দশ কারণে ৩০ বছরে চার শতাধিক নৌ-দুর্ঘটনা

নৌযানে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ও অদক্ষ চালকসহ ১০টি কারণে গত ৩০ বছরে ৪ শতাধিক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪ হাজারের অধিক মানুষ নিহত হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীতে বালুবাহী নৌযান ও যাত্রীবাহী স্পিডবোটের মধ্যে সংঘর্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছে। এর আগে গত ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের কয়লাঘাট এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গোর ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে যায়।

এতে ৩৪ যাত্রী নিহত হয়েছে।

জানা গেছে, নৌযানে ত্রুটিপূর্ণ নকশা প্রণয়ন ও অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে নৌযান নির্মাণ, অবকাঠামোগত ও যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস প্রদান, অদক্ষ মাস্টার ও ড্রাইভার দিয়ে নৌযান পরিচালনা, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্যবোঝাই করে অবৈধ নৌযান চলাচল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস যথাযথভাবে অনুসরণ না করাসহ একাধিক কারণে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে ২০১৪ সালে পদ্মা নদীর মাওয়া ঘাটে ডুবে যাওয়া এমএল পিনাক-৬টি আবহাওয়া পূর্বাভাস অমান্য করে পদ্মা পাড়ি দিয়েছিল। ফিটনেস না থাকার পরও এই লঞ্চটিকে টোকেনের (সিøপের) মাধ্যমে সাময়িক চলাচলের অনুমতি নেয়া হয়েছিল বলে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়। এছাড়া নৌপথে দিক-নির্দেশক বিকন ও বয়াবাতি না থাকা, নাব্য সংকট ও ডুবোচর, নৌপথে কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখা এবং আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে একাধিক লঞ্চ দুর্ঘটনায় শিকার হয়েছে। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক সংবাদকে বলেন, নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নৌ-পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি কিন্তু তারপরও চালকদের অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। বর্তমানে লকডাউনের কারণে নৌপথে সব ধরনের যাত্রী পারাপার বন্ধ রয়েছে কিন্তু তারপরও অনেকে লুকিয়ে স্পিডবোট ও ট্রলারের মাধ্যমে যাত্রী পারাপার করে থাকে। মাদারীপুরের শিবচরে একইভাবে যাত্রী পারাপার করেছিল স্পিডবোটটি। এই দুর্ঘটনায় বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

নৌ-দুর্ঘটনার ১০ কারণ

অদক্ষ মাস্টার ও ড্রাইভার (চালক) নিয়োগও দুর্ঘটনায় অন্যতম কারণ। অনেক সময় দেখা যায়, বৈধ নৌযানও অদক্ষ-অপেশাদার মাস্টার-ড্রাইভার দ্বারা পরিচালিত। এর ফলেও ঘটে দুর্ঘটনা। ২০১২ সালের ১২ মার্চ মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে নিমজ্জিত হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি শরীয়তপুর-১; এই দুর্ঘটনার পর উদ্ধার করা হয় ১৪৭টি লাশ। এই ট্র্যাজেডির পর সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দুর্ঘটনাকবলিত দোতলা লঞ্চটির মাস্টার ও ড্রাইভারের নাম লঞ্চমালিক নিজেই বলতে পারেননি বলে তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়।

অবৈধ নৌযানও দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। ২০১৪ সালের ১৫ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে এমভি মিরাজ-৪ এবং এর মাত্র ১২ দিন আগে ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপায় রামদাবাদ নদীতে দুর্ঘটনায় পড়ে এমভি শাতিল-১। দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নথিপত্র যাচাই, লঞ্চ দুটির নকশা ও অবকঠামো পরীক্ষা এবং তদন্ত কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে জানা গেছে, যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও এ দুটি যাত্রীবাহী নৌযানকে ফিটনেস সনদ দেয়া হয়েছিল। অবকাঠামোগত মারাত্মক ত্রুটির কারণেই সামান্য কালবৈশাখী ঝড়ের আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে লঞ্চ দুটি ডুবে যায়।

এছাড়া এমভি মিরাজ-৪ ও এমভি শাতিল-১- দুটি লঞ্চেই ছিলেন অদক্ষ মাস্টার। তারা আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও তাৎক্ষণিক ঘূর্ণিঝড় উপেক্ষা করে নৌযান দুটি চালাচ্ছিলেন। অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ ইনল্যান্ড সিপিং অর্ডিন্যান্স (আইএসও)- ১৯৭৬-এর অধীনে প্রণীত বিধি অনুযায়ী, নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ এবং মাস্টার ও ড্রাইভারের সনদ যাচাই এবং যাত্রীসংখ্যা গণনার পরই সেটি ছাড়ার অনুমতি দেয়ার (ভয়েজ ডিক্লারেশন) বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর বন্দর এবং নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক (নৌ-নিট্রা) বিভাগের কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্দর কর্মকর্তা ও ট্রাফিক ইন্সপেক্টররা (টিআই) এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

অবৈধ নৌযান চলাচল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, নৌপথে দিক-নির্দেশক বিকন ও বয়াবাতি না থাকা, নাব্য সংকট ও ডুবোচর, নৌপথে কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখা এবং আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে লঞ্চ দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে থাকে। অনেক দুর্ঘটনার জন্য বালুবাহী নৌযানই বেশি দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুরের মতলব যাওয়ার পথে মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদীতে নিমজ্জিত হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি সারস। এটি মিথিলা ফারজানা নামের বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় ডুবে যায়। এতে ১৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়। লঞ্চে প্রয়োজনীয়সংখ্যক জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম লাইফ জ্যাকেট, লাইফবয়া, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা, এগুলো খোঁজ নেয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কিন্তু তাও সঠিকভাবে কর্মকর্তারা তত্ত্বাবধায়ন করছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়।

৩০ বছরে প্রায় এক হাজারের অধিক নৌ-দুর্ঘটনা

বেসরকারি হিসাবে গত ৩০ বছরে ১ হাজারের অধিক ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত গত ৩ বছরে নৌপথে ৬০১টি ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনায় ৭৭৩ জন নিহত, ৯১২ জন আহত ও ১ হাজার ১৬৬ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালে ১৫৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১২৬ জন নিহত, ২৩৪ জন আহত ৩৮৭ জন নিখোঁজ হয়। ২০১৯ সালে ২০৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত, ২৮২ জন আহত, ৩৭৫ জন নিখোঁজ হয়। ২০২০ সালে লকডাউনের মধ্যেও ১৮৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩১৩ জন নিহত, ৩৪২ জন আহত, ৩৭১ জন নিখোঁজ হয়। চলতি বছরে জানুয়ারি মাসে ১৭টি ছোট বড় নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত, ১৩ জন আহত, ১১ জন নিখোঁজ হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২৫ জন নিহত, ১৯ জন আহত, ১৭ জন নিখোঁজ হয়। মার্চ মাসে ১০টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত ১৩ জন আহত, ৩ জন নিখোঁজ হয়। লকডাউনের এপ্রিল মাসে ১৪টি দুর্ঘটনায় ৩৮ জন নিহত, ৯ জন আহত, ২ জন নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। তবে ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৪ সালে আগস্ট পর্যন্ত ৩৯৩টি লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬১৩ জন লোক নিহত হয়েছেন বলে নৌ-মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ৪৭৯ জন আহত এবং নিখোঁজ রয়েছে প্রায় ৪৬২ জন মানুষ। সবচেয়ে বেশি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে ২০০১ সালে। সে বছর এর সংখ্যা ছিল ৩১টি। ২০০৫ সালে নৌ-দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২৮টি, ২০০২ সালে ২৬টি ও ২০০৩ সালে ২৩টি আর ২০টি করে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০৪ ও ২০০৬ সালে। ১৯টি করে দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৯১ ও ২০০০ সালে। ১৯৯২ সালে ১৭টি, ২০১০ সালে ১৬টি ও ২০১২ সালে ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটে। এই নৌ-দুর্ঘটনার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মামলা করে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। গত দুই যুগে ৩১০টি মামলা করা হয়েছে। ২০০১ সালে সবচেয়ে বেশি মামলা হয় ২৯টি। এর মধ্যে ২২টি মামলায় শাস্তি হয়। বাকি ৭টি মামলা খারিজ হয়। ২০০২ সালে মামলা হয় ২৩টি, যার মধ্যে ১৯টিতে শাস্তি হয়। ২০০৩ সালে ২১টির মামলার মধ্যে ১৬টিতে ও ২০০৫ সালে ২০টির মধ্যে ১৮টিতে দায়ীদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা ও ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে মেরিন কোর্টে। তবে আবার আপিল বিভাগে গিয়ে স্থগিত করে নিয়ে আসে আসামিরা।

image

শিবচর : স্পিডবোটের বেপরোয়াপনায় দুর্ঘটনায় পুরো পরিবার হারালো ৯ বছরের শিশু মিম, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে খুলনার তেরখাদা উপজেলায় বাড়ি যাচ্ছিল মিম, তাকে উদ্ধার করা হয় সময়মতো। মিমকে কোলে নিয়ে সান্ত¡না দিচ্ছেন উপজেলা কর্মকর্তা -সংবাদ

আরও খবর
শিবচরে বাল্কহেডে ধাক্কা : ২৬ লাশ উদ্ধার
৯ বছরের মিমকে বইতে হলো বাবা-মা ও দু’বোনের লাশ
শ্বাসকষ্ট বেড়েছে সিসিইউতে খালেদা জিয়া
লকডাউন বাড়লো ১৬ মে পর্যন্ত
তৃতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী পদে কাল শপথ নিচ্ছেন মমতা
চীনের ৫ লাখ ডোজ ১০ মে’র মধ্যে আসতে পারে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সংক্রমণ ৯ শতাংশের নিচে
দেশে ৮৮ লাখের বেশি ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া শেষ

মঙ্গলবার, ০৪ মে ২০২১ , ২২ বৈশাখ ১৪২৮ ২২ রমজান ১৪৪২

দশ কারণে ৩০ বছরে চার শতাধিক নৌ-দুর্ঘটনা

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

শিবচর : স্পিডবোটের বেপরোয়াপনায় দুর্ঘটনায় পুরো পরিবার হারালো ৯ বছরের শিশু মিম, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে খুলনার তেরখাদা উপজেলায় বাড়ি যাচ্ছিল মিম, তাকে উদ্ধার করা হয় সময়মতো। মিমকে কোলে নিয়ে সান্ত¡না দিচ্ছেন উপজেলা কর্মকর্তা -সংবাদ

নৌযানে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ও অদক্ষ চালকসহ ১০টি কারণে গত ৩০ বছরে ৪ শতাধিক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪ হাজারের অধিক মানুষ নিহত হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীতে বালুবাহী নৌযান ও যাত্রীবাহী স্পিডবোটের মধ্যে সংঘর্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছে। এর আগে গত ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের কয়লাঘাট এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গোর ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে যায়।

এতে ৩৪ যাত্রী নিহত হয়েছে।

জানা গেছে, নৌযানে ত্রুটিপূর্ণ নকশা প্রণয়ন ও অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে নৌযান নির্মাণ, অবকাঠামোগত ও যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস প্রদান, অদক্ষ মাস্টার ও ড্রাইভার দিয়ে নৌযান পরিচালনা, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্যবোঝাই করে অবৈধ নৌযান চলাচল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস যথাযথভাবে অনুসরণ না করাসহ একাধিক কারণে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে ২০১৪ সালে পদ্মা নদীর মাওয়া ঘাটে ডুবে যাওয়া এমএল পিনাক-৬টি আবহাওয়া পূর্বাভাস অমান্য করে পদ্মা পাড়ি দিয়েছিল। ফিটনেস না থাকার পরও এই লঞ্চটিকে টোকেনের (সিøপের) মাধ্যমে সাময়িক চলাচলের অনুমতি নেয়া হয়েছিল বলে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়। এছাড়া নৌপথে দিক-নির্দেশক বিকন ও বয়াবাতি না থাকা, নাব্য সংকট ও ডুবোচর, নৌপথে কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখা এবং আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে একাধিক লঞ্চ দুর্ঘটনায় শিকার হয়েছে। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক সংবাদকে বলেন, নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নৌ-পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি কিন্তু তারপরও চালকদের অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। বর্তমানে লকডাউনের কারণে নৌপথে সব ধরনের যাত্রী পারাপার বন্ধ রয়েছে কিন্তু তারপরও অনেকে লুকিয়ে স্পিডবোট ও ট্রলারের মাধ্যমে যাত্রী পারাপার করে থাকে। মাদারীপুরের শিবচরে একইভাবে যাত্রী পারাপার করেছিল স্পিডবোটটি। এই দুর্ঘটনায় বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

নৌ-দুর্ঘটনার ১০ কারণ

অদক্ষ মাস্টার ও ড্রাইভার (চালক) নিয়োগও দুর্ঘটনায় অন্যতম কারণ। অনেক সময় দেখা যায়, বৈধ নৌযানও অদক্ষ-অপেশাদার মাস্টার-ড্রাইভার দ্বারা পরিচালিত। এর ফলেও ঘটে দুর্ঘটনা। ২০১২ সালের ১২ মার্চ মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে নিমজ্জিত হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি শরীয়তপুর-১; এই দুর্ঘটনার পর উদ্ধার করা হয় ১৪৭টি লাশ। এই ট্র্যাজেডির পর সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দুর্ঘটনাকবলিত দোতলা লঞ্চটির মাস্টার ও ড্রাইভারের নাম লঞ্চমালিক নিজেই বলতে পারেননি বলে তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়।

অবৈধ নৌযানও দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। ২০১৪ সালের ১৫ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে এমভি মিরাজ-৪ এবং এর মাত্র ১২ দিন আগে ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপায় রামদাবাদ নদীতে দুর্ঘটনায় পড়ে এমভি শাতিল-১। দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নথিপত্র যাচাই, লঞ্চ দুটির নকশা ও অবকঠামো পরীক্ষা এবং তদন্ত কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে জানা গেছে, যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও এ দুটি যাত্রীবাহী নৌযানকে ফিটনেস সনদ দেয়া হয়েছিল। অবকাঠামোগত মারাত্মক ত্রুটির কারণেই সামান্য কালবৈশাখী ঝড়ের আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে লঞ্চ দুটি ডুবে যায়।

এছাড়া এমভি মিরাজ-৪ ও এমভি শাতিল-১- দুটি লঞ্চেই ছিলেন অদক্ষ মাস্টার। তারা আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও তাৎক্ষণিক ঘূর্ণিঝড় উপেক্ষা করে নৌযান দুটি চালাচ্ছিলেন। অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ ইনল্যান্ড সিপিং অর্ডিন্যান্স (আইএসও)- ১৯৭৬-এর অধীনে প্রণীত বিধি অনুযায়ী, নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ এবং মাস্টার ও ড্রাইভারের সনদ যাচাই এবং যাত্রীসংখ্যা গণনার পরই সেটি ছাড়ার অনুমতি দেয়ার (ভয়েজ ডিক্লারেশন) বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর বন্দর এবং নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক (নৌ-নিট্রা) বিভাগের কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্দর কর্মকর্তা ও ট্রাফিক ইন্সপেক্টররা (টিআই) এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

অবৈধ নৌযান চলাচল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, নৌপথে দিক-নির্দেশক বিকন ও বয়াবাতি না থাকা, নাব্য সংকট ও ডুবোচর, নৌপথে কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখা এবং আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে লঞ্চ দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে থাকে। অনেক দুর্ঘটনার জন্য বালুবাহী নৌযানই বেশি দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুরের মতলব যাওয়ার পথে মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদীতে নিমজ্জিত হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি সারস। এটি মিথিলা ফারজানা নামের বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় ডুবে যায়। এতে ১৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়। লঞ্চে প্রয়োজনীয়সংখ্যক জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম লাইফ জ্যাকেট, লাইফবয়া, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা, এগুলো খোঁজ নেয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কিন্তু তাও সঠিকভাবে কর্মকর্তারা তত্ত্বাবধায়ন করছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়।

৩০ বছরে প্রায় এক হাজারের অধিক নৌ-দুর্ঘটনা

বেসরকারি হিসাবে গত ৩০ বছরে ১ হাজারের অধিক ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত গত ৩ বছরে নৌপথে ৬০১টি ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনায় ৭৭৩ জন নিহত, ৯১২ জন আহত ও ১ হাজার ১৬৬ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালে ১৫৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১২৬ জন নিহত, ২৩৪ জন আহত ৩৮৭ জন নিখোঁজ হয়। ২০১৯ সালে ২০৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত, ২৮২ জন আহত, ৩৭৫ জন নিখোঁজ হয়। ২০২০ সালে লকডাউনের মধ্যেও ১৮৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩১৩ জন নিহত, ৩৪২ জন আহত, ৩৭১ জন নিখোঁজ হয়। চলতি বছরে জানুয়ারি মাসে ১৭টি ছোট বড় নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত, ১৩ জন আহত, ১১ জন নিখোঁজ হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২৫ জন নিহত, ১৯ জন আহত, ১৭ জন নিখোঁজ হয়। মার্চ মাসে ১০টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত ১৩ জন আহত, ৩ জন নিখোঁজ হয়। লকডাউনের এপ্রিল মাসে ১৪টি দুর্ঘটনায় ৩৮ জন নিহত, ৯ জন আহত, ২ জন নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। তবে ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৪ সালে আগস্ট পর্যন্ত ৩৯৩টি লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬১৩ জন লোক নিহত হয়েছেন বলে নৌ-মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ৪৭৯ জন আহত এবং নিখোঁজ রয়েছে প্রায় ৪৬২ জন মানুষ। সবচেয়ে বেশি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে ২০০১ সালে। সে বছর এর সংখ্যা ছিল ৩১টি। ২০০৫ সালে নৌ-দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২৮টি, ২০০২ সালে ২৬টি ও ২০০৩ সালে ২৩টি আর ২০টি করে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০৪ ও ২০০৬ সালে। ১৯টি করে দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৯১ ও ২০০০ সালে। ১৯৯২ সালে ১৭টি, ২০১০ সালে ১৬টি ও ২০১২ সালে ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটে। এই নৌ-দুর্ঘটনার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মামলা করে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। গত দুই যুগে ৩১০টি মামলা করা হয়েছে। ২০০১ সালে সবচেয়ে বেশি মামলা হয় ২৯টি। এর মধ্যে ২২টি মামলায় শাস্তি হয়। বাকি ৭টি মামলা খারিজ হয়। ২০০২ সালে মামলা হয় ২৩টি, যার মধ্যে ১৯টিতে শাস্তি হয়। ২০০৩ সালে ২১টির মামলার মধ্যে ১৬টিতে ও ২০০৫ সালে ২০টির মধ্যে ১৮টিতে দায়ীদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা ও ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে মেরিন কোর্টে। তবে আবার আপিল বিভাগে গিয়ে স্থগিত করে নিয়ে আসে আসামিরা।