গৃহহীনদের জন্য ঘর, যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়ার দুশ্চিন্তা

মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর গৃহহীনদের গৃহ দেয়ার কর্মসূচিতে যে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো কত বছর টিকবে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটা সক্ষম তা নিয়ে ইতোমধ্যে যারা ঘর পেয়েছেন বা ঘর নির্মাণ করতে দেখেছেন তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

বরিশাল সদর উপজেলার রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের শোলনা গ্রামের মো. আলাউদ্দিনের (৭৫) স্ত্রী মমতাজ বেগম (৫৫) তার নামে বরাদ্দকৃত ঘর দেখে বলছিলেন ভাঙ্গাচোরা হলেও আগে আমার একটা ঘর ছিল। সরকারের দেয়া নতুন ঘর পাবার আশায় পুরান ঘরটা ভেঙে ফেলেছেন।

নতুন ঘর পেতে অনেক টাকাও খরচ করেছেন। কয়েক মাসেও ঘরের কাজ শেষ না হওয়ায় এখন অন্যের ঘরে থাকেন কিন্তু যে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে যে কোন সময়ে ঘরচাপা পড়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আঙ্গুলের এক কর দেখিয়ে বললেন- এইটুকু মাটি খুঁড়ে ইটগাঁথা শুরু করেছে। এইঘর বাতাসে পড়ে যাবে।

আলাউদ্দিন এক সময়ে বরিশাল নগরীর পোর্ট রোডে দিনমজুরের কাজ করতেন। বয়সের ভারে এখন কিছুই করেন না। একমাত্র ছেলেটি সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছে। বিয়ে হয়ে গেছে চার মেয়ের। শোলনা গ্রামের সেরাজ মাওলানার বাড়ি তার স্থায়ী ঠিকানা। সেখানে তার একটি ছাপড়া ঘর ছিল। সরকারি উদ্যোগে ১ লাখ টাকায় আধাপাকা এক কক্ষের ঘর নির্মাণ করে দেয়ার প্রকল্পের আওতায় একটি ঘর পেয়েছেন এই দম্পতি। কিন্তু ঘরটি নিয়ে ইউপি সদস্য মোসাম্মৎ কাজল ও ঠিকাদার এইচএম সুমনের নানামুখী বানিজ্যে ‘ঘরের আশায় গৃহহীন’ হওয়ার উপক্রম হয়েছে হতদরিদ্র আলাউদ্দিন-মমতাজ দম্পতির।

তাদের অভিযোগ, গত জানুয়ারি মাসে নতুন ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু করলেও এখনও কাজ শেষ করেননি ঠিকাদার। সেসময় থেকে তারা চাচা শ্বশুরের ঘরে থাকছেন। বিনামূল্যে ঘর পাওয়ার কথা থাকলেও ধারদেনা করে এ পর্যন্ত ২২ হাজার টাকা খরচ করেছেন তারা। আরও টাকা খরচ করতে না পারায় ঠিকাদার নির্মাণ কাজ শেষ করছেন না। খরচের হিসাব জানিয়ে মমতাজ বেগম বলেন, ঘরটি পাইয়ে দেয়ার জন্য ইউপি মেম্বর কাজল বেগম নিয়েছেন ১৫ হাজার টাকা। ইট কেনার জন্য ঠিকাদার নিয়েছেন ৫ হাজার টাকা এবং রাস্তার ওপর রাখা ইট-বালু বাড়িতে আনতে শ্রমিক মজুরি দিয়েছেন ২ হাজার ২০০ টাকা। এর সঙ্গে তাদের নিজেদের শ্রম তো আছেই।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাড়ে ৬ ফুট উঁচু ১৮দ্ধ২২ ফুটের দেয়াল দিয়ে একটি কক্ষের অবকাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে আলাউদ্দিন-মমতাজ দম্পতির ভিটিতে। পিলারহীন নির্মিত এ কক্ষটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আলাউদ্দিনের দেয়া তথ্যমতে, মাটির নিচে গাঁথুনি দেয়নি ঠিকাদার। তাই মাটি ফেলে ভিটি তৈরি করেছেন দেয়াল মজবুত করার জন্য। মমতাজ বেগম অভিযোগ করেন, ঠিকাদার তাকে কাঠমিস্ত্রি খুঁজে বের করতে বলেছেন টিনের চাল ও দরজা-জানালা করে দেয়ার জন্য কিন্তু ঠিকাদার যে মজুরির কথা বলছেন, তাতে মিস্ত্রি পাওয়া যায় না। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ঠিকাদার এইচএম সুমন দাবি করেন, সরকারি অনুমোদন অনুযায়ী ঘরটি নির্মাণ হবে ১৬ বাই ১৬ ফুট। আলাউদ্দিন-মমতাজ দম্পতি ১৮ বাই ২২ ফুট করেছেন। তখন তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অতিরিক্ত খরচ তারা বহন করবেন।

ঘর পাইয়ে দেয়ার জন্য হতদরিদ্র পরিবার থেকে ১৫ হাজার টাকা উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন ইউপি সদস্য মোসাম্মৎ কাজল বেগম। তিনি উল্টো মমতাজ বেগমকে দায়ী করে বলেন, ঘর অনুমোদন হওয়ার পর তার সঙ্গে দেখাও করেননি। তবে ঘরটি ঠিকাদার সঠিকভাবে নির্মাণ করেননি বলে স্বীকার করেন এই ইউপি সদস্য। একই অভিযোগ ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আবুল বাশারেও।

রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান খোকন বলেন, গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ করে দেয়ার বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তদারকি করা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসাবে তাদের সম্পৃক্ত না করায় এসব বিষয়ে তাদের কিছু করণীয় থাকে না।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ইটের গাঁথুনি ও টিনের বেড়া দিয়ে ১ লাখ টাকা ব্যয়ে গৃহহীনদের ঘর দেয়ার প্রকল্পটি তিনি যোগদানের আগে শুরু হয়েছে। এ পরিমাণ টাকায় মজবুত ঘর নির্মাণ করা সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, শোলনায় ঘর নির্মাণে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তার খোঁজখবর নেয়া এবং কাজটি দ্রুত শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে তিনি নির্দেশ দেবেন।

মঙ্গলবার, ০১ জুন ২০২১ , ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৯ শাওয়াল ১৪৪২

গৃহহীনদের জন্য ঘর, যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়ার দুশ্চিন্তা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, বরিশাল

মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর গৃহহীনদের গৃহ দেয়ার কর্মসূচিতে যে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো কত বছর টিকবে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটা সক্ষম তা নিয়ে ইতোমধ্যে যারা ঘর পেয়েছেন বা ঘর নির্মাণ করতে দেখেছেন তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

বরিশাল সদর উপজেলার রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের শোলনা গ্রামের মো. আলাউদ্দিনের (৭৫) স্ত্রী মমতাজ বেগম (৫৫) তার নামে বরাদ্দকৃত ঘর দেখে বলছিলেন ভাঙ্গাচোরা হলেও আগে আমার একটা ঘর ছিল। সরকারের দেয়া নতুন ঘর পাবার আশায় পুরান ঘরটা ভেঙে ফেলেছেন।

নতুন ঘর পেতে অনেক টাকাও খরচ করেছেন। কয়েক মাসেও ঘরের কাজ শেষ না হওয়ায় এখন অন্যের ঘরে থাকেন কিন্তু যে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে যে কোন সময়ে ঘরচাপা পড়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আঙ্গুলের এক কর দেখিয়ে বললেন- এইটুকু মাটি খুঁড়ে ইটগাঁথা শুরু করেছে। এইঘর বাতাসে পড়ে যাবে।

আলাউদ্দিন এক সময়ে বরিশাল নগরীর পোর্ট রোডে দিনমজুরের কাজ করতেন। বয়সের ভারে এখন কিছুই করেন না। একমাত্র ছেলেটি সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছে। বিয়ে হয়ে গেছে চার মেয়ের। শোলনা গ্রামের সেরাজ মাওলানার বাড়ি তার স্থায়ী ঠিকানা। সেখানে তার একটি ছাপড়া ঘর ছিল। সরকারি উদ্যোগে ১ লাখ টাকায় আধাপাকা এক কক্ষের ঘর নির্মাণ করে দেয়ার প্রকল্পের আওতায় একটি ঘর পেয়েছেন এই দম্পতি। কিন্তু ঘরটি নিয়ে ইউপি সদস্য মোসাম্মৎ কাজল ও ঠিকাদার এইচএম সুমনের নানামুখী বানিজ্যে ‘ঘরের আশায় গৃহহীন’ হওয়ার উপক্রম হয়েছে হতদরিদ্র আলাউদ্দিন-মমতাজ দম্পতির।

তাদের অভিযোগ, গত জানুয়ারি মাসে নতুন ঘরের নির্মাণ কাজ শুরু করলেও এখনও কাজ শেষ করেননি ঠিকাদার। সেসময় থেকে তারা চাচা শ্বশুরের ঘরে থাকছেন। বিনামূল্যে ঘর পাওয়ার কথা থাকলেও ধারদেনা করে এ পর্যন্ত ২২ হাজার টাকা খরচ করেছেন তারা। আরও টাকা খরচ করতে না পারায় ঠিকাদার নির্মাণ কাজ শেষ করছেন না। খরচের হিসাব জানিয়ে মমতাজ বেগম বলেন, ঘরটি পাইয়ে দেয়ার জন্য ইউপি মেম্বর কাজল বেগম নিয়েছেন ১৫ হাজার টাকা। ইট কেনার জন্য ঠিকাদার নিয়েছেন ৫ হাজার টাকা এবং রাস্তার ওপর রাখা ইট-বালু বাড়িতে আনতে শ্রমিক মজুরি দিয়েছেন ২ হাজার ২০০ টাকা। এর সঙ্গে তাদের নিজেদের শ্রম তো আছেই।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাড়ে ৬ ফুট উঁচু ১৮দ্ধ২২ ফুটের দেয়াল দিয়ে একটি কক্ষের অবকাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে আলাউদ্দিন-মমতাজ দম্পতির ভিটিতে। পিলারহীন নির্মিত এ কক্ষটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আলাউদ্দিনের দেয়া তথ্যমতে, মাটির নিচে গাঁথুনি দেয়নি ঠিকাদার। তাই মাটি ফেলে ভিটি তৈরি করেছেন দেয়াল মজবুত করার জন্য। মমতাজ বেগম অভিযোগ করেন, ঠিকাদার তাকে কাঠমিস্ত্রি খুঁজে বের করতে বলেছেন টিনের চাল ও দরজা-জানালা করে দেয়ার জন্য কিন্তু ঠিকাদার যে মজুরির কথা বলছেন, তাতে মিস্ত্রি পাওয়া যায় না। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ঠিকাদার এইচএম সুমন দাবি করেন, সরকারি অনুমোদন অনুযায়ী ঘরটি নির্মাণ হবে ১৬ বাই ১৬ ফুট। আলাউদ্দিন-মমতাজ দম্পতি ১৮ বাই ২২ ফুট করেছেন। তখন তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অতিরিক্ত খরচ তারা বহন করবেন।

ঘর পাইয়ে দেয়ার জন্য হতদরিদ্র পরিবার থেকে ১৫ হাজার টাকা উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন ইউপি সদস্য মোসাম্মৎ কাজল বেগম। তিনি উল্টো মমতাজ বেগমকে দায়ী করে বলেন, ঘর অনুমোদন হওয়ার পর তার সঙ্গে দেখাও করেননি। তবে ঘরটি ঠিকাদার সঠিকভাবে নির্মাণ করেননি বলে স্বীকার করেন এই ইউপি সদস্য। একই অভিযোগ ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আবুল বাশারেও।

রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান খোকন বলেন, গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ করে দেয়ার বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তদারকি করা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসাবে তাদের সম্পৃক্ত না করায় এসব বিষয়ে তাদের কিছু করণীয় থাকে না।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ইটের গাঁথুনি ও টিনের বেড়া দিয়ে ১ লাখ টাকা ব্যয়ে গৃহহীনদের ঘর দেয়ার প্রকল্পটি তিনি যোগদানের আগে শুরু হয়েছে। এ পরিমাণ টাকায় মজবুত ঘর নির্মাণ করা সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, শোলনায় ঘর নির্মাণে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তার খোঁজখবর নেয়া এবং কাজটি দ্রুত শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে তিনি নির্দেশ দেবেন।