কমরেড রেবতী মোহন বর্মণ

মোতাহার হোসেন

ভৈরবের এক নিভৃতপল্লীতে সম্ভ্রান্ত ক্ষত্রীয় তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রেবতীমোহন বর্মণ। বাবা অ্যাডভোকেট হরমোহন বর্মণ রায় বাহাদুর ছেলেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলার জন্য প্রথমে সরাইলের চুন্টায় পরে ঢাকার পোগোজ স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও অসাধারণ মেধাবী এই তরুণের মধ্যে শ্রেণি-বৈষম্য, বর্ণবিরোধ ছিল না। বরং ইংরেজদের শোষণ, বঞ্চনা, দারুণভাবে ছেলেবেলা থেকেই তার হৃদয়ে রেখাপাত করেছিল। যোগ দিয়েছিলেন গান্ধিজীর অসযোগ আন্দোলনে এবং শ্রীসঙ্গে। ১৯২৩ থেকে ১৯২৪ সালে তিনি বেঙ্গল বলান্টিয়ারের কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯২৭ থেকে ১৯২৮ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই জাগ্রত তরুণ আগ্নেয়গিরি মতোই জ্বলে উঠেছিলেন।

মেধাবী এই তরুণ ইচ্ছা করলে আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি আমলা হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কলকাতা, বাকুরা ও বীরভূমে তিনি বৈপ্লবিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৩০ সালো ১ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার রাজবন্দীদের সাথে রেবতী মোহনকেও রাজস্থান থেকে স্বৈরাচারী ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে। রাজপুতনার দেওলী কারগার থেকে ২১ জুলাই ১৯৩৮ সালে অসুস্থ অবস্থায় তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে তিনি কমরেড মুজাফফর আহামদের সাথে দেখা করে সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন।

১৯৪০ সালে কলকাতার আশপাশের জেলাগুলো থেকে ব্রিটিশ স্বৈরাচারী সরকার রেবতী মোহনকে বহিষ্কার করে। শরীরে দূরারোগ্য মরণঘাতী কুষ্ঠব্যাধি নিয়ে প্রথমে কিশোরগঞ্জ শহরে কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে শিমুলকান্দিতে তার নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। রেবতী মোহন নিভৃত পল্লীতে থেকে সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে লাগলেন। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই শিমুলকান্দি হয়ে উঠল রাজনৈতিক নেতাদের মিলনমেলা। তিনি ভুলেই যেতেন কুষ্ঠ রোগের কথা এবং দুঃসহ যন্ত্রণার কথা।

মন্বন্তরের সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত নিরন্নœ মানুষের জন্য রেবতীদের বাড়িতে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। সেখানে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে অনাহারি মানুষদের প্রতিদিন খাওয়াতেন।

ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ বিভাজিত হয়। উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে পড়ে। ধর্মীয় কারণে অভিগমনের জন্য রেবতীর পরিবারও শিমুলকান্দি ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমায়। ১৯৪৮ সালে তার পরিবারের সাথে রেবতীও কলকাতায় এসেছিলেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি আবারো শিমুলকান্দিতে চলে আসেন। রাজনৈতিক চাপ, ভয়াবহ অসুস্থতা, পারিবারিক বিচ্ছেদ বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মর্মাহত হয়ে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি চিরদিনের জন্য দেশ ছাড়তে। তিনি ১৯৫১ সালে আগরতলায় চলে যান। সেখানে একটি টিলার উপর খড়ের ছাল দিয়ে নির্মাণ করেন এক ছোট্ট কুটির। সেখানেও ভারতবর্ষের জাঁদরেল কমিউনিস্ট নেতারা তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে কমরেড মোজাফফর আহমেদ তার সাথে দেখা করেছিলেন। তখন তার শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ যে, তিনি আর শরীরের ভার বহন করতে পারছিলেন না। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে তার মাংস খসে পড়েছিল। তবু তিনি হাতের সাথে দড়ি দিয়ে কলম বেঁধে লেখা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই লেখাগুলো উদ্ধার হয়নি।

ত্রিপুরার বর্মণ টিলায় মরণঘাতী কুষ্ঠের আক্রমণে ভারতের অবিসংবাধিত মানবতাবাদী নেতা ১৯৫২ সালের ৬ মে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে একান্ত নিঃসঙ্গ পরিবেশে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর খবর তার আত্মীয়স্বজন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। শিমুলকান্দিতে এই মহান নেতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ২০০৬ সালে জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

[লেখক : অধ্যাপক, ভৈরব হাজী আসমত কলেজ]

শুক্রবার, ০৭ মে ২০২১ , ২৫ বৈশাখ ১৪২৮ ২৫ রমজান ১৪৪২

কমরেড রেবতী মোহন বর্মণ

মোতাহার হোসেন

image

ভৈরবের এক নিভৃতপল্লীতে সম্ভ্রান্ত ক্ষত্রীয় তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রেবতীমোহন বর্মণ। বাবা অ্যাডভোকেট হরমোহন বর্মণ রায় বাহাদুর ছেলেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলার জন্য প্রথমে সরাইলের চুন্টায় পরে ঢাকার পোগোজ স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও অসাধারণ মেধাবী এই তরুণের মধ্যে শ্রেণি-বৈষম্য, বর্ণবিরোধ ছিল না। বরং ইংরেজদের শোষণ, বঞ্চনা, দারুণভাবে ছেলেবেলা থেকেই তার হৃদয়ে রেখাপাত করেছিল। যোগ দিয়েছিলেন গান্ধিজীর অসযোগ আন্দোলনে এবং শ্রীসঙ্গে। ১৯২৩ থেকে ১৯২৪ সালে তিনি বেঙ্গল বলান্টিয়ারের কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯২৭ থেকে ১৯২৮ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই জাগ্রত তরুণ আগ্নেয়গিরি মতোই জ্বলে উঠেছিলেন।

মেধাবী এই তরুণ ইচ্ছা করলে আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি আমলা হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কলকাতা, বাকুরা ও বীরভূমে তিনি বৈপ্লবিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৩০ সালো ১ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার রাজবন্দীদের সাথে রেবতী মোহনকেও রাজস্থান থেকে স্বৈরাচারী ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে। রাজপুতনার দেওলী কারগার থেকে ২১ জুলাই ১৯৩৮ সালে অসুস্থ অবস্থায় তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে তিনি কমরেড মুজাফফর আহামদের সাথে দেখা করে সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন।

১৯৪০ সালে কলকাতার আশপাশের জেলাগুলো থেকে ব্রিটিশ স্বৈরাচারী সরকার রেবতী মোহনকে বহিষ্কার করে। শরীরে দূরারোগ্য মরণঘাতী কুষ্ঠব্যাধি নিয়ে প্রথমে কিশোরগঞ্জ শহরে কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে শিমুলকান্দিতে তার নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। রেবতী মোহন নিভৃত পল্লীতে থেকে সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে লাগলেন। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই শিমুলকান্দি হয়ে উঠল রাজনৈতিক নেতাদের মিলনমেলা। তিনি ভুলেই যেতেন কুষ্ঠ রোগের কথা এবং দুঃসহ যন্ত্রণার কথা।

মন্বন্তরের সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত নিরন্নœ মানুষের জন্য রেবতীদের বাড়িতে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। সেখানে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে অনাহারি মানুষদের প্রতিদিন খাওয়াতেন।

ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ বিভাজিত হয়। উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে পড়ে। ধর্মীয় কারণে অভিগমনের জন্য রেবতীর পরিবারও শিমুলকান্দি ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমায়। ১৯৪৮ সালে তার পরিবারের সাথে রেবতীও কলকাতায় এসেছিলেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি আবারো শিমুলকান্দিতে চলে আসেন। রাজনৈতিক চাপ, ভয়াবহ অসুস্থতা, পারিবারিক বিচ্ছেদ বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মর্মাহত হয়ে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি চিরদিনের জন্য দেশ ছাড়তে। তিনি ১৯৫১ সালে আগরতলায় চলে যান। সেখানে একটি টিলার উপর খড়ের ছাল দিয়ে নির্মাণ করেন এক ছোট্ট কুটির। সেখানেও ভারতবর্ষের জাঁদরেল কমিউনিস্ট নেতারা তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে কমরেড মোজাফফর আহমেদ তার সাথে দেখা করেছিলেন। তখন তার শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ যে, তিনি আর শরীরের ভার বহন করতে পারছিলেন না। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে তার মাংস খসে পড়েছিল। তবু তিনি হাতের সাথে দড়ি দিয়ে কলম বেঁধে লেখা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই লেখাগুলো উদ্ধার হয়নি।

ত্রিপুরার বর্মণ টিলায় মরণঘাতী কুষ্ঠের আক্রমণে ভারতের অবিসংবাধিত মানবতাবাদী নেতা ১৯৫২ সালের ৬ মে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে একান্ত নিঃসঙ্গ পরিবেশে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর খবর তার আত্মীয়স্বজন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। শিমুলকান্দিতে এই মহান নেতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ২০০৬ সালে জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

[লেখক : অধ্যাপক, ভৈরব হাজী আসমত কলেজ]