ণ্ডবহু বিচিত্র সেলিনা হোসেন

রাহাত রাব্বানী

সেলিনা হোসেন বাংলা কথাসাহিত্যে এক অপরিহার্য নাম। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে রচনা করেছেন কালোত্তীর্ণ নানান লেখা। হয়েছেন বিভিন্ন ভাষার পাঠকের কাছেও অতি প্রিয়।

সেলিনা হোসেনের গল্প-উপন্যাসে আধুনিকতার ছাপ প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে। আধুনিকতার এই হাতেখড়িও শুরু হয় পরিবার থেকেই। আকিকা করা ‘খায়রুন্নেসা’ নাম বদলিয়ে তার বড় বোন পরীক্ষায় খাতায় নাম রাখেন ‘সেলিনা হোসেন’। সময়ের তুলনায় যা নিঃসন্দেহে প্রবল সাহসিকতা, একই সাথে, আধুনিকতা। ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। রাকসু এবং ছাত্রী হলে নির্বাচনও করেন আধুনিক এই কথাকার। তাঁর মা ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন- যা তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোতে ধরা পড়ে।

১৯৪৭ সালে রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ভাষার প্রভাবসঞ্চারী লেখক সেলিনা হোসেন। ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই প্রকাশ পায় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনে প্রবেশ ঘটলেও মধ্য ষাটের দশকে গল্প চর্চা শুরু করেন সেলিনা হোসেন। তিনি মনে করেন, “লেখক তার সাহিত্যে রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ এবং দেশজ প্রকৃতির মধ্যে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন, সে শেকড় যায় গভীর থেকে গভীরে। কথাসাহিত্যে সেই শেকড় শেকড় প্রোথিত করা সহজ। ছড়ানো ছিটানো বর্ণনা, অসংখ্য চরিত্র মিলে এই ক্যানভাস হয়ে ওঠে অনেক বড়। যা কবিতায় সহজ নয়।”

লেখালেখিই তাঁর একমাত্র আরাধ্য। লেখালেখি তাকে দিয়েছেও প্রচুর। ইংরেজি, রুশ, কানাডি, মেলেসহ নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার গল্প-উপন্যাস। দেশ-বিদেশের বেশ কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রচনা পাঠ্য। শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি উপন্যাস এমফিল গবেষণাভুক্ত। সেলিনা হোসেনের সাহিত্য কর্মের ওপর হয়েছে ১১ টি পিএইচডি।

বাবার চাকুরির কল্যাণে তিনি দেখেছেন বাংলার প্রকৃতি। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মানুষের জীবন। যা তার সাহিত্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মানব সম্পর্কের নানান জটিল সূত্র ধরে রচিত হয়েছে তার গল্প-উপন্যাস? ‘টানপোড়েন’ উপন্যাসে দৃষ্টি দিলে তা আরও স্পষ্ট হয়। শৈশবের স্মৃতি তার উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায়। রেশম চাষ এলাকায় বেড়ে হয়ে ওঠার দারুণ রেশম চাষ নিয়ে ছিলো তার বিস্তর অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার পরিচয় মেলে ‘কাঁটাতারের প্রজাপতি’ উপন্যাসে।

সেলিনা হোসেনের সাহিত্যে নারীচরিত্রগুলো প্রকাশ পেয়েছে অনেকটা খোলামেলাভাবেই। পুরুষের সমান্তরালে তাদের দায়িত্ব, সমাজে নানামুখী অবদান তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলন ঘটছে। পরিবার আর সমাজের গণ্ডির ভেতর আটকে থাকেনি এই চরিত্ররা। কট্টর নারীবাদী না হলেও নারীকে তিনি বৃহত্তর সমাজ থেকে আলাদা করার পক্ষে নন। ‘পদশব্দ’ উপন্যাস যদি খেয়াল করি, তবে দেখতে পাই- ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে সালমা ও নাসিমা নামে দুটি নারী চরিত্র। একজন বাবা সততা ও নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। অন্যজন শিক্ষকতা করে এবং সমাজকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে লিভ টুগেদার করে। ‘দীপান্বিতা’, ‘আনবিক আঁধার’- এও নারী চরিত্র হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলোনে নারীর অংশগ্রহণ প্রাধান্য পেয়েছে ‘ভালবাসা প্রীতিলতা’য়। মুক্তিযুদ্ধের পটভূতিতে রচিত ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসেও নারীর অবদানকে তুলে ধরেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। মুক্তিযোদ্ধা মাখনকে যখন বেনু বলে “ভালো কইরে দেখো হামাক। তুমি দিছো পা। আমি দিছি জরায়ু। তোমার পায়ের ঘা শুকায়ে গেছে। কয়দিন পর হামারও জরায়ুর ঘা শুকায়ে যাবে। আমি ভালো হয়ে যাবো।” তখন তাঁর লেখায় নারীর শক্ত অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’ উপন্যাসেও আমরা মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা প্রকটভাবে টের পাই। ঢাকাকে কেন্দ্র করে লেখা এই উপন্যাসে একদিকে যেমন ক্র্যাকপ্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অভিযান অন্যদিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বন্দি নারীদের অকথ্য দৈহিক নির্যাতন ভোগের পাশাপাশি তাদের ফুঁসে ওঠা, বর্বর পাকিস্তানিদের মেরে তাদের অকুতোভয় আত্মদানের মর্মচেরা কাহিনি এ উপন্যাসকে দিয়েছে ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা। খুলনার মংলা সমুদ্র বন্দরে বানিয়াশান্তা পতিতালয় ঘুরে গণিকাদের জীবন নিয়ে রচিত ‘মোহিনির বিয়ে’ উপন্যাসে নারী জীবনকেই ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখক তুলে এনেছেন।

সেলিনা হোসেন বেড়ে উঠেছেন ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য সময়কে সঙ্গ করে- যা তার লেখকসত্তাকে আলোড়িত করে। মানব-মানবীর ম্যাড়মেড়ে প্রেম নয়, বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব অন্বেষণ; ইতিহাসচেতনাই হয়ে ওঠে তার প্রধান উপজীব্য।

’৪৭-এর দেশভাগের পর পাকিস্তানি হানাদার শিবির প্রথমেই হিং¯্র থাবা বসায় আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। কিন্তু প্রতিবাদী বাঙালি তা মেনে নেয় নি। মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য রাজপথ রঞ্জিত করেছে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। এটিই আমাদের স্বাধীনতার সূচনাপর্ব। ইতিহাসকে অক্ষুণœ রেখে, ১৯৩৭ থেকে ১৯৫৩ সময়কালকে কেন্দ্র করে সেলিনা হোসেন রচনা করেছেন ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’; যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে রূপকের আড়ালে ইতিহাসের এই অধ্যায় তুলে ধরেছেন ইতিহাস সচেতন এই কথাশিল্পী। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে তেভাগা আন্দোলন নিয়ে লিখেন ‘ভালবাসা প্রীতিলতা’র মতো উপন্যাস।

ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। তিনি অতীতকে দেখেন বর্তমানের দৃষ্টিতে। খুঁজে নেন শিল্পিত উপাদান- যা তার ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে উপস্থিতি। লোভ, অধঃপতন ও প্রতিরোধের এই

গল্পে টের পাওয়া যায় স্বৈরশাসনের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সেলিনা হোসেনের লেখার মৌল উপাদান। তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সালের ধারা বর্ণনা পাই সহজেই।

সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ গোছানো শুরু হতেই আবার বাংলার ভাগ্যাকাশে নামে কালো মেঘের ঘনঘটা। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ রাতে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে সেলিনা হোসেন রচনা করেন ‘আগস্টের একরাত’। মুজিব হত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ এখানে লেখক না দেখিয়ে পাঠককে করেছেন অনুসন্ধানী। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। কোনো প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি তিনি। কবি শহীদ কাদরীর কণ্ঠে সেলিনা হোসেন উপস্থাপন করেছেন সেই সতর্কবার্তা: “প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশক্রমে মি. কাও চুয়াত্তরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন। আপনার জীবন সংশয় বিষয়ে তিনি জানালে, আপনি বলেছিলেন, ওরা আমার সন্তান। ওরা আমার কোনো ক্ষতি করবে না।”

সেলিনা হোসেনের সাহিত্যের মূল প্রবণতা সময়কে নিজস্ব ঘরানায় চিহ্নিত করা। যার কারণে ঘুরেফিরে রাজনীতি নানানভাবে তাঁর লেখায় ধরা দেয়। একসময়ের তুমুল আলোচিত ছিটমহল নিয়ে লিখেন ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাস। সম্ভবত বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম এই বিষয়ে উপন্যাস লিখেন। সেইসময়, অধ্যাপক ইউলিয়াম ভ্যান সেন্ডেল (নেদারল্যান্ড)-এর একটি গবেষণা পড়ে আন্দোলিত হন সেলিনা হোসেন। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পটভূমি লেখা ‘ভূমি ও কুসুম’-এ মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে তাৎপর্যপূর্ণ।

নানান বিষয়ে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতেই বেশি ভালোবাসেন সেলিনা হোসেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে উক্ত উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ। কাল্পনিক এক কাহিনির শেষে এসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কঠিন বাস্তবতা তুলে আনেন উপন্যাসের শেষ অংশে। বুড়ি তার ছেলেকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দেওয়ার এই ঘটনা লেখক জানেন তার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজের কাছ থেকে। যশোরের কালীগঞ্জের এই ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে প্রথমে অনুরোধ তিনিই করেন। “তুই মরে গেলি। আমি রইলাম তোর শোক বহন করার জন্য।” -মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করা সন্তানের জন্য সকল মায়ের করুণ হাহাকার বুড়ির মাধ্যমেই ধরা দিয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে শিকাগোর ওকটন কলেজের সাহিত্য বিভাগ দ. এশিয়ার সাহিত্য কোর্সে উপন্যাসটি পাঠ্য।

সেলিনা হোসেন মানুষকে দেখেছেন নানানভাবে। নাগরিক মধ্যবিত্তের আত্ম-সংকট, ধর্মান্ধতা বিষয়কে নিয়ে রচিত হয়েছে তার নগরজীবন কেন্দ্রিক উপন্যাস ‘মগ্ন চৈতন্যে শিষ’। ১৯৭৩ সালে প্রকাশ পায় তার প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’ প্রকাশ পায়। নদী তীরবর্তী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষের সংগ্রামী জীবনধারাকে চিত্রিত করেছেন এখানে। একইভাবে নাফ নদীর তীরবর্তী মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চিহ্নিত হয়েছে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’তে। এশিয়া ও আফ্রিকা এই দুই মহাদেশের মানুষের গল্প নিয়ে রচনা করেন ‘গাছটির ছায়া নেই’। ২০১২ সালে এইচআইভি ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে।

সেলিনা হোসেনের অনুপ্রেরণার এক বড় অংশজুড়ে বিচরণ করছে কবিগুরুর জীবন ও সাহিত্য সৃষ্টি। বিশ্বকবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েও রয়েছে সেলিনা হোসেনের সরব উপস্থিতি। শিলাইদহ, পতিসর, শাহবাজপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থানের পটভূমি নিয়ে চিত্রিত হয়েছে ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’। রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের চরিত্রগুলোকে ভেঙে নতুন করে, ‘ছিন্নপত্র’ ও নাটক ব্যবহার করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে।

উপমহাদেশের শক্তিশালী কবি মির্জা গালিকে নিয়ে রচিত হয়েছে নানান ধরনের বই। দেশ বিদেশের অসংখ্য গবেষকদের বিষয় হয়েছেন তিনি। তাঁর জীবন নানাবৈচিত্র্যে ভরপুর। ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এই মানুষকে নিয়ে সেলিনা হোসেন ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’র তুলে এনেছেন শিল্পের সাথে ইতিহাসের যোগ।

সেলিনা হোসেনের লেখার বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, উঠে এসেছে মানবিকতা। মা-মেয়ের গভীর সম্পর্কের সফল উদাহরণ তার ‘লারা’ উপন্যাস। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার অদূরে পোস্তাগোলায় এরার পারাবতের সেসাস-১৫০ প্রকৃতির বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন লেখকের প্রিয় কন্যা, দেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক বৈমানিক ফারিয়া লারা। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে লারা লিখেন, ‘আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি পৃথিবীতে। আমরা হয়তো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।’ ফারিয়া লারার দৈহিক প্রস্থান হলেও তার স্বপ্ন এখনো জাগিয়ে রেখেছে মা সেলিনা হোসেন এবং বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান। লারা গণমানুষের কথা ভাবতো। তার ভাবনা আর স্মৃতি আঁকড়ে অই একই বছর প্রতিষ্ঠিত হয়

‘লারা ফাউন্ডেশন।’ “দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঞ্চনা ও আবহেলার শিকার প্রান্তিক নারী-মেয়ে-শিশু ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বেকার সমস্যা নিরসনে সর্বাত্মক সহায়তা দান” - এই লক্ষ্যে দুই দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনটি।

ফারিয়া লারার এই মৃত্যুতে প্রচণ্ড ভেঙেও পড়েছিলেন সেলিনা হোসেন। স্তব্ধ হয়ে যায় তার কলম। দেহ-মনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অস্থিরাবস্থায়ও হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়ে ফিরে আসেন আবার। লিখেন নিয়মিত। শুধু উপন্যাস নয় গল্প, শিশুসাহিত্যেও রয়েছে তাঁর সরব উপস্থিতি। মননশীল প্রবন্ধেও জয় করেছেন পাঠকহৃদয়। তাঁর সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে দেশ, সমাজ আর মানুষের কথা। যেখানে খুব সহজেই ধরা পড়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজের আলো কিংবা অন্ধকার।

জীবনের চুয়াত্তর বছর ফেলে আসা প্রিয় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কলম থেকে আরও অনেক ‘মগ্ন চৈতন্যের শিস’ বেরিয়ে আসুক। পঁচাত্তরে এই শুভ প্রত্যাশা।

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১ , ৩ আষাড় ১৪২৮ ৫ জিলকদ ১৪৪২

ণ্ডবহু বিচিত্র সেলিনা হোসেন

রাহাত রাব্বানী

image

সেলিনা হোসেন / জন্ম : ১৪ জুন ১৯৪৭

সেলিনা হোসেন বাংলা কথাসাহিত্যে এক অপরিহার্য নাম। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে রচনা করেছেন কালোত্তীর্ণ নানান লেখা। হয়েছেন বিভিন্ন ভাষার পাঠকের কাছেও অতি প্রিয়।

সেলিনা হোসেনের গল্প-উপন্যাসে আধুনিকতার ছাপ প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে। আধুনিকতার এই হাতেখড়িও শুরু হয় পরিবার থেকেই। আকিকা করা ‘খায়রুন্নেসা’ নাম বদলিয়ে তার বড় বোন পরীক্ষায় খাতায় নাম রাখেন ‘সেলিনা হোসেন’। সময়ের তুলনায় যা নিঃসন্দেহে প্রবল সাহসিকতা, একই সাথে, আধুনিকতা। ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। রাকসু এবং ছাত্রী হলে নির্বাচনও করেন আধুনিক এই কথাকার। তাঁর মা ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন- যা তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোতে ধরা পড়ে।

১৯৪৭ সালে রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ভাষার প্রভাবসঞ্চারী লেখক সেলিনা হোসেন। ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই প্রকাশ পায় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনে প্রবেশ ঘটলেও মধ্য ষাটের দশকে গল্প চর্চা শুরু করেন সেলিনা হোসেন। তিনি মনে করেন, “লেখক তার সাহিত্যে রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ এবং দেশজ প্রকৃতির মধ্যে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন, সে শেকড় যায় গভীর থেকে গভীরে। কথাসাহিত্যে সেই শেকড় শেকড় প্রোথিত করা সহজ। ছড়ানো ছিটানো বর্ণনা, অসংখ্য চরিত্র মিলে এই ক্যানভাস হয়ে ওঠে অনেক বড়। যা কবিতায় সহজ নয়।”

লেখালেখিই তাঁর একমাত্র আরাধ্য। লেখালেখি তাকে দিয়েছেও প্রচুর। ইংরেজি, রুশ, কানাডি, মেলেসহ নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার গল্প-উপন্যাস। দেশ-বিদেশের বেশ কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রচনা পাঠ্য। শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি উপন্যাস এমফিল গবেষণাভুক্ত। সেলিনা হোসেনের সাহিত্য কর্মের ওপর হয়েছে ১১ টি পিএইচডি।

বাবার চাকুরির কল্যাণে তিনি দেখেছেন বাংলার প্রকৃতি। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মানুষের জীবন। যা তার সাহিত্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মানব সম্পর্কের নানান জটিল সূত্র ধরে রচিত হয়েছে তার গল্প-উপন্যাস? ‘টানপোড়েন’ উপন্যাসে দৃষ্টি দিলে তা আরও স্পষ্ট হয়। শৈশবের স্মৃতি তার উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায়। রেশম চাষ এলাকায় বেড়ে হয়ে ওঠার দারুণ রেশম চাষ নিয়ে ছিলো তার বিস্তর অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার পরিচয় মেলে ‘কাঁটাতারের প্রজাপতি’ উপন্যাসে।

সেলিনা হোসেনের সাহিত্যে নারীচরিত্রগুলো প্রকাশ পেয়েছে অনেকটা খোলামেলাভাবেই। পুরুষের সমান্তরালে তাদের দায়িত্ব, সমাজে নানামুখী অবদান তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলন ঘটছে। পরিবার আর সমাজের গণ্ডির ভেতর আটকে থাকেনি এই চরিত্ররা। কট্টর নারীবাদী না হলেও নারীকে তিনি বৃহত্তর সমাজ থেকে আলাদা করার পক্ষে নন। ‘পদশব্দ’ উপন্যাস যদি খেয়াল করি, তবে দেখতে পাই- ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে সালমা ও নাসিমা নামে দুটি নারী চরিত্র। একজন বাবা সততা ও নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। অন্যজন শিক্ষকতা করে এবং সমাজকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে লিভ টুগেদার করে। ‘দীপান্বিতা’, ‘আনবিক আঁধার’- এও নারী চরিত্র হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলোনে নারীর অংশগ্রহণ প্রাধান্য পেয়েছে ‘ভালবাসা প্রীতিলতা’য়। মুক্তিযুদ্ধের পটভূতিতে রচিত ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসেও নারীর অবদানকে তুলে ধরেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। মুক্তিযোদ্ধা মাখনকে যখন বেনু বলে “ভালো কইরে দেখো হামাক। তুমি দিছো পা। আমি দিছি জরায়ু। তোমার পায়ের ঘা শুকায়ে গেছে। কয়দিন পর হামারও জরায়ুর ঘা শুকায়ে যাবে। আমি ভালো হয়ে যাবো।” তখন তাঁর লেখায় নারীর শক্ত অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’ উপন্যাসেও আমরা মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা প্রকটভাবে টের পাই। ঢাকাকে কেন্দ্র করে লেখা এই উপন্যাসে একদিকে যেমন ক্র্যাকপ্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অভিযান অন্যদিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বন্দি নারীদের অকথ্য দৈহিক নির্যাতন ভোগের পাশাপাশি তাদের ফুঁসে ওঠা, বর্বর পাকিস্তানিদের মেরে তাদের অকুতোভয় আত্মদানের মর্মচেরা কাহিনি এ উপন্যাসকে দিয়েছে ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা। খুলনার মংলা সমুদ্র বন্দরে বানিয়াশান্তা পতিতালয় ঘুরে গণিকাদের জীবন নিয়ে রচিত ‘মোহিনির বিয়ে’ উপন্যাসে নারী জীবনকেই ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখক তুলে এনেছেন।

সেলিনা হোসেন বেড়ে উঠেছেন ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য সময়কে সঙ্গ করে- যা তার লেখকসত্তাকে আলোড়িত করে। মানব-মানবীর ম্যাড়মেড়ে প্রেম নয়, বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব অন্বেষণ; ইতিহাসচেতনাই হয়ে ওঠে তার প্রধান উপজীব্য।

’৪৭-এর দেশভাগের পর পাকিস্তানি হানাদার শিবির প্রথমেই হিং¯্র থাবা বসায় আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। কিন্তু প্রতিবাদী বাঙালি তা মেনে নেয় নি। মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য রাজপথ রঞ্জিত করেছে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। এটিই আমাদের স্বাধীনতার সূচনাপর্ব। ইতিহাসকে অক্ষুণœ রেখে, ১৯৩৭ থেকে ১৯৫৩ সময়কালকে কেন্দ্র করে সেলিনা হোসেন রচনা করেছেন ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’; যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে রূপকের আড়ালে ইতিহাসের এই অধ্যায় তুলে ধরেছেন ইতিহাস সচেতন এই কথাশিল্পী। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে তেভাগা আন্দোলন নিয়ে লিখেন ‘ভালবাসা প্রীতিলতা’র মতো উপন্যাস।

ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। তিনি অতীতকে দেখেন বর্তমানের দৃষ্টিতে। খুঁজে নেন শিল্পিত উপাদান- যা তার ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে উপস্থিতি। লোভ, অধঃপতন ও প্রতিরোধের এই

গল্পে টের পাওয়া যায় স্বৈরশাসনের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সেলিনা হোসেনের লেখার মৌল উপাদান। তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সালের ধারা বর্ণনা পাই সহজেই।

সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ গোছানো শুরু হতেই আবার বাংলার ভাগ্যাকাশে নামে কালো মেঘের ঘনঘটা। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ রাতে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে সেলিনা হোসেন রচনা করেন ‘আগস্টের একরাত’। মুজিব হত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ এখানে লেখক না দেখিয়ে পাঠককে করেছেন অনুসন্ধানী। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। কোনো প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি তিনি। কবি শহীদ কাদরীর কণ্ঠে সেলিনা হোসেন উপস্থাপন করেছেন সেই সতর্কবার্তা: “প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশক্রমে মি. কাও চুয়াত্তরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন। আপনার জীবন সংশয় বিষয়ে তিনি জানালে, আপনি বলেছিলেন, ওরা আমার সন্তান। ওরা আমার কোনো ক্ষতি করবে না।”

সেলিনা হোসেনের সাহিত্যের মূল প্রবণতা সময়কে নিজস্ব ঘরানায় চিহ্নিত করা। যার কারণে ঘুরেফিরে রাজনীতি নানানভাবে তাঁর লেখায় ধরা দেয়। একসময়ের তুমুল আলোচিত ছিটমহল নিয়ে লিখেন ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাস। সম্ভবত বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম এই বিষয়ে উপন্যাস লিখেন। সেইসময়, অধ্যাপক ইউলিয়াম ভ্যান সেন্ডেল (নেদারল্যান্ড)-এর একটি গবেষণা পড়ে আন্দোলিত হন সেলিনা হোসেন। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পটভূমি লেখা ‘ভূমি ও কুসুম’-এ মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে তাৎপর্যপূর্ণ।

নানান বিষয়ে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতেই বেশি ভালোবাসেন সেলিনা হোসেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে উক্ত উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ। কাল্পনিক এক কাহিনির শেষে এসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কঠিন বাস্তবতা তুলে আনেন উপন্যাসের শেষ অংশে। বুড়ি তার ছেলেকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দেওয়ার এই ঘটনা লেখক জানেন তার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজের কাছ থেকে। যশোরের কালীগঞ্জের এই ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে প্রথমে অনুরোধ তিনিই করেন। “তুই মরে গেলি। আমি রইলাম তোর শোক বহন করার জন্য।” -মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করা সন্তানের জন্য সকল মায়ের করুণ হাহাকার বুড়ির মাধ্যমেই ধরা দিয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে শিকাগোর ওকটন কলেজের সাহিত্য বিভাগ দ. এশিয়ার সাহিত্য কোর্সে উপন্যাসটি পাঠ্য।

সেলিনা হোসেন মানুষকে দেখেছেন নানানভাবে। নাগরিক মধ্যবিত্তের আত্ম-সংকট, ধর্মান্ধতা বিষয়কে নিয়ে রচিত হয়েছে তার নগরজীবন কেন্দ্রিক উপন্যাস ‘মগ্ন চৈতন্যে শিষ’। ১৯৭৩ সালে প্রকাশ পায় তার প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’ প্রকাশ পায়। নদী তীরবর্তী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষের সংগ্রামী জীবনধারাকে চিত্রিত করেছেন এখানে। একইভাবে নাফ নদীর তীরবর্তী মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চিহ্নিত হয়েছে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’তে। এশিয়া ও আফ্রিকা এই দুই মহাদেশের মানুষের গল্প নিয়ে রচনা করেন ‘গাছটির ছায়া নেই’। ২০১২ সালে এইচআইভি ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে।

সেলিনা হোসেনের অনুপ্রেরণার এক বড় অংশজুড়ে বিচরণ করছে কবিগুরুর জীবন ও সাহিত্য সৃষ্টি। বিশ্বকবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েও রয়েছে সেলিনা হোসেনের সরব উপস্থিতি। শিলাইদহ, পতিসর, শাহবাজপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থানের পটভূমি নিয়ে চিত্রিত হয়েছে ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’। রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের চরিত্রগুলোকে ভেঙে নতুন করে, ‘ছিন্নপত্র’ ও নাটক ব্যবহার করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে।

উপমহাদেশের শক্তিশালী কবি মির্জা গালিকে নিয়ে রচিত হয়েছে নানান ধরনের বই। দেশ বিদেশের অসংখ্য গবেষকদের বিষয় হয়েছেন তিনি। তাঁর জীবন নানাবৈচিত্র্যে ভরপুর। ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এই মানুষকে নিয়ে সেলিনা হোসেন ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’র তুলে এনেছেন শিল্পের সাথে ইতিহাসের যোগ।

সেলিনা হোসেনের লেখার বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, উঠে এসেছে মানবিকতা। মা-মেয়ের গভীর সম্পর্কের সফল উদাহরণ তার ‘লারা’ উপন্যাস। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার অদূরে পোস্তাগোলায় এরার পারাবতের সেসাস-১৫০ প্রকৃতির বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন লেখকের প্রিয় কন্যা, দেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক বৈমানিক ফারিয়া লারা। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে লারা লিখেন, ‘আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি পৃথিবীতে। আমরা হয়তো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।’ ফারিয়া লারার দৈহিক প্রস্থান হলেও তার স্বপ্ন এখনো জাগিয়ে রেখেছে মা সেলিনা হোসেন এবং বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান। লারা গণমানুষের কথা ভাবতো। তার ভাবনা আর স্মৃতি আঁকড়ে অই একই বছর প্রতিষ্ঠিত হয়

‘লারা ফাউন্ডেশন।’ “দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঞ্চনা ও আবহেলার শিকার প্রান্তিক নারী-মেয়ে-শিশু ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বেকার সমস্যা নিরসনে সর্বাত্মক সহায়তা দান” - এই লক্ষ্যে দুই দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনটি।

ফারিয়া লারার এই মৃত্যুতে প্রচণ্ড ভেঙেও পড়েছিলেন সেলিনা হোসেন। স্তব্ধ হয়ে যায় তার কলম। দেহ-মনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অস্থিরাবস্থায়ও হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়ে ফিরে আসেন আবার। লিখেন নিয়মিত। শুধু উপন্যাস নয় গল্প, শিশুসাহিত্যেও রয়েছে তাঁর সরব উপস্থিতি। মননশীল প্রবন্ধেও জয় করেছেন পাঠকহৃদয়। তাঁর সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে দেশ, সমাজ আর মানুষের কথা। যেখানে খুব সহজেই ধরা পড়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজের আলো কিংবা অন্ধকার।

জীবনের চুয়াত্তর বছর ফেলে আসা প্রিয় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কলম থেকে আরও অনেক ‘মগ্ন চৈতন্যের শিস’ বেরিয়ে আসুক। পঁচাত্তরে এই শুভ প্রত্যাশা।