ঘরেফেরা ও আনন্দ-বেদনার উৎসব

শেখর ভট্টাচার্য

বাঙালির মন বড়ই কোমল। বাঙালির মন যে কোমল- এ প্রসঙ্গ হঠাৎ কেনো? ভূমিকা না দিলে আমার বয়ানকে খোলাসা করা যাবে না। লকডাউন শুরু হলো এবার ‘কঠোর লকডাউন’ নাম দিয়ে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে। যখন প্রতি দিন গড়ে প্রায় একশ’ মানুষ মারা যাচ্ছেন। আক্রান্তের সংখ্যা দিনে চার হাজারের মতো। এই কঠোর ‘লকডাউন’ নাম দিয়ে হলো আরেক বিপদ। বাঙালি যে এত কৌতূহলী, নীতি-নির্ধারকদের ধারণা ছিল না। পুলিশ চেকপোস্ট বসালো পথে পথে। প্রাইভেটকার, অ্যাম্বুলেন্স, অটোরিক্সায়, কেউ কেউ হেঁটে হেঁটে ছুটছে। পথে পথে উৎসব। উৎসব কেনো? প্রথম কিছুদিন কিছু মানুষ রাস্তায় নেমেছে, কঠোর লকডাউন কী এই অভিনব বিষয়টি দেখার জন্য, বোঝার জন্য। পুলিশ প্রথম কয়েক দিন যানবাহন থামিয়ে বের হওয়ার যৌক্তিকতা জিজ্ঞেস করে মানুষজনদের। যুক্তি শুনে আক্কেলগুড়ুম। কারো বাড়ি রঙ করতে হবে, কারো অনেক দিন বেয়াই সাহেবের বাড়ি যাওয়া হয়নি। কেউ ‘জাতীয় ছুটির’ এই সময়ে মেয়ের বিয়েটা সেরে ফেলতে চান। আমার কথাগুলো কেউ যদি যাচাই করতে চান তাহলে, বাংলদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের নিউজ ফুটেজ কিংবা সংবাদপত্রের পাতা খোলে দেখতে পারেন।

পথে বের হওয়া মানুষের সঙ্গে পুলিশের কথোপথন শোনা যুগপৎ আনন্দ ও বেদনাদায়ক। আমার মনে হয় করোনাকাল শেষ হয়ে গেলে, আনন্দ দায়ক কারণগুলোর শীর্ষে থাকবে যে কারণ, সেটি হলো, কঠোর লকডাউন দেখার জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে পথে নামা। এই যে বললাম বাঙালির মন কোমল, এই কোমলতার কারণেই, কঠোর লকডাউনের প্রাথমিক সময়ে কঠোর আইনের থেকে মানুষের সখ মেটানোকে অগ্রাধিকার দেয়া হলো, পথে বের হওয়া মানুষের অহেতুক কারণগুলো কঠিনভাবে না দেখে মানবিক(!) ভাবে দখা হলো। বাংলাদেশে আজকাল অনেকেই অনেক কিছু করে মানবিকতার কারণে। মানবিকতার কারণে আজকাল আমাদের এই কঠিন সংস্কারে পরিপূর্ণ এই সমাজে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে হচ্ছে আবার অন্ধভাবে ভক্তরা চুক্তিভিত্তিক আইন পরিপন্থি বিয়েকে মেনেও নিচ্ছেন। বাংলাদেশের থেকে দশ বছর বেশি বয়সী মানুষ আমি। এ রকম চুক্তি ভিত্তিক মানবিকতার বিয়ের কথা শোনা হয়নি আমার কোন কালে। তবে বঙ্গে এবং দুনিয়ায় রঙ্গের অভাব হয়না কখনো। আমাদের সিলেটের বিখ্যাত গায়ক অমর পালের সেই বিখ্যাত সংগীতে অনেক আগেই এ কথা বলা হয়েছে, ‘ও ভাই ভাইরে, কতোই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।’

সত্যজিত বাবু আবার আমাদের সিলেটি বাবুর গানটির গুরুত্ব বুঝে, যতœ করে তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র হীরক রাজার দেশেতে যথাযথভাবে ব্যবহার করেছেন গানটি। ভাবতে ভালোই লাগে মানবতার নামে করোনাকালের এই চরম বেদনা ভারাক্রান্ত সময়েও বাঙালি রঙ্গ রস করে তারা যে হিউমারাস জাতি, এ কথাটি বিশ্বকে জানাতে উদগ্রীব।

বাঙালির কোমল হৃদয় আমরা দেখলাম আর একটি ক্ষেত্রে। কোমল হৃদয়ের নীতি নির্ধারকরা বড় বড় শপিং মলের ব্যবসায়িরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই কথা ভেবে এবং তাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করের শপিং মল গুলোও খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত দিলেন ‘কঠোর লকডাউনের’ সময়ে। সরকার থেকে বলা হলো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন ব্যবসা বাণিজ্য চলে। আহা স্বাস্থ্যবিধি। মাস্ক পরা লোকের সংখ্যা খুব বেশি নেই। বেশির ভাগেরই মাস্ক আছে থুঁতনিতে। কারো কারো পকেটে। কারো মাস্ক বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে মনে থাকেনা। মাস্ক পরে না পরে যারা ঈদের বাজার করতে শপিং মলে ঢোকেন তারা অতিমারির কালে নিজের জন্য ঈদের বাজার করতে আসেন না। তারা আসেন পরিবারের ছোট ছোট শিশুদের জন্য। সবাই একই কথা বলছেন, ‘আমাদের ঈদের বাজার করার ইচ্ছে ছিলো না শিশুদের জন্য বাধ্য হয়ে আসতে হলো।’ আবার টেলিভিশন সংবাদে আমরা দেখি শিশুদের থেকে বুড়োখোকা, খুকিদের কাপড় পোশাকের দোকানে ভিড় বেশি। আহারে শিশুর দল তোমরা এই ঈদে বড়ই অবলা থেকে গেলে।

কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছিলো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, ইংরেজি ১৪ এপ্রিল। লকডাউনকে কঠোরতম করে ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে অনুরোধ করেছিলেন যে যেখানে আছেন, সেখানে থেকেই ঈদ উদযাপনের জন্য। জলে স্থলে যখন মানুষ নিজেদের উৎসর্গ করার জন্য পাগলের মতো ভীড় করছে তখন তিনি আবারও ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘আপনারা পথে নেমে নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও বিপদগ্রস্ত করবেন না।’ আমাদের সরকারি দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার স্বভাব সুলভ অনন্য ভঙ্গিতে অনুরোধ করলেন এভাবেÑ ‘ঈদযাত্রা যেন অন্তিম যাত্রা না হয়।’ এতো হুশিয়ারি, এতো কথা শোনার সময় কোথায়? জলে , স্থলে, অন্তরীক্ষে বাঙালি ছুটছে। বাঙালি প্রতি বছরই নানা উৎসবে বাড়ি ছোটে, এবারো একই উৎসাহে ছুটছে। বাঙালির এই ছোটা আজকের নয়, বঙ্কিম চন্দ্র থেকে নজরুলের আমলেও আমরা এই ছুটে চলার গল্প শুনতে পাই। সে সময় মানুষ সুদূর ব্রহ্মদশ থেকে উৎসবে বাড়ি ফিরতো। ওই সময়ের উপন্যাসে নায়কেরা গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে নানান স্থানে যেতো। এখন ফেরে পাটুরিয়া, শিমুলিয়া ঘাটসহ নানা ফেরিঘাট দিয়ে। বাঙালি ফিরে উৎসবে আর ফিরে দুর্যোগে, প্রাণ বাঁচানোর জন্য। মানুষের ওই ফেরাকে ঠেকানোর সাধ্য কার?

একাত্তরে শহর থেকে গ্রামে ফিরেছিল মানুষ প্রাণের ভয়ে। গ্রাম প্রথম দিকে কিছুটা নিরাপদ ছিল। মানুষের ওই গ্রামে ছোটার কথা শুনলে কিংবা টেলিভিশনে দেখলে তাই আমার সৈয়দ শামছুল হকের বিখ্যাত কাব্য নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এর প্রথম দৃশ্যের সংলাপ গুলো মনে হয়।

মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা/মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ি নাগেশ্বরী থিকা/মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান/মানুষ আসতে আছে মহরামের ধূলার সমান।

যদিও এখন যুদ্ধ দিন নেই। কোন শত্রু আমাদের পেছনে অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রাণ হরণ করার জন্য তাড়া করছে না। তবুও যুদ্ধ দিনের মতো আমাদের ‘যমুনার বানের লাহান’ বাড়ির দিকে ছুটতে হবে। যুদ্ধ দিনের মতোই প্রাণ হাতে নিয়েই ছুটতে হবে কেনো? এবার কেনো মানুষ স্বজনদের বিপদে ফেলার জন্য ছোটবেন? প্রতি বছর এই ছোটে চলাকে কেউ নেতিবাচক ভাবে দেখে না, দেখার কোন কারণো নেই। ঈদ, পূজার মতো পার্বণে নাড়ির টানে মানুষ কাছের মানুষের কাছে যেতে চায়, এই যাওয়া, যেতে চাওয়ার ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে অন্যের জন্য মৃত্যুর আয়োজনকে ত্বরান্বিত করে এরকম পাগলের মতো ছোটাকে শুধু সরকার নয়, সকল শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা অশনিসংকেত বলে মনে করছেন।

সবাই ভয়ে আছেন, দ্বিতীয় ঢেউ যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে তখন আমরা সবাই মিলে কী তৃতীয় ঢেউকে ঈদের পর আমাদের এই ছোট, ঘনবসতিপূর্ণ দেশে আমন্ত্রণ জানানোর চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে করোনার মারাত্মক ‘ভারতীয় ধরন’ বাংলাদেশে ধরা পড়েছে। মে মাসের নয় তারিখ পর্যন্ত সরকারিভাবে ছয় জনকে শনাক্ত করা হয়েছে যারা করোনার ভয়ানক ভারতীয় ধরন বহন করছেন। আর যারা শনাক্ত হননি, তারা যদি এই ভিড়ের মধ্যে পড়ে অন্যদের শরীরে একবার ভারতীয় ধরনের করোনা ছড়িয়ে দেন, তাহলে? ভাবতেই ভয় লাগছে। নেপাল ইতিমধ্যে যথেস্ট বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ভারতের মতো নেপালের সঙ্গে ও আমাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা এতো কিছু দেখার পরও মৃত্যু কূপে ঝাঁপ দেবো?

মজার ব্যাপার হলো এই যে, যারা ছুটছেন কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করেন, কেনো এভাবে ছুটছেন তারা। তাদের সবাই আপনাকে করোনা বিশেষজ্ঞের মতো, চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দেবেনÑ না ছোটা যে কতো ভালো, ছোটাছুটি করে জাতিকে বিপদে ফেলা বড়ই অনৈতিক কাজ। শুধু তাদের ছোটার মধ্যে পৃথিবীর অলঙ্ঘনীয় কিছু যুক্তি আছে। আপনি সংবেদনশীল মানুষ হলে হয়তো নিজেই লজ্জা পাবেন। এই হলো বাঙালির চরিত্র। সব সময় জেনে শোনে বিষপান করে বাঙালি গান গাবেÑ ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান।’

সব মহামারী অতিমারিকে এক সময় পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছে কিংবা মানুষের নিয়ন্ত্রণে আসতে হয়েছে। করোনা অণুজীবও এক সময় আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবে অথবা নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমরা হয়তো আগামী বছর ঈদ সহ যাবতীয় উৎসব পালন করবো মহাআনন্দে। আমাদের আগামীর উৎসবগুলোকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য আমরা কী পারতাম না, এ বছর নিজেদেরকে আর একটু সংযমী করে তোলতে? সংযমী হওয়ার জন্য জ্ঞান, বুদ্ধিতো আমরা পেয়েছি। এই অতিমারির কালের উৎসব কি ভাবে উদযাপন হয়েছে, অতিমারি উত্তর সময়ে আমাদের উত্তরসূরীরা জানবে নানা মাধ্যমে। তখন আমাদের কান্ডজ্ঞান বিবেক বোধ নিয়ে যেনো প্রশ্ন না ওঠে।

ঈদযাত্রার সমূহ আনুমানিক বিপদের পরেও আমরা বলবো, ঈদের মতো আনন্দদায়ক উৎসব যেনো আমরা নির্ঝঞ্ঝাটে পালন করতে পারি। আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব যারা বাড়িতে চলে গেছেন নানাভাবে, তারা ফিরে আসুন নিরাপদে। তাদের উদযাপন হোক আনন্দময়। আমরা প্রার্থনা করি ঈদের পর যেন দাবানলের মতো করোনার তৃতীয় ঢেউ আমাদের দেশে ছড়িয়ে না পড়ে। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক, বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে। সমতা, ভ্রাতৃত্ব বোধ, সবাইকে কাছে টানার ঈদের যে মর্মার্থ, তা যেনো আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারি। এবারের ঈদ, সামনের বছরগুলোর ঈদ যেন হয় আনন্দময়। সবাইকে আন্তরিক ঈদ শুভেচ্ছা।

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]

মঙ্গলবার, ১১ মে ২০২১ , ২৮ বৈশাখ ১৪২৮ ২৮ রমজান ১৪৪২

ঘরেফেরা ও আনন্দ-বেদনার উৎসব

শেখর ভট্টাচার্য

image

বাঙালির মন বড়ই কোমল। বাঙালির মন যে কোমল- এ প্রসঙ্গ হঠাৎ কেনো? ভূমিকা না দিলে আমার বয়ানকে খোলাসা করা যাবে না। লকডাউন শুরু হলো এবার ‘কঠোর লকডাউন’ নাম দিয়ে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে। যখন প্রতি দিন গড়ে প্রায় একশ’ মানুষ মারা যাচ্ছেন। আক্রান্তের সংখ্যা দিনে চার হাজারের মতো। এই কঠোর ‘লকডাউন’ নাম দিয়ে হলো আরেক বিপদ। বাঙালি যে এত কৌতূহলী, নীতি-নির্ধারকদের ধারণা ছিল না। পুলিশ চেকপোস্ট বসালো পথে পথে। প্রাইভেটকার, অ্যাম্বুলেন্স, অটোরিক্সায়, কেউ কেউ হেঁটে হেঁটে ছুটছে। পথে পথে উৎসব। উৎসব কেনো? প্রথম কিছুদিন কিছু মানুষ রাস্তায় নেমেছে, কঠোর লকডাউন কী এই অভিনব বিষয়টি দেখার জন্য, বোঝার জন্য। পুলিশ প্রথম কয়েক দিন যানবাহন থামিয়ে বের হওয়ার যৌক্তিকতা জিজ্ঞেস করে মানুষজনদের। যুক্তি শুনে আক্কেলগুড়ুম। কারো বাড়ি রঙ করতে হবে, কারো অনেক দিন বেয়াই সাহেবের বাড়ি যাওয়া হয়নি। কেউ ‘জাতীয় ছুটির’ এই সময়ে মেয়ের বিয়েটা সেরে ফেলতে চান। আমার কথাগুলো কেউ যদি যাচাই করতে চান তাহলে, বাংলদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের নিউজ ফুটেজ কিংবা সংবাদপত্রের পাতা খোলে দেখতে পারেন।

পথে বের হওয়া মানুষের সঙ্গে পুলিশের কথোপথন শোনা যুগপৎ আনন্দ ও বেদনাদায়ক। আমার মনে হয় করোনাকাল শেষ হয়ে গেলে, আনন্দ দায়ক কারণগুলোর শীর্ষে থাকবে যে কারণ, সেটি হলো, কঠোর লকডাউন দেখার জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে পথে নামা। এই যে বললাম বাঙালির মন কোমল, এই কোমলতার কারণেই, কঠোর লকডাউনের প্রাথমিক সময়ে কঠোর আইনের থেকে মানুষের সখ মেটানোকে অগ্রাধিকার দেয়া হলো, পথে বের হওয়া মানুষের অহেতুক কারণগুলো কঠিনভাবে না দেখে মানবিক(!) ভাবে দখা হলো। বাংলাদেশে আজকাল অনেকেই অনেক কিছু করে মানবিকতার কারণে। মানবিকতার কারণে আজকাল আমাদের এই কঠিন সংস্কারে পরিপূর্ণ এই সমাজে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে হচ্ছে আবার অন্ধভাবে ভক্তরা চুক্তিভিত্তিক আইন পরিপন্থি বিয়েকে মেনেও নিচ্ছেন। বাংলাদেশের থেকে দশ বছর বেশি বয়সী মানুষ আমি। এ রকম চুক্তি ভিত্তিক মানবিকতার বিয়ের কথা শোনা হয়নি আমার কোন কালে। তবে বঙ্গে এবং দুনিয়ায় রঙ্গের অভাব হয়না কখনো। আমাদের সিলেটের বিখ্যাত গায়ক অমর পালের সেই বিখ্যাত সংগীতে অনেক আগেই এ কথা বলা হয়েছে, ‘ও ভাই ভাইরে, কতোই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।’

সত্যজিত বাবু আবার আমাদের সিলেটি বাবুর গানটির গুরুত্ব বুঝে, যতœ করে তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র হীরক রাজার দেশেতে যথাযথভাবে ব্যবহার করেছেন গানটি। ভাবতে ভালোই লাগে মানবতার নামে করোনাকালের এই চরম বেদনা ভারাক্রান্ত সময়েও বাঙালি রঙ্গ রস করে তারা যে হিউমারাস জাতি, এ কথাটি বিশ্বকে জানাতে উদগ্রীব।

বাঙালির কোমল হৃদয় আমরা দেখলাম আর একটি ক্ষেত্রে। কোমল হৃদয়ের নীতি নির্ধারকরা বড় বড় শপিং মলের ব্যবসায়িরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই কথা ভেবে এবং তাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করের শপিং মল গুলোও খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত দিলেন ‘কঠোর লকডাউনের’ সময়ে। সরকার থেকে বলা হলো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন ব্যবসা বাণিজ্য চলে। আহা স্বাস্থ্যবিধি। মাস্ক পরা লোকের সংখ্যা খুব বেশি নেই। বেশির ভাগেরই মাস্ক আছে থুঁতনিতে। কারো কারো পকেটে। কারো মাস্ক বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে মনে থাকেনা। মাস্ক পরে না পরে যারা ঈদের বাজার করতে শপিং মলে ঢোকেন তারা অতিমারির কালে নিজের জন্য ঈদের বাজার করতে আসেন না। তারা আসেন পরিবারের ছোট ছোট শিশুদের জন্য। সবাই একই কথা বলছেন, ‘আমাদের ঈদের বাজার করার ইচ্ছে ছিলো না শিশুদের জন্য বাধ্য হয়ে আসতে হলো।’ আবার টেলিভিশন সংবাদে আমরা দেখি শিশুদের থেকে বুড়োখোকা, খুকিদের কাপড় পোশাকের দোকানে ভিড় বেশি। আহারে শিশুর দল তোমরা এই ঈদে বড়ই অবলা থেকে গেলে।

কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছিলো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, ইংরেজি ১৪ এপ্রিল। লকডাউনকে কঠোরতম করে ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে অনুরোধ করেছিলেন যে যেখানে আছেন, সেখানে থেকেই ঈদ উদযাপনের জন্য। জলে স্থলে যখন মানুষ নিজেদের উৎসর্গ করার জন্য পাগলের মতো ভীড় করছে তখন তিনি আবারও ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘আপনারা পথে নেমে নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও বিপদগ্রস্ত করবেন না।’ আমাদের সরকারি দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার স্বভাব সুলভ অনন্য ভঙ্গিতে অনুরোধ করলেন এভাবেÑ ‘ঈদযাত্রা যেন অন্তিম যাত্রা না হয়।’ এতো হুশিয়ারি, এতো কথা শোনার সময় কোথায়? জলে , স্থলে, অন্তরীক্ষে বাঙালি ছুটছে। বাঙালি প্রতি বছরই নানা উৎসবে বাড়ি ছোটে, এবারো একই উৎসাহে ছুটছে। বাঙালির এই ছোটা আজকের নয়, বঙ্কিম চন্দ্র থেকে নজরুলের আমলেও আমরা এই ছুটে চলার গল্প শুনতে পাই। সে সময় মানুষ সুদূর ব্রহ্মদশ থেকে উৎসবে বাড়ি ফিরতো। ওই সময়ের উপন্যাসে নায়কেরা গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে নানান স্থানে যেতো। এখন ফেরে পাটুরিয়া, শিমুলিয়া ঘাটসহ নানা ফেরিঘাট দিয়ে। বাঙালি ফিরে উৎসবে আর ফিরে দুর্যোগে, প্রাণ বাঁচানোর জন্য। মানুষের ওই ফেরাকে ঠেকানোর সাধ্য কার?

একাত্তরে শহর থেকে গ্রামে ফিরেছিল মানুষ প্রাণের ভয়ে। গ্রাম প্রথম দিকে কিছুটা নিরাপদ ছিল। মানুষের ওই গ্রামে ছোটার কথা শুনলে কিংবা টেলিভিশনে দেখলে তাই আমার সৈয়দ শামছুল হকের বিখ্যাত কাব্য নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এর প্রথম দৃশ্যের সংলাপ গুলো মনে হয়।

মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা/মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ি নাগেশ্বরী থিকা/মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান/মানুষ আসতে আছে মহরামের ধূলার সমান।

যদিও এখন যুদ্ধ দিন নেই। কোন শত্রু আমাদের পেছনে অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রাণ হরণ করার জন্য তাড়া করছে না। তবুও যুদ্ধ দিনের মতো আমাদের ‘যমুনার বানের লাহান’ বাড়ির দিকে ছুটতে হবে। যুদ্ধ দিনের মতোই প্রাণ হাতে নিয়েই ছুটতে হবে কেনো? এবার কেনো মানুষ স্বজনদের বিপদে ফেলার জন্য ছোটবেন? প্রতি বছর এই ছোটে চলাকে কেউ নেতিবাচক ভাবে দেখে না, দেখার কোন কারণো নেই। ঈদ, পূজার মতো পার্বণে নাড়ির টানে মানুষ কাছের মানুষের কাছে যেতে চায়, এই যাওয়া, যেতে চাওয়ার ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে অন্যের জন্য মৃত্যুর আয়োজনকে ত্বরান্বিত করে এরকম পাগলের মতো ছোটাকে শুধু সরকার নয়, সকল শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা অশনিসংকেত বলে মনে করছেন।

সবাই ভয়ে আছেন, দ্বিতীয় ঢেউ যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে তখন আমরা সবাই মিলে কী তৃতীয় ঢেউকে ঈদের পর আমাদের এই ছোট, ঘনবসতিপূর্ণ দেশে আমন্ত্রণ জানানোর চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে করোনার মারাত্মক ‘ভারতীয় ধরন’ বাংলাদেশে ধরা পড়েছে। মে মাসের নয় তারিখ পর্যন্ত সরকারিভাবে ছয় জনকে শনাক্ত করা হয়েছে যারা করোনার ভয়ানক ভারতীয় ধরন বহন করছেন। আর যারা শনাক্ত হননি, তারা যদি এই ভিড়ের মধ্যে পড়ে অন্যদের শরীরে একবার ভারতীয় ধরনের করোনা ছড়িয়ে দেন, তাহলে? ভাবতেই ভয় লাগছে। নেপাল ইতিমধ্যে যথেস্ট বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ভারতের মতো নেপালের সঙ্গে ও আমাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা এতো কিছু দেখার পরও মৃত্যু কূপে ঝাঁপ দেবো?

মজার ব্যাপার হলো এই যে, যারা ছুটছেন কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করেন, কেনো এভাবে ছুটছেন তারা। তাদের সবাই আপনাকে করোনা বিশেষজ্ঞের মতো, চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দেবেনÑ না ছোটা যে কতো ভালো, ছোটাছুটি করে জাতিকে বিপদে ফেলা বড়ই অনৈতিক কাজ। শুধু তাদের ছোটার মধ্যে পৃথিবীর অলঙ্ঘনীয় কিছু যুক্তি আছে। আপনি সংবেদনশীল মানুষ হলে হয়তো নিজেই লজ্জা পাবেন। এই হলো বাঙালির চরিত্র। সব সময় জেনে শোনে বিষপান করে বাঙালি গান গাবেÑ ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান।’

সব মহামারী অতিমারিকে এক সময় পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছে কিংবা মানুষের নিয়ন্ত্রণে আসতে হয়েছে। করোনা অণুজীবও এক সময় আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবে অথবা নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমরা হয়তো আগামী বছর ঈদ সহ যাবতীয় উৎসব পালন করবো মহাআনন্দে। আমাদের আগামীর উৎসবগুলোকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য আমরা কী পারতাম না, এ বছর নিজেদেরকে আর একটু সংযমী করে তোলতে? সংযমী হওয়ার জন্য জ্ঞান, বুদ্ধিতো আমরা পেয়েছি। এই অতিমারির কালের উৎসব কি ভাবে উদযাপন হয়েছে, অতিমারি উত্তর সময়ে আমাদের উত্তরসূরীরা জানবে নানা মাধ্যমে। তখন আমাদের কান্ডজ্ঞান বিবেক বোধ নিয়ে যেনো প্রশ্ন না ওঠে।

ঈদযাত্রার সমূহ আনুমানিক বিপদের পরেও আমরা বলবো, ঈদের মতো আনন্দদায়ক উৎসব যেনো আমরা নির্ঝঞ্ঝাটে পালন করতে পারি। আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব যারা বাড়িতে চলে গেছেন নানাভাবে, তারা ফিরে আসুন নিরাপদে। তাদের উদযাপন হোক আনন্দময়। আমরা প্রার্থনা করি ঈদের পর যেন দাবানলের মতো করোনার তৃতীয় ঢেউ আমাদের দেশে ছড়িয়ে না পড়ে। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক, বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে। সমতা, ভ্রাতৃত্ব বোধ, সবাইকে কাছে টানার ঈদের যে মর্মার্থ, তা যেনো আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারি। এবারের ঈদ, সামনের বছরগুলোর ঈদ যেন হয় আনন্দময়। সবাইকে আন্তরিক ঈদ শুভেচ্ছা।

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]