উন্নয়নের নতুন অভিযাত্রা

আনু মাহমুদ

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে এ উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) বৈঠকে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সুপারিশ প্রাপ্ত হলো।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নতুন মাইলফলক অর্জন করল দেশ। জাতিসংঘের বিচারে চূড়ান্তভাবে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়নের নতুন অভিযাত্রা শুরু হলো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জন্য যা এক অনন্য অর্জন। বিশেষ এ স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের শ্রেণী থেকে বেরিয়ে আসবে।

প্রথম দফায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রথমবারের মতো এবারও তিনটি সূচকেই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করেছে। সরকারের নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা জাতিসংঘের এ স্বীকৃতিকে উন্নয়নের যাত্রায় বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন। তবে এর জন্য সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।

এলডিসি থেকে বের হতে সিডিপির পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পেতে হয়। স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রস্তুতির জন্য সাধারণত তিন বছর এলডিসি হিসেবে থাকে একটি দেশ। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সম্প্রতি এ বিষয়ক এক্সপোর্ট গ্রুপের সভায় প্রস্তুতির জন্য সময় তিন বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করার আহ্বান জানিয়েছে। উত্তরণ প্রক্রিয়াকে মসৃণ ও টেকসই করা এবং করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বাড়তি দু’বছর সময় চায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে সিডিপি।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর সুবিধার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে। উন্নয়নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে। বাংলাদেশের বড় ধরনের ব্র্যান্ডিং হবে। এখানকার অর্থনীতি উদীয়মান, বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছে- এমন বার্তা বিশ্ববাসী পাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম শর্ত হলো অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হওয়া। বাংলাদেশ এ শর্ত পূরণ করতে পেরেছে; মানে অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম ঝুঁকি রয়েছে। এসব বিষয় বিনিয়োগকারীদের উপলব্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অন্যদিকে এলডিসি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধাসহ অন্যান্য যেসব অগ্রাধিকার পায়, তা থাকবে না। সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণ কমে যাবে। ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক আইনকানুনের অব্যাহতি থাকবে না। কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে।

বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারগুলোতে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তিন বছর রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হবে। সে অনুযায়ী ইইউর বাজারে ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। ইইউর বাইরে অন্যান্য দেশে ২০২৬ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। করোনার কারণে এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর কয়েক বছর এ সুবিধা যাতে অব্যাহত থাকে সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে তদবির করছে। বাংলাদেশসহ উত্তরণ প্রক্রিয়ায় থাকা দেশগুলোর এ সুবিধার জন্য সিডিপিও সুপারিশ করেছে।

সিডিপি তিনটি সূচকের মানের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা মূল্যায়ন করে। সূচকগুলো হচ্ছেÑ মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই প্রয়োজনীয় মান অর্জন করে। এ বছর পর্যালোচনার মানদন্ডে আন্তর্জাতিক পদ্ধতির হিসাবে গড় মাথাপিছু আয়ের প্রয়োজন এক হাজার ২২২ ডলার। গত বছর শেষে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা তার বেশি স্কোর থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ২০২০ সাল থেকে স্কোর দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ৩। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পয়েন্ট রয়েছে বাংলাদেশের। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা তার কম স্কোর থাকতে হবে। বাংলাদেশের স্কোর ২৭ দশমিক ৩। তিনটি সূচকেই আগের মতো এবারো উত্তীর্ণ হয়েছে, যা সচরাচর দেখা যায় না। বাংলাদেশসহ ৪৬টি দেশ এখন এলডিসির তালিকায় রয়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেসরকারি খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। একই সঙ্গে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠান বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবহন, বন্দর, আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জালানি সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়]

anumahmud@yahoo.com

শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল ২০২১ , ১৮ বৈশাখ ১৪২৮ ১৮ রমজান ১৪৪২

উন্নয়নের নতুন অভিযাত্রা

আনু মাহমুদ

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে এ উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) বৈঠকে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সুপারিশ প্রাপ্ত হলো।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নতুন মাইলফলক অর্জন করল দেশ। জাতিসংঘের বিচারে চূড়ান্তভাবে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়নের নতুন অভিযাত্রা শুরু হলো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জন্য যা এক অনন্য অর্জন। বিশেষ এ স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের শ্রেণী থেকে বেরিয়ে আসবে।

প্রথম দফায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রথমবারের মতো এবারও তিনটি সূচকেই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করেছে। সরকারের নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা জাতিসংঘের এ স্বীকৃতিকে উন্নয়নের যাত্রায় বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন। তবে এর জন্য সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।

এলডিসি থেকে বের হতে সিডিপির পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পেতে হয়। স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রস্তুতির জন্য সাধারণত তিন বছর এলডিসি হিসেবে থাকে একটি দেশ। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সম্প্রতি এ বিষয়ক এক্সপোর্ট গ্রুপের সভায় প্রস্তুতির জন্য সময় তিন বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করার আহ্বান জানিয়েছে। উত্তরণ প্রক্রিয়াকে মসৃণ ও টেকসই করা এবং করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বাড়তি দু’বছর সময় চায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে সিডিপি।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর সুবিধার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে। উন্নয়নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে। বাংলাদেশের বড় ধরনের ব্র্যান্ডিং হবে। এখানকার অর্থনীতি উদীয়মান, বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছে- এমন বার্তা বিশ্ববাসী পাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম শর্ত হলো অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হওয়া। বাংলাদেশ এ শর্ত পূরণ করতে পেরেছে; মানে অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম ঝুঁকি রয়েছে। এসব বিষয় বিনিয়োগকারীদের উপলব্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অন্যদিকে এলডিসি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধাসহ অন্যান্য যেসব অগ্রাধিকার পায়, তা থাকবে না। সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণ কমে যাবে। ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক আইনকানুনের অব্যাহতি থাকবে না। কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে।

বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারগুলোতে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তিন বছর রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হবে। সে অনুযায়ী ইইউর বাজারে ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। ইইউর বাইরে অন্যান্য দেশে ২০২৬ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। করোনার কারণে এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর কয়েক বছর এ সুবিধা যাতে অব্যাহত থাকে সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে তদবির করছে। বাংলাদেশসহ উত্তরণ প্রক্রিয়ায় থাকা দেশগুলোর এ সুবিধার জন্য সিডিপিও সুপারিশ করেছে।

সিডিপি তিনটি সূচকের মানের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা মূল্যায়ন করে। সূচকগুলো হচ্ছেÑ মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই প্রয়োজনীয় মান অর্জন করে। এ বছর পর্যালোচনার মানদন্ডে আন্তর্জাতিক পদ্ধতির হিসাবে গড় মাথাপিছু আয়ের প্রয়োজন এক হাজার ২২২ ডলার। গত বছর শেষে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা তার বেশি স্কোর থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ২০২০ সাল থেকে স্কোর দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ৩। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পয়েন্ট রয়েছে বাংলাদেশের। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা তার কম স্কোর থাকতে হবে। বাংলাদেশের স্কোর ২৭ দশমিক ৩। তিনটি সূচকেই আগের মতো এবারো উত্তীর্ণ হয়েছে, যা সচরাচর দেখা যায় না। বাংলাদেশসহ ৪৬টি দেশ এখন এলডিসির তালিকায় রয়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেসরকারি খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। একই সঙ্গে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠান বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবহন, বন্দর, আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জালানি সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়]

anumahmud@yahoo.com