বৈধতা ছাড়া কীভাবে চলছে স্পিডবোট?

মোহাম্মদ আবু নোমান

সরকার নৌপথের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও এই খাতে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা, দায়িত্বে অবহেলাসহ নানা কারণে নৌপথের যাত্রীদের নিরাপত্তা উপেক্ষিত থাকছে। হিসাব করে দেখা যাবে, আমাদের দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনা আর জলপথ দুর্ঘটনায় করোনার থেকেও কয়েকগুণ বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু এর জন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয় না। আমরা বুঝি না, আর কত রক্ত লাগবে এদেশের নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থার জন্য?

সড়কপথ নৌপথ সবখানেই আজ বেপরোয়া দক্ষ-অদক্ষ চালক। কার আগে কে যাবে, এটা যেন একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। বেপরোয়া গতি ও অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে পদ্মায় প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয় স্পিডবোট। পদ্মায় স্পিডবোটে যাত্রী বহনে কোন বৈধতা না থাকলেও এত চোখ এড়িয়ে কীভাবে এটি চলে, সংবাদমাধ্যমকে সে উত্তর দিতে পারেননি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পুলিশ ও নৌপুলিশের কর্তাব্যক্তিরা।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে চলছে লকডাউন, সঙ্গে কালবৈশাখীর আশঙ্কা। এরই মধ্যে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ যাত্রী নিয়ে চলে স্পিডবোট। এমনকি যাত্রীদের লাইফজ্যাকেটও দেয়া হয় না। এই দেশে কবে সঠিক নিয়ম হবে সব কিছুর? কবে আমরা অর্থ লোভের আশা ত্যাগ করে মানুষ হিসেবে সভ্য হবো! অনিয়মের বেড়াজালে আর কত প্রাণের বিসর্জন হলে আমরা শান্ত হবো? কার কাছে আছে এর উত্তর ও সমাধান।

বছরের পর বছর অবৈধ পন্থায় এই স্পিডবোটগুলো অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে, প্রশাসন বরাবরই নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী যারাই তাদের জবাবদিহিতা কোথায়?

লকডাউনে স্পিডবোট বন্ধ থাকার পরেও কেন এমন দুর্ঘটনা? এ প্রশ্নের জবাবে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্পিডবোটটি মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে বাংলাবাজার আসে। তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্পিডবোট ছাড়ে। এসব বিষয় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এছাড়া ফরিদপুর অঞ্চলের নৌপুলিশ সুপার মো. আবদুল বারেক বলেন, ‘লকডাউন কার্যকর থাকায় স্পিডবোট চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। যে স্পিডবোট চলে তা বাংলাবাজার ঘাট থেকে চলে না। এগুলো চলে শিমুলিয়া ঘাট থেকে। আমাদের এপারের (বাংলাবাজার) ঘাটে লকডাউন কার্যকর আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মায় স্পিডবোটে যাত্রী বহনে কোন বৈধতা নেই। তবু কেন চলাচল করছে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর এড়িয়ে যান।’

স্পিডবোটগুলো মনে হয়, মঙ্গলগ্রহ থেকে বুধগ্রহে যাতায়াত করত! না হয়তো ইসরায়েল অথবা রাশিয়ার তৈরি, যা রাডারকেও ফাঁকি দিতে সক্ষম! তাই এত বছরেও সংশ্লিষ্টদের চোখে পড়েনি! দুর্ঘটনা ঘটার পর সবেমাত্র স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছেন! প্রকৃত বাস্তবতা হলো, শত শত স্পিডবোট বছরের পর বছর চলছে কর্তৃপক্ষকে ‘খুশি’ করেই। স্পিডবোটগুলো কারও চোখ এড়িয়ে চলেছিল না। বরং সত্যিটা হলো, যাদের এসব দেখার কথা, তারা অর্থের প্রলোভনে ‘সরল বিশ্বাসে; চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে ছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, নৌ দুর্ঘটনায় মৃত্যু, ভবন ধসে মৃত্যু, আবাসিকে রাসায়নিক গোডাইনে অগ্নিকান্ড এসব দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। খুব কষ্ট লাগে এ সংবাদ শুনতে। এটাই আমাদের অব্যবস্থাপনার ‘প্রিয়’ বাংলাদেশ। দেখার দায়িত্ব যাদের তাদের চরিত্রের সঙ্গে আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত বাংলা সিনেমাগুলোর শেষ (পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হলে পুলিশ এসে হাজির হওয়া) দৃশ্যের সঙ্গে মিল রয়েছে। তারা, কোন ঘটনা ঘটার পর তার পোস্টমর্টেম করে।

বিআইডব্লিউটিএর শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ) মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শনে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, চিফ সার্ভেয়ার, চিফ পরিদর্শকসহ অনেকেই এসেছেন। লকডাউন চলার সময় এখান থেকে স্পিডবোটটি কীভাবে ছেড়ে গেল, এটা সবারই প্রশ্ন। এত সকালে স্পিডবোট চলার বিষয় আমরা কেউ বলতে পারছি না। স্পিডবোটের কোন নিবন্ধন নেই। তাই তারা ইচ্ছেমতো চলছে। এগুলো চলাচলে আমাদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের পক্ষে কী আর করা!’ এছাড়া মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘পদ্মা নদী দিয়ে যে নৌযানে যাত্রী পরিবহন করে তাদের অনুমোদনের বিষয়গুলো নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় দেখে। আমরা যাত্রীদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য কাজ করি। কোন অবৈধ নৌযান চলাচল করে থাকলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর আমাদের সহযোগিতা চাইলে আমরা তাদের পাশে থাকি। তারপরও স্পিডবোটে যেহেতু যাত্রী পরিবহনের অনুমোদন নেই, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করব।’

প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেই দেখা যায়, নানামুখী কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করছে। এছাড়া ঘটনা ঘটার পরই দেখা যায়, সেই বাহন ও চালকের লাইসেন্স নেই। অতিরিক্ত যাত্রী বহন করেছে। কিন্তু তার আগে কোথায় থাকেন দায়িত্বশীলরা? দুর্ঘটনা ও জান-মাল হানির পরই কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙে।

মাদারীপুরের শিবচরে বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষে ২৮ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর বেঁচে থাকা আদুরি বেগম অভিযোগ করেন, চালক ঠিকমতো স্পিডবোট চালাতে পারছিলেন না। নৌ দুর্ঘটনায় স্বামী আরজু মিয়া ও দেড় বছরের সন্তান ইয়ামিনকে হারিয়ে আদুরি বেগম বলছিলেন, ‘শিমুলিয়া ঘাট থাইকা গাদাগাদি কইরা স্পিডবোট ছাড়ে চালক। যাত্রার শুরু থিকাই এলোমেলো স্পিডবোট চালাচ্ছিল। শুরুতে একবার বোটটি উল্টো যাচ্ছিল। চালকের কারণেই আইজ আমার স্বামী-সন্তান হারাইলাম।’

একদিকে লকডাউন, অন্যদিকে কালবৈশাখীর ভরা মৌসুম। এরই মধ্যে ১২-১৪ জন যাত্রী ধারণক্ষমতার স্পিডবোটে লাইফজ্যাকেটবিহীন ৩০-৩৫ জন যাত্রীকে কীভাবে ওঠানো হলো? কারা এ স্পি?বোড চালায়? কারা এ অবৈধ কারবার নিয়ন্ত্রণ ক?রে? অনিয়ম এবং দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শা?স্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। লকডাউনের মধ্যেও এত বেশিসংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্পিডবোট চলাচলের জন্য ঘাট ইজারাদার, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বিআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কেউ দায় এড়াতে পারে কী? তাই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মীদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগে হত্যা মামলা দায়ের হওয়া উচিত কী-না সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখতে হবে। আমরা বলতে চাই, নিহত প্রতিটি ব্যক্তির পরিবারকে এবং আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক।

প্রশাসন ও পুলিশ টাকা খেয়ে স্পিডবোটের অনুমতি দিয়ে থাকে, যা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এখানে রয়েছে কোটি টাকা বাণিজ্য। এদের পেছনে রয়েছে অনেক বড় মাফিয়া ও এলাকার প্রধান। যারা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠায় ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করে। বড় ধরনের দুর্ঘটনার সঙ্গে জীবনহানি না হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। এত বড় অনিয়ম বছরের পর বছর চলছে, সরকারি কোন সংস্থার তদারকি ছিল কী? আজকে এতগুলো মানুষ মরে যাওয়ার পর প্রশাসনের ঘুম ভেঙেছে। এখন কে এই মৃত্যুর দায় নেবে? প্রাণহানি নাহলে অনিয়ম কখনোই চোখে পড়ে না কর্তৃপক্ষের।

যারা মারা গেছে তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, একটা স্পিডবোটে কীভাবে ৩২-৩৪ জন যাত্রী উঠতে পারে। জীবনের মূল্য কি এতই কম আমাদের? এমনিতে করোনা তারপর আবার এত ছোট একটা নৌযানে কীভাবে ৩০-এর অধিক মানুষ উঠতে পারে। আমরা নিজেরাই কবে সচেতন হবো? নিয়মশৃঙ্খলা কি জিনিস আমাদের শিখতে হবে। রাষ্ট্রঘোষিত নিয়মশৃঙ্খলা কতটুকু মানছি আমরা? যারা এভাবে গাদাগাদি করে যাত্রী ওঠায় তারা তো অবশ্যই দোষী, কিন্তু যারা ওঠে তারা কি একটুও বিবেচনা করবেন না? আমরা কেন সচেতন হই না? কেন ছোট একটা বোটে এত লোক উঠতে হবে? আমাদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। জীবনের কোনো ক্ষতি হলে আমারই হবে। আমরা জেনেশুনে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে উঠছি। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে।

যারা উঠেছিল তাদের কেউ জোর করে উঠায়নি। তারাই কীভাবে উঠলো? স্পিটবোটওয়ালারা তো টাকার জন্য পারলে ৫০ জন নিতে চাইবে। কিন্তু যাত্রীরা দেখে-শুনে-বুঝে কেন উঠবে? যারা বুঝে-শুনে মরণফাঁদে পা দেয়, তাদের পরিণতি কীভাবে ভালো আশা করা যায়?

abunoman1972@gmail.com

শুক্রবার, ০৭ মে ২০২১ , ২৫ বৈশাখ ১৪২৮ ২৫ রমজান ১৪৪২

বৈধতা ছাড়া কীভাবে চলছে স্পিডবোট?

মোহাম্মদ আবু নোমান

সরকার নৌপথের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও এই খাতে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা, দায়িত্বে অবহেলাসহ নানা কারণে নৌপথের যাত্রীদের নিরাপত্তা উপেক্ষিত থাকছে। হিসাব করে দেখা যাবে, আমাদের দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনা আর জলপথ দুর্ঘটনায় করোনার থেকেও কয়েকগুণ বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু এর জন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয় না। আমরা বুঝি না, আর কত রক্ত লাগবে এদেশের নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থার জন্য?

সড়কপথ নৌপথ সবখানেই আজ বেপরোয়া দক্ষ-অদক্ষ চালক। কার আগে কে যাবে, এটা যেন একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। বেপরোয়া গতি ও অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে পদ্মায় প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয় স্পিডবোট। পদ্মায় স্পিডবোটে যাত্রী বহনে কোন বৈধতা না থাকলেও এত চোখ এড়িয়ে কীভাবে এটি চলে, সংবাদমাধ্যমকে সে উত্তর দিতে পারেননি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পুলিশ ও নৌপুলিশের কর্তাব্যক্তিরা।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে চলছে লকডাউন, সঙ্গে কালবৈশাখীর আশঙ্কা। এরই মধ্যে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ যাত্রী নিয়ে চলে স্পিডবোট। এমনকি যাত্রীদের লাইফজ্যাকেটও দেয়া হয় না। এই দেশে কবে সঠিক নিয়ম হবে সব কিছুর? কবে আমরা অর্থ লোভের আশা ত্যাগ করে মানুষ হিসেবে সভ্য হবো! অনিয়মের বেড়াজালে আর কত প্রাণের বিসর্জন হলে আমরা শান্ত হবো? কার কাছে আছে এর উত্তর ও সমাধান।

বছরের পর বছর অবৈধ পন্থায় এই স্পিডবোটগুলো অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে, প্রশাসন বরাবরই নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী যারাই তাদের জবাবদিহিতা কোথায়?

লকডাউনে স্পিডবোট বন্ধ থাকার পরেও কেন এমন দুর্ঘটনা? এ প্রশ্নের জবাবে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্পিডবোটটি মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে বাংলাবাজার আসে। তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্পিডবোট ছাড়ে। এসব বিষয় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এছাড়া ফরিদপুর অঞ্চলের নৌপুলিশ সুপার মো. আবদুল বারেক বলেন, ‘লকডাউন কার্যকর থাকায় স্পিডবোট চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। যে স্পিডবোট চলে তা বাংলাবাজার ঘাট থেকে চলে না। এগুলো চলে শিমুলিয়া ঘাট থেকে। আমাদের এপারের (বাংলাবাজার) ঘাটে লকডাউন কার্যকর আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মায় স্পিডবোটে যাত্রী বহনে কোন বৈধতা নেই। তবু কেন চলাচল করছে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর এড়িয়ে যান।’

স্পিডবোটগুলো মনে হয়, মঙ্গলগ্রহ থেকে বুধগ্রহে যাতায়াত করত! না হয়তো ইসরায়েল অথবা রাশিয়ার তৈরি, যা রাডারকেও ফাঁকি দিতে সক্ষম! তাই এত বছরেও সংশ্লিষ্টদের চোখে পড়েনি! দুর্ঘটনা ঘটার পর সবেমাত্র স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছেন! প্রকৃত বাস্তবতা হলো, শত শত স্পিডবোট বছরের পর বছর চলছে কর্তৃপক্ষকে ‘খুশি’ করেই। স্পিডবোটগুলো কারও চোখ এড়িয়ে চলেছিল না। বরং সত্যিটা হলো, যাদের এসব দেখার কথা, তারা অর্থের প্রলোভনে ‘সরল বিশ্বাসে; চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে ছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, নৌ দুর্ঘটনায় মৃত্যু, ভবন ধসে মৃত্যু, আবাসিকে রাসায়নিক গোডাইনে অগ্নিকান্ড এসব দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। খুব কষ্ট লাগে এ সংবাদ শুনতে। এটাই আমাদের অব্যবস্থাপনার ‘প্রিয়’ বাংলাদেশ। দেখার দায়িত্ব যাদের তাদের চরিত্রের সঙ্গে আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত বাংলা সিনেমাগুলোর শেষ (পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হলে পুলিশ এসে হাজির হওয়া) দৃশ্যের সঙ্গে মিল রয়েছে। তারা, কোন ঘটনা ঘটার পর তার পোস্টমর্টেম করে।

বিআইডব্লিউটিএর শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ) মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শনে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, চিফ সার্ভেয়ার, চিফ পরিদর্শকসহ অনেকেই এসেছেন। লকডাউন চলার সময় এখান থেকে স্পিডবোটটি কীভাবে ছেড়ে গেল, এটা সবারই প্রশ্ন। এত সকালে স্পিডবোট চলার বিষয় আমরা কেউ বলতে পারছি না। স্পিডবোটের কোন নিবন্ধন নেই। তাই তারা ইচ্ছেমতো চলছে। এগুলো চলাচলে আমাদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের পক্ষে কী আর করা!’ এছাড়া মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘পদ্মা নদী দিয়ে যে নৌযানে যাত্রী পরিবহন করে তাদের অনুমোদনের বিষয়গুলো নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় দেখে। আমরা যাত্রীদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য কাজ করি। কোন অবৈধ নৌযান চলাচল করে থাকলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর আমাদের সহযোগিতা চাইলে আমরা তাদের পাশে থাকি। তারপরও স্পিডবোটে যেহেতু যাত্রী পরিবহনের অনুমোদন নেই, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করব।’

প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেই দেখা যায়, নানামুখী কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করছে। এছাড়া ঘটনা ঘটার পরই দেখা যায়, সেই বাহন ও চালকের লাইসেন্স নেই। অতিরিক্ত যাত্রী বহন করেছে। কিন্তু তার আগে কোথায় থাকেন দায়িত্বশীলরা? দুর্ঘটনা ও জান-মাল হানির পরই কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙে।

মাদারীপুরের শিবচরে বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষে ২৮ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর বেঁচে থাকা আদুরি বেগম অভিযোগ করেন, চালক ঠিকমতো স্পিডবোট চালাতে পারছিলেন না। নৌ দুর্ঘটনায় স্বামী আরজু মিয়া ও দেড় বছরের সন্তান ইয়ামিনকে হারিয়ে আদুরি বেগম বলছিলেন, ‘শিমুলিয়া ঘাট থাইকা গাদাগাদি কইরা স্পিডবোট ছাড়ে চালক। যাত্রার শুরু থিকাই এলোমেলো স্পিডবোট চালাচ্ছিল। শুরুতে একবার বোটটি উল্টো যাচ্ছিল। চালকের কারণেই আইজ আমার স্বামী-সন্তান হারাইলাম।’

একদিকে লকডাউন, অন্যদিকে কালবৈশাখীর ভরা মৌসুম। এরই মধ্যে ১২-১৪ জন যাত্রী ধারণক্ষমতার স্পিডবোটে লাইফজ্যাকেটবিহীন ৩০-৩৫ জন যাত্রীকে কীভাবে ওঠানো হলো? কারা এ স্পি?বোড চালায়? কারা এ অবৈধ কারবার নিয়ন্ত্রণ ক?রে? অনিয়ম এবং দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শা?স্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। লকডাউনের মধ্যেও এত বেশিসংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্পিডবোট চলাচলের জন্য ঘাট ইজারাদার, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বিআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর কেউ দায় এড়াতে পারে কী? তাই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মীদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগে হত্যা মামলা দায়ের হওয়া উচিত কী-না সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখতে হবে। আমরা বলতে চাই, নিহত প্রতিটি ব্যক্তির পরিবারকে এবং আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক।

প্রশাসন ও পুলিশ টাকা খেয়ে স্পিডবোটের অনুমতি দিয়ে থাকে, যা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এখানে রয়েছে কোটি টাকা বাণিজ্য। এদের পেছনে রয়েছে অনেক বড় মাফিয়া ও এলাকার প্রধান। যারা সিন্ডিকেট করে ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠায় ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করে। বড় ধরনের দুর্ঘটনার সঙ্গে জীবনহানি না হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। এত বড় অনিয়ম বছরের পর বছর চলছে, সরকারি কোন সংস্থার তদারকি ছিল কী? আজকে এতগুলো মানুষ মরে যাওয়ার পর প্রশাসনের ঘুম ভেঙেছে। এখন কে এই মৃত্যুর দায় নেবে? প্রাণহানি নাহলে অনিয়ম কখনোই চোখে পড়ে না কর্তৃপক্ষের।

যারা মারা গেছে তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, একটা স্পিডবোটে কীভাবে ৩২-৩৪ জন যাত্রী উঠতে পারে। জীবনের মূল্য কি এতই কম আমাদের? এমনিতে করোনা তারপর আবার এত ছোট একটা নৌযানে কীভাবে ৩০-এর অধিক মানুষ উঠতে পারে। আমরা নিজেরাই কবে সচেতন হবো? নিয়মশৃঙ্খলা কি জিনিস আমাদের শিখতে হবে। রাষ্ট্রঘোষিত নিয়মশৃঙ্খলা কতটুকু মানছি আমরা? যারা এভাবে গাদাগাদি করে যাত্রী ওঠায় তারা তো অবশ্যই দোষী, কিন্তু যারা ওঠে তারা কি একটুও বিবেচনা করবেন না? আমরা কেন সচেতন হই না? কেন ছোট একটা বোটে এত লোক উঠতে হবে? আমাদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। জীবনের কোনো ক্ষতি হলে আমারই হবে। আমরা জেনেশুনে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে উঠছি। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে।

যারা উঠেছিল তাদের কেউ জোর করে উঠায়নি। তারাই কীভাবে উঠলো? স্পিটবোটওয়ালারা তো টাকার জন্য পারলে ৫০ জন নিতে চাইবে। কিন্তু যাত্রীরা দেখে-শুনে-বুঝে কেন উঠবে? যারা বুঝে-শুনে মরণফাঁদে পা দেয়, তাদের পরিণতি কীভাবে ভালো আশা করা যায়?

abunoman1972@gmail.com