়, নিরাপদও নয়।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে। দোকানপাট আগেই বন্ধ হয়েছে। দেশি বাসযাত্রীর সতর্কবাণী শুনে মিনিবাসেই ফিরে এলাম হোটেলে। এ হোটেলে আবার খাবার নেই। তবে রাতে রাস্তা ভেঙ্গে খেতে যাওয়া লাগলো না আর থাকতে হলো না অভুক্ত। বিশেষ অনুরোধে পেলাম ডিম মামলেট এবং সেঁকা পাউরুটি। বোনাস হিসাবে খাঁটি দুধ এবং কফি বিন ভাঙা গরম কফি। আহ্ আর কী লাগে!

শুতে যাব এই সময়ে হোটেলের মালিক এলেন আমার সাথে কখা বলতে। সারাদিন তিনি বাইরে ছিলেন। আমিই নাকি তার হোটেলে প্রথম বাংলাদেশী কাস্টমার তাই তার কৌতূহল। তিনি কলকাতা, আগরতলা, শিলং গিয়েছেন আনেকবার কিন্তু বাংলাদেশে কখনো যাননি; এমনকি কোনো বাঙালির সঙ্গে পরিচয়ও হয়নি। পরিবারের সদস্যরা কম্বলের তলায় গেল আর আমাকে তিনি নিয়ে গেলেন মাথার উপরের তলায় তার বাসস্থানে। তার মেয়ে সেই সুস্বাদু কফি বানিয়ে এনে বসল বাবার গা ঘেঁষে। বুঝলাম সেও সমান কৌতূহলী। আমি তার কৌতূহল মেটালাম, তিনিও আমার।

পাহাড়ী রাজ্য মিজোরামের এক-তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল। রয়েছে হাজারের উপর আয়ুর্বেদিক ও ঔষুধি গাছ। আছে দুষ্প্রাপ্য অর্কিড ও বনজ ফুল। তাই মিজোরামকে বলা হয় ‘বোটানিক প্যারাডাইস’। প্রাকৃতিক সোন্দর্যমণ্ডিত দেশ হলেও পাহাড়ী শহর আইজলে পানির বড় সমস্যা। টিনের চালের সাথে প্লাস্টিকের পাইপ যুক্ত করে মিনি জলাধারে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করে রেখে প্রয়োজন মেটানো হয়।

মিজোরা খুব আমোদপ্রিয় জাতি। সারা বছরে তাদের তিনটি উৎসব, মিজো ভাষায় কূট মানে উৎসব। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ফসল তোলার উৎসব মুন কূট। মার্চে জুম কেটে ঘরে তোলার উৎসব হচ্ছে চ্যাপচুর কূট বা বসন্তোৎসব। ডিসেম্বরে পল কূট। এই সময় মিজোরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নাচে-গানে আকাশ-বাতাস মুখর করে তোলে। প্রতি উৎসবেই নাচ হচ্ছে প্রধান আনন্দ মাধ্যম। নাচের মধ্যে ‘চেরো’ বা বাঁশ নৃত্য প্রধান। চেরো এখন সারা ভারতেই জনপ্রিয়। মিজোরামে সুযোগ না পেলেও চেরো থেকে বঞ্চিত করেনি পরবর্তি গন্তব্য মনিপুরে। সেখানে তখন একটি সাংস্কৃতিক উৎসব চলছিল, মনিপুর সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. থোকচম ইবোহানবি আমস্ত্রিত অতিথি হিসাবে আমাদেরকে নিয়ে যান অনুষ্ঠানে এবং আমার পাশে বসে নাচ সমন্ধে অবহিত করেন। চেরো হচ্ছে দলবদ্ধ নাচ। সাধারণত এই নাচ হয় বড় মাঠে। একই সঙ্গে চার, ছয় বা আট দলে নাচ করে। প্রতি দলে থাকে আটজন তরুণ এবং নয় জন বা তার চেয়ে বেশি মেয়ে। প্রথমে চারজন চারজন করে আটজন ছেলে ঢোকে দুখণ্ড করে বাঁশ দুহাতে নিয়ে মুখোমুখি বসে। দুহাত দিয়ে দুটি বাঁশের একদিক ধরে, বিপরীতে দিকে বসা অন্য ছেলেটি ধরে বাঁশের অন্যপ্রান্ত। বাঁজনার তালেতালে মুখোমুখি দুজন দুটি বাঁশ প্রসারিত করে আবার শব্দ করে একত্রিত করে। নেপথ্যে বাঁশি ও বাজনার সাথে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সেজে নাচতে নাচতে ঢোকে তরুণীরা। চৌকো করে সাজানো বাঁশের মাঝে ঢুকে তালে তালে নাচতে থাকে। বাঁশি ও নেপথ্য সঙ্গীত, দুটি বাঁশের একত্র করার শব্দ এবং হাসি খুশি স্বাস্থ্যবতী তরুণীদের তালে তালে ও ঘুরে ঘুরে ছন্দোবদ্ধ নাচ দর্শকদের মোহিত করে।

পর পর দু’রাত গেছে বাসের সিটে। আজ সারা দিনও ঘোরাঘুরিতে। বেশ শীত,কম্বলে নাকমুখ ঢেকে নিলে ঘুমোতে অসুবিধা হলো না। এলার্ম দেওয়া ছিল তাই গভীর ঘুম শেষে ঠিকই জেগে উঠলাম খুব ভোরে।

ঠিক এক রাত এক দিন পাহাড়ী মানুষের দেশে কাটিয়ে আইজল ছাড়লাম ভোর সাড়ে ছ’টায়। জানালা দিয়ে শেষবারের মতো শহর দেখব তাতেও বাদ সাধলো কনডাকটর। কাচের জানালা বন্ধই ছিল, ভারি পর্দা টেনে দিয়ে বলল, ডর হ্যায়!

ছিয়াশি সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসে। প্রথমবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজ্যসভার চল্লিশটি আসনের সব ক’টি দখল করে তারা, কিন্তু মেয়াদকাল পূর্ণ করতে সমর্থ হয় না রাজনীতির কূটচালে। দ্বিতীয়বারে ইন্দিরা কংগ্রেস সব ক’টি আসনে জয়ী হয়। তারা পূর্ণ মেয়াদকাল পর্যন্ত বিধানসভা সক্রিয় রাখে। সর্বশেষ নির্বাচন হচ্ছে ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে। কোনোদলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। ইন্দরা দল পেয়েছে ষোলো, তাকে সমর্থনকারী মিজোরাম জনতা দল আট এবং এমএনএফ ও তার সহযোগী দল যথাক্রমে ‘আট ও দু’টি আসন। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি অব্যাহত থাকলেও চুক্তি স্বাক্ষরের আট বছর পরও শান্তি পুরোপুরি আসেনি। মিজোদের মধ্যে অশান্তি বিরাজ করছে। কেন্দ্রের উপর তারা সন্তুষ্ট নয়। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সন্ত্রাস ও উগ্রতায়।

শহর পার হলে কনডাক্টরের বিধি-নিষেধ উঠে গেল। পর্দা সরিয়ে অবলোকন করতে পারলাম প্রকৃতি। সলোমন্স কেভের ভেতর দিয়ে পাহাড় পেরুলাম। আড়াঅড়িভাবে। সূর্যের অকৃপণ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে পাহাড়ী পথ, দু’পাশের পাহাড় অরণ্য ও গিরিখাত। পাহাড়েরা পাশ ঘেঁষে পাকা রাস্তা। বিপরীত দিকে গভীর খাদ- এতই গভীর যে, সেখানে দৃষ্টি যায় না, সূর্যের আলোও। রাতের অন্ধকার এখনো বাসা বেঁধে রয়েছে। কিছুদূর যাওয়ার পর বাস দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছে কোনো জনপদ নেই থামার কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি, ড্রাইভার নেমে গেছে। সামনে আরো বাস-ট্রাক। অগত্যা নেমে বেশ কিছু দরে যেতে কারণ জানা গেল। আগের দিন একটি ট্রাক স্লিপ কেটে গড়িয়ে পড়েছিল, আজ শুরু হয়েছে তার উদ্ধার অভিযান। ট্রাকটি প্রায় শ’ ফুট নিচে গড়িয়ে একটি বড় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আটকে আছে। একদিকে মস্ত খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে বাঁধা হয়েছে ক্রেন ও উইঞ্চ মেশিন। দীর্ঘ স্টিল রোপ দিয়ে ট্রাকের সামনের দিকটা বেঁধে উদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টা চলছে ভোর থেকে। দু’দিকেই বাস-ট্রাক জমছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা দীর্ঘতর হতে থাকল। উদ্ধার অভিযানের কাছে বাসযাত্রীদের উপচে-পড়া ভিড়। এর ভেতর দুটি বাসে চলছে গিটার বাজিয়ে তুমুল গান গাওয়া। বাস ভর্তি কিশোর-কিশোরি। কান পাতলে বুঝতে পারি গাইছে ইংরেজিতে। একদল হাসি-খুশি উচ্ছল কিশোর-কিশোরীকে কাছে পেয়ে তাদের ক্যামেরাবন্দি করি। বয়সের ধর্মে তাদের হাসি উচ্ছলতা বেড়ে যায়। অল্প বয়সী সব ছেলে ছবি উঠাতে চায়। ভেবেছিলাম বনভোজনে নয়তো কোনো আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করে জানলাম তাঁরা যাচ্ছে গির্জায়। আজ রোববার, তাদের স্কুলের উপর দায়িত্ব পড়েছে ধর্মীয় সংগীত পরিবেশনের।

সামনের বাসে পেলাম এদের দলপতি শিক্ষককে, সিপাহির সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক। নাম সি লালরিঙটাঙ্গ। রাস্তা সচল হওয়ার অপেক্ষার সময়ে তার কাছ থেকে পেলাম শিক্ষাক্ষেত্রে মিজোদের অগ্রগতির এক অভূতপূর্ব চিত্র।

লন্ডনের আর্লিঙটন ব্যাপিস্ট মিশনের দু’জন মিশনারি এফ ডব্লিউ স্যভিজ এবং এ এইচ, লরেইন তখনকার জেলা সদর আইজলে আসে ১৮৯৪ সালে। এক বছরের মধ্যে তারা লুশাইদের আঞ্চলিক ভাষাকে রোমান হরফে লিখিত রূপ দেয়, স্থানীয়দের শিক্ষিত করে তুলতে সচেষ্ট হয়। ১৯০৩ সালে প্রথমবারের মতো লোয়ার প্রাইমারি পরীক্ষা নেয়া হয়। প্রথম এনট্রান্স পাস মিজো ছাত্রের নাম পুর আর ডি লেটা, ১৯১০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সে পরীক্ষা দেয়। এর চৌদ্দ বছর পরে ১৯১৪ সালে প্রথম গ্র্যাজুয়েট হয়। এরও একুশ বছর পরে প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রি গ্রহণ করে ১৯৪৫ সালে। প্রথম হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৪৪ সালে। এখন এই দেশটির শিক্ষা হার শুনলে বিশ্বাস হতে বাধে, শতকরা একাশি। আর ক’বছরেই তারা শতকরা একশ’ ভাগ শিক্ষিত হয়ে উঠবে। কারণ ১৯৮১ সালের আদমশুমারি অনুসারে তাদের শিক্ষার হার ছিল শতকরা ষাট। ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা একাশি।

নিজে লেখালেখি করি বলেই সাগ্রহে জানতে চাই মিজোরামের সাহিত্যচর্চার দিকটিও। তার কাছ থেকে জানতে পারি মিজোরামের লোকসংখ্যা প্রায় সাত লাখের কাছাকাছি (১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে লোকসংখ্যা ৬,৮৯,৭৫৬ জন)। মিজোরামে বিভিন্ন ভাষাভাষি উপজাতির সংখ্যা অনেক। পাঁচটি প্রধান উপজাতি হচ্ছে লুশাই, রালত, হ্যমার, পাত্তই ও পৈতে। অপ্রধান উপজাতির সংখ্যা আরো বারোটি। প্রধান উপজাতিসূহের মধ্যে আবার রয়েছে বহু সংখ্যক উপ-গোত্র। তাদের রয়েছে স্বতন্ত্র আঞ্চলিক ভাষা।

বর্তমানে মিজো ভাষা বলে যে ভাষা পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা আসলে লুশাইদের দুহলিয়ান নামের আঞ্চলিক ভাষা। সে ভাষা আন্তঃগোত্রের ভাষা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে ১৭৪০ সাল থেকে লাল্লুলা নামের এক সেইলো দলপতির দূরদর্শী প্রচেষ্টায়। মৈতৈ বা মণিপুরী ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তিব্বত-বর্মী গোষ্ঠীভুক্ত এই দুহলিয়ান আঞ্চলিক ভাষাকেই মিশনারিরা রোমান হরফে লেখ্য রূপ দেয়। প্রথম দিকে বাইবেলের অংশবিশেষ বা ধর্মীয় নীতি কথা লিখিত হতো। পরে রচিত ও লিখিত হলো ধর্মসঙ্গীত। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। লুশাই বা মিজো ভাষার অগ্রগতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একজন বাঙালির অবদান। তিনি হচ্ছেন আঠারো শতকের শেষ দিকে চট্টগ্রামে কর্মরত সরকারি মেডিকেল অফিসের ডা. ব্রজনাথ সাহা। তিনি লুশাই ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন। ধর্মীয় সঙ্গীতের পরে মিজো ভাষায় রচিত নিজস্ব বিষয় আসে তাদের পূর্বপুরুষ বীর যোদ্ধাদের কাহিনী এবং সম্প্রদায়গত সঙ্গীত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে লেখকদের রচনায় আসে ভালোবাসা এবং মানবিক বিষয়। মিজো ভাষাভাষি জনসংখ্যা স্বল্পতার কারণে সাহিত্য-পুস্তক কিংবা পত্রিকার প্রচার-সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। ফলে অনেক সময় বই বা পত্রিকা বের হয়ে সাইক্লোস্টাইল করে। প্রচারের প্রতিকূল অবস্থা এবং অত্যন্ত সীমিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মিজো লেখক জেম্স ডকুমা ১৯৮৫ সালে পেয়েছেন সাহিত্যের জন্য পদ্মশ্রী উপাধি, রেভারেন্ড লিয়াংখৈয়া পেয়েছেন মিজো সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার।

মিজোরা যে সঙ্গীতপ্রিয় এবং আনন্দ উপভোগে ক্লান্তিহীন, তার প্রমাণ পেলাম বাসের ছেলেমেয়েদের ক্রমাগত সঙ্গীত পরিবেশন দেখে। অপেক্ষার দীর্ঘ সময় তারা মাতিয়ে রাখল গিটার সহযোগে সমবেত কণ্ঠসগঙ্গীতে। একসময় বাস ছাড়ে। ডার্টলং, শিপাহির, লুঙডাই, বুয়ালপুই ইত্যাদি ছোট ছোট জনপদ হয়ে আমরা পৌঁছি যাই লাহফলানলো চেকপোস্টে। বাস প্রবেশ করে আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলায়। ভিড়-গরম, ধুলা- ঘিঞ্জি বসতি দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।

মেঘ ও পাহাড়ের মাখামাখি সঙ্গীতপ্রিয় মিজোদের দেশে আর কখনো কি যেতে পারব? কাছে গিয়েও দ্রুত উন্নতিশীল জনগোষ্ঠীকে ভালভাবে জানতে পারলাম না এই অতৃপ্তি বোধহয় বইতে হবে সারাজীবন। (সমাপ্ত)

বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৮ মাঘ ১৪২৭, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

ভ্রমণ

অভিমুখ পাহাড়ী মানুষের দেশ

ইশতিয়াক আলম

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ম্যাপ এবং গাইড বই পড়ে আগেই জেনেছি শহরের দেখার কী আছে, কোথায় এবং কোনদিকে তার অবস্থান। উত্তরে সবচেয়ে উঁচু হচ্ছে হ্যালি টিলা, তা ছাড়িয়ে চাঁদমারির শিরে ডার্টল্যান্ড হিল্স, দক্ষিণে খাটলা বাজার। পুবে নিচে বেথেলহেমে জুয়োলজিক্যাল গার্ডেন এবং চিড়িয়াখানা। শহরের দক্ষিণে বেশিরভাগ দর্শনীয় স্পট।

ঘণ্টা হিসাবে মিটিয়ে অমরা একটা উঠি টাটা সুমোতে। যে রাস্তাটা সামনে যেয়ে পাহাড়ে উঠেছে সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর যেতেই পাহাড়ের মাথায় সমতলে থামে। পৌঁছে গেলাম ম্যাকডোনাল্ড হিল্ শীর্ষে। ওপরটায় সমতল মাঠ। সেখানে ফুটবল খেলছে একদল স্কুল ছাত্র।

এখানেই মাঠের ডানে মিজোরাম স্টেট মিউজিয়াম, নতুন। ১৯৭৭ সালে যাত্রা শুরু করলেও ছ’তলা এ নতুন ভবনে এসেছে ১৯৮১-তে। চার তলা নিয়ে মিউজিয়াম। গ্যালারি সংখ্যা পাঁচ। মিউজিয়ামটিতে প্রতœতত্ত্ব এবং নৃতাত্বিক অনেক উপকরণ রয়েছে এক্সিবিট হিসাবে। রয়েছে প্রস্তর নির্মিত গৃহস্থালী দ্রব্যাদি, শিলালিপি, ফসিল, বিভিন্ন সময়ে আদিবাসীদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, দৈনন্দিন ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, প্রাচীন পদ্ধতিতে হাতে বোনা বস্ত্র, দলপতিদের পোশাক এবং বিচিত্র অলঙ্কার। রেপ্লিকার সাহায্যে দেখানো হয়েছে আদিম জীবনযাপন পদ্ধতি।

ঢোকার মুখে ধাতুর ঢালের উপর লেখা মিউজিয়ামের নাম ও উদ্বোধনের তথ্য। পাশে কাঠের ফ্রেমে ঝোলানো বিরাট ঢাক, যা বাজিয়ে তারা কখনো পাঠাতো সংবাদ, কখনো ব্যবহৃত হতো রণসঙ্গীত কিংবা সামাজিক নৃত্য উৎসবে সহযোগী যন্ত্র হিসাবে। তার পাশে এক শিলাপাথরের স্তম্ভ, আদিম কোনো গোত্রের বীরযোদ্ধার স্মরণে যা স্থাপিত হয়েছিল পাহাড়ে। ঢুকেই বাম দিকের ঘরে আদিবাসীদের ঘরের একাধিক মডেল। দলপতির বাড়ি এবং তরুণদের একত্রে বসবাসের জন্য ডর্মিটরি বা ‘জওলাবুক’। ‘জওল’ অর্থ চওড়া, বুক অর্থ অস্থায়ী বিশ্রামাগার। বার্মা থেকে যখন আদিবাসীরা দেশান্তরী হয়ে এদেশে আগমন করে তখন থেকে এর শুরু। মিজোদের সমাজজীবনে এই জওলাবুক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিজো বালকদের শৈশব কাটে এখানে। শরীরচর্চা, শিকার ও যুদ্ধের কৌশল শিক্ষা, সামাজিক রীতি-নীতি, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, শৃঙ্খলা সব কিছুরই শিক্ষা গ্রহণের জন্য অবস্থান করতে হয় এখানে। এমনকি বিয়ের পর প্রথম বছর কিংবা প্রথম সন্তান জন্ম গ্রহণ পর্যন্ত মিজো যুবকদের কাটে এই জওলাবুকে। প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণের পরে মিজো যুবক পৃথক ঘর করে স্বাবলম্বীভাবে বাস করা শুরু করে, কিন্তু সে যদি কনিষ্ঠ সন্তান হয়, তবে তাকে থাকতে হবে পিতামাতার সঙ্গে তাদের দেখাশোনা করবার জন্য এবং সে সন্তানই হবে পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার। পূর্বপুরুষের বাসগৃহটিও পাবে সে। যদি সে মারা যায় তবে উত্তরাধিকার বর্তাবে তার পরের বড় ভাইয়ের উপর।

মিউজিয়ামের সামনের মাঠের ওপারে সরকারি হাই স্কুল এবং বড় একটা গির্জা। কাছেই একজন মিশনারীর সমাধি। ব্যবসা করতে আসা ইংরেজরা এদেশে শুধু রাজত্বের প্রসারই করেনি, করেছে ধর্ম প্রচার এবং প্রসারও। ১৮৯৪ সালের এক উত্তপ্ত গ্রীষ্মে স্যাভিজ এবং লরেইল নামের দু’জন মিশনারীর আগমনের মধ্য দিয়ে এই রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের যে যাত্রা শুরু হয়, মাত্র অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে তা পুরোপুরি সম্পূর্ণতায় পৌঁছায়। মিজোরমে এখন একক ধর্মের দেশ এবং সেই ধর্মটি হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্ম। একাশি সালের জনসংখ্যা অনুসারে মোট জনসংখ্যার শতকরা চুরাশি জন খ্রিস্টান। শতকরা ৮ জন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ৭ জন হিন্দু। মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা একেরও কম।

এখানে ছবি তোলার সময় রাস্তা অতিক্রমকারী দুই মিজো তরুণীকে অনুরোধ করতে তারা সাহাস্যে এসে দাঁড়াল ক্যামেরার সামনে। দেশে যেয়ে তাদের ছবি পাঠিয়ে দেব বলায় এক টুকরো কাগজে ঠিকানা লিখে দিল। এরপর নিচের রাস্তা দেখিয়ে সেদিকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে যা বলল তা আর বুঝতে পারিনে। একজনের সাহায্য নিয়ে জানতে পারলাম, নিচে তাদের দোকান আছে। সেখানে গেলে ছবি তোলার চার্জ দিয়ে দেবে। জানালাম, খরচ লাগবে না। এমনিতেই ছবি পাঠাব। ছবি ওঠাতে দেওয়ার জন্য বরং ধন্যবাদ। তরুণী দু’টি অবাক হলো। খুশিও।

না নেমে গাড়িতে বসেই দেখে নিলাম সার্কিট হাউস, রাজ্যভবন, এসেমব্লি হাউস ও ভিউ পয়েন্ট।

ফেরার পথে রাস্তার পাশে পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী আগ্রাসন প্রতিহত করতে যেয়ে নিহত মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের কবর। এরা সব ভারতীয়। পরিচ্ছন্নতা দেখে মনে হয় যত্ন নেয়া হয় প্রতিদিন।

পথে পড়ল বড়াবাজার। ওপর-নিচে দু’তিন ধাপে রাস্তার পাশে বাজার। দোকানে ভারতের বাজারে প্রাপ্য দ্রব্যসামগ্রী। রাস্তার ঢালে এক পাশে আয়তাকায় অনেকটা জায়গা নিয়ে কাঁচাবাজার। বেলা এগারোটা, কিন্তু বাজার প্রায় শেষ। লেবু, পেয়ারা, বরবটি, কচু ও কয়েক রকম শাক। বিক্রেতা শত ভাগ মহিলা। ক্রেতার হারও শতের কাছাকাছি। ছবি তোলার অনুমতি চাইতে সহাস্যে অনুমতি দেয়। স্কার্টের উপর টপ্্্স, প্যান্টের সঙ্গে হাফহাতা শার্ট কিংবা স্যান্ডো গেঞ্জি যেমন রয়েছে, তেমনি মহিলাদের পরনে রয়েছে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক স্কার্ট ধরনের কোমর জড়ানো ‘সিয়াপসুপ’। ঊর্ধ্বাংশে বড় হাতার ব্লাউজ, গেঞ্জি বা হাফশার্ট।

হোটেলে ফেরার পথে সঞ্চিত হলো এক বিরল অভিজ্ঞতা। শহর থেকে যে রাস্তাটি বেরিয়ে গেছে শিলচরের দিকে, সেই রাস্তায় দিন-দুপুরে ঘটল এক প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা। আকস্মিক কোনো কারণে পাহাড়ের উপরের দিক থেকে একাংশ ধসে পড়ছে। দূর থেকেও তার শব্দ শোনা যেতে থাকল। পাথর-মাটি ভেঙ্গে পড়েছে প্রথমে রাস্তা ও বাড়িঘরের উপর, এরপরে ধ্বসে পড়া অংশ ক্রমান্বয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকল নিচে। কিছুক্ষণ চলল ধ্বংসপ্রক্রিয়া। রাস্তার দু’দিকের চলমান গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল সার বেঁধে। বেশ দূরে, তাই তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতির পরিসংখ্যান জানতে পারলাম না। তবে চাক্ষুষভাবে দেখতে ও জানতে পারলাম পাহাড়ি শহরে বসবাসের ভীতিকর দুর্ঘটনার সম্ভাবনার দিকটি।

মিনিবাসে পুরো শহর চক্কর দেওয়ার জন্য ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মাঝ শহর জারকট থেকে উঠে ট্রেজারি স্কোয়ারের ঢালে মিনি বদলে ঘুরে ঘুরে একদম নিচে রেথেনভেনে নেমে চোখের সামনে পুরো শহরকে দেখলাম। কথাটা বোধ হয় সঠিক হলো না। পাহাড়ী শহর; পাহাড় চূড়া থেকে একদম নিচে পর্যন্ত নেমেছি আমরা। শহরতলীর বাড়িঘর এবং সামনের পাহাড়ের ওপিঠে আড়াল করা সূর্যের আভায় আইজল শহরের অন্যরূপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আইজল শহরের গড় উচ্চতা চার হাজার ফুট। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি সেখান থেকে শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় চূড়ার উচ্চতা প্রায় হাজার ফুট। কাছেই যুয়োলজিক্যাল গার্ডেন এবং চিড়িয়াখানা, কিস্তু এখন এই সন্ধ্যায় কে আর যায় সেদিকে।

আসার সময় বাসে পেয়েছি এক বাঙালি মুসলমান ভদ্রলোককে। বাসে নিজের পরিচয় দেননি। বাসযাত্রীরা নেমে কাছ এসে পরিচিত হন। তিনি বাংলাদেশের, চট্টগ্রামে বাড়ি। এখানে আছেন অনেক দিন। কাপড়ের দোকান আছে। তার কাছেই জানলাম আইজল থেকেও বাস যায় মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ইম্ফল। তাই তাকে সঙ্গে নিয়ে চললাম ইম্ফলগামী বাসের সন্ধানে। বেশি দূরে না তবে যা খবর পেলাম তা কোনো কাজে লাগলো না। হাটবারে বাস আসে। যেদিন আসে তার পরদিন ফিরে যায়। যেতে সময় নেয় পুরো দেড় দিন। পথ ভালো নয়, নিরাপদও নয়।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে। দোকানপাট আগেই বন্ধ হয়েছে। দেশি বাসযাত্রীর সতর্কবাণী শুনে মিনিবাসেই ফিরে এলাম হোটেলে। এ হোটেলে আবার খাবার নেই। তবে রাতে রাস্তা ভেঙ্গে খেতে যাওয়া লাগলো না আর থাকতে হলো না অভুক্ত। বিশেষ অনুরোধে পেলাম ডিম মামলেট এবং সেঁকা পাউরুটি। বোনাস হিসাবে খাঁটি দুধ এবং কফি বিন ভাঙা গরম কফি। আহ্ আর কী লাগে!

শুতে যাব এই সময়ে হোটেলের মালিক এলেন আমার সাথে কখা বলতে। সারাদিন তিনি বাইরে ছিলেন। আমিই নাকি তার হোটেলে প্রথম বাংলাদেশী কাস্টমার তাই তার কৌতূহল। তিনি কলকাতা, আগরতলা, শিলং গিয়েছেন আনেকবার কিন্তু বাংলাদেশে কখনো যাননি; এমনকি কোনো বাঙালির সঙ্গে পরিচয়ও হয়নি। পরিবারের সদস্যরা কম্বলের তলায় গেল আর আমাকে তিনি নিয়ে গেলেন মাথার উপরের তলায় তার বাসস্থানে। তার মেয়ে সেই সুস্বাদু কফি বানিয়ে এনে বসল বাবার গা ঘেঁষে। বুঝলাম সেও সমান কৌতূহলী। আমি তার কৌতূহল মেটালাম, তিনিও আমার।

পাহাড়ী রাজ্য মিজোরামের এক-তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল। রয়েছে হাজারের উপর আয়ুর্বেদিক ও ঔষুধি গাছ। আছে দুষ্প্রাপ্য অর্কিড ও বনজ ফুল। তাই মিজোরামকে বলা হয় ‘বোটানিক প্যারাডাইস’। প্রাকৃতিক সোন্দর্যমণ্ডিত দেশ হলেও পাহাড়ী শহর আইজলে পানির বড় সমস্যা। টিনের চালের সাথে প্লাস্টিকের পাইপ যুক্ত করে মিনি জলাধারে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করে রেখে প্রয়োজন মেটানো হয়।

মিজোরা খুব আমোদপ্রিয় জাতি। সারা বছরে তাদের তিনটি উৎসব, মিজো ভাষায় কূট মানে উৎসব। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ফসল তোলার উৎসব মুন কূট। মার্চে জুম কেটে ঘরে তোলার উৎসব হচ্ছে চ্যাপচুর কূট বা বসন্তোৎসব। ডিসেম্বরে পল কূট। এই সময় মিজোরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নাচে-গানে আকাশ-বাতাস মুখর করে তোলে। প্রতি উৎসবেই নাচ হচ্ছে প্রধান আনন্দ মাধ্যম। নাচের মধ্যে ‘চেরো’ বা বাঁশ নৃত্য প্রধান। চেরো এখন সারা ভারতেই জনপ্রিয়। মিজোরামে সুযোগ না পেলেও চেরো থেকে বঞ্চিত করেনি পরবর্তি গন্তব্য মনিপুরে। সেখানে তখন একটি সাংস্কৃতিক উৎসব চলছিল, মনিপুর সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. থোকচম ইবোহানবি আমস্ত্রিত অতিথি হিসাবে আমাদেরকে নিয়ে যান অনুষ্ঠানে এবং আমার পাশে বসে নাচ সমন্ধে অবহিত করেন। চেরো হচ্ছে দলবদ্ধ নাচ। সাধারণত এই নাচ হয় বড় মাঠে। একই সঙ্গে চার, ছয় বা আট দলে নাচ করে। প্রতি দলে থাকে আটজন তরুণ এবং নয় জন বা তার চেয়ে বেশি মেয়ে। প্রথমে চারজন চারজন করে আটজন ছেলে ঢোকে দুখণ্ড করে বাঁশ দুহাতে নিয়ে মুখোমুখি বসে। দুহাত দিয়ে দুটি বাঁশের একদিক ধরে, বিপরীতে দিকে বসা অন্য ছেলেটি ধরে বাঁশের অন্যপ্রান্ত। বাঁজনার তালেতালে মুখোমুখি দুজন দুটি বাঁশ প্রসারিত করে আবার শব্দ করে একত্রিত করে। নেপথ্যে বাঁশি ও বাজনার সাথে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সেজে নাচতে নাচতে ঢোকে তরুণীরা। চৌকো করে সাজানো বাঁশের মাঝে ঢুকে তালে তালে নাচতে থাকে। বাঁশি ও নেপথ্য সঙ্গীত, দুটি বাঁশের একত্র করার শব্দ এবং হাসি খুশি স্বাস্থ্যবতী তরুণীদের তালে তালে ও ঘুরে ঘুরে ছন্দোবদ্ধ নাচ দর্শকদের মোহিত করে।

পর পর দু’রাত গেছে বাসের সিটে। আজ সারা দিনও ঘোরাঘুরিতে। বেশ শীত,কম্বলে নাকমুখ ঢেকে নিলে ঘুমোতে অসুবিধা হলো না। এলার্ম দেওয়া ছিল তাই গভীর ঘুম শেষে ঠিকই জেগে উঠলাম খুব ভোরে।

ঠিক এক রাত এক দিন পাহাড়ী মানুষের দেশে কাটিয়ে আইজল ছাড়লাম ভোর সাড়ে ছ’টায়। জানালা দিয়ে শেষবারের মতো শহর দেখব তাতেও বাদ সাধলো কনডাকটর। কাচের জানালা বন্ধই ছিল, ভারি পর্দা টেনে দিয়ে বলল, ডর হ্যায়!

ছিয়াশি সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসে। প্রথমবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজ্যসভার চল্লিশটি আসনের সব ক’টি দখল করে তারা, কিন্তু মেয়াদকাল পূর্ণ করতে সমর্থ হয় না রাজনীতির কূটচালে। দ্বিতীয়বারে ইন্দিরা কংগ্রেস সব ক’টি আসনে জয়ী হয়। তারা পূর্ণ মেয়াদকাল পর্যন্ত বিধানসভা সক্রিয় রাখে। সর্বশেষ নির্বাচন হচ্ছে ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে। কোনোদলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। ইন্দরা দল পেয়েছে ষোলো, তাকে সমর্থনকারী মিজোরাম জনতা দল আট এবং এমএনএফ ও তার সহযোগী দল যথাক্রমে ‘আট ও দু’টি আসন। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি অব্যাহত থাকলেও চুক্তি স্বাক্ষরের আট বছর পরও শান্তি পুরোপুরি আসেনি। মিজোদের মধ্যে অশান্তি বিরাজ করছে। কেন্দ্রের উপর তারা সন্তুষ্ট নয়। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সন্ত্রাস ও উগ্রতায়।

শহর পার হলে কনডাক্টরের বিধি-নিষেধ উঠে গেল। পর্দা সরিয়ে অবলোকন করতে পারলাম প্রকৃতি। সলোমন্স কেভের ভেতর দিয়ে পাহাড় পেরুলাম। আড়াঅড়িভাবে। সূর্যের অকৃপণ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে পাহাড়ী পথ, দু’পাশের পাহাড় অরণ্য ও গিরিখাত। পাহাড়েরা পাশ ঘেঁষে পাকা রাস্তা। বিপরীত দিকে গভীর খাদ- এতই গভীর যে, সেখানে দৃষ্টি যায় না, সূর্যের আলোও। রাতের অন্ধকার এখনো বাসা বেঁধে রয়েছে। কিছুদূর যাওয়ার পর বাস দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছে কোনো জনপদ নেই থামার কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি, ড্রাইভার নেমে গেছে। সামনে আরো বাস-ট্রাক। অগত্যা নেমে বেশ কিছু দরে যেতে কারণ জানা গেল। আগের দিন একটি ট্রাক স্লিপ কেটে গড়িয়ে পড়েছিল, আজ শুরু হয়েছে তার উদ্ধার অভিযান। ট্রাকটি প্রায় শ’ ফুট নিচে গড়িয়ে একটি বড় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আটকে আছে। একদিকে মস্ত খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে বাঁধা হয়েছে ক্রেন ও উইঞ্চ মেশিন। দীর্ঘ স্টিল রোপ দিয়ে ট্রাকের সামনের দিকটা বেঁধে উদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টা চলছে ভোর থেকে। দু’দিকেই বাস-ট্রাক জমছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা দীর্ঘতর হতে থাকল। উদ্ধার অভিযানের কাছে বাসযাত্রীদের উপচে-পড়া ভিড়। এর ভেতর দুটি বাসে চলছে গিটার বাজিয়ে তুমুল গান গাওয়া। বাস ভর্তি কিশোর-কিশোরি। কান পাতলে বুঝতে পারি গাইছে ইংরেজিতে। একদল হাসি-খুশি উচ্ছল কিশোর-কিশোরীকে কাছে পেয়ে তাদের ক্যামেরাবন্দি করি। বয়সের ধর্মে তাদের হাসি উচ্ছলতা বেড়ে যায়। অল্প বয়সী সব ছেলে ছবি উঠাতে চায়। ভেবেছিলাম বনভোজনে নয়তো কোনো আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করে জানলাম তাঁরা যাচ্ছে গির্জায়। আজ রোববার, তাদের স্কুলের উপর দায়িত্ব পড়েছে ধর্মীয় সংগীত পরিবেশনের।

সামনের বাসে পেলাম এদের দলপতি শিক্ষককে, সিপাহির সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক। নাম সি লালরিঙটাঙ্গ। রাস্তা সচল হওয়ার অপেক্ষার সময়ে তার কাছ থেকে পেলাম শিক্ষাক্ষেত্রে মিজোদের অগ্রগতির এক অভূতপূর্ব চিত্র।

লন্ডনের আর্লিঙটন ব্যাপিস্ট মিশনের দু’জন মিশনারি এফ ডব্লিউ স্যভিজ এবং এ এইচ, লরেইন তখনকার জেলা সদর আইজলে আসে ১৮৯৪ সালে। এক বছরের মধ্যে তারা লুশাইদের আঞ্চলিক ভাষাকে রোমান হরফে লিখিত রূপ দেয়, স্থানীয়দের শিক্ষিত করে তুলতে সচেষ্ট হয়। ১৯০৩ সালে প্রথমবারের মতো লোয়ার প্রাইমারি পরীক্ষা নেয়া হয়। প্রথম এনট্রান্স পাস মিজো ছাত্রের নাম পুর আর ডি লেটা, ১৯১০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সে পরীক্ষা দেয়। এর চৌদ্দ বছর পরে ১৯১৪ সালে প্রথম গ্র্যাজুয়েট হয়। এরও একুশ বছর পরে প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রি গ্রহণ করে ১৯৪৫ সালে। প্রথম হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৪৪ সালে। এখন এই দেশটির শিক্ষা হার শুনলে বিশ্বাস হতে বাধে, শতকরা একাশি। আর ক’বছরেই তারা শতকরা একশ’ ভাগ শিক্ষিত হয়ে উঠবে। কারণ ১৯৮১ সালের আদমশুমারি অনুসারে তাদের শিক্ষার হার ছিল শতকরা ষাট। ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা একাশি।

নিজে লেখালেখি করি বলেই সাগ্রহে জানতে চাই মিজোরামের সাহিত্যচর্চার দিকটিও। তার কাছ থেকে জানতে পারি মিজোরামের লোকসংখ্যা প্রায় সাত লাখের কাছাকাছি (১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে লোকসংখ্যা ৬,৮৯,৭৫৬ জন)। মিজোরামে বিভিন্ন ভাষাভাষি উপজাতির সংখ্যা অনেক। পাঁচটি প্রধান উপজাতি হচ্ছে লুশাই, রালত, হ্যমার, পাত্তই ও পৈতে। অপ্রধান উপজাতির সংখ্যা আরো বারোটি। প্রধান উপজাতিসূহের মধ্যে আবার রয়েছে বহু সংখ্যক উপ-গোত্র। তাদের রয়েছে স্বতন্ত্র আঞ্চলিক ভাষা।

বর্তমানে মিজো ভাষা বলে যে ভাষা পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা আসলে লুশাইদের দুহলিয়ান নামের আঞ্চলিক ভাষা। সে ভাষা আন্তঃগোত্রের ভাষা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে ১৭৪০ সাল থেকে লাল্লুলা নামের এক সেইলো দলপতির দূরদর্শী প্রচেষ্টায়। মৈতৈ বা মণিপুরী ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তিব্বত-বর্মী গোষ্ঠীভুক্ত এই দুহলিয়ান আঞ্চলিক ভাষাকেই মিশনারিরা রোমান হরফে লেখ্য রূপ দেয়। প্রথম দিকে বাইবেলের অংশবিশেষ বা ধর্মীয় নীতি কথা লিখিত হতো। পরে রচিত ও লিখিত হলো ধর্মসঙ্গীত। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। লুশাই বা মিজো ভাষার অগ্রগতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একজন বাঙালির অবদান। তিনি হচ্ছেন আঠারো শতকের শেষ দিকে চট্টগ্রামে কর্মরত সরকারি মেডিকেল অফিসের ডা. ব্রজনাথ সাহা। তিনি লুশাই ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন। ধর্মীয় সঙ্গীতের পরে মিজো ভাষায় রচিত নিজস্ব বিষয় আসে তাদের পূর্বপুরুষ বীর যোদ্ধাদের কাহিনী এবং সম্প্রদায়গত সঙ্গীত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে লেখকদের রচনায় আসে ভালোবাসা এবং মানবিক বিষয়। মিজো ভাষাভাষি জনসংখ্যা স্বল্পতার কারণে সাহিত্য-পুস্তক কিংবা পত্রিকার প্রচার-সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। ফলে অনেক সময় বই বা পত্রিকা বের হয়ে সাইক্লোস্টাইল করে। প্রচারের প্রতিকূল অবস্থা এবং অত্যন্ত সীমিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মিজো লেখক জেম্স ডকুমা ১৯৮৫ সালে পেয়েছেন সাহিত্যের জন্য পদ্মশ্রী উপাধি, রেভারেন্ড লিয়াংখৈয়া পেয়েছেন মিজো সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার।

মিজোরা যে সঙ্গীতপ্রিয় এবং আনন্দ উপভোগে ক্লান্তিহীন, তার প্রমাণ পেলাম বাসের ছেলেমেয়েদের ক্রমাগত সঙ্গীত পরিবেশন দেখে। অপেক্ষার দীর্ঘ সময় তারা মাতিয়ে রাখল গিটার সহযোগে সমবেত কণ্ঠসগঙ্গীতে। একসময় বাস ছাড়ে। ডার্টলং, শিপাহির, লুঙডাই, বুয়ালপুই ইত্যাদি ছোট ছোট জনপদ হয়ে আমরা পৌঁছি যাই লাহফলানলো চেকপোস্টে। বাস প্রবেশ করে আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলায়। ভিড়-গরম, ধুলা- ঘিঞ্জি বসতি দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।

মেঘ ও পাহাড়ের মাখামাখি সঙ্গীতপ্রিয় মিজোদের দেশে আর কখনো কি যেতে পারব? কাছে গিয়েও দ্রুত উন্নতিশীল জনগোষ্ঠীকে ভালভাবে জানতে পারলাম না এই অতৃপ্তি বোধহয় বইতে হবে সারাজীবন। (সমাপ্ত)