করোনা ক্ষমতার বৃত্ত চেনে না

এমএ কবীর

ক্ষমতার বৃত্তে থাকলে অন্য ঝুঁকি কিছুটা কম হলেও করোনার হাত থেকে রেহাই নেই। করোনা ক্ষমতার বৃত্ত চেনে না। রাজা-প্রজা সবাই তার কাছে সমান। ক’দিন পরপরই শুনতে পাই বাংলাদেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক এবং কানাডার জিডিপি ছাড়িয়ে যাচ্ছে! রাজা-উজিররা তো এরকম কথাই বলেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় শীর্ষ অবস্থানে থাকার খবরে আমাদের মন্ত্রী, সচিব, আমলা নিশ্চয়ই আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। মহামারীর ব্যাপকতা কিংবা এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে যে সার্বক্ষণিক নজরদারি কিংবা সতত সব ক্ষমতাকে মহামারী প্রতিরোধে নিয়োজিত রাখা প্রয়োজন, তাতে তারা অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

আমরা একদিকে করোনা টেস্ট করানোর জন্য ফিস ধার্য করেছি, অন্যদিকে মানুষজনকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করছি। সেই টিকা নিয়ে হুলুস্থুল কান্ড। প্রথম ডোজ নেয়ার ৪-৬ সপ্তাহ পর অহরহ মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। অনেকে মারা যাচ্ছেন। কেন এমন হচ্ছে? কোন স্টাডি আছে বাংলাদেশে? সাধারণ মানুষ উত্তর পাচ্ছে না। লোকজন ভ্যাকসিনের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে? কোন গবেষণা হচ্ছে? এসব করার কি সময় আছে? তারচেয়ে বরং লাইভ টকশোতে গিয়ে কথা বললে ভালো। বাস্তবে তাই হচ্ছে। মানুষ মারা পড়ছে। চিকিৎসা খরচ জোগাতে গিয়ে পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে।

করোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ-নিষেধের পরিপত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দিচ্ছে। তাদের কাছে তো এর বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত থাকার কথা নয়। চিকিৎসা পেশায় যারা নিয়োজিত একমাত্র তারাই এর উত্তর দিতে পারেন। এসব বিষয় তদারকি করার জন্য ১৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি রয়েছে। তারা কেন সামনে এগিয়ে আসছেন না? কেন সাংবাদিক সম্মেলনে আসছেন না? কেন মানুষের মনে জেগে ওঠা অসংখ্য প্রশ্নের কোনো জবাব দিচ্ছেন না?

বিশ্ব পরিসরে করোনার গতিপ্রকৃতি দেখে আমাদের বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্যবিদরাও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আভাস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণও দিয়েছেন, সেভাবে আগাম প্রস্তুতি ও জনগণকে সচেতন হওয়ার কথা বলেছেন। ততদিনে করোনার নতুন ধরন (যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা) আঘাত হানতে শুরু করেছে অথচ আমরা সচেতন হইনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যেখানে প্রতিনিয়তই কোভিড-১৯ জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শ সুপারিশ মেনে চলার কথা, সেটি হয়নি। এমনিতেই কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়েছে দেশে করোনার সংক্রমণের পর অনেক দেরিতে, তারপরও পরামর্শক কমিটিকে সবসময় সক্রিয় রাখা হয়নি। তাদের পরামর্শও আমলারা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে বৈজ্ঞানিক দিকটিই প্রধান, অথচ আমাদের এখানে প্রশাসনিক দিকটিই প্রধান হয়ে উঠেছে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় যে সব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে প্রতিপালনে গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়নি। মৃত্যু ও সংক্রমণ প্রতিদিন যখন রেকর্ড করছে তখন নির্দেশনা বা লকডাউন যেভাবে ঢিলেঢালা চলেছে তা সব মহল থেকে সমালোচিত হচ্ছে।

লকডাউন দেয়া হয়েছে অথচ কলকারখানা, দোকানপাট খোলা রাখা হয়েছে। আবার গণপরিবহন বন্ধ। লকডাউন ঘোষণার সিদ্ধান্ত শোনার পর ঢাকা ও বড় বড় শহর থেকে মানুষ যেভাবে বাড়ি, গ্রামে ছুটেছে তার ফল হয়েছে ভয়াবহ, সংক্রমণ সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখন প্রায় সব জেলাকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে।

মানুষ সংকটাপন্ন স্বজন নিয়ে হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন, কোথাও আইসিইউ, বেড খালি নেই, অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যুবরণ করছেন অনেকে। অসহায় মানুষ চিকিৎসার আশায় ছুটে চলেছেন, মিলছে না চিকিৎসা সেবাÑ এই পরিস্থিতি প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

সরকার করোনা চিকিৎসা সেবা উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে যেতে এবং জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করতে, অন্যান্য সরঞ্জামাদি, ওষুধ সহজলভ্য করতে সময় পেয়েছে। কিন্তু সে সময় যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয়নি।

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর সংক্রমণ যখন কমে আসছিল, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হলো, তখন থেকেই করোনার প্রতিরোধ প্রতিকারে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করা প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। এখনও দেশের জেলা ও বড় বড় নগরের হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানো হয়নি। মানুষ রোগী নিয়ে অক্সিজেনের জন্য ছোটাছুটি করছেন। জেলা-উপজেলা থেকে রোগী নিয়ে স্বজনরা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় নগরের দিকে ছুটছেন। জনগণের এ অবস্থায় করণীয় কি, তা বলে দেয়া হচ্ছে না। জেলা-উপজেলায় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা যথাযথ না থাকায় সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে।

করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শুধু সরকার বা প্রশাসনের নয়, এতে সামগ্রিকভাবে সব রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, তরুণদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ অথচ তারা জনগণকে সচেতন করতে সক্রিয় হননি।

রাজনৈতিক নেতারা দলীয় সমাবেশ অনুষ্ঠান করেছেন। গাদাগাদি করে কর্মী সমর্থকরা নেতাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করছেন, অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই, নেতারা কি এসব বিষয় করোনার জন্য যে বিপর্যয়কর তা কি খেয়াল করেননি? মানুষ ব্যাপকভাবে পর্যটন স্পটে ভিড় জমিয়েছে, বিয়ে-শাদী, সামাজিক অনুষ্ঠান, মানববন্ধন, সমাবেশ হয়েছে, কোথায়ও সচেতনতা দেখা যায়নি।

হোটেল রেস্টুরেন্টে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। নগরে তাই করোনার সংক্রমণ ধীরে ধীরে বেড়েছে, অবস্থা এমন হয়েছে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। প্রশাসন এই দীর্ঘসময়ে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে তেমন প্রচেষ্টাও নেয়নি।

লকডাউনের সময় কিছু পুলিশ এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চোখে পড়ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কেন লকডাউনের সময় নিয়োজিত করা হলো না সেটি বিশেষজ্ঞরা উত্থাপন করেছেন। সময় থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারলে, তা একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, জাতি ও জনগণের দুর্ভোগ সীমাহীন হয়ে ওঠে। এই করোনার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আরও প্রকট হয়েছে।

সরকার ৬৪টি জেলায় জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিবদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন দেখভালের, তা খুব একটা কাজে আসছে না। আমলারা করোনা প্রতিরোধে যার যার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন কি? পত্রিকান্তরে প্রকাশ, সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের অর্থ ৬ মাস ধরে বিপুল জনগোষ্ঠী পাচ্ছেন না, আবার করোনার সময় অসহায় দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার এক বড় অংশ অবণ্টিত রয়ে গেছে। সামনে কঠোর লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে, এ সময় দরিদ্র, নি¤œবিত্ত, দিন আনে দিন খাওয়া মানুষের জীবন কিভাবে চলবে যদি দ্রুত ত্রাণ ও অর্থ তাদের হাতে প্রযোজনমতো না পৌঁছায়।

রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় এই দুর্যোগে শুধু সরকারের সমালোচনা করে নিজেরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকেছে। পত্রিকা, টেলিভিশনে মতামত দিয়ে কর্তব্য শেষ করেছে।

আমাদের জাতীয় জীবনে এত দীর্ঘ সময় ধরে এত বড় দুর্যোগ আসেনি।

‘জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট’- এ উপলব্ধি জাগ্রত নেই কারও কাছে।

এ ভয়াবহ পরিস্থিতি আসার আগে বিশ্ব দূষণ রোধে বারবার সতর্ক করা হলেও মানুষ এতে কর্ণপাত করেনি এমনকি নিজেদের শারীরিক সুস্থতার জন্য চোখ, মুখ ঢেকে রাখতে বলা হলেও তা তারা থোড়াই কেয়ার করে। এরফলে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এসব রোগাক্রান্তের বেশিরভাগই হয়েছে পৃথিবীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্টকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের কারণে।

প্রকৃতির সঙ্গে পৃথিবীর মানুষের এমন বৈরী আচরণের জন্য প্রকৃতিও মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। কখনও ঘূর্ণিঝড়, কখনও বন্যা, আবার কখনও বা সুনামি দিয়ে মানুষের বিরুদ্ধে গেছে।

মানুষ এতকাল দেখেছে পরাশক্তিধর দেশগুলোর দাম্ভিক আচরণ। আর এখন দেখছে করোনাভাইরাসের দাম্ভিকতা। তবে প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কতটা অসহায়, এবার বিশ্ববাসী তার প্রমাণ পেয়েছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোন পরাশক্তিই টিকে থাকতে পারছে না। কোন আণবিক বোমা দিয়েও তাদের ধ্বংস করা সম্ভব হচ্ছে না। খোদ আমেরিকাতেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে হামলা করেনি করোনাভাইরাস। মৃত্যুর ঘটনা নেই এমন একটি রাষ্ট্রকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

যেসব মানবদেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তারাই আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা যাচ্ছেন। সুতরাং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এ সময়ের অন্যতম হাতিয়ার ইমিউনিটি বাড়ানো এবং সুরক্ষা। ভাইরাস প্রতিরোধে নির্দিষ্ট এবং চূড়ান্ত কোন ব্যবস্থা বিজ্ঞান এখনও দিতে পারেনি। টিকা এসেছে। তবে তা এখনো সর্বজনীন হতে পারেনি। বিজ্ঞান বলছে, এটিও নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিষেধক হিসেবে। অনেকাংশে সফল হিসেবে মেনে নিয়েছে বিশ্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকাই শেষ সমাধান নয়। সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাই সর্বোত্তম পন্থা।

শত্রু হিসেবে করোনাভাইরাস বেছে বেছে কাউকে আক্রমণ করবে না। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু দেশের প্রতিটি মানুষ। সুতরাং মানুষকেই তার নিজের স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে। কারো ওপর দায়ভার ছেড়ে দেয়াটাই হবে আত্মঘাতী।

[ লেখক : সাংবাদিক, ঝিনাইদহ ]

trynew70@gmail.com

শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল ২০২১ , ১৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৮ রমজান ১৪৪২

করোনা ক্ষমতার বৃত্ত চেনে না

এমএ কবীর

image

ক্ষমতার বৃত্তে থাকলে অন্য ঝুঁকি কিছুটা কম হলেও করোনার হাত থেকে রেহাই নেই। করোনা ক্ষমতার বৃত্ত চেনে না। রাজা-প্রজা সবাই তার কাছে সমান। ক’দিন পরপরই শুনতে পাই বাংলাদেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক এবং কানাডার জিডিপি ছাড়িয়ে যাচ্ছে! রাজা-উজিররা তো এরকম কথাই বলেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় শীর্ষ অবস্থানে থাকার খবরে আমাদের মন্ত্রী, সচিব, আমলা নিশ্চয়ই আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। মহামারীর ব্যাপকতা কিংবা এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে যে সার্বক্ষণিক নজরদারি কিংবা সতত সব ক্ষমতাকে মহামারী প্রতিরোধে নিয়োজিত রাখা প্রয়োজন, তাতে তারা অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

আমরা একদিকে করোনা টেস্ট করানোর জন্য ফিস ধার্য করেছি, অন্যদিকে মানুষজনকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করছি। সেই টিকা নিয়ে হুলুস্থুল কান্ড। প্রথম ডোজ নেয়ার ৪-৬ সপ্তাহ পর অহরহ মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। অনেকে মারা যাচ্ছেন। কেন এমন হচ্ছে? কোন স্টাডি আছে বাংলাদেশে? সাধারণ মানুষ উত্তর পাচ্ছে না। লোকজন ভ্যাকসিনের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে? কোন গবেষণা হচ্ছে? এসব করার কি সময় আছে? তারচেয়ে বরং লাইভ টকশোতে গিয়ে কথা বললে ভালো। বাস্তবে তাই হচ্ছে। মানুষ মারা পড়ছে। চিকিৎসা খরচ জোগাতে গিয়ে পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে।

করোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ-নিষেধের পরিপত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দিচ্ছে। তাদের কাছে তো এর বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত থাকার কথা নয়। চিকিৎসা পেশায় যারা নিয়োজিত একমাত্র তারাই এর উত্তর দিতে পারেন। এসব বিষয় তদারকি করার জন্য ১৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি রয়েছে। তারা কেন সামনে এগিয়ে আসছেন না? কেন সাংবাদিক সম্মেলনে আসছেন না? কেন মানুষের মনে জেগে ওঠা অসংখ্য প্রশ্নের কোনো জবাব দিচ্ছেন না?

বিশ্ব পরিসরে করোনার গতিপ্রকৃতি দেখে আমাদের বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্যবিদরাও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আভাস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণও দিয়েছেন, সেভাবে আগাম প্রস্তুতি ও জনগণকে সচেতন হওয়ার কথা বলেছেন। ততদিনে করোনার নতুন ধরন (যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা) আঘাত হানতে শুরু করেছে অথচ আমরা সচেতন হইনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যেখানে প্রতিনিয়তই কোভিড-১৯ জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শ সুপারিশ মেনে চলার কথা, সেটি হয়নি। এমনিতেই কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়েছে দেশে করোনার সংক্রমণের পর অনেক দেরিতে, তারপরও পরামর্শক কমিটিকে সবসময় সক্রিয় রাখা হয়নি। তাদের পরামর্শও আমলারা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে বৈজ্ঞানিক দিকটিই প্রধান, অথচ আমাদের এখানে প্রশাসনিক দিকটিই প্রধান হয়ে উঠেছে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় যে সব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে প্রতিপালনে গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়নি। মৃত্যু ও সংক্রমণ প্রতিদিন যখন রেকর্ড করছে তখন নির্দেশনা বা লকডাউন যেভাবে ঢিলেঢালা চলেছে তা সব মহল থেকে সমালোচিত হচ্ছে।

লকডাউন দেয়া হয়েছে অথচ কলকারখানা, দোকানপাট খোলা রাখা হয়েছে। আবার গণপরিবহন বন্ধ। লকডাউন ঘোষণার সিদ্ধান্ত শোনার পর ঢাকা ও বড় বড় শহর থেকে মানুষ যেভাবে বাড়ি, গ্রামে ছুটেছে তার ফল হয়েছে ভয়াবহ, সংক্রমণ সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখন প্রায় সব জেলাকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে।

মানুষ সংকটাপন্ন স্বজন নিয়ে হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন, কোথাও আইসিইউ, বেড খালি নেই, অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যুবরণ করছেন অনেকে। অসহায় মানুষ চিকিৎসার আশায় ছুটে চলেছেন, মিলছে না চিকিৎসা সেবাÑ এই পরিস্থিতি প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

সরকার করোনা চিকিৎসা সেবা উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে যেতে এবং জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করতে, অন্যান্য সরঞ্জামাদি, ওষুধ সহজলভ্য করতে সময় পেয়েছে। কিন্তু সে সময় যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয়নি।

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর সংক্রমণ যখন কমে আসছিল, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হলো, তখন থেকেই করোনার প্রতিরোধ প্রতিকারে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করা প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। এখনও দেশের জেলা ও বড় বড় নগরের হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানো হয়নি। মানুষ রোগী নিয়ে অক্সিজেনের জন্য ছোটাছুটি করছেন। জেলা-উপজেলা থেকে রোগী নিয়ে স্বজনরা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় নগরের দিকে ছুটছেন। জনগণের এ অবস্থায় করণীয় কি, তা বলে দেয়া হচ্ছে না। জেলা-উপজেলায় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা যথাযথ না থাকায় সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে।

করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শুধু সরকার বা প্রশাসনের নয়, এতে সামগ্রিকভাবে সব রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, তরুণদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ অথচ তারা জনগণকে সচেতন করতে সক্রিয় হননি।

রাজনৈতিক নেতারা দলীয় সমাবেশ অনুষ্ঠান করেছেন। গাদাগাদি করে কর্মী সমর্থকরা নেতাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করছেন, অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই, নেতারা কি এসব বিষয় করোনার জন্য যে বিপর্যয়কর তা কি খেয়াল করেননি? মানুষ ব্যাপকভাবে পর্যটন স্পটে ভিড় জমিয়েছে, বিয়ে-শাদী, সামাজিক অনুষ্ঠান, মানববন্ধন, সমাবেশ হয়েছে, কোথায়ও সচেতনতা দেখা যায়নি।

হোটেল রেস্টুরেন্টে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। নগরে তাই করোনার সংক্রমণ ধীরে ধীরে বেড়েছে, অবস্থা এমন হয়েছে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। প্রশাসন এই দীর্ঘসময়ে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে তেমন প্রচেষ্টাও নেয়নি।

লকডাউনের সময় কিছু পুলিশ এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চোখে পড়ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কেন লকডাউনের সময় নিয়োজিত করা হলো না সেটি বিশেষজ্ঞরা উত্থাপন করেছেন। সময় থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারলে, তা একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, জাতি ও জনগণের দুর্ভোগ সীমাহীন হয়ে ওঠে। এই করোনার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আরও প্রকট হয়েছে।

সরকার ৬৪টি জেলায় জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিবদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন দেখভালের, তা খুব একটা কাজে আসছে না। আমলারা করোনা প্রতিরোধে যার যার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন কি? পত্রিকান্তরে প্রকাশ, সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের অর্থ ৬ মাস ধরে বিপুল জনগোষ্ঠী পাচ্ছেন না, আবার করোনার সময় অসহায় দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার এক বড় অংশ অবণ্টিত রয়ে গেছে। সামনে কঠোর লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে, এ সময় দরিদ্র, নি¤œবিত্ত, দিন আনে দিন খাওয়া মানুষের জীবন কিভাবে চলবে যদি দ্রুত ত্রাণ ও অর্থ তাদের হাতে প্রযোজনমতো না পৌঁছায়।

রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় এই দুর্যোগে শুধু সরকারের সমালোচনা করে নিজেরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকেছে। পত্রিকা, টেলিভিশনে মতামত দিয়ে কর্তব্য শেষ করেছে।

আমাদের জাতীয় জীবনে এত দীর্ঘ সময় ধরে এত বড় দুর্যোগ আসেনি।

‘জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট’- এ উপলব্ধি জাগ্রত নেই কারও কাছে।

এ ভয়াবহ পরিস্থিতি আসার আগে বিশ্ব দূষণ রোধে বারবার সতর্ক করা হলেও মানুষ এতে কর্ণপাত করেনি এমনকি নিজেদের শারীরিক সুস্থতার জন্য চোখ, মুখ ঢেকে রাখতে বলা হলেও তা তারা থোড়াই কেয়ার করে। এরফলে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এসব রোগাক্রান্তের বেশিরভাগই হয়েছে পৃথিবীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্টকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের কারণে।

প্রকৃতির সঙ্গে পৃথিবীর মানুষের এমন বৈরী আচরণের জন্য প্রকৃতিও মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। কখনও ঘূর্ণিঝড়, কখনও বন্যা, আবার কখনও বা সুনামি দিয়ে মানুষের বিরুদ্ধে গেছে।

মানুষ এতকাল দেখেছে পরাশক্তিধর দেশগুলোর দাম্ভিক আচরণ। আর এখন দেখছে করোনাভাইরাসের দাম্ভিকতা। তবে প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কতটা অসহায়, এবার বিশ্ববাসী তার প্রমাণ পেয়েছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোন পরাশক্তিই টিকে থাকতে পারছে না। কোন আণবিক বোমা দিয়েও তাদের ধ্বংস করা সম্ভব হচ্ছে না। খোদ আমেরিকাতেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে হামলা করেনি করোনাভাইরাস। মৃত্যুর ঘটনা নেই এমন একটি রাষ্ট্রকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

যেসব মানবদেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তারাই আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা যাচ্ছেন। সুতরাং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এ সময়ের অন্যতম হাতিয়ার ইমিউনিটি বাড়ানো এবং সুরক্ষা। ভাইরাস প্রতিরোধে নির্দিষ্ট এবং চূড়ান্ত কোন ব্যবস্থা বিজ্ঞান এখনও দিতে পারেনি। টিকা এসেছে। তবে তা এখনো সর্বজনীন হতে পারেনি। বিজ্ঞান বলছে, এটিও নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিষেধক হিসেবে। অনেকাংশে সফল হিসেবে মেনে নিয়েছে বিশ্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকাই শেষ সমাধান নয়। সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাই সর্বোত্তম পন্থা।

শত্রু হিসেবে করোনাভাইরাস বেছে বেছে কাউকে আক্রমণ করবে না। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু দেশের প্রতিটি মানুষ। সুতরাং মানুষকেই তার নিজের স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে। কারো ওপর দায়ভার ছেড়ে দেয়াটাই হবে আত্মঘাতী।

[ লেখক : সাংবাদিক, ঝিনাইদহ ]

trynew70@gmail.com