বিপ্রতীপ মাকালফল

মনজুর শামস

কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। শেষবিকেলের এই বৃষ্টিটুকুও না। একটুও না। এই চৈত্রের হাঁসফাঁস গরমের শেষবিকেলে এক পসলা বৃষ্টি হলে কী যে ভালো লাগত আগে! নাগরিক ব্যস্ত জীবনে রূঢ়তার জাঁতাকলে সেই মনটাই বুঝি মরে গেছে। বরং উল্টো এই নচ্ছার বিষ্টির চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছিলাম মনে মনে। ভাঙা ছাতাটি সারানো হয়নি বলে অফিস ছুটির পরেও প্রায় ঘণ্টাখানেক আটকে থাকতে হলো বৃষ্টির জন্য। গা বেয়ে পিঁপড়ের অস্বস্তিকর উঠে যাওয়ার মতো মেজাজটা চড়ে যাচ্ছিল মাথায়।

অগত্যা মনকে বশে রাখতে মনটাকে নিজের ভেতর আটকে না রেখে ছড়িয়ে দিলাম চারপাশে। খামারবাড়ির অফিস থেকে বেরিয়ে দু’টাকার বুট কিনে চিবুতে চিবুতে বাস ধরার জন্য হাঁটতে থাকলাম আর আশপাশের মানুষ, বাস-ট্রাক এবং সারাদিনের তাতানো রোদে খাবি খেতে খেতে এখন ঝিমুতে থাকা গাছপালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খুঁজতে থাকলাম মন ভালো করার মতো কিছু পাওয়া যায় কি-না।

ওভারব্রিজ পেরিয়ে ফার্মগেট থেকে দক্ষিণমুখো বাসে ওঠার আগে হাঁটতে হাঁটতে বাদাম বা বুট চিবুনো অনেকটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। বুট শেষ হয়ে যেতেই দলা করে কাগজটা পথের পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছিলাম। থেমে গেলাম কাগজের টুকরোর ছবিটিতে হঠাৎ চোখ আটকে যাওয়ায়। কাগজের রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছিল বড়জোর মাসখানক আগেকার খবরের কাগজের টুকরো এটি।

সেদিন একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল অফিসে বেরুতে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সবে মোজা জোড়া পায়ে গলাচ্ছি অমনি ঘুমের চোখ দুটোকে একটু ফাঁক করে নীলা বলে উঠল, ‘খুব তো বেড়ে রাখা ভাত গিলে বেরিয়ে যাচ্ছ! ছেলে-মেয়ে দুজন কী খেয়ে স্কুল যাবে সে খেয়াল আছে?’ অগত্যা কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বুয়াকে দরজা লাগাতে বলে দোকানে ছুটলাম পাউরুটি আনতে। মেয়াদ-তারিখ মিলিয়ে পাউরুটি কিনতে বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরতে হয়েছিল।

মতিঝিল শাপলা চত্বরে পৌঁছামাত্র বাসে ঝুলে পড়তে পারলে অবশ্য সময়মতোই অফিসে পৌঁছা যেতো, শুধু চায়ের বিলাসিতাটা এ বেলা বাদ দিতে হতোÑ এই যা। হনহনিয়ে হাঁটছিলাম। মানিকনগর থেকে বিশ্বরোড পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গোপীবাগ রেলগেট পার হতেই ইচ্ছে হচ্ছিল আজ একটু শেয়ারে রিক্সা চেপে ইত্তেফাকের মোড় পর্যন্ত যাই। দেরি যখন হয়েই গেছে সময় বাঁচাতে এটুকু বাড়তি খরচ করাই যেতো। মাস শেষের গোনা পয়সার কথা মনে হতে সে ইচ্ছের গলা টিপে ধরেছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের আগে নতুন একটা রাস্তা হয়েছেÑ বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে সেটি গিয়ে মতিঝিল-কমলাপুর রাস্তায় পড়েছে। সে রাস্তা ধরেই রোজ মতিঝিলে যাই; মধুমিতা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা এসে মিশেছে এ পথেÑ সেদিক দিয়েই।

নতুন রাস্তাটির দু পাশে এরই মধ্যে কয়েকটি অটোমোবাইল গ্যারেজ ব্যবসা বেশ জমিয়ে তুলেছে। ধাই ধাই করে হাঁটছি। হঠাৎ পাশ থেকে এক মহিলা আমাকে থামিয়ে দিল। ‘ভাইজান, এই রাস্তায় কি মালিবাগ যাইতে পারুম?’ উটকো ঝামেলা! বেশভুষা দেখে একেবারে ভিখিরিনিও মনে হচ্ছে না। না শোনার ভান করে চলেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু থেমে গেলাম। ছোটবেলায় স্কাউট ছিলাম। তখন তিনটি প্রতিজ্ঞা আর দশটি আইন মুখস্থ করানো হয়েছিল। সেই দশটি আইনের একটি ছিল রোজ অন্তত একটি পরোপকার করা। সুযোগ পেলে এখনো এই আইনটি মেনে চলার চেষ্টা করি। ‘এই রাস্তা ধরে একটু সামনে গেলে বাঁদিকে একটি রাস্তা গেছে, সেটি ধরে মতিঝিলে চলে যান। সেখান থেকে মালিবাগ-মৌচাকের দিকে যাওয়ার বাসে উঠে মালিবাগে নেমে পড়বেন।’ বলে আবার হাঁটতে শুরু করেছিলাম। কিছুদূর আসতেই মনে হয়েছিলÑ মহিলা মতিঝিলে যাওয়ার রাস্তা চেনে তো? অগত্যা পিছু হটে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘মতিঝিল চেনেন তো?’

‘না বাই।’

‘আচ্ছা বেশ, আমার পিছু পিছু আসুন। আমিও মতিঝিলে যাচ্ছি। আপনাকে মালিবাগে যাওয়ার বাস দেখিয়ে দেব।’ এবার গতি একটু কমিয়ে হাঁটতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরপর পেছন ফিরে দেখছিলাম মহিলা আমাকে ঠিকমতো অনুসরণ করতে পারছেন কিনা।

অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছেÑ মনে হতেই আমার চলার গতি বেড়ে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিলাম মহিলার কথা। মধুমিতা সিনেমা হল পেরিয়ে ঘরোয়া রেস্তরাঁর কাছে এসেই মনে পড়ে গেল আবার। কিন্তু পেছন ফিরে তাকিয়ে মহিলাকে আর দেখতে পেলাম না। মনে মনে ভাবলামÑ যাক, বাঁচা গেছে; নিজে থেকেই কেটে পড়েছে। হয়তো কাউকে সঙ্গী পেয়ে গেছে! আরেক নজর পেছনে তাকিয়ে মহিলাকে না দেখে অনেকটা নিশ্চিত হয়ে লম্বা কদমে আবার হাঁটতে শুরু করেছিলাম।

দশ কদম যেতেই পা-জোড়া গাড়িতে কড়া ব্রেক কষে থেমে গেলাম। মহিলা কোনো বিপদে পড়ল না তো! উপকার করতে গিয়ে এ পথ দিয়ে এনে আমিই কি তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলাম! নাহ্, তাকে মালিবাগের বাসে তুলে না দিলে অফিসে গিয়েও শান্তি পাব না। এবার ঘুরে উল্টোপথে হাঁটতে হাঁটতে মহিলাকে খুঁজতে লাগলাম। এবং পেয়েও গেলাম কয়েক কদম যেতেই। অফিসমুখো মানুষের ভিড়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে আমাকেই খুঁজছে।

আমাকে দেখতে পেয়ে সে হাঁটতে শুরু করলে আমিও ঘুরে শাপলা চত্বরের দিকে এগুতে থাকলাম। এবার আর হনহনিয়ে হেঁটে দূরত্ব বাড়ালাম না। অনেকটা পাশাপাশিই হাঁটতে থাকলাম। ঢাকা মহানগরীতে কত ধরনের প্রতারণাচক্র আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মহিলা আমাকে কোনো ফাঁদে ফেলছে না তো! একটু বাজিয়ে নিতে হয়।

‘মালিবাগের কোথায় যাবেন?’

‘টুইন টাওয়ার।’

‘ওটা তো মালিবাগের আগে। আপনাকে মালিবাগে নেমে পেছন দিকে আবার বেশ খানিকটা হেঁটে আসতে হবে। ওখানে কার কাছে যাবেন?’

‘আমি ওইখানে এক বাসায় কাম করি।’

সন্দেহ হতে লাগল। বাসা-বাড়িতে কাজ করে অথচ সেখানে যাওয়ার পথ চেনে নাÑ এমন তো সাধারণত দেখা যায় না। অবশ্য নতুন এলে এমনটা হতেই পারে। ‘কতদিন ধরে কাজ করেন? আর এদিকে গিয়েছিলেনইবা কোথায়?’

‘বাই ঢাহায় আসছি পরাই মাস সাতেক হবি। আর এই বাসায় কামে ঢুকছি দুই মাস আগে। আমি মাণ্ডায় গেছিলাম।’

সন্দেহটা রয়েই গেল। মাণ্ডা থেকে মালিবাগে যেতে এ পথে কেন? শাপলা চত্বরে এসে গিয়েছিলাম। সন্দেহ ঘোচাতে তাই আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। মালিবাগ-মৌচাক হয়ে যে বাসগুলো টঙ্গীর দিকে যায় সেগুলো যেখানে থামে সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। এ লাইনে অনেকক্ষণ পরপর বাস আসে। ব্যাপারটা জানা থাকলেও আজ খুব বিরক্ত লাগছিল।

‘আপনার কাছে বাস ভাড়া আছে তো?’

‘না, বাই।’

বিশ টাকার একটি নোট তার হাতে গুঁজে দিয়েছিলাম। মহিলা কোনো আপত্তি না করায় সন্দেহটা আরো বেড়ে গিয়েছিল। তবুও কেটে পড়তে মন সায় দিচ্ছিল না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও এ রুটের বাসের কোনো দেখাই পেলাম না। এমনিতেই এ রুটে বাস কম, তার ওপর এখন অফিস টাইম। যেদিক দিয়ে বাস আসবে সেদিকে আমার দৃষ্টিকে আড়াল করে একটি খালি রিক্সা এসে দাঁড়িয়ে থাকল। ইচ্ছে হচ্ছিল কষে এক ধমক লাগাই চ্যাংরামতো রিক্সাওলাকে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলাম।

না, আর পারা যাচ্ছে না। ধৈর্যটা আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলাম না। ‘তিনের বি নম্বর বাস এলে তাতে উঠে পড়বেন।’ বলে আমি আমার বাসের দিকে পা বাড়াতেই মহিলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে উঠল, ‘বাই, আমি তো পইড়বার পারমু না! আপনে আমারে হাঁইট্যা যাওনের পথটা চিনাইয়া দেন।’

ভালো বিপদ তো! মামাবাড়ির আবদার! মনে মনে রাগে রীতিমতো ফুঁসছিলাম। রাগের সঙ্গেই এতক্ষণে ভালো করে তাকালাম মহিলার দিকে। ছোটখাটো গড়নের ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের মহিলার হাতে একটি বাজার করার ব্যাগ, তা থেকে উঁকি মারছে প্লাস্টিকের কয়েকটি খালি টিফিনবাটি। চোখ-মুখে ভীতির ছায়া। রাগের ভেতরেও একটু মায়া জমল মনে।

অগত্যা বেয়াড়ার মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাটার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মালিবাগ টুইন টাওয়ারে যাবে কিনা। ভেবেছিলাম যেতে চাইবে না। আরো কয়েকটা রিক্সা খোঁজার ফাঁকে বাস চলে আসবে আর আমি মহিলাকে তাতে তুলে দিয়ে মুক্তি পাব। কিন্তু যেন দুর্গতি আমাকে বাগে পেয়ে গিয়েছিল। রিক্সাওলা যেতে রাজি হলো এবং যৌক্তিক ভাড়াই চাইল। আমি আর দর কষাকষি না করে মহিলাকে উঠতে বলে নিজেও উঠে পড়লাম।

কিছুদূর যেতেই হুঁশ হলো। মহিলা রিক্সায় উঠতে আপত্তি করল না কেন? তার কাছে আমি তো এক বেগানা পুরুষ! বাস থামার ঐ জায়গাটায় তো ওভাবে রিক্সা এসে থেমে থাকার কথা নয়! আর প্রথম জিজ্ঞাসাতেই যেতে রাজিই বা হলো কেন রিক্সাওলা? তাও আবার সুযোগ বুঝে অনেক বেশি ভাড়া হাঁকল না! তবে কি আগে থেকেই সব ঠিক করে রাখা? শিকার ধরার কৌশল? মনে পড়ে গেল এক অফিস কলিগের বলা অভিজ্ঞতার কথা :

‘... মহিলা আস্তে আস্তে আমার আরো কাছে সরে এলো। তার বাজারের ব্যাগটা দু পায়ের মাঝখানে রেখে বাঁহাত দিয়ে ব্যাগের মুখের ফিতে ধরে রেখে ডানহাতটা আমার পিঠের পেছন দিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে আমার পাশের হুডটা আঁকড়ে ধরল। রিক্সার ঝাঁকুনিতে বারবার তার বুকটা এসে আমার শরীরের বাঁপাশটা ছুঁয়ে দিচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম অনিচ্ছায়। কিন্তু তার পরেই সে আমার পিঠের ওপরে হাত এনে আলতো চাপ দিল। এবার আর কোনো সন্দেহ রইল না সে ইচ্ছে করেই এমন করছে। স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকায় বহুদিন কোনো নারীর এমন ছোঁয়া পাইনি। নিজেকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। বাঁ হাত বাড়িয়ে তাকে আরো কাছে টেনে নিলাম। রাস্তার চারপাশে নজর বুলিয়ে তার শরীরের এখানে-সেখানে হাত চালাতে থাকলাম।

রিক্সাটা কোন ফাঁকে শান্তিনগরের এক এঁদো গলিতে ঢুকে পড়েছে টের পাইনি। হঠাৎ আকাশ কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। নির্জন গলিতে নেমে এলো অন্ধকার। একসময় কড়া ব্রেক চেপে থেমে গেল রিক্সা। দু পাশ থেকে পিস্তল উঁচিয়ে দুজন লোক এসে আমার মোবাইল, মানিব্যাগ সবকিছু কেড়ে নিল। তারপর একজন একটি লাথি মেরে আমাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে বলে উঠল, ‘শালা, লুচ্চা মাল! মাইয়া মানুষ দেখলে হুঁশ থাহে না!’ রাস্তায় ছিটকে পড়তেই এক ঝাঁকুনিতে জ্ঞান হলো আমার।...’

বাস্তবে ফিরতেই দেখি কড়া রোদের ভেতর রিক্সাটা ফকিরার পুল পেরিয়ে রাজারবাগের দিকে ডুকছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মহিলা রিক্সার ওপাশটায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ছোঁয়া তো দূরের কথাÑ বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে শক্ত হয়ে আছে সে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ, কী বাজে ভাবনাই ভেবেছি এতক্ষণ তাকে নিয়ে। আসলে তার মতো মেয়েদের আমরা কিছুতেই যেন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না। আমরাÑ মানে নিজেদের যারা ভদ্রলোক বলে জাহির করে থাকি।

এবার একটু স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম।

‘আপনার বাড়ি কোথায়?’

‘গাইবান্ধার চরে।’

‘মাণ্ডায় কোথায় গেছিলেন?’

‘সুয়ামির কাছে। সেহানকার এক বস্তিতে আমারে আইন্যা তুলছে হ্যায়। টুইন টাওয়ারের বাসায় কাম পাওনের পর এই পেত্থম গেলাম হ্যানে।’

‘ছেলে-মেয়ে?’

‘এক পোলা। তারে লেহাপড়া শিহাইচ্ছি। তার জন্যিই তো খাইট্যা মরিচ্ছি দুইজনে।’

‘আপনার স্বামী কী করেন?’

‘হ্যায় বাই রিক্সা চালায়। তয় এট্টু আইলস্যা কিছিমের মানুষ। দুইদিন রিক্সা চালায় তো তিনদিনই কামাই দেয়। আমি কাম পাওনের পর তো আরো আইলস্যামি করে। দুইদিন পরপরই আমার কাছে যাইয়া প্যাট জাইত্যা খাইয়া আসে।’

‘ছেলে কার কাছে থাকে?’

‘দ্যাশে, হ্যার দাদাবাড়ি।’

আচ্ছা এমনও তো হতে পারে মহিলা আমাকে যা যা বলছে তার সবই বানোয়াট! এই মুহূর্তে সে যদি চিৎকার করে লোক জড়ো করে আমার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে?

ধ্যাত! কী যে উল্টাপাল্টা ভাবছিলাম! নিজের মনের এক মহৎ উদ্দেশ্যকে কেন এমন নোংরা পথে হাঁটাচ্ছিলাম? শান্তিনগর মোড়ের কাছে অনেকক্ষণ জ্যামে আটকে ছিল রিক্সা। আমি আর কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না তাকে। মনের এতক্ষণের ভাবনাগুলোর জন্য নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। আড়চোখে অবশ্য বেশ কয়েকবার তাকিয়ে তাকে ভালো করে দেখে নিয়েছিলাম। নাকের ওপর বেশ বড় একটা কালো তিল। অনেকটা জরুলের মতো।

টুইন টাওয়ারের উল্টোদিকে এসে রিক্সা থামিয়েই তাকে বললাম, ‘ঐ তো টুইন টাওয়ার। এবার যেতে পারবেন তো?’

‘হ বাই। পারমু। বাই আপনেও নামেন। আপনের রিক্সা ভাড়ার ট্যাকা দিয়া দিবানি বেগম সাবের কাছ থাইক্যা। আপায় খুব ভালা মানুষ। রেডিও-টেলিভিশনে গান করে। আরো কত্তো কত্তো জায়গায় যায় গান গাইবার!’

‘না বোন। রিক্সা ভাড়ার টাকা দিতে হবে না। আপনি শুধু আমার ছেলে-মেয়ে আর ওদের মায়ের জন্য দোয়া করবেন।’

‘হ বাই, মন খুইল্যা দোয়া করমু।’

রিক্সাওলাকে তাড়া দিতেই সে সামনে যেতে থাকল। মালিবাগের কাছে এসে নেমে পকেট হাতড়ে দেখি ভাংতি টাকা নেই। ‘তোমার কাছে এক শ টাকার ভাংতি হবে?’

‘না, সাব।’

‘তবে একটু দাঁড়াও। আমি টাকা ভাঙিয়ে আনি।’

‘না, সাব। ভাড়া লাগবো না।’ বলে আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্যাডেল মেরে দ্রুত সামনে বাড়ল। আমি থ মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। অমানুষ দেখতে দেখতে মানুষ চিনতে ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর মালিবাগের মোড়ের দিকে ৬ নম্বর বাস ধরার জন্য ছুটেছিলাম। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম দেরির জন্য অফিসে কী অজুহাত দেব।

বুট ভাজার কাগজের ছবিটার দিকে আবারো ভালো করে তাকালাম। মেলে ধরলাম বৃষ্টিধোয়া শেষবিকেলের কমলা-রোদে। সেই চেহারা। নাকের ওপর বড় একটা কালো তিল। এক তরুণের এক পাশে দাঁড়িয়ে সে। অন্যপাশের লোকটা নিশ্চয়ই তার স্বামী! এবার ছবিটার ক্যাপশনে চোখ গেল। সেখানে লেখা, ‘এসএসসিতে জিপিএ গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছেলের পাশে গর্বিত রিক্সাওলা বাবা এবং গৃহপরিচারিকা মা।’

রবিবার, ০৯ মে ২০২১ , ২৬ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমজান ১৪৪২

বিপ্রতীপ মাকালফল

মনজুর শামস

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। শেষবিকেলের এই বৃষ্টিটুকুও না। একটুও না। এই চৈত্রের হাঁসফাঁস গরমের শেষবিকেলে এক পসলা বৃষ্টি হলে কী যে ভালো লাগত আগে! নাগরিক ব্যস্ত জীবনে রূঢ়তার জাঁতাকলে সেই মনটাই বুঝি মরে গেছে। বরং উল্টো এই নচ্ছার বিষ্টির চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছিলাম মনে মনে। ভাঙা ছাতাটি সারানো হয়নি বলে অফিস ছুটির পরেও প্রায় ঘণ্টাখানেক আটকে থাকতে হলো বৃষ্টির জন্য। গা বেয়ে পিঁপড়ের অস্বস্তিকর উঠে যাওয়ার মতো মেজাজটা চড়ে যাচ্ছিল মাথায়।

অগত্যা মনকে বশে রাখতে মনটাকে নিজের ভেতর আটকে না রেখে ছড়িয়ে দিলাম চারপাশে। খামারবাড়ির অফিস থেকে বেরিয়ে দু’টাকার বুট কিনে চিবুতে চিবুতে বাস ধরার জন্য হাঁটতে থাকলাম আর আশপাশের মানুষ, বাস-ট্রাক এবং সারাদিনের তাতানো রোদে খাবি খেতে খেতে এখন ঝিমুতে থাকা গাছপালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খুঁজতে থাকলাম মন ভালো করার মতো কিছু পাওয়া যায় কি-না।

ওভারব্রিজ পেরিয়ে ফার্মগেট থেকে দক্ষিণমুখো বাসে ওঠার আগে হাঁটতে হাঁটতে বাদাম বা বুট চিবুনো অনেকটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। বুট শেষ হয়ে যেতেই দলা করে কাগজটা পথের পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছিলাম। থেমে গেলাম কাগজের টুকরোর ছবিটিতে হঠাৎ চোখ আটকে যাওয়ায়। কাগজের রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছিল বড়জোর মাসখানক আগেকার খবরের কাগজের টুকরো এটি।

সেদিন একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল অফিসে বেরুতে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সবে মোজা জোড়া পায়ে গলাচ্ছি অমনি ঘুমের চোখ দুটোকে একটু ফাঁক করে নীলা বলে উঠল, ‘খুব তো বেড়ে রাখা ভাত গিলে বেরিয়ে যাচ্ছ! ছেলে-মেয়ে দুজন কী খেয়ে স্কুল যাবে সে খেয়াল আছে?’ অগত্যা কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বুয়াকে দরজা লাগাতে বলে দোকানে ছুটলাম পাউরুটি আনতে। মেয়াদ-তারিখ মিলিয়ে পাউরুটি কিনতে বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরতে হয়েছিল।

মতিঝিল শাপলা চত্বরে পৌঁছামাত্র বাসে ঝুলে পড়তে পারলে অবশ্য সময়মতোই অফিসে পৌঁছা যেতো, শুধু চায়ের বিলাসিতাটা এ বেলা বাদ দিতে হতোÑ এই যা। হনহনিয়ে হাঁটছিলাম। মানিকনগর থেকে বিশ্বরোড পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গোপীবাগ রেলগেট পার হতেই ইচ্ছে হচ্ছিল আজ একটু শেয়ারে রিক্সা চেপে ইত্তেফাকের মোড় পর্যন্ত যাই। দেরি যখন হয়েই গেছে সময় বাঁচাতে এটুকু বাড়তি খরচ করাই যেতো। মাস শেষের গোনা পয়সার কথা মনে হতে সে ইচ্ছের গলা টিপে ধরেছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের আগে নতুন একটা রাস্তা হয়েছেÑ বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে সেটি গিয়ে মতিঝিল-কমলাপুর রাস্তায় পড়েছে। সে রাস্তা ধরেই রোজ মতিঝিলে যাই; মধুমিতা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা এসে মিশেছে এ পথেÑ সেদিক দিয়েই।

নতুন রাস্তাটির দু পাশে এরই মধ্যে কয়েকটি অটোমোবাইল গ্যারেজ ব্যবসা বেশ জমিয়ে তুলেছে। ধাই ধাই করে হাঁটছি। হঠাৎ পাশ থেকে এক মহিলা আমাকে থামিয়ে দিল। ‘ভাইজান, এই রাস্তায় কি মালিবাগ যাইতে পারুম?’ উটকো ঝামেলা! বেশভুষা দেখে একেবারে ভিখিরিনিও মনে হচ্ছে না। না শোনার ভান করে চলেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু থেমে গেলাম। ছোটবেলায় স্কাউট ছিলাম। তখন তিনটি প্রতিজ্ঞা আর দশটি আইন মুখস্থ করানো হয়েছিল। সেই দশটি আইনের একটি ছিল রোজ অন্তত একটি পরোপকার করা। সুযোগ পেলে এখনো এই আইনটি মেনে চলার চেষ্টা করি। ‘এই রাস্তা ধরে একটু সামনে গেলে বাঁদিকে একটি রাস্তা গেছে, সেটি ধরে মতিঝিলে চলে যান। সেখান থেকে মালিবাগ-মৌচাকের দিকে যাওয়ার বাসে উঠে মালিবাগে নেমে পড়বেন।’ বলে আবার হাঁটতে শুরু করেছিলাম। কিছুদূর আসতেই মনে হয়েছিলÑ মহিলা মতিঝিলে যাওয়ার রাস্তা চেনে তো? অগত্যা পিছু হটে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘মতিঝিল চেনেন তো?’

‘না বাই।’

‘আচ্ছা বেশ, আমার পিছু পিছু আসুন। আমিও মতিঝিলে যাচ্ছি। আপনাকে মালিবাগে যাওয়ার বাস দেখিয়ে দেব।’ এবার গতি একটু কমিয়ে হাঁটতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরপর পেছন ফিরে দেখছিলাম মহিলা আমাকে ঠিকমতো অনুসরণ করতে পারছেন কিনা।

অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছেÑ মনে হতেই আমার চলার গতি বেড়ে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিলাম মহিলার কথা। মধুমিতা সিনেমা হল পেরিয়ে ঘরোয়া রেস্তরাঁর কাছে এসেই মনে পড়ে গেল আবার। কিন্তু পেছন ফিরে তাকিয়ে মহিলাকে আর দেখতে পেলাম না। মনে মনে ভাবলামÑ যাক, বাঁচা গেছে; নিজে থেকেই কেটে পড়েছে। হয়তো কাউকে সঙ্গী পেয়ে গেছে! আরেক নজর পেছনে তাকিয়ে মহিলাকে না দেখে অনেকটা নিশ্চিত হয়ে লম্বা কদমে আবার হাঁটতে শুরু করেছিলাম।

দশ কদম যেতেই পা-জোড়া গাড়িতে কড়া ব্রেক কষে থেমে গেলাম। মহিলা কোনো বিপদে পড়ল না তো! উপকার করতে গিয়ে এ পথ দিয়ে এনে আমিই কি তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলাম! নাহ্, তাকে মালিবাগের বাসে তুলে না দিলে অফিসে গিয়েও শান্তি পাব না। এবার ঘুরে উল্টোপথে হাঁটতে হাঁটতে মহিলাকে খুঁজতে লাগলাম। এবং পেয়েও গেলাম কয়েক কদম যেতেই। অফিসমুখো মানুষের ভিড়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে আমাকেই খুঁজছে।

আমাকে দেখতে পেয়ে সে হাঁটতে শুরু করলে আমিও ঘুরে শাপলা চত্বরের দিকে এগুতে থাকলাম। এবার আর হনহনিয়ে হেঁটে দূরত্ব বাড়ালাম না। অনেকটা পাশাপাশিই হাঁটতে থাকলাম। ঢাকা মহানগরীতে কত ধরনের প্রতারণাচক্র আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মহিলা আমাকে কোনো ফাঁদে ফেলছে না তো! একটু বাজিয়ে নিতে হয়।

‘মালিবাগের কোথায় যাবেন?’

‘টুইন টাওয়ার।’

‘ওটা তো মালিবাগের আগে। আপনাকে মালিবাগে নেমে পেছন দিকে আবার বেশ খানিকটা হেঁটে আসতে হবে। ওখানে কার কাছে যাবেন?’

‘আমি ওইখানে এক বাসায় কাম করি।’

সন্দেহ হতে লাগল। বাসা-বাড়িতে কাজ করে অথচ সেখানে যাওয়ার পথ চেনে নাÑ এমন তো সাধারণত দেখা যায় না। অবশ্য নতুন এলে এমনটা হতেই পারে। ‘কতদিন ধরে কাজ করেন? আর এদিকে গিয়েছিলেনইবা কোথায়?’

‘বাই ঢাহায় আসছি পরাই মাস সাতেক হবি। আর এই বাসায় কামে ঢুকছি দুই মাস আগে। আমি মাণ্ডায় গেছিলাম।’

সন্দেহটা রয়েই গেল। মাণ্ডা থেকে মালিবাগে যেতে এ পথে কেন? শাপলা চত্বরে এসে গিয়েছিলাম। সন্দেহ ঘোচাতে তাই আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। মালিবাগ-মৌচাক হয়ে যে বাসগুলো টঙ্গীর দিকে যায় সেগুলো যেখানে থামে সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। এ লাইনে অনেকক্ষণ পরপর বাস আসে। ব্যাপারটা জানা থাকলেও আজ খুব বিরক্ত লাগছিল।

‘আপনার কাছে বাস ভাড়া আছে তো?’

‘না, বাই।’

বিশ টাকার একটি নোট তার হাতে গুঁজে দিয়েছিলাম। মহিলা কোনো আপত্তি না করায় সন্দেহটা আরো বেড়ে গিয়েছিল। তবুও কেটে পড়তে মন সায় দিচ্ছিল না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও এ রুটের বাসের কোনো দেখাই পেলাম না। এমনিতেই এ রুটে বাস কম, তার ওপর এখন অফিস টাইম। যেদিক দিয়ে বাস আসবে সেদিকে আমার দৃষ্টিকে আড়াল করে একটি খালি রিক্সা এসে দাঁড়িয়ে থাকল। ইচ্ছে হচ্ছিল কষে এক ধমক লাগাই চ্যাংরামতো রিক্সাওলাকে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলাম।

না, আর পারা যাচ্ছে না। ধৈর্যটা আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলাম না। ‘তিনের বি নম্বর বাস এলে তাতে উঠে পড়বেন।’ বলে আমি আমার বাসের দিকে পা বাড়াতেই মহিলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে উঠল, ‘বাই, আমি তো পইড়বার পারমু না! আপনে আমারে হাঁইট্যা যাওনের পথটা চিনাইয়া দেন।’

ভালো বিপদ তো! মামাবাড়ির আবদার! মনে মনে রাগে রীতিমতো ফুঁসছিলাম। রাগের সঙ্গেই এতক্ষণে ভালো করে তাকালাম মহিলার দিকে। ছোটখাটো গড়নের ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের মহিলার হাতে একটি বাজার করার ব্যাগ, তা থেকে উঁকি মারছে প্লাস্টিকের কয়েকটি খালি টিফিনবাটি। চোখ-মুখে ভীতির ছায়া। রাগের ভেতরেও একটু মায়া জমল মনে।

অগত্যা বেয়াড়ার মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাটার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মালিবাগ টুইন টাওয়ারে যাবে কিনা। ভেবেছিলাম যেতে চাইবে না। আরো কয়েকটা রিক্সা খোঁজার ফাঁকে বাস চলে আসবে আর আমি মহিলাকে তাতে তুলে দিয়ে মুক্তি পাব। কিন্তু যেন দুর্গতি আমাকে বাগে পেয়ে গিয়েছিল। রিক্সাওলা যেতে রাজি হলো এবং যৌক্তিক ভাড়াই চাইল। আমি আর দর কষাকষি না করে মহিলাকে উঠতে বলে নিজেও উঠে পড়লাম।

কিছুদূর যেতেই হুঁশ হলো। মহিলা রিক্সায় উঠতে আপত্তি করল না কেন? তার কাছে আমি তো এক বেগানা পুরুষ! বাস থামার ঐ জায়গাটায় তো ওভাবে রিক্সা এসে থেমে থাকার কথা নয়! আর প্রথম জিজ্ঞাসাতেই যেতে রাজিই বা হলো কেন রিক্সাওলা? তাও আবার সুযোগ বুঝে অনেক বেশি ভাড়া হাঁকল না! তবে কি আগে থেকেই সব ঠিক করে রাখা? শিকার ধরার কৌশল? মনে পড়ে গেল এক অফিস কলিগের বলা অভিজ্ঞতার কথা :

‘... মহিলা আস্তে আস্তে আমার আরো কাছে সরে এলো। তার বাজারের ব্যাগটা দু পায়ের মাঝখানে রেখে বাঁহাত দিয়ে ব্যাগের মুখের ফিতে ধরে রেখে ডানহাতটা আমার পিঠের পেছন দিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে আমার পাশের হুডটা আঁকড়ে ধরল। রিক্সার ঝাঁকুনিতে বারবার তার বুকটা এসে আমার শরীরের বাঁপাশটা ছুঁয়ে দিচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম অনিচ্ছায়। কিন্তু তার পরেই সে আমার পিঠের ওপরে হাত এনে আলতো চাপ দিল। এবার আর কোনো সন্দেহ রইল না সে ইচ্ছে করেই এমন করছে। স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকায় বহুদিন কোনো নারীর এমন ছোঁয়া পাইনি। নিজেকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। বাঁ হাত বাড়িয়ে তাকে আরো কাছে টেনে নিলাম। রাস্তার চারপাশে নজর বুলিয়ে তার শরীরের এখানে-সেখানে হাত চালাতে থাকলাম।

রিক্সাটা কোন ফাঁকে শান্তিনগরের এক এঁদো গলিতে ঢুকে পড়েছে টের পাইনি। হঠাৎ আকাশ কালো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। নির্জন গলিতে নেমে এলো অন্ধকার। একসময় কড়া ব্রেক চেপে থেমে গেল রিক্সা। দু পাশ থেকে পিস্তল উঁচিয়ে দুজন লোক এসে আমার মোবাইল, মানিব্যাগ সবকিছু কেড়ে নিল। তারপর একজন একটি লাথি মেরে আমাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে বলে উঠল, ‘শালা, লুচ্চা মাল! মাইয়া মানুষ দেখলে হুঁশ থাহে না!’ রাস্তায় ছিটকে পড়তেই এক ঝাঁকুনিতে জ্ঞান হলো আমার।...’

বাস্তবে ফিরতেই দেখি কড়া রোদের ভেতর রিক্সাটা ফকিরার পুল পেরিয়ে রাজারবাগের দিকে ডুকছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মহিলা রিক্সার ওপাশটায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ছোঁয়া তো দূরের কথাÑ বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে শক্ত হয়ে আছে সে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ, কী বাজে ভাবনাই ভেবেছি এতক্ষণ তাকে নিয়ে। আসলে তার মতো মেয়েদের আমরা কিছুতেই যেন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না। আমরাÑ মানে নিজেদের যারা ভদ্রলোক বলে জাহির করে থাকি।

এবার একটু স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম।

‘আপনার বাড়ি কোথায়?’

‘গাইবান্ধার চরে।’

‘মাণ্ডায় কোথায় গেছিলেন?’

‘সুয়ামির কাছে। সেহানকার এক বস্তিতে আমারে আইন্যা তুলছে হ্যায়। টুইন টাওয়ারের বাসায় কাম পাওনের পর এই পেত্থম গেলাম হ্যানে।’

‘ছেলে-মেয়ে?’

‘এক পোলা। তারে লেহাপড়া শিহাইচ্ছি। তার জন্যিই তো খাইট্যা মরিচ্ছি দুইজনে।’

‘আপনার স্বামী কী করেন?’

‘হ্যায় বাই রিক্সা চালায়। তয় এট্টু আইলস্যা কিছিমের মানুষ। দুইদিন রিক্সা চালায় তো তিনদিনই কামাই দেয়। আমি কাম পাওনের পর তো আরো আইলস্যামি করে। দুইদিন পরপরই আমার কাছে যাইয়া প্যাট জাইত্যা খাইয়া আসে।’

‘ছেলে কার কাছে থাকে?’

‘দ্যাশে, হ্যার দাদাবাড়ি।’

আচ্ছা এমনও তো হতে পারে মহিলা আমাকে যা যা বলছে তার সবই বানোয়াট! এই মুহূর্তে সে যদি চিৎকার করে লোক জড়ো করে আমার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে?

ধ্যাত! কী যে উল্টাপাল্টা ভাবছিলাম! নিজের মনের এক মহৎ উদ্দেশ্যকে কেন এমন নোংরা পথে হাঁটাচ্ছিলাম? শান্তিনগর মোড়ের কাছে অনেকক্ষণ জ্যামে আটকে ছিল রিক্সা। আমি আর কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না তাকে। মনের এতক্ষণের ভাবনাগুলোর জন্য নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। আড়চোখে অবশ্য বেশ কয়েকবার তাকিয়ে তাকে ভালো করে দেখে নিয়েছিলাম। নাকের ওপর বেশ বড় একটা কালো তিল। অনেকটা জরুলের মতো।

টুইন টাওয়ারের উল্টোদিকে এসে রিক্সা থামিয়েই তাকে বললাম, ‘ঐ তো টুইন টাওয়ার। এবার যেতে পারবেন তো?’

‘হ বাই। পারমু। বাই আপনেও নামেন। আপনের রিক্সা ভাড়ার ট্যাকা দিয়া দিবানি বেগম সাবের কাছ থাইক্যা। আপায় খুব ভালা মানুষ। রেডিও-টেলিভিশনে গান করে। আরো কত্তো কত্তো জায়গায় যায় গান গাইবার!’

‘না বোন। রিক্সা ভাড়ার টাকা দিতে হবে না। আপনি শুধু আমার ছেলে-মেয়ে আর ওদের মায়ের জন্য দোয়া করবেন।’

‘হ বাই, মন খুইল্যা দোয়া করমু।’

রিক্সাওলাকে তাড়া দিতেই সে সামনে যেতে থাকল। মালিবাগের কাছে এসে নেমে পকেট হাতড়ে দেখি ভাংতি টাকা নেই। ‘তোমার কাছে এক শ টাকার ভাংতি হবে?’

‘না, সাব।’

‘তবে একটু দাঁড়াও। আমি টাকা ভাঙিয়ে আনি।’

‘না, সাব। ভাড়া লাগবো না।’ বলে আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্যাডেল মেরে দ্রুত সামনে বাড়ল। আমি থ মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। অমানুষ দেখতে দেখতে মানুষ চিনতে ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর মালিবাগের মোড়ের দিকে ৬ নম্বর বাস ধরার জন্য ছুটেছিলাম। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম দেরির জন্য অফিসে কী অজুহাত দেব।

বুট ভাজার কাগজের ছবিটার দিকে আবারো ভালো করে তাকালাম। মেলে ধরলাম বৃষ্টিধোয়া শেষবিকেলের কমলা-রোদে। সেই চেহারা। নাকের ওপর বড় একটা কালো তিল। এক তরুণের এক পাশে দাঁড়িয়ে সে। অন্যপাশের লোকটা নিশ্চয়ই তার স্বামী! এবার ছবিটার ক্যাপশনে চোখ গেল। সেখানে লেখা, ‘এসএসসিতে জিপিএ গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছেলের পাশে গর্বিত রিক্সাওলা বাবা এবং গৃহপরিচারিকা মা।’