সুন্দরবন : বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান থাকবে কি

সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রর কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেসকো)। গত ১৬ জুন সংস্থার ‘রিয়েকটিভ মনিটরিং মিশনের’ এক প্রতিবেদনে এ শর্ত দেয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবনে ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাগুলোর প্রভাব মূল্যায়ন করতে একটি সমীক্ষা (এসইএ) করতে হবে। সেখানে আর কোন ভারী শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া যাবে না। বাংলাদেশের এসব শর্ত পালনের ওপর নির্ভর করবে সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান থাকবে কি-না। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

ইউনেসকো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান দিয়েছিল। সুন্দরবনের ঐতিহ্যই হোক আর অস্তিত্বই হোক সেটা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কাজটা একেবারেই সহজ নয়। কারণ সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পরার পেছনে একক কোন কারণ দায়ী নয়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ বনকে বহুমুখী সংকট মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হচ্ছে।

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজসহ ভারী নৌযান চলাচল, নদীতে তেল ও কয়লাসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী জাহাজডুবি, উজান থেকে আসা মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে লবণাক্ততা বাড়- এসব কারণে বনের নদীগুলো ভালো নেই। তাছাড়া বনের পাশে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় (ইসিএ) পরিবেশ দূষণকারী ১৫৪টি শিল্প-কারখানা আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তো আছেই। নতুন করে যুক্ত হয়েছে পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বরগুনার তালতলীতে নির্মীয়মাণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। দুই দশকে ২৩ বার আগুন লাগা, গাছ-পালা কেটে বন ধ্বংস করা, আবাধে বন্যপ্রাণি শিকার প্রভৃতি কারণেও ধুঁকছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বন।

বনের অস্তিত্ব কেন হুমকির মুখে, রক্ষা করতে হলে কী কী করতে হবে- সেগুলো বার বার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমরা বিভিন্ন সময় লিখেছি। ইউনোসকোর সর্বশেষ প্রতিবেদনেও বিষয়গুলো ওঠে এসেছে। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয়, সুন্দরবনকে রক্ষা করার কোন সদিচ্ছা নীতিনির্ধারকদের নেই। বন ধ্বংসের সব আয়োজনেই সরকারি সংস্থাগুলোকে বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বন্ধ হয়নি, ইতোমধ্যে ৬৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। থেমে নেই পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও তালতলী বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজও। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবন রক্ষা করতে না পারলে বাংলাদেশের উপকূল অরক্ষিত হয়ে পড়বে। টেকসই উন্নয়নের পথে প্রতি পদে পদে হোঁচট খাবে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন না যে, সুন্দরবনকে ঘিরে উন্নয়নের নামে যেসব কর্মকা- চলছে তাতে বন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা করার প্রশ্নে তারা কতটা সংবেদনশীল সে প্রশ্ন ওঠেছে। আমরা মনেকরি, যতদিন দেশের এ বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন না হবে, তাতোদিন পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে না। সুন্দরবনের পরিবেশ নিয়ে ইউনেসকোর উদ্বেগ, বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি, আমাদের লেখাÑ কোনকিছুরই মূল্য থাকবে না।

সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হলে সরকারের মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। কিসে বনের ক্ষতি হয় আর কিসে এর মঙ্গল হয় সেটা সংবেদনশীলতার সঙ্গে অনুধাবন করতে হবে। বনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয় এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া সঙ্গত হবে না। বনের ক্ষতি করা থেকে মানুষ যদি বিরত থাকে তাহলে সুন্দরবন নিজেই নিজের দেখভাল করতে পারবে। তাতে এর বিশ্ব ঐতিহ্যও বজায় থাকবে।

বুধবার, ৩০ জুন ২০২১ , ১৬ আষাঢ় ১৪২৮ ১৮ জিলক্বদ ১৪৪২

সুন্দরবন : বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান থাকবে কি

সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রর কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেসকো)। গত ১৬ জুন সংস্থার ‘রিয়েকটিভ মনিটরিং মিশনের’ এক প্রতিবেদনে এ শর্ত দেয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবনে ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাগুলোর প্রভাব মূল্যায়ন করতে একটি সমীক্ষা (এসইএ) করতে হবে। সেখানে আর কোন ভারী শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া যাবে না। বাংলাদেশের এসব শর্ত পালনের ওপর নির্ভর করবে সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান থাকবে কি-না। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

ইউনেসকো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান দিয়েছিল। সুন্দরবনের ঐতিহ্যই হোক আর অস্তিত্বই হোক সেটা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কাজটা একেবারেই সহজ নয়। কারণ সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পরার পেছনে একক কোন কারণ দায়ী নয়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ বনকে বহুমুখী সংকট মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হচ্ছে।

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজসহ ভারী নৌযান চলাচল, নদীতে তেল ও কয়লাসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী জাহাজডুবি, উজান থেকে আসা মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে লবণাক্ততা বাড়- এসব কারণে বনের নদীগুলো ভালো নেই। তাছাড়া বনের পাশে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় (ইসিএ) পরিবেশ দূষণকারী ১৫৪টি শিল্প-কারখানা আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তো আছেই। নতুন করে যুক্ত হয়েছে পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বরগুনার তালতলীতে নির্মীয়মাণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। দুই দশকে ২৩ বার আগুন লাগা, গাছ-পালা কেটে বন ধ্বংস করা, আবাধে বন্যপ্রাণি শিকার প্রভৃতি কারণেও ধুঁকছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বন।

বনের অস্তিত্ব কেন হুমকির মুখে, রক্ষা করতে হলে কী কী করতে হবে- সেগুলো বার বার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমরা বিভিন্ন সময় লিখেছি। ইউনোসকোর সর্বশেষ প্রতিবেদনেও বিষয়গুলো ওঠে এসেছে। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয়, সুন্দরবনকে রক্ষা করার কোন সদিচ্ছা নীতিনির্ধারকদের নেই। বন ধ্বংসের সব আয়োজনেই সরকারি সংস্থাগুলোকে বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বন্ধ হয়নি, ইতোমধ্যে ৬৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। থেমে নেই পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও তালতলী বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজও। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবন রক্ষা করতে না পারলে বাংলাদেশের উপকূল অরক্ষিত হয়ে পড়বে। টেকসই উন্নয়নের পথে প্রতি পদে পদে হোঁচট খাবে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন না যে, সুন্দরবনকে ঘিরে উন্নয়নের নামে যেসব কর্মকা- চলছে তাতে বন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা করার প্রশ্নে তারা কতটা সংবেদনশীল সে প্রশ্ন ওঠেছে। আমরা মনেকরি, যতদিন দেশের এ বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন না হবে, তাতোদিন পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে না। সুন্দরবনের পরিবেশ নিয়ে ইউনেসকোর উদ্বেগ, বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি, আমাদের লেখাÑ কোনকিছুরই মূল্য থাকবে না।

সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হলে সরকারের মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। কিসে বনের ক্ষতি হয় আর কিসে এর মঙ্গল হয় সেটা সংবেদনশীলতার সঙ্গে অনুধাবন করতে হবে। বনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয় এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া সঙ্গত হবে না। বনের ক্ষতি করা থেকে মানুষ যদি বিরত থাকে তাহলে সুন্দরবন নিজেই নিজের দেখভাল করতে পারবে। তাতে এর বিশ্ব ঐতিহ্যও বজায় থাকবে।